ইমাম সাহেবের দিলে আল্লাহর খাঁটি নূর আছে। আলি কেনানের কথা শুনে মহল্লার সমস্ত মানুষ ইমাম সাহেবের দিকে তাকায়। তাদের কেউ কেউ ইমাম সাহেবের চুপসে যাওয়া মুখমণ্ডলে অন্তরের জ্যোতির প্রতিফলন দেখতে পায় ।
আলি কেনানের প্রতি ইমাম সাহেবের রাগ বিদ্বেষ তো রইলোই না বরং তাকে আল্লাহর বিশেষ রহমতপ্রাপ্ত উঁচু মর্যাদার একজন বুজর্গ ব্যক্তি বলে ধরে নিলেন। এতোদিন তিনি অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে ধর্মের পথে চলে আসছেন।
ইমাম সাহেব জীবনে কখনো আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কাল রাখতে ভুল করেননি। দুবেলা আহার জুটুক বা না জুটুক তিনি ফুলতলির মানুষদের হেদায়েত করে আসছেন। কিন্তু ফুলতলির মানুষ তাকে অবহেলা এবং অবজ্ঞার অধিক কিছু দিয়েছে। তার তো সে কথা মনে পড়ে না। আজ আলি কেনানের মুখে তার যে একটা নতুন পরিচয় ফুলতলির মানুষদের কাছে প্রচারিত হলো, কুদরতী ইলাহির এটাও একটা দৃষ্টান্ত বটে। তিনি মনে করলেন,
ওহাবী তরিকার মানুষ হওয়ায় মারেফাতকে এতোকাল কোনো দাম দেননি। আলি কেনানকে তিনি মন্দলোক ভেবে আসছিলেন, এটাও তার মনের একটা সংস্কার মাত্র। অন্তরে মারেফতি এলেমের পবিত্র জ্যোতি না থাকলে আলি কেনান তাঁকে এমনভাবে চিনলেন কি করে! অতএব মাসিক পঞ্চাশ টাকা মাইনেয় আলি কেনানের আস্তানায় তাবিজ লেখার কাজটি কবুল করতে তার কোনো আপত্তি হলো না। বরঞ্চ এটাকে আল্লাহতালার বিশেষ রহমত বলে ধরে নিলেন।
আলি কেনান চারদিক থেকে সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে। ফুলতলির সর্দার সাহেব এখন তার আস্তানায় নিত্য যাতায়াত করেন। ইমাম সাহেব এককোণায় বসে জল চৌকির ওপর কাগজ রেখে ডানদিক থেকে গুটি গুটি হরফে সুরা আয়াত লিখে লাল সুতো দিয়ে পেঁচিয়ে তাবিজ বানিয়ে রাখেন। আলি কেনান সে সব তাবিজ মক্কেলদের দিয়ে বলে, গলায় ঝুলিয়ে রাখবি। অবস্থা ভেদে তামা কিংবা পিতলের খোল ব্যবহার করতে বলে। বিবাহিত পুরুষ মানুষ হলে বিধান দেয়, বিবির সঙ্গে সহবাস করার সময় খুলে রাখবি। মেয়ে মানুষদের বলে, হায়েজ নেফাজের সময় খুলে পানিতে ভিজিয়ে রাখবি। গোছল করে পাক পবিত্র না হয়ে পরবিনে। তাহলে ক্ষেতি হবে।
আজকাল আলি কেনান দু চারটে আরবী শব্দ উচ্চারণ করতে শিখেছে। ইমাম সাহেবের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসার পর কিছু কিছু আরবী বুলি তার কণ্ঠে আপনা আপনি উঠে আসছে। একথা সে বিলক্ষণ বুঝতে পারে। সে বুঝতে পারে তার ভেতরে ইমাম সাহেবের প্রভাব ক্রিয়া করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার সাধ হয় গভর্ণর সাহেবকে ডেকে বর্তমান অবস্থাটা দেখায়। সেটি তো আর সম্ভব নয়! কখনো কখনো ভোলার কথা মনে পড়ে। তখন তার প্রাণটা ছাত করে উঠে। কি জানি কেমন আছে তার বুড়ো বাপ বুড়ো মা। বাঘের মতো ছয় ছয়টি ভাই, তারা কোথায় কি অবস্থায় আছে? হয়তো তারা জেল খানায় ঘানি টানছে। কিন্তু কি করতে পারে আলি কেনান? নতুন করে জীবন নির্মাণ করার প্রক্রিয়ার মধ্যে সে বাঁধা পড়ে গেছে। ছেড়ে দিয়ে কোথাও যাওয়া তার পক্ষে এখন সম্ভব হবে না। ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতে দেখা যাবে। আলি কেনানের একদল নতুন ভক্ত জুটেছে। তারা তার মতো লাল সালুর লুঙ্গি এবং আজানুলম্বিত আলখেল্লা পরে। গলায় বড়ো বড়ো কাঠের মালা ঝোলায় এবং বগলের পাশে দিয়ে পেঁচিয়ে লোহার শিকল কোমর অবধি দোলায়। আলি কেনান এই ভক্ত সম্প্রদায়কে তার কল্পনার সন্তান মনে করে। অবশ্য ভক্তদের অতীত নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা চালু আছে। মোট সাতজনের মধ্যে দুজন জেল খাটা দাগী আসামী। একজন সমকামী। একজন সংসারে পোড় খাওয়া একেবারে হতাশ মানুষ। সর্বক্ষেত্রে মার খেয়ে আলি কেনানের আস্তানায় মুখ্যত দুবেলা অন্ন সংস্থানের জন্যই পড়ে আছে। বাকি দুটি ফুলতলিরই অল্প বয়স্ক কিশোর। তাদের মা বাবা আছে, আছে ঘরবাড়ি। সংসারের কোনো জটিলতা তাদের জীবন স্পর্শ করেনি। তারা আস্তানায় এসেছে লোকে সচরাচর পায়না, পাওয়া যায় না তেমনি অলৌকিক কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায়।
এই সাত জনের দলটি নিয়ে আলি কেনান শুক্রবার দিন খুব সকাল বেলা বেরিয়ে পড়ে। কুকুর ছানাটির তাদের সঙ্গে যায়। রাস্তা দিয়ে গান গেয়ে বাজনা বাজিয়ে বিচিত্র পোশাক পরে মিছিল করে যাওয়ার সময় শহরের মানুষ তাদের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। তারা গান গায় :
তোমরা দেইখাছো কোথায়?
শুকনা ডালে জবা ফুলে
ভ্রমর মধু খায়।
পরান পদ্মের গহীন তলে
মধুর রসের ধারা
সেইখানেতে শুরুরে ভাই
মারেফাতের পাড়া।…
ফুলতলি পেরিয়ে বাংলা বাজার রোড ধরে এ রাস্তা সে রাস্তা অতিক্রম করে আস্ত মিছিলটি হাইকোর্টে এসে থামে। হাইকোর্টের মাজার জমজমাট থাকে। এই মাজারের আভিজাত্য আছে। এখানে অনেক লোক আসে গাড়িতে চড়ে। তারা দান খয়রাতও করে। সে জন্য অন্য মাজারের তুলনায় এখানে গরিব গোরবা ফকির ফোকরার ভীড় বেশি। মাজারে আলি কেনানেরা অনেকক্ষণ গান বাজনা করে। তাদের গান মানুষের হৃদয়ে আবেদন সৃষ্টি করে। দলের দুজনের কণ্ঠ খুব মিষ্টি। আলি কেনান বেছে বেছে সেসব গানই নির্বাচন করে, যেগুলো মানুষের অনুভব শক্তিকে ধাক্কা দিতে পারে। লোকজন চারপাশে ভীড় করে। গান বাজনার পর বাবার মাজার সালাম করে। দুপুর গড়িয়ে গেলে আবার পথে নামে।