এভাবে হেঁটে হেঁটে তারা নিমবাগান অবধি আসে। নিমবাগানের মাজারটিতে ঢুকে বোঁচকা বুচকি খুলে কিছু খেয়ে নেয়। খাওয়া দাওয়ার পাঠ সারা হলে আমগাছটির ছায়ায় বসে বিশ্রাম করে এবং গাঁজা টানে। তখন আলি কেনানের মনে জগৎ জীবনের নানা রহস্য ভীড় করতে থাকে।
এই জগৎ কি? এখানে এলাম কেননা এবং যাবো কোথায়? এই সমস্ত সূক্ষ বিষয়ও তার মনে ছায়া ফেলে। যাহোক বিশ্রাম পর্ব শেষ হলে শেষ গন্তব্য স্থল মিরপুরের শাহ আলি বাবার মাজারের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
শাহ আলি বাবার মাজারে আলি কেনানের অসীম প্রতিপত্তি। তার কারণ অন্য কিছু নয় তার দলটির গান। আলি কেনানের দলটি বাস্তবিকই সুন্দর গায়। গানের তো নিজস্ব ক্ষমতা আছে। হিন্দুরা গানকে স্বয়ং ভগবান মনে করে। বাংলাদেশের এতো পীরফকির বুজর্গের মাজার, ভক্তবৃন্দদের গানের শক্তিতেই তার বেশির ভাগ টিকে আছে। গানের রস না থাকলে মাজারগুলো মরুভূমি হয়ে যেতো। সেখানে মানুষ যাওয়ার কোনো প্রয়োজন দেখা দিতো না। প্রতি শুক্রবারে বাবার মাজারে গান বাজনার আসর বসে। আলি কেনানের দলের মধ্যে জেলফেরত একজন দাগী আসামী এবং ফুলতলির কিশোরদের একজন, তারা বেবাক পরিবেশ ভাপিয়ে তোলে কণ্ঠের উত্তাপে। জেলফেরত লোকটির নাম কালাম। তার গলাটি একটু ভারী। আর অন্যদিকে কিশোরটির কণ্ঠস্বর বাঁশির মতো। আলি কেনানের দল বেছে বেছে সে সকল গানই গায় যেগুলো মানুষকে কাঁদায়, ভাবায় এবং চিন্তার মধ্যে ডুবিয়ে রাখে। আলি কেনান কান পাকা মানুষ। দূর দূরান্তে যেখানেই ভাল গান শুনতে পায় কথাগুলো যত্নসহকারে কপি করে নিয়ে আসে। আল্লাহ আলি কেনানকে অনেক দিয়েছে। তবু আল্লাহর বিরুদ্ধে তার একটি নালিশ আছে। আল্লাহ তাকে গানের গলাটি দেননি।
আলি কেনানের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হচ্ছে। মাজারে ঘুরে ঘুরে নানা কিসিমের মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটতে থাকে। ওদের কেউ স্বভাব ভিখিরি। কেউ মস্তান, লুচ্চা, বদমায়েশ সব ধরনের মানুষই মাজারে থাকে। মাজারে অবস্থান করে এমন দু তিনটা জাত খানকির সঙ্গেও তার চেনাজানা হয়েছে। এখানে সংসার বিরাগি স্বর্গ পাগল মানুষ সে দেখেছে। দেখেছে ধর্মপ্রাণ মানুষ। ধর্মকর্মের ধার ধারে না মেয়ে মানুষ নিয়ে অবৈধ ব্যবসা চালায়, তেমন মানুষও মাজারে থাকে। কেউ আপত্তি করে না। অন্ধ নুলা বোবা খঞ্জ পাপীতাপী সকলকে মাজার সমান মেহে আদরে লালন করে। মাজারের ছায়া অনেক দূর প্রসারিত। এখানে সবাই আশ্রয় পায়।
পয়লা দেখলে মনে হতে পারে মাজারে যে সকল মানুষ দেখা যায় তারা জন্মের পর থেকেই এখানে বসবাস করছে। কিছু মানুষ স্থায়ীভাবে মাজারে বসবাস করে একথা সত্যি। কিন্তু পাশাপাশি আরেক দল মানুষ আছে যারা ভাসমান। এক মাজার থেকে অন্য মাজারে ছুটে ছুটে বেড়ায়। যে মেয়েটি বট গাছের ছায়ায় রেহেলে একটি কোরান শরীফ খুলে বসে থাকতো, দেখা গেলো একদিন হঠাৎ সে উধাও। হয়তো চট্টগ্রাম বায়েজিদ বোস্তামী কিংবা আমানত শাহের মাজারে একই ভাবে রেহেলে কোরান নিয়ে বসে রয়েছে চুপচাপ। চুপচাপ বসে আছে এ কারণে যে সে কোরান পড়তে জানে না। হয়তো একমাস কি দুমাস পর আবার মিরপুরের মাজারে হাজির হলো। অনেক তরতাজা, কারণ গায়ে নতুন হাওয়া লেগেছে। কেউ যদি জিগগেস করে, কই গেছিলি ফাতেমা খাতুন? ফাতেমা খাতুন ফোকলা দাঁতে হেসে জবাব দেবে, মুই গিছিলাম বাজী মস্তান (বায়েজিদ বোস্তামী)। যে অন্ধটির চোটপাটে প্রতিদিন মিরপুর মাজারে শায়িত বাবার ঘুম ভেঙে যাবার দশা হয় এক সকালে দেখা গেলো সেও নেই। কাউকে কিছু বলেও যায়নি। পনেরোদিন বাদে দেখা গেলো সিলেটে শাহজালাল বাবার মাজারে মনের সুখে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে।
মাজারে যারা থাকে, তাদের সকলের না হলেও অনেকেরই, আলাদা একটি ভূগোল থাকে। মিরপুরের মাজার থেকে মানুষ খুলনায় খানজাহান আলীর মাজারে যায়, সেখান থেকেও মানুষ আসে রাজশাহীর শাহ মখদুমের মাজারে। আবার শাহ মখদুমের মাজার থেকে মানুষ আসে হয়তো চট্টগ্রামের মাইজ ভাণ্ডার। কেননা যে তারা মাজারে মাজারে ঘুরাফেরা করে তা নিজেরাও বলতে পারে না। এটা একটা নেশার মতো। যাকে একবার পেয়েছে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকতে দেবে না। এই নেশা যাদের মনে অপেক্ষাকৃত গাঢ় তারা দেশের সীমানা অতিক্রম করে চলে যায় দূরে আরো দূরে। দিনে রাতে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করে বলে,
আল্লাহ নিজামুদ্দিন আউলিয়া, বখতিয়ার কাকির মাজার জিয়ারত করার সুযোগ দেও। এমনও মানুষ আছে যারা একবেলা খেয়ে পয়সা জমায় হিন্দুস্থানের সুলতান খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর রওজা শরীফ জেয়ারত করার জন্য।
আলি কেনানের প্রখর কাণ্ডজ্ঞান তাকে মাজারের নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থাপনার দিকটির প্রতি অধিক মনোযোগী করে তুলেছে। এই জিনিসগুলো সে অতি সহজে বুঝতে পারে। মাজারের অনেক কিছু সে বুঝে না, বুঝতে চায় না। এক একটি মাজার বছরে লক্ষ লক্ষ টাকায় নিলাম হয়। হাট বাজার ঘাটের মতো। যে সর্বোচ্চ অর্থ প্রদান করতে পারে সে বছরের সমস্ত টাকা পয়সা আদায় করার দায়িত্ব পেয়ে যায়। এদিক দিয়ে দেখলে একেকটা মাজার অন্য দশটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চাইতে আলাদা নয়। তফাৎ শুধু এটুকু যে অন্য ব্যবসায়ে মূলধন মারা যাওয়ার ঝুঁকি আছে, মাজার ব্যবসায়ে তা নেই। মাজারে মানুষ আসবেই। মানুষ আসবে কারণ সে দুর্বল অসহায় এবং উচ্চাকাঙ্খী।