Site icon BnBoi.Com

অলাতচক্র – আহমদ ছফা

অলাতচক্র - আহমদ ছফা

০১-২. হাসপাতাল এসে পৌঁছলাম

 

অলাতচক্র (মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস) – আহমদ ছফা
উৎসর্গ – আমার জার্মান বন্ধু পিটার জেভিৎসকে

আমি যখন হাসপাতাল এসে পৌঁছলাম, সূর্য পশ্চিমে ঢলেছে। মনুমেন্টের ছায়া দীর্ঘতরো হয়ে নামছে। রবীন্দ্রসদনের এদিকটাতে মানুষজন গাড়ি ঘোড়র উৎপাত অধিক নয়। মহানগর কোলকাতা এই বিশেষ স্থানটি অপেক্ষাকৃত শান্ত নিরিবিলি। বিশেষ করে এই ক্ষণটিতে যখন গোধুলির সঙ্গে বিদ্যুতের আলোর দৃষ্টি বিনিময় হয়।

ঝাকড়া গাছগুলোর ছায়া রাস্তার ওপর বাঁকা হয়ে পড়েছে। এখানে সেখানে নগর কাকের কয়েকটি জলসা চোখে পড়লো। পরিবেশের প্রভাব বলতে হবে। বায়স কলের সমবেত কাংস্যধ্বনিও মোলায়েম কর্কশতা বর্জিত মনে হয়। ট্রাফিকের মোড়টা বায়ে রেখে পিজি হাসপাতালে ঢোকার পর মনে হলো, লাল ইটের তৈরি কমপ্লেক্স বিল্ডিং আমাকে আস্ত গিলে খাওয়ার জন্য যেনো উদ্যত হয়ে রয়েছে।

হাসপাতালে ভিজিটিং আওয়ারের সময় শেষ হয়ে আসছে। মানুষজন চলে যেতে শুরু করেছে। আমার কর্তব্য কি ঠিক করতে না পেরে কম্পাউণ্ডের প্রাচীর ঘেঁষা নিম গাছটির তলায় দাঁড়িয়ে একটা চারমিনার জ্বালালাম। আমি একজনের খোঁজ করতে এসেছি। কিন্তু জানিনে কোন্ ওয়ার্ডে কতো নম্বর বেডে আছে। তার ওপর নতুন জায়গা এবং আমি পরিশ্রান্ত। সুতরাং সিগারেট খেয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে নিরাপদ মনে হলো।

এই যে দাদা আগুনটা দেবেন? একজন মানুষ আমার সঙ্গে কথা বললো। গায়ে হাসপাতালের ইউনিফরম। আমার যা অবস্থা মনে হলো অকূলে কূল পেয়ে গেলাম। মানুষটা লম্বাটে, বাঁ চোখটা একটু ট্যারা। দারোয়ান হতে পারে, ওয়ার্ডবয় হতে পারে, আবার মেল নার্স হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি ম্যাচ জ্বালতে যাচ্ছিলাম। বাধা দিলো লোকটি। আহা শুধু শুধু একটা কাঠি নষ্ট করবেন কেন? দিন না সিগারেটটা। আমার হাত থেকে আধপোড়া সিগারেটটি নিয়ে লোকটি নিজের সিগারেট জ্বালালো।

ভাগ্যটা যে ফর্সা একথা মানতেই হবে। না চাইতে হাসপাতালের একজন খাস মানুষ পেয়ে যাওয়ায় মনে হলো ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। আমি জিগগেস করলাম, আচ্ছা দাদা, আপনি কি এই হাসপাতালের লোক? নাকে মুখে প্রচুর ধূম্ররাশি উদ্গীরণ করে জানালো, আমি চৌদ্দ নম্বর ফিমেল ওয়ার্ডে আছি। তারপর আমার দিকে একটা তেরছা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে আপাদস্তক ভালো করে দেখে নিয়ে বললো, আপনি বুঝি জয়বাংলার মানুষ? আমার জবাব দেয়ার প্রয়োজন ছিলো না। কাপড়চোপড় মুখ ভর্তি দাড়ি এসব পরিচয়পত্রের কাজ করলো। লোকটা এরই মধ্যে হাতের সিগারেটটি শেষ করে একটুখানি আমার কাছে ঘেঁষে এলো। তারপর নিজে নিজেই বলতে থাকলো, মশায় আজ সারাদিন কি হ্যাঙ্গামাটাই না পোহাতে হলো। তিন তিন বেটা এ্যাবসেন্ট। ডবল ডিউটি করতে হচ্ছে। দিন আপনার একখানি চারমিনার। এখুনি আবার ডাক পড়বে। এমন একটা মোক্ষম মওকা পেয়ে কৃতার্থ হয়ে গেলাম। পারলে গোটা প্যাকেটটাই দিয়ে দিতাম। আপাতত সেরকম কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হওয়ায় একটি শলাকাতেই আগুন জ্বালিয়ে দিলাম। লোকটার সিগারেট টানার একটা বিশেষ ভঙ্গি আছে। অসন্তুষ্ট বিরক্ত শিশু যেমন মাতৃবুকে মুখ লাগিয়ে গিসগিসিয়ে টান মারে সেরকম একটা দৃশ্যের সৃষ্টি হতে চায়। কপালের বলিরেখাগুলো জেগে ওঠে, চোখের মণি দুটো বেরিয়ে আসতে চায়। বোধহয় আমাকে খুশি করার জন্যই বললো, জানেন দাদা, আমাদের ওয়ার্ডে আপনাদের জয়বাংলার একটি পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে। লোকটা এপর্যন্ত দু’ দু’বার ‘জয়বাংলা’ শব্দটি উচ্চারণ করলো। কোলকাতা শহরের লোকদের মুখে ইদানীং জয়বাংলা শব্দটি শুনলে আমার অস্তিত্বটা কেমন কুঁকড়ে আসতে চায়। শেয়ালদার মোড়ে মোড়ে সবচে সস্তা, সবচে ঠুনকো স্পঞ্জের স্যাণ্ডেলের নাম জয়বাংলা স্যাণ্ডেল। এক সপ্তার মধ্যে যে গেঞ্জি শরীরের মায়া ত্যাগ করে তার নাম জয়বাংলা গেঞ্জি। জয়বাংলা সাবান, জয়বাংলা-ছাতা, কতো জিনিস বাজারে ছেড়েছে কোলকাতার ব্যবসায়ীরা। দামে সস্তা, টেকার বেলায়ও তেমন। বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের ট্যাকের দিকে নজর রেখে এ সকল পণ্য বাজারে ছাড়া হয়েছে। কিছুদিন আগে যে চোখওঠা রোগটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো, কোলকাতার মানুষ মমতাবশত তারও নামকরণ করেছিলো জয়বাংলা। এই সকল কারণে খুব দ্র অর্থেও কেউ যখন আমাকে জয়বাংলার মানুষ বলে চিহ্নিত করে অল্পস্বল্প বিব্রত না হয়ে উপায় থাকে না।

সে যাকগে। আমি জিগগেস করলাম, আপনার ওয়ার্ডে বাংলাদেশের পেশেন্টটির কি নাম জানেন নামধাম জানিনে। উনি আছেন উনত্রিশ নম্বর বেডে। বললাম, আমি এসেছি একজন রোগিনীর খোঁজে। কি অসুখ, কোথায় ভর্তি হয়েছে কিছুই বলতে পারবো না। আপনি কি এ ব্যাপারে কোনো উপকার করতে পারেন? চারমিনারের অবশিষ্ট সিগারেটগুলো তার হাতে তুলে দিলাম। লোকটি আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললো, চলুন না চৌদ্দ নম্বর ওয়ার্ডে, উনত্রিশের পেশেন্টটি যদি হয়ে যায়, তাহলে তো পেয়েই গেলেন। উনত্রিশের পেশেন্ট জয়বাংলার। অন্য কোনো পেসেন্ট থাকলে তার খবরও বলতে পারবে।

ছিপছিপে এল টাইপের একতলা বিল্ডিংটির লনের কাছে এলাম। লোকটি বললো, একটু দাঁড়ান, জিগগেস করে দেখি। চার পাঁচজন মহিলা লনে পায়চারি করছে সেদিকে লক্ষ করেই হাঁক দিলো, এই যে জয়বাংলার দিদিমণি। আপনাদের দেশের এক ভদ্দরলোক একজন ফিমেল পেশেন্টের খোঁজ করছে। দেখুন তো সাহায্য করতে পারেন কিনা। আমি তাকিয়ে দেখলাম, কপালের দিকে সরে আসা চুলের গোছাটি সরাতে সরাতে তায়েবা সুরকি বিছানো পথের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে। আমাকে ডাকছো নাকি গোবিন্দদা! আজ্ঞে দিদিমণি, আপনাদের জয়বাংলার একজন ভদ্দরলোক একজন ফিমেল পেশেন্ট তালাশ করছেন। আপনি একটু কথা বলে দেখুন তো।

এতোক্ষণে জানা গেলো লোকটির নাম গোবিন্দ। তায়েবা এরই মধ্যে তার পুরোনো সম্পর্ক পাতানোর ব্যাপারটি চালু করে ফেলেছে দেখছি। আমার চোখে চোখ পড়তে তায়েবা আনন্দে চকমক করে উঠলো। পিঠের ওপর ঢলের মতো নেমে আসা ছড়ানো চুলের রাশিতে একটা কাঁপন জাগিয়ে বললো, একে কোথায় পেলে গোবিন্দদা। দিদিমণি আপনার অতোসব জবাব দিতে পারবো না, আমি চলোম। ডঃ মাইতি আমাকে ওয়ার্ডে না পেলে একেবারে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। ডঃ মাইতির কাঁচা খাওয়া থেকে বাঁচার জন্য গোবিন্দ চলে গেলো।

তায়েবাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। এই ক’মাসে তার চেহারায় একটা বাড়তি লাবণ্য ফুটে উঠেছে। তার পিঠ ঝাপা অবাধ্য চুলের রাশি। চোখে না দেখলে চিনে নিতে কয়েক মিনিট সময় নিতো। তায়েবার এমন সুন্দর, সুগঠিত শরীরে কোথায় রোগ ঢুকে হাসপাতালে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে ভেবে ঠিক করতে পারিনি। আমার চোখে সরাসরি চোখ রেখে জিগগেস করলো, দানিয়েল ভাই, এতোদিন আসেননি কেন? কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলেন যে? যান আপনার সাথে কোন কথা নাই। যান চলে যান। পরক্ষণে হাততালি দিয়ে খিল খিল করে হেসে উঠলো। এই যে আরতিদি, শিপ্রা, মঞ্জুলিকা, উৎপলা দেখে যাও কে এসেছে। তায়েবাকে কোনোদিন বুঝতে পারিনি। বোঝার চেষ্টাও ছেড়ে দিয়েছি। পায়ে পায়ে চারজন নারীমূর্তি এগিয়ে এলো এবং আমার মনে একটা খারাপ চিন্তা জন্ম নিলো। এ সমস্ত মহিলা রোগ সারাতে হাসপাতালে এসেছে, না বিউটি কম্পিটিশন করতে এসেছে। তায়েবা বললো, আসুন আরতিদি, পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি হচ্ছেন দানিয়েল ভাই, ভীষণ প্রতিভাবান মানুষ। এসএসসি হতে এমএ পর্যন্ত সবগুলো পরীক্ষায় প্রথম হয়ে আসছেন। স্কলারশীপ নিয়ে বিলেত যাবার ব্যবস্থাও পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিলো, মাঝখানে সংগ্রাম শুরু হয়ে গেলো, তাই..। আর আরতিদির বাড়ি ছিলো আপনাদের চাঁটগায়ে। আমার পাশের কেবিনে থাকেন। এ হচ্ছে শিপ্রাগুহ ঠাকুরতা। বরিশালের বানরীপাড়ার মেয়ে। আর যে মঞ্জুলাকে দেখছেন তারও আসল বাড়ি বাংলাদেশে ময়মনসিংহ জেলায়। পোড়ামুখী তিন বছর ধরে এই হাসপাতালে ডেরা পেতে আছে। অবশেষে উৎপলার হাত ধরে বললো, এর পরিচয় আপনি জানতে পারবেন না। ওর সাতপুরুষের কেউ কস্মিনকালেও পদ্মার হেপাড়ে যায়নি। একেবারে জাত ঘটি, তার ওপর আবার ব্রাহ্মণকন্যা। এখন ঠেকায় পড়ে এই মেলেচ্ছনির সঙ্গে রাত্রিবাস করতে হচ্ছে। ‘রাত্রিবাস’ শব্দটি এমন এক বিশেষ ভঙ্গি সহকারে উচ্চারণ করলো সকলে হো হো করে হেসে উঠলো। এই ঘটা করে পরিচয় করানোটা যে আমার ভালো লাগেনি তায়েবার অজানা থাকার কথা নয়। তুচ্ছ জিনিসকে বড়ো করে দেখানোর ব্যাপারে তার জুড়ি নেই। কিন্তু আজকের বাড়াবাড়িটা সমস্ত সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। জীবনে আমি ফার্স্ট সেকেণ্ড কোনোদিনই হতে পারিনি। একবার উত্তীর্ণ ছাত্রমণ্ডলীর তালিকায় ওপরের দিক থেকে লাস্ট এবং শেষের দিক থেকে ফার্স্ট হয়েছিলাম। গোটা ছাত্রজীবনে সাফল্যের সেই ধারাটিই আমি মোটামুটিভাবে রক্ষা করে আসছি। এজন্য আফসোসও নেই। বরঞ্চ পরীক্ষায় যারা ভালোটালো করে তাদের প্রতি রয়েছে আমার মুদ্রাগত আক্রোশ। মুখে সাত আট দিনের না-কামানো দাড়ি। পায়ে জয়বাংলা চপ্পল, জামা-কাপড়ও তেমনি। অনাহার, অর্ধাহার, অনিদ্রার ছাপ মুখে ধারণ করে আমি জয়বাংলার মূর্তিমান শিলাস্তম্ভে পরিণত হয়েছি। এটাই আমার বর্তমান, এটাই আমার অস্তিত্ব। এই কোলকাতা শহরে অনেক মানুষ আমাদের সমাদর করেছে আশাতীত দয়া-দাক্ষিণ্য দেখিয়েছে, অনেকে হেলাফেলাও করেছে। ভালো লাগুক, খারাপ লাগুক সব নির্বিচারে মেনে নিয়েছি। কিন্তু তায়েবার আজকের আচরণ আমার কাছে একটা ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা বলে মনে হলো। তার ঠিকানা সংগ্রহ করে হাসপাতাল অবধি আসতে আমাকে কি কম কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে! পারলে মুখে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে সোজা পা ঘুরিয়ে ফেরত চলে যেতাম। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূল ছিলো না। তাছাড়া শরীরে মনে এতোদূর ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত ছিলাম যে সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় আনকোরা একটি অভাবিত নাটক জমিয়ে তোলা সম্ভব ছিলো না।

তায়েবা আমাকে তার কেবিনে নিয়ে গেলো। দুটো মাত্র খাট, পানির বোতল, গ্লাস ইত্যাদি রাখার একটা কাঠের স্ট্যাণ্ড, স্টীলের একটা মিটসেফ জাতীয় বাক্স, যেখানে প্রয়োজন মতো কাপড় চোপড় রাখা যায় এবং ভিজিটরদের জন্য একটি টুল… এই হলো আসবাবপত্তর। তায়েবা বিছানায় উঠে বালিসটা বুকের কাছে টেনে নিয়ে আমাকে টুলটা দেখিয়ে বললো, বসুন। জানেন তো ভিজিটরদের রোগীর বিছানায় বসতে নেই। তাছাড়া আপনার পায়ে সব সময়ে রাজ্যের ময়লা থাকে, কোনো সুস্থ মানুষও যদি আপনাকে বিছানায় বসতে দেয়, পরে পস্তাতে হয়। কথাটা সত্যি। আমি ওদের বাসায় গেলে আগেভাগে আরেকটি চাদর বিছিয়ে দিতো। তারপর আমি বসতাম। এভাবে খাটজোড়া ধবধবে সাদা চাঁদরের অকলঙ্ক শুভ্রতা রক্ষা করা হতো।’

এই সময়ে হাসপাতালের শেষ ঘণ্টা বেজে উঠলো। না চাইতেই একটা সুযোগ আমার হাত এসে গেলো। আমতা আমতা করে বললাম, জায়গাটি তো চেনা হলো, আরেকদিন না হয় আসা যাবে। আজ চলি। যতোই মৃদুভাবে বলি না কেন, আমার কথাগুলোতে রাগ ছিলো, ঝাঁঝ ছিলো। এটুকু না বুঝতে পারার মতো বোকা নিশ্চয়ই তায়েবা নয়। সে শশব্যস্তে বললো, সেকি কতোদিন পরে এলেন, এখুনি চলে যাবেন?। বসুন দু’চারটা কথাবার্তা বলি। আমি বললাম, শেষ ঘণ্টা বেজে গেছে, এখন যাওয়াই উত্তম। তায়েবা শাড়ির আঁচল আঙুলে জড়াতে জড়াতে বললো, সেজন্য আপনাকে চিন্তা করতে হবে না, আমি মাইতিদাকে বলে সব ম্যানেজ করে নেবো। আমি স্পষ্টতই অনুভব করলাম, আমার বুকের ভেতরে ঈর্ষার একটা কুটিল রেখা। জানতে চাইলাম, মাইতিদাটি কে? জবাবে বললো, মাইতিদা হচ্ছে ডঃ মাইতি। অসম্ভব ভালো মানুষ। কিন্তু বাইরে ভদ্রলোক ভীষণ কড়া। একটু পরেই আসবেন, আলাপ করলেই বুঝতে পারবেন কি সুন্দর মন। তার কথায় আমি স্প্রীংয়ের মতো লাফিয়ে উঠলাম। দোহাই তায়েবা উদ্ধার করো। দিদিমণিদের সামনে তুমি আগে একটা সার্কাস দেখিয়ে ফেলেছে। আরো একটা সার্কাস তুমি তোমার মাইতিদার সামনে দেখাবে বলে যদি মনস্থ করে থাকো। আমি তাতে রাজী হতে পারবো না। তারচে বরং আমি চলি। সুন্দর মনের মানুষদের নিয়ে তুমি থাকো। তোমার সুন্দর মনের মানুষদের গুণপনা এই সময়ে গোটা কোলকাতা জেনে ফেলেছে।

তায়েবা হঠাৎ সাপের মতো ফোঁস করে উঠলো। আপনি আমার অসুখের সংবাদ নিতে এসেছেন, নাকি যে সব কথা শুনতে শুনতে আমার কান পঁচে গেছে, সেগুলো পাঁচ কাহন করে বলতে এসেছেন। চলে যান, আপনি এখুনি চলে যান। একখানা লাউড স্পীকার ভাড়া করে আমার লোকদের কথা কোলকাতা শহরে ঘটা করে প্রচার করুন। ভাড়ার টাকা আমি দেবো। এই আচমকা বিস্ফোরণে আমি দমে গেলাম। টুলটা নেড়ে বিছানার কাছে এসে বসতে বসতে বললাম, তুমি এই মহিলাদের সামনে আমাকে এমনভাবে অপমানটা করলে কেন? কই অপমান করলাম, কোথায় অপমান করলাম? মনটা আপনার অত্যন্ত সংকীর্ণ। এই যে বললে প্রতি বছরে আমি ফার্স্ট হয়ে আসছি। বারে, অন্যায় কি করেছি। আপনি তো অনেক কাজ করে পড়াশোনা করেন। সব ছেড়ে ছুঁড়ে একটুখানি মন লাগালে আপনিও অনায়াসে ফাস্টটাস্ট কিছু একটা হতেন। আর যারা ফার্স্ট সেকেন্ড হয় তারা আপনার চাইতে ভালো কিসে? নিজের তারিফ শুনতে কার না ভালো লাগে। মনের উষ্মর ভাবটি কেটে গেলো। আমি হাসি মুখে বললাম, আর বিলেত যাওয়ার ব্যাপারটি। আরে দূর দূর ওটা একটা ব্যাপার নাকি, আজকাল কুকুর বেড়ালেরাও হরদম বিলেত আমেরিকা যাচ্ছে। আপনি চাইলে অবশ্যই যেতে পারেন। তাছাড়া…। আমি বললাম, তা ছাড়া আর কি। তাছাড়া আপনি একটা গেঁয়োভূত। একেবারে মাঠ থেকে সদ্য আসা একটি মিষ্টি কুমোড়। আমি বললাম, আমি যে মিষ্টি কুমোড় সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কুকুর বেড়ালও বিলেত আমেরিকা যাচ্ছে একথা সত্যি। কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছো টিকিট করে ওসব দেশে যেতে হয়। আপনি সব কথার কুষ্ঠিনামা বের করতে চান। চাল বোঝেন, চাল? ঐ মেয়েরা প্রতিদিন কথায় কথায় আমার সঙ্গে চাল মারে। আজ না হয় আমিও একটা চাল মারলাম। আপনি এটুকুও বোঝেন না? তুমি তো পরিচয় করিয়ে দিলে, তোমার দিদি, তোমার সই, তোমার বান্ধবী, এখন বলছে সব চালবাজ। আমার দিদি, আমার সই, আমার বান্ধবী ঠিক আছে, কিন্তু চাল মারতে অসুবিধেটা কোথায়? আপনি মেয়েদের সম্পর্কে জানেন কচু। সে বুড়ো আঙুলটি উঠিয়ে দেখালো।

শুনুন দানিয়েল ভাই, তায়েবা ঝলমল করে উঠলো। সেদিন হাসপাতালে একটা কাণ্ড ঘটে গেছে। এখানকার ধনী ঘরের এক মহিলা সেদিন বিউটি পারলারে গিয়ে ছাতার মতো এক মস্ত খোঁপা তৈরি করিয়ে আনে। বাড়ি আসার পরে কি হলো জানেন, মহিলার মনে হলো তার মগজের ভেতর কিছু একটা নড়ছে, লাফ দিচ্ছে। এরকম একটা আজগুবী অসুখের কথা কেউ কখনো শোনেনি। সকলের খুব দুশ্চিন্তা। অনেক ডাক্তার দেখানো হলো। কেউ বিশেষ কিছু করতে পারলো না। মহিলাকে নাকি স্যার নীলরতন হাসপাতালে নেয়া হয়েছিলো। সেখানে ডাক্তারেরা কিছু করতে পারেনি। অবশেষে তাকে এক রকম ফেন্ট অবস্থায় এ হাসপাতালে আনা হয়। ডাক্তারেরা স্থির করেন, মহিলার খোঁপাটি খুলে যন্ত্রপাতি দিয়ে দেখতে হবে মগজের ঘটনাটি কী। সত্যি সত্যি নার্সরা যখন মাথার খোঁপাটি খুলতে লেগে গেলো, মহিলা ফেন্ট অবস্থায়ও দু’হাত দিয়ে খোঁপা খুলতে বাধা দিচ্ছে। পরে যখন খোঁপা খোলা হলো অমনি এক টিকটিকি বাহাদুর লেজ দুলিয়ে লাফ দিলো। খোঁপা বাঁধার কোন ফাঁকে আটকা পড়ে গেছে টের পায়নি। সেই থেকে টিকটিকিটি যতোই বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছে, মহিলার মনে হয়েছে, মাথার মগজ খুলি ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সত্যি ঘটনা, বুঝলেন মেয়েরা কেমন হয়? আমি বললাম, যতোদূর জানি, তুমিও তো একজন মেয়ে, তোমার বিষয়েই বা অন্যরকম হবে কেমন করে। তায়েবা কৃত্রিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো, আপনি এখনো মিষ্টি কুমোড়ই থেকে গেছেন। কিছু শিখতে পারেননি।

এই সময়ে ডান হাতে স্টেথিসকোপ দোলাতে দোলাতে এক ভদ্রলোক কেবিনে প্রবেশ করলেন। বয়স খুব বেশি হবে না। ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের কোঠায়। চোখের দৃষ্টি অসম্ভব ধারালো। চেকন করে কাটা একজোড়া শাণিত গোঁফ। ধারালো চিবুক। একহারা গড়নের চেহারাখানা ব্যক্তিত্বের দীপ্তিতে খোলা তলোয়ারের মতো ঝকঝক করছে। সন্ধ্যের এ আলো আঁধারিতেও আমার দৃষ্টি এড়ালো না। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই যে এদিকে আসুন তো। আমি এগিয়ে গেলে তিনি অনেকটা ধমকের ভঙ্গিতে জিগগেস করলেন, কি বেল বাজলো আওয়াজ শুনতে পাননি? আমি মৃদুস্বরে বললাম, পেয়েছি। পেয়েছেন তো হাসপাতালে বসে আছেন কেন? আপনাদের ঘাড় ধরে বের করে না দিলে শিক্ষা হবে না দেখছি। এই যে মাইতিদা থামুন, থামুন। আমাদের দুজনের মাঝখানে তায়েবা এসে দাঁড়িয়েছে। আপাততঃ আপনার চোখা চোখা কথাগুলো তুলে টুলে রাখুন। আমি কতো বলে কয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়ার জন্য দানিয়েল ভাইকে সেই বিকেল থেকে আটকে রেখেছি। এদিকে আপনি তাকে ঘাড় ধরে বের করে দিচ্ছেন। ডঃ মাইতি স্মিত হেসে বললেন, এই তোমার দানিয়েল ভাই, যিনি ফার্স্ট ছাড়া কিছুই হন না। মশায় আপনার অসাধারণ কীর্তিকাহিনী শুনতে শুনতে তো পাগল হবার উপক্রম। অধীর আগ্রহে দিন গুণছি, কখন এসে দর্শনটা দেবেন। শুনেছি মশায়ের কোলকাতা আগমনও ঘটেছে তায়েবার অনেক আগে। যাক ভাগ্যে ছিলো, তাই দেখা হলো। তিনি আমার সঙ্গে শেকহ্যাণ্ড করলেন। তারপর বললেন, আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি ওয়ার্ডে। একটা রাউন্ড দিয়ে আসি।

উৎপলা এখনো বাইরে থেকে ফেরেনি। কেবিনে আমরা দু’জন। এই ফাঁকে আমি জিগ্‌গেস করলাম, তায়েবা, তোমার শরীর কেমন? কেমন আছো? রোগের অবস্থা কি? তায়েবা মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে বললো, ওসব কথা থাকুক। আমার শরীর ভালো, আমি ভালো আছি। আমি বললাম, আগরতলা আসার সময় তোমাদের সঙ্গে শেষ দেখা। তোমরা তো আমার সঙ্গে এলে না, কোলকাতা এসে খবর পেলাম, তোমরাও আগরতলা এসে একটা ক্যাম্পে উঠেছে। কোলকাতায় নানাজনের কাছ থেকে নানাভাবে তোমার খবর পেয়েছি। একজন বললো, তোমাকে তিনদিন পার্ক সার্কাসের কাছে রাস্তা পার হতে দেখেছে। আরেকজন বললো, তুমি সকাল বিকেল তিনটি করে টিউশনি করছে। শেষ পর্যন্ত নির্মল একদিন এসে জানালো, তোমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। কোন্ হাসপাতাল, কি রোগ কিছুই জানাতে পারলো না। তোমার ঠিকানা যোগাড় করতে যেয়ে প্রায় একটা খুনখারাবী বাধিয়ে বসেছিলাম। তায়েবা বললো, সেসব কথা থাকুক। আপনার খবর বলুন, কোথায় আছেন, কখন এসেছেন? দু’বেলা চলছে কেমন করে বাড়ি ঘরের খবর পেয়েছেন? আপনার মা বোন এবং ভায়ের ছেলেরা কেমন আছে?

আমার তো বলবার মতো কোনো খবর নেই। তায়েবাকে জানাবো কি? কোলকাতা শহরে আমরা কচুরিপানার মতো ভেসে ভেসে দিন কাটাচ্ছি, বিশেষ করে মুসলমান ছেলেরা। আমাদের সঙ্গে মা বোন বা পরিবারের কেউ আসেনি। সে কারণে শরণার্থী শিবিরে আমাদের ঠাই হয়নি। আমরাও শিবিরের মানুষদের প্রাণান্তকর কষ্ট দেখে মানে মানে শহরের দিকে ছিটকে পড়েছি এবং কোলকাতা শহরে গুলতানি মেরে সময় যাপন করছি। একজন আরেক জনকে ল্যাং মারছি। বাংলাদেশের ফর্সা কাপড়চোপড় পরা অধিকাংশ মানুষের উদ্দেশ্যবিহীন বেকার জীবনযাপনের ক্লেদ কোলকাতার হাওয়া দুষিত করে তুলছে। আমরা সে হাওয়াতে শ্বাস টানছি। সীমান্তে একটা যুদ্ধ হচ্ছে। দেশের ভেতরেও একটা যুদ্ধ চলছে। অবস্থানগত কারণে আমরা সে ভয়ঙ্কর ব্যাপারটি ভুলে থাকতে চাই। কিন্তু পারি কই? যুদ্ধে চলে গেলে ভালো হতো। দেশের স্বাধীনতার জন্য কতোটুকু করতে পারতাম জানিনে। তবে বেঁচে থাকবার একটা উদ্দেশ্য চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করতে পারতাম। আমার যুদ্ধে যাওয়া হয়নি। যুদ্ধকে ভয় করি বলে নয়। আমাদের দেশের যে সকল মানুষের হাতে যুদ্ধের দায় দায়িত্ব, তারা আমাকে ট্রেনিং সেন্টারে পাঠাবার যথেষ্ট উপযুক্ত বিবেচনা করতে পারেননি। আমি তিন তিনবার চেষ্টা করেছি। প্রতিবারই মহাপুরুষদের দৃষ্টি আমার ওপর পড়েছে। অবশ্য আমাকে বুঝিয়েছেন, আপনি যুদ্ধে যাবেন কেন? আপনার মতো ক্রিয়েটিভ মানুষের ইউজফুল কতো কিছু করবার আছে। যান কোলকাতা যান। সেই থেকে কোলকাতায় আছি। হাঁটতে, বসতে, চলতে, ফিরতে মনে হয় আমি শূণ্যের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছি। এ সব কথা তায়েবাকে জানিয়ে লাভ কী? কোন্ বাস্তব পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে তাকে এই হাসপাতাল অবধি আসতে হয়েছে। সবটা না হলেও অনেকটা আমি জানি। তাকে খুশি করার জন্য বললাম, আমরা বাংলাদেশের বারো চৌদ্দজন ছেলে বৌবাজারের একটা হোস্টেলে খুব ভালোভাবে আছি। তুমি তো দাড়িঅলা নরেশদাকে চিনতে। এই হোস্টেলে তাঁর তিন ভাই আগে থেকে থাকতো। আমাদের অসুবিধে দেখে তারা দু’টো আস্ত রুম ছেড়ে দিয়েছে। রান্নাবান্না বাজার সব কিছু নিজেরাই করি। আমি এখানকার একটা সাপ্তাহিকে কলাম লিখছি। শীগগীর নরেশদা একটা কলেজে চাকরি পেতে যাচ্ছেন। এখানে বাংলাদেশের লক্ষ্মীছাড়া ছন্নছাড়াদের নিয়ে একটা সুন্দর সংসার গড়ে তুলেছি। আর শুনেছি বাড়িতে সবাই বেঁচেবর্তে আছে। তায়েবা আমার হাতে হাত রেখে বললো, দানিয়েল ভাই, আপনি একটা পথ করে নেবেন, এ কথা আমি নিশ্চিত জানতাম।

এরই মধ্যে জুতোর আওয়াজ পাওয়া গেলো। তায়েবা অবলীলায় বলে দিলো ওই যে মাইতিদা আসছেন। সত্যি সত্যি ডঃ মাইতি এসে কেবিনে প্রবেশ করলেন। তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, দানিয়েল সাহেব, আমি রসকষ হীন মানুষ। রোগী ঠেঙিয়ে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করি। শুনেছি আপনি একজন জিনিয়স, আপনার সাথে কি নিয়ে আলাপ করা যায় ভেবে স্থির করে একদিন জানাবো। আজ ভয়ানক ব্যস্ত; ক্ষমা করতে হবে। এখন আমি উঠবো।

তায়েবা বিছানা থেকে তড়াক করে নেমে ডঃ মাইতির ঝোলানো স্টেথেসকোপটা নিজের হাতে নিয়ে বললো, মাইতিদা আপনাকে দু’মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, দানিয়েল ভাই, কালও কি আপনি হাসপাতালে আসবেন? আমি মাথা নাড়লাম। তাহলে আমার জন্য অল্প ক’টা ভাত আর সামান্য ছোট মাছের তরকারি রান্না করে নিয়ে আসবেন। মরিচ দেবেন না, কেবল জিরে আর হলুদ। ছোট্ট মেয়েটির মতো আবদেরে গলায় বললো, মাইতিদা, আমাকে আগামীকাল ভাত খেতে না দিলে আপনাদের কথামতো আমি ইনজেকশন দেবো না, ক্যাপসুল খাবো না, হেন টেস্ট তেন টেস্ট কিছুই করতে দেবো না। ডঃ মাইতির হাত ধরে বললো, আপনি হ্যাঁ বলুন মাইতিদা। ডঃ মাইতি বেশ শান্ত কণ্ঠে বললেন, বেশতো দানিয়েল সাহেব, কালকে ভাত মাছ রান্না করে নিয়ে আসুন। কিন্তু আমি ভাবছি, পুরুষ মানুষের হাতের রান্না তোমার মুখে রুচবে কিনা? তায়েবা বললো, রুচবে, খুব রুচবে। দানিয়েল ভাই ট্যাংরা মাছ পান কিনা দেখবেন। ডঃ মাইতি ঘড়ি দেখে বললেন, এবার আমি উঠবো। দানিয়েল সাহেব, আপনিও কেটে পড়ুন। এমনিতে অনেক কনসেসন দেয়া হয়েছে।

তায়েবার কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে পেছন ফিরে একবার হাসপাতাল কমপ্লেক্সটির দিকে তাকালাম। ছেঁড়া ছেঁড়া অন্ধকারে বিরাট বাড়িটাকে নিস্তব্ধতার প্রতিমূর্তির মতো দেখাচ্ছে। মৃত্যু এবং জীবনের সহাবস্থান বাড়িটার শরীরে এক পোচ অতিরিক্ত গাম্ভীর্য মাখিয়ে দিয়েছে মনে হলো। হাসপাতাল কম্পাউণ্ড থেকে বেরিয়ে এসপ্ল্যানেডের পথ ধরলাম। পনেরো নম্বর ট্রাম ধরে আমাকে বৌবাজারে নামতে হবে। উল্টোপাল্টা কতো রকমের চিন্তা মনের ভেতর ঢেউ তুলছিলো। তায়েবার অসুখটা কি খুব সিরিয়াস? তার মা কি দিনাজপুর থেকে কোলকাতা আসতে পেরেছে? ডোরা শেষ পর্যন্ত পিলে চমকানো এমন একটা দুর্ঘটনার সৃষ্টি করলো। এতো বড়ো একটা কাণ্ড ঘটাবার পরেও জাহিদ নামের মাঝ বয়েসী মানুষটি কি করে, কোন্ সাহসে হুলোবেড়ালের মতো গোঁফ জোড়া বাগিয়ে তায়েবাকে হাসপাতাল দর্শন দিতে আসে। আমি তো ভেবে পাইনে। ট্রাম দাঁড়াতে দেখে দৌড়ে চড়তে যাচ্ছি, এমন সময় পেছনে ঘাড়ের কাছে কার করস্পর্শ অনুভব করলাম। তাকিয়ে দেখি ডঃ মাইতি। তিনি বললেন, দানিয়েল সাহেব, একটা কথা বলতে এলাম। মাছ রান্না করার সময় একেবারে লবণ ছোঁয়াবেন না। আমি বললাম, আপনি ঠিকই ধরতে পেরেছেন গেণ্ডারিয়ার বাসাতেও তায়েবা কখনো লবণ খেতো না। তিনি জানতে চাইলেন, আপনি কতোদিন তায়েবাকে চেনেন। আমি বললাম, তা বছর চারেক তো হবেই। তিনি আমাকে জেরা করার ভঙ্গিতে বললেন, তার কী রোগ আপনি জানেন? বললাম, জানিনে, মাঝে মাঝে দেখতাম নিঃসার হয়ে পড়ে আছে। কিছুদিনের জন্য হাসপাতাল যেতো। আবার ভালো হয়ে চলে আসতো। শুধু এটুকু জানি সে লবণ খেতো না। আর চা টা ঠাণ্ডা করে খেতো। তিনি বললেন, এর বেশি আপনি কিছু জানেন না? বললাম, বারে জানবো কি করে। মহিলাদের রোগের কি কোনো সীমা সংখ্যা আছে? তাছাড়া তায়েবা আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি, আসলে তার অসুখটা কী? তিনি বললেন, উচিত কাজ করেছে, এসব আপনাকে পোষাবে না। আপনি অন্যরকমের মানুষ। আর শুনুন ভাত তরকারি আনার সময় লুকিয়ে আনবেন। ডঃ ভট্টাচার্য জানতে পেলে ওকে হাসপাতালে থাকতে দেবেন না। এটুকু কষ্ট করে মনে রাখবেন। তারপর নিজে নিজে বিড় বিড় করে বললেন, মেয়েটি তো ফুরিয়েই যাচ্ছে। যা খেতে চায় খেয়ে নিক। ডঃ মাইতি একটা চাপা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। আমার বুকটা ভয়ে আশঙ্কায় গুড় গুড় করে উঠলো। ডঃ মাইতি বললেন, আপনার ট্রাম, আমি চলি।

.

০২.

বৌ বাজারের স্টপেজে ট্রাম থামতেই লোডশেডিং শুরু হয়ে গেলো। সেই কোলকাতার বিখ্যাত লোডশেডিং। এটা এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে এখনো আমাদের ঠিক গা সওয়া হয়ে উঠেনি। অনেক কষ্টে হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ির গোড়ায় এসে দেখি দারোয়ান পাঁড়েজী কেরোসিনের কুপী জ্বালিয়ে কম্বলের ওপর দিব্যি হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। বিরাট উদরটা আস্ত একখানি ছোট্টো টিলার মতো নিশ্বাসের সাথে সাথে ওঠানামা করছে। নাক দিয়ে মেঘ ডাকার মতো শব্দ হচ্ছে। সকালবেলা বেরুবার সময় পাঁড়েজীকে টিকিতে একটা লাল জবা ফুল খুঁজে কপালে চন্দন মেখে সুর করে হিন্দিতে তুলসীদাসের রামায়ণ পড়তে দেখেছি। তাঁর যে এতোবড়ো একটা প্রকাণ্ড ভূঁড়ি আছে, তখন কল্পনাও করতে পারিনি। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে পাঁড়েজী ধড়মড় করে জেগে হাঁক দিলো, কৌন? আমি তার সামনে এসে দাঁড়ালে চোখ রগড়াতে রগড়াতে একটুখানি হেসে বললো, আমি তো ভাবলাম কৌন না কৌন আপনি তো জয়বাংলার বাবু আছেন, যাইয়ে।

দোতলায় পা দিতে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেলো। এ লক্ষ্যহীন, উদ্দেশ্যহীন জীবনে বচসা ঝগড়া এসব আমরা নিয়মিত করে যাচ্ছি। আমার শরীরটা আজ ক্লান্ত। মনটা ততোধিক। ভেবেছিলাম, কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকবো। কিছু সময় একা একা থাকা আমার বড়ো প্রয়োজন। বাইরে কোথাও পার্কে টার্কে বসে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসবো কিনা ভাবাগোণা করছি, এ সময়ে আলো জ্বলে উঠলো। সুতরাং ঘরের দিকে পা বাড়ালাম, মেঝের ওপর পাতা আমাদের ঢালাও বিছানার ওপর নরেশদা গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। তাঁর বিপরীত দিকে দু’জন অচেনা তরুণ, দু’জনেরই গায়ে মোটা কাপড়ের জামা। একজনের হাতা কনুই অবধি গুটানো। জামার রঙ বাদামী ধরনের, তবে ঠিক বাদামী নয়। বুঝলাম, এরা কোনো ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে এসে থাকবে। হাত গুটানো তরুণের গায়ের রঙ হয়তো এক সময়ে উজ্জ্বল ফর্সা ছিলো, এখন তামাটে হয়ে গেছে। আরেকজন একেবারে কুচকুচে কালো। নরেশদা বললেন, এসো দানিয়েলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। ফর্সা তরুণটির দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, এর নাম হচ্ছে আজহার, আমার ছাত্র। আর ও হচ্ছে তার বন্ধু হিরন্ময়। দু’জনেই জলাঙ্গী ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে এসেছে। আজ রাত সাড়ে বারোটার সময় ট্রেনিং নেয়ার জন্য অন্যান্যদের সঙ্গে দেরাদুন চলে যাচ্ছে। নরেশদা জিগগেস করলেন, আজহার, তোমরা কিছু খাবে? না স্যার, হোটেলে খেয়েই তো আপনার কাছে এলাম। নরেশদা বললেন, তারপর খবর টবর বলো। এখানে এসে কি দেখলে, আর কি শুনলে? আজহার বললো, দেখলাম স্যার ঘুরে ঘুরে প্রিন্সেপ স্ট্রীট, থিয়েটর রোডের সাহেবরা খেয়ে দেয়ে তোফা আরামে আছেন। অনেককে তো চেনাই যায় না। চেহারায় চেকনাই লেগেছে। আমাদের ক্যাম্পগুলোর অবস্থা যদি দেখতেন স্যার। কি বলবো, খোলা আকাশের নিচে হাজার হাজার তরুণ রাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজছে, রোদে পুড়ছে। কারো অসুখবিসুখ হলে কি করুণ অবস্থা দাঁড়ায় নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না স্যার। আমরা কোলকাতা এসেছি চারদিন হলো। এ সময়ের মধ্যে অনেক কিছু দেখে ফেলেছি। একেকজন লোক ভারত সরকারের অতিথি হিসেবে এখানে জামাই আদরে দিন কাটাচ্ছে। তাদের খাওয়া-দাওয়া ফুর্তি করা, কোনো কিছুর অভাব নেই। আরেক দল বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে সোনা লুট করে কোলকাতা এসে ডেরা পেতেছে। আবার অনেকে এসেছে বিহারীদের পুঁজিপাট্টা হাতিয়ে নিয়ে। আপনি এই কোলকাতা শহরের সবগুলো বার, নাইট ক্লাবে খোঁজ করে দেখুন। দেখতে পাবেন ঝাঁকে ঝাঁকে বাংলাদেশের মানুষ দু’হাতে পয়সা ওড়াচ্ছে। এদের সঙ্গে থিয়েটার রোডের কর্তাব্যক্তিদের কোনো যোগাযোগ নেই বলতে পারেন? কথায় কথায় আজহার ভীষণ রেগে উঠলো। আগে আমরা ফিরে আসি, দেখবেন এই সমস্ত হারামজাদাদের কি কঠিন শিক্ষাটা দেই। স্যার, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমি একটা সিগারেট খেতে পারি? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আমারই অফার করা উচিত ছিলো। কিন্তু মাস্টার ছিলাম তো সংস্কার কাটতে কাটতেও কাটে না। আজহার একটা সিগারেট ধরালো।

এই ফাঁকে হিরন্ময় মুখ খুললো। স্যার, আমি একটা গল্প শুনেছি। তবে গল্পটা খুব ভালো নয়। যদি বেয়াদবি না ধরেন বলতে পারি। বেয়াদবি ধরার কি আছে, বলে যাও। এই যুদ্ধ মান অপমান, ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায় সবকিছু বানের তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যে সকল মানুষকে দেশে থাকতে শ্রদ্ধা করতাম, কোলকাতায় তাদের অনেকের আচরণ দেখে সরল বাংলায় যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়- তাই হতে হচ্ছে। এখনো তোমরা স্যার ডাকছো, তার বদলে শালা বললেও অবাক হবার কিছু ছিলো না। অতএব বিনা সঙ্কোচে বলে যেতে পারো তোমার গল্প। ঠিক গল্প নয় স্যার। এখানকার একটা মন্ত্রী নাকি সোনাগাছিতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। চেনেন তো স্যার, সোনাগাছি কি জন্য বিখ্যাত। নরেশদা দাড়িতে আঙুল চালাতে চালাতে বললেন, এই নিরীহ মাস্টার অন্য কিছু বলতে না পারলেও সোনাগাছি কি জন্য বিখ্যাত সে কথা অবশ্যই বলতে পারে। কেননা না কোলকাতা আসার অনেক আগেই তাকে প্রেমেন্দ্র মিত্তিরের অনেকগুলো ছোটো গল্প পাঠ করতে হয়েছিলো। এবার তোমার গল্পটা শুরু করতে পারো। হিরন্ময়ও একটা সিগারেট জ্বালালো। তারপর একমুখ ধোয়া ছেড়ে বললো, পুলিশ অফিসারের জেরার মুখে ভদ্রলোককে কবুল করতে হলো, তিনি ভারতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের একজন মন্ত্রী। পুলিশ অফিসার তখন বললেন, তাহলে স্যারের গুডনেমটা বলতে হয়। মন্ত্রী বাহাদুর নিজের নাম প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ টেলিফোন করে দেখে যে বক্তব্য সঠিক। পুলিশ অফিসারটি দাঁতে জিব কেটে বললেন, স্যার, কেননা মিছিমিছি সোনাগাছির মতো খারাপ জায়গায় গিয়ে না হক ঝুট ঝামেলার মধ্যে পড়বেন। আর ভারত সরকারের আতিথেয়তার নিন্দে করবেন। আগে ভাগে আমাদের স্মরণ করলেই পারতেন, আমরা আপনাকে ভিআইপি-র উপযুক্ত জায়গায় পাঠিয়ে দিতাম।

নরেশদা বললেন, চারদিকে কতো কিছু ঘটছে নিজের চোখেই তো দেখতে পাচ্ছি। তবে এ কথাও মিথ্যে নয় যে এসব একেবারে অস্বাভাবিক নয়। আমরা তো সবাই প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এসেছি। নিজের প্রাণ ছাড়া আর কিছু যেখানে বাঁচাবার নেই, সেখানে এ ধরনের বিকৃতিগুলো আসবে, আসতে বাধ্য। চিন্তা করে দেখো জানুয়ারি থেকে পঁচিশে মার্চের আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের দিনগুলোর কথা। আর মানুষদের কথা চিন্তা করো। প্রাণপাতালের তাপে জেগে ওঠা সেই মানুষগুলো। একেকটা ব্যক্তি যেনো একেকটা ঝরোণা। আর আজ দেখো সেই মানুষদের অবস্থা। এই তোমার আসার একটু আগেই আমি বনগাঁ থেকে ফিরলাম। বাংলাদেশের মানুষ কি অবস্থার মধ্যে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করছে, নিজের চোখেই তো দেখে এলাম। ওপরের দিকে কিছু মানুষ কি করছে না করছে, সেটা এখন আমার কাছে কোনো ব্যাপারই নয়। শরণার্থী শিবিরগুলোতে কি অবর্ণনীয় কষ্ট এই বিজুলীর আলো জ্বলা কোলকাতা শহরে বসে কল্পনাও করতে পারবে না। প্রতিটি ক্যাম্পে প্রতিদিন বেশিরভাগ মারা যাচ্ছে শিশু এবং বৃদ্ধ। সকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। বনগাঁ থেকে শেয়ালদা প্রতিটি স্টেশনে তুমি দেখতে পাবে বাংলাদেশের মানুষ। খোলা প্লাটফর্মের তলায় কি চমৎকার সংসারই না পেতেছে তারা। পুরুষেরা সব বসে আছে নির্বিকার। তাদের চোখের দৃষ্টি মরে গেছে। চিন্তা করবার, ভাবনা করবার, স্বপ্ন দেখবার কিছু নেই। সকলেরই একমাত্র চিন্তা আজকের দিনটি কেমন করে কাটে। তাও কি সকলের কাটে। মরণ যখন কাউকে করুণা করে পরিবারের লোক ছাড়া অন্য কারো মনে রেখাপাত পর্যন্ত করে না। মৃতদেহ প্লাটফর্মের পাশে পড়ে থাকে, অথচ দেখতে পাবে পাশের পরিবারটি এলুমিনিয়ামের থালায় মরিচ দিয়ে বাসী ভাত খাচ্ছে। এমন অনুভূতিহীন মানুষের কথা আগে তুমি কল্পনা করতে পেরেছো? মেয়েগুলোকে দেখো। সকলের পরনে একেকখানি তেনা। চুলে জট বেঁধেছে। পুষ্টির অভাবে সারা শরীর কাঠি হয়ে গেছে। এদের মধ্যে এমনও অনেক আছে, জীবনে রেলগাড়ি দেখেছে কীনা সন্দেহ। এখন সাধ মিটিয়ে রেলগাড়ি চলাচলের পথের ধারে তাদের অচল জীবন কাটাচ্ছে। এ অবস্থা কেননা হলো? সবাই বলছে একটা সংগ্রাম চলছে। আমিও মেনে নেই। হ্যাঁ সংগ্রাম চলছে। কিন্তু আমার কথা হলো সংগ্রাম চলছে অথচ আমি বসে আছি। আমি তো দেশকে কম ভালবাসিনি। দেশের জন্য মরতে আমি ভয় পাইনে। কিন্তু লড়াই করে মরে যাওয়ার সুযোগটা নেই কেন? গলদটা কোথায় জানো আজহার, এই মানুষগুলো লড়াইর ময়দানে থাকলে সকলেরই করবার মতো কিছু না কিছু কাজ পাওয়া যেতো। দেশ যুদ্ধ করছে, কিন্তু যুদ্ধের ময়দান না দেখেই এদের দেশত্যাগ করতে হয়েছে। অচল জীবন্ত মানুষ এখানে এসে জড়পদার্থে পরিণত হচ্ছে। সেখানেই দুঃখ। নেতা এবং দল এসব মানুষের মনে স্বাধীনতার আকাক্ষার সৃষ্টি করলো। কিন্তু তাদের সংগ্রামের ক্ষেত্র রচনা করতে ব্যর্থ হলো। নেতা গেলো পাকিস্তানের কারাগারে। আর আমরা পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণের মুখে দেশ ছেড়ে চলে এলাম। সেখানেই আফসোস। নানা হতাশা এবং বেদনার মধ্যেও স্বীকার করি একটা যুদ্ধ হচ্ছে। একদিন না একদিন আমাদের মাটি থেকে পাকিস্তানী সৈন্যদের চলে যেতেই হবে। কিন্তু আমার তো বাবা এ তক্তপোষের ওপর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পিঠে বাত ধরে গেলো। নরেশদা এক নাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বলে থামলেন। কিছু মনে করো না বাবা, মাস্টার মানুষ। একবার বলতে আরম্ভ করলে আর থামতে পারিনে।

হিরন্ময় জানতে চাইলো, স্যার, বনগাঁ কেনো গিয়েছিলেন? নরেশদা জবাবে বললেন, আমার বুড়ো মা এবং বাবা কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনসহ আজকে বনগাঁ শরণার্থী শিবিরে পৌঁছানোর কথা। বনগাঁর আশেপাশে যে কটা শরণার্থী শিবির আছে, সবগুলোতেই তালাশ করলাম। পরিচিত আত্মীয়-স্বজন অনেকের সঙ্গেই দেখা হলো। কিন্তু মা বাবাকে পাওয়া গেলো না। হয়তো এসে পড়বেন দু’চারদিনের মধ্যে। নইলে…, নরেশদা চুপ করে গেলেন। কথাটার অশুভ ইঙ্গিত সকলকেই স্পর্শ করলো। আমি অত্যন্ত দুঃখিত স্যার। হাতের আধ পোড়া সিগারেটটি ছুঁড়ে ফেলে দিলো আজহার। স্যার, আপনার এই মানসিক অবস্থায় বিরক্ত করার জন্য অত্যন্ত লজ্জিত এবং দুঃখিত। আসলে প্রথমেই আপনার মা বাবা আত্মীয়-স্বজনের সংবাদ নেয়াই উচিত ছিলো। আমাদের মুসলমান ছেলেদের বেশিরভাগই একা একা এসেছি কীনা, তাই পরিবারের কথাটা মনে থাকে না। সেজন্য এমনটি ঘটেছে। আশা করছি, অবশ্যই তারা দু’চারদিনের মধ্যে এসে পড়বেন। আপনি চিন্তাভাবনা করবেন না স্যার। আমি দেরাদুনে পৌঁছেই আপনাকে চিঠি দেবো। আপনি অবশ্যই জানাবেন, তারা পৌঁছুলেন কিনা। আজহার ঘড়ি দেখে প্রায় এক রকম লাফিয়ে উঠলো। স্যার, এবার আমাদের উঠতে হয়। মেজর হরদয়াল সিংয়ের কাছে হাওড়া স্টেশনে হাজিরা দিতে হবে। তার আগে অনেকগুলো ফর্মালিটি পালন করতে হবে। কাঁটায় কাঁটায় রাত বারোটায় রিপোর্ট করতে হবে। আজহার এবং হিরন্ময় উঠে দাঁড়ালো। তাদের পিছু পিছু আমি এবং নরেশদা বিদায় জানাতে নিচ তলার গেট পর্যন্ত এলাম। আজহার নত হয়ে নরেশদার পা ছুঁয়ে সালাম করলো। তারপর বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদে ফেললো। নরেশদা মমতা মেশানো কণ্ঠে বললো, ছি বাবা, কাঁদতে নেই। আজহার কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললো, আমার দু’ভাই পাকিস্তানের মারীতে আটকা পড়ে আছে। এক বোন এবং ভগ্নিপতি লাহোরে। এতোদিন মনেই পড়েনি। আপনার মা বাবার কথা শুনে তাদের কথা মনে পড়লো। রাস্তার ফুটপাত ধরে দু’জন হন হন করে চলে গেলো। আমরা দুজন কিছুক্ষণ সেদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমাদের সকলেরই একেকটা করুণকাহিনী রয়েছে।

নরেশদা জানতে চাইলেন। দানিয়েল তুমি খেয়েছো? আমি মাথা নাড়লাম। চল ওপরে যেয়ে কাজ নেই, একেবারে খেয়েই আসি। বললাম, চলুন তিনি জিগগেস করলেন, কোথায় যাবে? আমার অতো বেশি খাওয়ার ইচ্ছে নেই, যেখানেই হোক চলুন। নরেশদা বললেন, এতো দুঃখ, এতো মৃত্যু, এসবের যেনো শেষ নেই। যাই হোক, চলো আজ মাছ ভাত খাই। আজ আমার একটুখানি নেশা করতে ইচ্ছে করছে। নরেশদা এমনিতে হাসিখুশি ভোজনবিলাসী মানুষ। কিন্তু পয়সার অভাবে তাঁকেও আমাদের সঙ্গে দু’বেলা মাদ্রাজী দোকানে দোসা খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। বাঙালি দোকানে সামান্য পরিমাণ মাছ, ডাল এবং ভাত খেতে কম করে হলেও ছয় টাকা লেগে যায়; সেখানে মাদ্রাজী দোকানে দেড় দু’টাকায় চমৎকার আহারপর্ব সমাধা করা যায়।

ভীমনাগের মিষ্টির দোকানের সামনে দিয়ে আমি রাস্তা পার হলাম। স্যার আশুতোষ মুখার্জীর ছবিটিতে কড়া আলো পড়েছে। স্যার আশুতোষ ভীমনাগের মিষ্টি খেতে পছন্দ করতেন, বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রচার করার জন্য ভীমনাগ স্যার আশুতোষের পোর্ট্রেটটা ঝুলিয়েছে। কিন্তু পোর্ট্রেটটি দেখে এরকম ধারণা হওয়াও একান্ত স্বাভাবিক যে ভীমনাগের মিষ্টির গুণেই স্যার আশুতোষ এতো বৃহদায়তন ভূঁড়ির অধিকারী হতে পেরেছেন। অতএব, যাঁরা ভূঁড়ির আয়তন বড়ো করতে চান, পত্রপাঠ ভীমনাগের দোকানে চলে আসুন।

আমরা দু’জন সামান্য একটু ডাইনে হেঁটে বঙ্গলক্ষ্মী হোটেলে ঢুকলাম। খদ্দেরের পরিমাণ যথেষ্ট নয়। একটা টেবিলের দু’পাশে বসলাম। নরেশদা বললেন, চলো আজ মাংস খাওয়া যাক। আমি জিগগেস করলাম, পয়সা আছে? তিনি টেবিলের ওপর টোকা দিয়ে বললেন, হ্যাঁ আজ কিছু পয়সা পাওয়া গেছে। এটাতো আশ্চর্য ব্যাপার। রাস্তায় কুড়িয়ে পেলেন নাকি? রাস্তায় কি আর টাকা পয়সা কুড়িয়ে পাওয়া যায়? মাদারীপুরের এক ভদ্রলোক আমার কাছ থেকে শ’তিনেক টাকা ধার নিয়েছিলেন। আজকে বনগাঁ স্টেশনের কাছে তাঁর সঙ্গে দেখা। অবশ্য তিনি জীপে চড়ে রিফিউজি ক্যাম্পে দর্শন দিতে এসেছিলেন। তাঁর হাতে অনেক টাকা, অনেক প্রতাপ। মাদারীপুর ব্যাংকের লুট করা টাকাও নাকি তাঁর হাত দিয়ে বিলিবণ্টন হয়েছে। ভাবলাম, এই সময়ে পাওনা টাকাটা দাবি না করাই হবে বোকামো। আমি জীপের সামনে দাঁড়াতেই তিনি ঝট করে জীপ থেকে নেমে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কতো কি জিগগেস করলেন। কিন্তু আমি আমার উদ্দেশ্যটা ভুলে যাইনি। আমাদের দিনকাল খারাপ যাচ্ছে শুনে পকেট থেকে একটি পাঁচশো টাকার নোটের তোড়া অন্য কেউ দেখতে না পায় মতো বের করে, সেখান থেকে একখানি নোট আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি তো বিপদেই পড়ে গেলাম। খুচরো কোথায় পাই! তাই বললাম, আপনি বরং তিনশোই দিন। আমার তো খুচরো করার কোনো উপায় নেই। তিনি বললেন, রাখুন প্রফেসর বাবু, আপনার খুচরো সে পরে দেখা যাবে। জীপে স্টার্ট দিয়ে দলবলসহ বারাসত রিফিউজি ক্যাম্প ভিজিট করতে চলে গেলেন। বেয়ারা এলে তিনি পাঁঠার মাংস, ভাত, ডাল দিতে বললেন।

খেতে খেতে জিগগেস করলাম, মা বাবার কোনো খোঁজ পেলেন? খবর তো পাচ্ছি রোজ পথে আছেন, পথে আছেন কিন্তু কোন্ পথ সেটাতো ভেবে স্থির করতে পারছিনে। আজই তো এসে যাওয়ার কথা ছিলো। গোটা দিন অপেক্ষা করলাম, কিন্তু অপেক্ষাই সার। হঠাৎ করে নরেশদার হিক্কা উঠলো। প্রাণপণ সংযমে হিক্কার বেগ দমন করে আবার খেতে লেগে গেলেন। আমি ফের জানতে চাইলাম, কল্যাণীরও কোনো খবর পাওয়া গেলো না। হ্যাঁ, তার একটা খবর আছে বটে। তবে সত্যি মিথ্যে বলতে পারবো না। সে নাকি কিভাবে পশ্চিম দিনাজপুরে তার এক আত্মীয়বাড়ি এসে উঠেছে। ঠিকানা পেয়েছেন? নরেশদা জবাবে বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, তবে দু’য়েকদিনের মধ্যে নিজে গিয়ে দেখে আসুন, অথবা ক্ষীতিশকে পাঠিয়ে দিন। নরেশদা আমাকে ধমক মারলেন। আরে রাখো তোমার পশ্চিম দিনাজপুর। যাওয়া আসার খরচ কতো জানো? এই কল্যাণীর সঙ্গে নরেশদার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। তারিখটা ছিলো একুশে এপ্রিল। এরই মধ্যে পঁচিশে মার্চের রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা ক্র্যাক ডাউন করে বসলো। খরচ যতোই হোক ম্যানেজ করা যাবে। আপনি ঘুরে আসুন। সে কথা এখন রাখো। তোমার খবর বলো। সকাল থেকে কোথায় কোথায় গেলে এবং কি করলে?

গোটা দিনের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে একদম ভুলেই ছিলাম। নরেশদার কথায় সমস্ত দিনের ঘটনারাজি একটার পর একটা বায়োস্কোপের ছবির মতো প্রাণবান হয়ে উঠলো। আমি বললাম, সকাল দশটার দিকে তো গেলাম লেনিন সরণিতে। তিনি জানতে চাইলেন, লেনিন সরণিতে কেনো? বললাম, জাহিদুলের কাছে তায়েবার ঠিকানা চাইতে। জাহিদুল তোমাকে তায়েবার ঠিকানা দিলেন? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন। দিতে কি চায়, শেষ পর্যন্ত দিতে বাধ্য করা হলো। কি করে? তিনি জানতে চাইলেন। জবাবে বললাম, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে দেখি একেবারে সিঁড়ির গোড়ার রুমটিতে জাহিদুল মটকার পাঞ্জাবি পরে বসে আছেন। হারমোনিয়াম, তবলা ইত্যাদি ফরাশের একপাশে। রিহার্সেল জাতীয় কিছু একটা হয়ে গেছে অথবা হবে। জাহিদুলের সঙ্গে আরো চার পাঁচজন মানুষ। একজন বাংলাদেশের। বাকিরা কোলকাতার। আপনি তো জানেন, মওকা পেলেই জাহিদুল ন্যাকা ন্যাকা ভাষায় চমৎকার গল্প জমাতে পারে। সেরকম কিছু একটা বোধ হয় করছিলো। সেখানে আরো তিনজন মহিলার মধ্যে ডোরাকেও দেখলাম। আমাকে দেখেই দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে আরম্ভ করেছে। তার মুখের শিশুর মতো অম্লান সরলতা তেমনি আছে। কোনো দুশ্চিন্তার রেখা, কোনো ভাবান্তর নেই। গেন্ডারিয়ার বাসায় যেমন সেজেগুজে থাকতো অবিকল তেমনি। যেনো সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, কোথাও কিছু ঘটেনি। জানেন তো ডোরাটা বরাবরই বোকা এবং পরনির্ভরশীল। নিশ্চয়ই এই সময়ের মধ্যে সে জাহিদুলের মধ্যে একটা নির্ভর করার মতো ক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছে। জাহিদুল সে সুযোগটার সদ্ব্যবহার করে মেয়েটিকে একেবারে নিকে করে ফেলেছে। জাহিদুলের বিরুদ্ধে আমার অনেক নালিশ আছে, তবু তার সৎ সাহসের তারিফ করি। বিয়ে না করে অন্যভাবেও মেয়েটিকে সে ব্যবহার করতে পারতো। জানেন তো জাহিদুলের আসল বউয়ের সংবাদ? শশীভূষণ তার মেয়েটির ট্যুইশনি করতো না, জাহিদুলকে একটা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে শশীকে বগলদাবা করে শান্তিনিকেতন চলে গেছে। এক্কেবারে ক্ষুরের মতো ধারালো মহিলা। যেদিকে যায়, ফাঁক করে যায়। তুমি কোন্ শশীর কথা বলছো? আমাদের জগন্নাথ হলের ছোট্টোমতো সুন্দর ছেলেটি নয়তো! সে তো অত্যন্ত সুশীল ছেলে। সে কেনো যাবে রাশেদা খাতুনের সঙ্গে? খাতুনেরও তো প্রচুর সুনাম শুনেছি, তিনিও বা এ রকম বাজে কাজ করতে যাবেন কেনো? এসব ব্যাপারে নরেশদার মাথাটা আস্তে আস্তে কাজ করে। তাই বিরক্ত না হয়েই বললাম, যুদ্ধ স্রোতে ভেসে যায় ধনমান জীবন যৌবন। আমি আর আপনি করলে যা অপকর্ম হয়, মহাপুরুষেরা করলেই সে সব লীলা হয়ে দাঁড়ায়। নরেশদা বললেন, ওসব কথা রাখো, তোমার খবর বলো। আমি বললাম, রাশেদা খাতুন যখন শশীকে ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর পুরে তীর্থযাত্রা করলো, ওদিকে জাহিদুল ভেবে দেখলো, সে কিছু একটা করে যদি না বসে, তাহলে লোকে তাকে মরদ বলবে না। তাই কোনোও কালবিলম্ব না করে ডোরাকে নিকে করে বসলো। তাতে তার কোনো বেগই পেতে হয়নি। সে ওদেরই তো অভিভাবক ছিলো। সুতরাং ‘আপনা উদ্যান ফল, তাতে কিবা বলাবল’ স্বামী স্ত্রীর দ্বৈত সংগ্রামে ডোরাকে বলি হতে হয়েছে। আঘাতটা সবচেয়ে বেশি লেগেছে তায়েবার। সে ছোটো বোনটাকে প্রাণের চাইতে ভালোবাসাতো আর জাহিদুলকে বাবারও অধিক শ্রদ্ধা করতো। তায়েবার সমস্ত বিশ্বাস, সমস্ত মানসিক আশ্রয় ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে। আমার তো মনে হয় ওটাই তার অসুখ গুরুতর হয়ে ওঠার মূল কারণ। নরেশদা কিছুক্ষণের জন্য মুখের ভেতর পুরে দেয়া গ্রাসটা চিবুতে পারলেন না। দু’মিনিটের মতো ঝিম মেরে বসে রইলেন। তারপর বললেন, তোমার ঠিকানা সংগ্রহের বৃত্তান্তটা বলো।

আমি শুরু করলাম। জাহিদুল আমাকে দেখার পর ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। জানেন, নরেশদা ওঁকে এখন বেশ স্লীম দেখায়। ভূড়িটাও কোথায় যেনো আত্মগোপন করেছে। গোঁফজোড়া এমন কায়দা করে ছেটেছেন, কাছে থেকে না দেখলে পাকনা অংশ চোখেই পড়ে না। নরেশদা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি আবার আজেবাজে কথা বলছো। কি ঘটেছে সেটাই বলো। সুতরাং আরম্ভ করলাম। প্রথমে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। মুখ খুলতেই পারিনি। কি জানি কেউ যদি কিছু মনে করে। শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে বললাম, আপনি কি একটু বাইরে আসবেন? জাহিদুল উঠে এলে আমি তাকে সিঁড়ির গোড়ায় ডেকে নিয়ে বললাম, আপনার কাছ থেকে আমি তায়েবার ঠিকানাটি সংগ্রহ করতে এসেছি। জাহিদুল অত্যন্ত উন্মা এবং ঝঝের সঙ্গে বললেন, আমি কি পকেটে পকেটে তায়েবার ঠিকানা বয়ে বেড়াই নাকি? আমি তার চোখে চোখ রেখে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে জানালাম। আপনার কাছে আমি তায়েবার ঠিকানা নিতে এসেছি এবং আপনি জানেন তার ঠিকানা। ভালোয় ভালোয় যদি না দেন চিৎকার করবো, চেঁচামেচি করবো। একেবারে বিফল হলে অন্যকিছু করবো। আমি প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে লম্বা চ্যাপ্টা জিনিসটির অস্তিত্ব তাকে বুঝিয়ে দিলাম। ধমকের সুরে আমাকে বললো, এক মিনিট দাঁড়াও। আমি তো ভয়ে অস্থির এই বুঝি পুলিশের কাছে টেলিফোন করে বলবেন, পাকিস্তানী গুপ্তচর পকেটে ছুরি নিয়ে বাংলাদেশের একজন সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধাকে খুন করতে এসেছে। কিন্তু সে ওসব কিছুই করলেন না, সিঁড়ি থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট কুড়িয়ে ভেতরের কাগজটা বের করে নিলেন এবং সেটা দেয়ালে ঠেকিয়ে তায়েবার হাসপাতালের নাম, ওয়ার্ড এবং বেড নম্বর লিখে আমাকে দিলেন। আমার কেমন অনুভূতি হয়েছিলো? দেশ থেকে আসার পর এই প্রথম একটা কাজের মতো কাজ করলাম। করুণার ওপর বাঁচতে বাঁচতে নিজের অস্তিত্বের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।

আমরা যখন নিচে নামলাম, তখন রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। কোলকাতা শহরের যন্ত্রযানের চলাচল একেবারে কমে এসেছে। তথাপি একথা বলা যাবে না কোলকাতা শহর বিশ্রাম নিচ্ছে। নোঙরা ঘেয়ো রাস্তা মান্ধাতার আমলের পাতা ট্রামলাইন, উন্মুক্ত ফুটপাতে শুয়ে থাকা মানুষজনের গাদাগাদি ঠেসাঠেসি ভিড় দেখলে একথা মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে এই নগরী বিশ্রাম কাকে বলে জানে না, শুধু যন্ত্রণায় কঁকায়। আচমকা ছুটে চলা নৈশ ট্যাক্সিগুলোর আওয়াজ শুনলে একথাই মনে হয়। ডানদিকের উঁচু বিল্ডিংটার ফাঁকে একখানি চাঁদ দেখা যাচ্ছে। রাস্তার গর্তের জমা পানিতে চাঁদের ছায়া পড়েছে। আহা তাহলে কোলকাতা শহরেও চাঁদ ওঠে। নরেশদা পানের দোকান থেকে পান এবং সিগারেট কিনলেন। পকেটে পয়সা থাকলে দুনিয়ার ভালো জিনিস যতো আছে কিনতে তার জুড়ি নেই। আমার হাতে একটা তবক দেয়া পানের খিলি তুলে দিয়ে বললেন, নাও খাও। কাল আবার পয়সা নাও থাকতে পারে। তারপর আবৃত্তি করলেন, নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও।

হোস্টেলের গেটে এসে দেখলাম, দারোয়ান গেটের তালায় চাবি লাগাচ্ছে। সেই আগের দারোয়ানটিই। বললো, বাবুজী আওর একটু হোলে গেট বন্ধ হোয়ে যেতো। তখন তো খুব অসুবিধে হোয়ে যেতো। আমরা তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ওপরে এলাম। আজ হোস্টেল একেবারে ফাঁকা। আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের যে ছেলেরা থাকে, সবাই বারাসত রিফিউজি ক্যাম্পে নাটক করতে গেছে। নরেশদার ভাই দু’জনও বাংলাদেশের ছেলেদের সঙ্গে গেছে। অঢেল জায়গা, ইচ্ছে করলে আমরা দুজন দু’রুমে কাটাতে পারি। অন্যদিন যে প্রাইভেসির অভাবে অন্তরে অন্তরে গুমরাতে থাকি আজ সেই প্রাইভেসিটাই বড়ো রকমের একটা বোঝা হয়ে দাঁড়ালো। আমরা দু’জন পরস্পরকে এতো ভালোভাবে চিনি যে হা করলে একে অপরের আলজিভ পর্যন্ত দেখে ফেলি।

নরেশদা বিছানার ওপর সটান শুয়ে পড়ে পুরোনো কথার খেই ধরে জিগেস করলেন, তায়েবাকে কোন্ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে? জবাব দিলাম, পিজিতে। তা ভালোই মনে হলো সকলের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করছে। আগের মতোই আছে, জেদী, বেপরোয়া। কিন্তু ডাক্তার যা বললেন, তাতে মনে হলো অসুখটা খুব একটা সাংঘাতিক। আমার কেমন জানি ভয় হচ্ছে। নরেশদা জিগগেশ করলেন, ডাক্তার কী রোগ বললেন। উল্টো ডাক্তার আমাকে জিগগেস করলেন, কী রোগ। আমরা কেমন করে বলবো। তায়েবা কখনো তার রোগের কথা আমাকে বলেছে নাকি! এটা তার প্রাইভেট ব্যাপার। নরেশদা বললেন, আমি তো কোনো কারণ খুঁজে পাইনে কেনো তোমার কাছে তায়েবার রোগের বিষয়ে জানতে চাইবেন। আমি বললাম, রহস্য টহস্য কিছু নেই। তাহলে গোটা ব্যাপারটা আপনাকে খুলেই বলি।

তায়েবা বলেছে, আগামীকাল যদি হাসপাতালে যাই তার জন্য কিছু ভাত এবং ছোটো মাছ মরিচ না দিয়ে শুধু জিরে আর হলুদ দিয়ে যেনো রান্না করে নিয়ে যাই। তাকে নাকি এক মাস থেকে ভাতই খেতে দেয়া হয়নি। আমি ভাত বেঁধে নিয়ে গেলে সেটা সে খাবে। এ ব্যাপারে ডঃ মাইতির কাছে আবদার ধরেছিলো। ডঃ মাইতি এক শর্তে রাজি হয়েছেন। ডঃ ভট্টাচার্যি যেনো জানতে না পারেন। তিনি জানতে পারলে তায়েবাকে নাকি হাসপাতালে থাকতে দেবেন না। তিনি ট্রাম স্টপেজের গোড়ায় এসে এ কথা আমাকে জানিয়েছেন। আরো বলেছেন, রান্না করার সময় কিছুতেই যেনো লবণ না দেই। পরে অবশ্য তাঁকে আপন মনে বিড়বিড় করতে শুনেছি, মেয়েটা তো শেষই হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং যা খেতে চায় খেয়ে নিক না । এই শেষের কথাটি শুনে আমার ভয় ধরে গেছে। তায়েবার যদি ভয়ানক কিছু ঘটে, সে যদি আর না বাঁচে।

নরেশদা সিগারেট ধরিয়ে আরেকটা ধমক দিলেন। কি সব আবোল তাবোল বকছো। বাঁচবে না কেনো, চুপ করো। মরণ কি খেলা নাকি! পাকিস্তানী সৈন্যদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে এতদূর যখন আসতে পেরেছে, দেখবে নিশ্চয়ই ভালো হয়ে উঠবে। হয়তো একটু সময় নেবে এই ভাত মাছ রান্নার ব্যাপারটি নিয়ে কিছু ভেবেছো কী?। না এখনো ভেবে ঠিক করতে পারিনি। আপনি বনগাঁ থেকে ফেরার পর আমি এলাম। সারাক্ষণ হাসপাতালেই তো কাটিয়ে এলাম। সত্যিই রান্না করাটাও দেখছি একটা অসম্ভব ব্যাপার। আচ্ছা নরেশদা একটা কাজ করলে হয় না। আমার বান্ধবী অর্চনা আছে না। গোলপার্কের কাছে যার বাসা। সে বাসায় তো আপনিও গিয়েছেন। তাকে গিয়ে সমস্ত বিষয় বুঝিয়ে বলবো, ভাবছি কাল সকালে তার বাসায় যাবো। অবশ্যই অর্চনা কোনো একটা উপায় বের করবে। নরেশদা বললেন, তিনি তো সকালবেলা কলেজে যান। দেখা করবে কেমন করে। আর কলেজে থেকে যদি সোজা বান্ধবীর বাসা বা অন্য কোথাও চলে যান, তখন কি করবে? একেবারে ফাঁকার উপর লাফ দেয়া যায় নাকি? আমার বোপোদয় হলো। সত্যিই তো এরকম ঘটতে পারে। আমি মাথা চুলকে বললাম, আরো একটি ভালো আইডিয়া এসেছে। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে কাকাবাবু মুজফফর আহমদের কাছে যাবো। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করেন। তাঁর কাছে সব খুলে টুলে বললে একটা উপায় অবশ্যই বের করে দেবেন। তোমার মাথায় যতো সব উদ্ভট জিনিস জট পাকিয়ে রয়েছে। নিজে বাথরুম পর্যন্ত যেতে পারেন না তার কাছে যাবে ভাত আর ছোটো মাছের আবদার করতে। তোমার বয়েস বাড়ছে না কমছে। আমি তো কোনো পথ দেখছিনে। কি করবো আপনি না হয় বলুন।

একটু অপেক্ষা করো। হোস্টেলের রান্নাঘরে গিয়ে নরেশদা কয়েকবার চিত্ত চিত্ত করে ডাকলেন। চিত্ত জবাব দিলো, যাই বাবু, অতো চিৎকার করবেন না। রাত বাজে বারোটা, এখনো রান্নাঘর ধোয়া শেষ করতে পারিনি। নরেশদা বললেন, বাবা কোনো কাজ নয়, এই তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলতে চাই। রান্নাঘর থেকে কালিঝুলি মাখা অবস্থায় চিত্ত আমাদের রুমে এসে বললো, আজ্ঞে বাবু বলেন। নরেশদা বললেন, বাবা কাল তিনটের মধ্যে একপোয়া সরু চাল এবং কিছু ছোটো মাছ মরিচ না দিয়ে শুধু হলুদ জিরে দিয়ে রান্না করে দিতে পারবে? একটা রোগীর জন্য। তুমি না পারলে অন্য কোথাও চেষ্টা করে দেখবো। তা বাবু হয়তো পারা যাবে। কিন্তু বাজারটা আমি করবো না আপনারা করবেন? সেটাও বাবা তোমাকে করতে হবে। ট্যাংরা মাছ পাওয়া যায় কিনা দেখবে। এই নাও, নরেশদা আস্ত একখানা পঞ্চাশ টাকার নোট চিত্তের হাতে তুলে দিলেন। চিত্তের মুখমণ্ডলে একটা প্রফুল্লতার ছোঁয়া দেখা গেলো।

নরেশদা বললেন, ঘুমোবে? বললাম, ঘুম যে আসতে চাইছে না। চোখ বন্ধ করে থাকো, এক সময় আসবে। তিনি বাতি নিভিয়ে মশারি টাঙিয়ে নিজে ঘুমিয়ে পড়লেন। একটু পরে নাক ডাকতে আরম্ভ করলেন, কিন্তু আমি চোখের পাতা জোড়া লাগাতে পারছিলাম না। কোথায় একটা মস্তবড়ো গণ্ডগোল হয়ে গেছে। তায়েবা, ডোরা, জাহিদুল, আমি, নরেশদা- আমাদের সকলেরই জীবন অন্যরকম ছিলো এবং অন্যরকম হতে পারতো। মাঝখানে একটা যুদ্ধ এসে সবকিছু ওলোটপালোট করে। দিয়ে গেলো। যতোই চিন্তা করতে চেষ্টা করিনে কেনো একটা সূত্রের মধ্যে বাঁধতে পারিনে। সব কিছুই এলোমেলো ছাড়া ছাড়া হয়ে যায়। এই দু-আড়াই মাস সময়, এরই মধ্যে কি রকম হয়ে গেলো আমাদের জীবন। সাতই মার্চের শেখ মুজিবের সে প্রকাণ্ড জনসভার কথা মনে পড়লো। লক্ষ লক্ষ মানুষ, কি তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা! চোখে কি দীপ্তি! কণ্ঠস্বরে কি প্রত্যয়! আন্দোলনের সে উত্তাল উত্তুঙ্গ জোয়ার, সব এখন এই কোলকাতায় রাতে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। অথচ এখনো দু-আড়াই মাসও পার হয়নি! সে পঁচিশে মার্চের রাতটি, আহা সেই চৈত্র রজনী। সেই বাংলাদেশের চৈত্র মাসের তারাজ্বলা, চাঁদজ্বলা আকাশ। বাংলাদেশের জনগণের বর্ধিত আকাক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে আরো প্রসারিত, আরো উদার হওয়া আকাশ। মানুষের ঘ্রাণশক্তি কি তীক্ষ্ণ! কিছু একটা ঘটবে সকলের মনের ভেতর একটি খবর রটে গেছে। দলে দলে মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে আপনাআপনি তৈরি হয়ে উঠছে ব্যারিকেড। জনগণের সৃজনী শক্তির সে কি প্রকাশ। রাত এগারোটা না বাজতেই রাস্তায় নামলো ট্যাঙ্ক। কামান, বন্দুক, মেশিনগানের শব্দে ঢাকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। ভারী ট্যাঙ্কের ঘড় ঘড় ঘটাং ঘটাং শব্দে ঝড়ের মুখে কুটোর মতো সরে যাচ্ছে ব্যারিকেডের বাধা। সেই চৈত্র রজনীর চাঁদের আলোতে আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমাদের রাজপথের ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে পাকিস্তানী সৈন্যের ট্যাঙ্ক। সেই ট্যাঙ্কের ওপর দাঁড়ানো দু’জন সৈন্যের বাদামী উর্দির কথা আমি ভুলতে পারছিনে। ভুলতে পারছিনে তাদের ভাবলেশহীন মুখমণ্ডল, আর কটমটে চোখের দীপ্তি।

তারপর কি ঘটলো? তারপর? একটা ঘটনার পাশে আরেকটা ঘটনা সাজিয়ে সঙ্গতি রক্ষা করে চিন্তা করতে পারিনে। আগামীকাল কি ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে আঁচটুকুও করতে পারিনে। তায়েবা যদি মারা যায়, কি করবো জানিনে। আমার মা, বোন, ভাইয়ের ছেলেরা বেঁচে আছে কিনা জানিনে। যেদিক থেকেই চিন্তা করিনে কে্নো, একটা বিরাট ‘না’-এর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। সব ব্যাপারে এতোগুলো ‘না’ নিয়ে মানুষ বাঁচে কেমন করে? সাবধানে উঠে বাতি না জ্বালিয়ে কুঁজো থেকে এক গ্লাস পানি গড়িয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলাম। একটা ট্যাক্সি ঘটাং ঘটাং করে শিয়ালদার দিকে ছুটে গেলো। আমি সন্তর্পণে দরোজা খুলে ব্যালকনিতে চলে এলাম। কোলকাতায় একসঙ্গে আকাশ দেখা যায় না। ঝাঁকে ঝাঁকে ফুটে থাকা নক্ষত্ররাজি, এদের কি আমি আগে কখনো দেখিনি। ছায়াপথে ফুটে থাকা অজস্র তারকারাজির মধ্যে আমার প্রিয় এবং পরিচিত তারকারাজি কোথায়? চোখের দৃষ্টি কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে।

০৩-৪. ঘুম ভাঙলো দেরিতে

পরের দিন আমার ঘুম ভাঙলো দেরিতে। ঘড়িতে দেখি বেলা সাড়ে দশটা বাজে। আমাদের ছেলেরা বারাসত থেকে ফিরে এসেছে। তাদের চিৎকার, কোলাহলই বলতে গেলে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়েছে। নইলে আমি আরো ঘুমোতে পারতাম। চোখ রগড়াতে রগড়াতে সিগারেটের প্যাকেটে দেখি একটাও সিগারেট নেই। মাসুমকে বললাম, দেতো একটা। টান দিতেই আমার চোখের দৃষ্টি সতেজ হয়ে উঠলো। মাসুমকে জিগ্‌গেস করলাম, কখন এলে, অন্যরা কোথায়, কেমন নাটক করলে? আমার মনে হলো সে কারো সঙ্গে কথা বলার জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিলো। বোঝা গেলো নরেশদার সঙ্গে কথা বলে বিশেষ যুত করতে পারেনি। কারণ তিনি বরাবর ঠাণ্ডা মানুষ। হঠাৎ করে কোনো ব্যাপারে অতিরিক্ত উৎসাহ প্রকাশ করতে পারেন না। মাসুম চাঙা হয়ে বললো, দানিয়েল ভাই, আপনি থাকলে দেখতেন কি ট্রিমেন্ডাস সাকসেস হয়েছে। আমরা ক্যারেকটরের মুখ দিয়ে এহিয়া ইন্দিরা এক হ্যায়’ এ শ্লোগান পর্যন্ত দিয়েছি। দর্শক শ্রোতারা কি পরিমাণ হাততালি দিয়েছে সে আমি প্রকাশ করতে পারবো না। আমি জানতে চাইলাম, অন্যান্যরা কোথায়? মাসুম জানালো, ক্ষীতিশ আর অতীশ টিফিন করে কলেজে চলে গেছে। বিপ্লব গেছে তার বোন শিখা আর দীপাকে মামার বাসায় রেখে আসতে। সালামটা তো পেটুক। এক সঙ্গে টিফিন করার পরও ফের খাবারের লোভে একজন সিপিএম কর্মীর সঙ্গে তার বাসায় গেছে। আমি বললাম, ওরা ফিরে এসেছে, একথা আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কেনো আপনি ওকথা বলছেন? সকলে এক সঙ্গে এসেছি, সবাই দেখেছে। বললাম, আমার কেমন জানি সন্দেহ হচ্ছে বারাসতের লোকেরা সবাইকে এক সঙ্গে খুন করে মাটির নিচে পুঁতে রেখে দিয়েছে। কেন, খুন করবে কেন, আমরা কি অপরাধ করেছি। আমি জবাব দিলাম, যদি খুন না করে থাকে এবং তোমরা এক সঙ্গে নিরাপদে ফিরে এসে থাকো, তাহলে ধরে নিতে হবে সেখানকার লোকেরা তোমাদের পাগলটাগল ঠাউরে নিয়েছিলো। সেজন্য কোনো কিছু করা অনাবশ্যক বিবেচনা করেছে। মাসুম বললো, অতো সোজা নয় খুন করা। আমরা তো রিফিউজি ক্যাম্পের ভেতরে নাটক করিনি। কে না জানে সেখানে কংগ্রেসের রাজত্ব। আমরা নাটক করেছি ক্যাম্প থেকে একটু দূরে। সিপিআই(এম) এর তৈরি করা স্টেজে। অথচ রিফিউজি ক্যাম্পের সমস্ত লোক নাটক দেখতে এসেছে। নাটক যখন চরম মুহূর্তটির দিকে এগুচ্ছিলো একজন সিপিএম কর্মী পরামর্শ দিলেন, দাদা এই জায়াগায় একটু প্রম্পট করে দিন এহিয়া ইন্দিরা এক হ্যায়। তাই দিলাম। কথাটা যখন চরিত্রের মুখে উচ্চারিত হলো, সে কি তুমুল করতালি আর গোটা মাঠ ভর্তি মানুষের মধ্যে কি তীব্র উত্তেজনা! জানেন তো বারাসত হলো সিপিআইএম-এর সবচে মজবুত ঘাঁটি। কংগ্রেসের মাস্তানরা এসে কোনো উৎপাত সৃষ্টির চেষ্টা যদি করতো, তাহলে একটাও জান লিয়ে পালিয়ে যেতে পারতো না। উত্তেজনার তোড়ে পানির জগটা মুখে নিয়ে ঢকঢক করে অনেকখানি পানি খেয়ে ফেললো। এরই মধ্যে মাসুমের উচ্চারণপদ্ধতির মধ্যে কোলকাতার লোকের মতো টানটোন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গালের বাঁ দিকটা মুছে নিয়ে সে বলতে আরম্ভ করলো, এহিয়া ইন্দিরার মধ্যে কি কোনো বেশ কম আছে। এহিয়ার সৈন্যরা সরাসরি খুন করছে। শ্রীমতি বাংলাদেশ ইস্যুটাকে নিয়ে লেজে খেলাচ্ছেন। এতে তাঁরই লাভ। বিরোধী দলগুলোকে কাবু করার এমন সুযোগ তিনি জীবনে কি আর কোনদিন পাবেন? নকশালদের তৎপরতা এখন কোথায়? এখন কোলকাতার রাস্তায় রাস্তায় বোমা ফাটে না কেনো? বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ভারতীয় জনগণ বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার জনগণের যে জাগ্রত সহানুভূতি ইন্দিরাজী সেটাকেই নিজের এবং দলের আখের গুছাবার কাজে লাগাচ্ছেন। এতোকাল সিপিএম বলতো শাসক কংগ্রেস বাংলাদেশের মানুষকে ধাপ্পা দিচ্ছে। তাদের দেশে ফেরত পাঠাবার কোনো বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করবে না। এখন সে কথা সবাই বলছে। এই তো সেদিন যুগান্তরের মতো কংগ্রেস সমর্থক পত্রিকায় বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রবীণ সাংবাদিকও লিখতে বাধ্য হয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা তুঙ্গে উঠেছে। আর ওদিকে শ্রীমতি ইউরোপ, আমেরিকায় বাবু’ ধরে বেড়াচ্ছেন। মাসুমের কোলকাতায় এসে অনেক উন্নতি হয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো জিভটি অত্যন্ত ধারালো এবং পরিষ্কার হয়েছে। এখন যে কোনো সভাসমিতিতে দাঁড় করিয়ে দিলে ঝাড়া আড়াই ঘন্টা লেকচার ঝাড়তে পারে।

আমি বাধা দিয়ে বললাম, তোমার এই মূল্যবান বক্তৃতার বাকি অংশ না হয় আরেকদিন শোনা যাবে। আজকে আমাকে অনেক কাজ করতে হবে। এখনো দাঁত মাজিনি। মুখ ধুইনি। কিছু মুখেও তো দিতে হবে। খালি পেটে কি আর লেকচার ভালো লাগে? স্পষ্টই মাসুম বিরক্ত হলো। তার জ্বলন্ত উৎসাহে বাধা পড়েছে। আপনি যতো বড়ো বড়ো কথাই বলুন না কেনো, ভেতরে ভেতরে একটি পেটি বুর্জোয়া। আমি বললাম, তোমার এই শ্রেণী বিশ্লেষণের কাজটিও আরেকদিন করতে হবে। আপাততঃ নরেশদা কোথায় আছেন, সংবাদটা জানিয়ে আমাকে বাধিত করো। কি জানি এখন কোথায় আছেন। কিছুক্ষণ আগে তো দেখলাম রাঁধুনি চিত্তের সঙ্গে ঘুটুর ঘুটুর করে কি সব কথাবার্তা বলছেন। দানিয়েল ভাই জানেন, এই নরেশদা লোকটার ওপর আমার ভয়ানক রাগ হয়। আপনার সঙ্গে তবু কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলা যায়, নরেশদা গাছের মতো মানুষ। কোনো ব্যাপারেই কোনো রিএ্যাকশন নেই।

আমি গামছাটা কাঁধে ঝুলিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে বেরিয়ে গেলাম। চাপাকলের গোড়ায় দেখি কোনো ভিড় নেই। দুটো মাত্র চাপাকল একশো দেড়শো জন ছাত্রের প্রয়োজন মেটাবার পক্ষে মোটেই যথেষ্ট নয়। গোসলের সময়টিতেও একটা তীব্র কম্পিটিশন লেগে যায়। প্রথম প্রথম এখানে গোসল করতে আসতে ভীষণ অপ্রস্তুত বোধ করতাম। কারণ, হোস্টেলের ছাত্রদের অনেকেরই আসল নিবাস পূর্ববাংলা, তথা বাংলাদেশ। কারো কারো মা, ভাই, আত্মীয়স্বজন এখনো বাংলাদেশে রয়ে গেছে। তবে এ কথা সত্যি যে সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা অংশের অত্যাচারে এদের দেশ ছাড়তে হয়েছে। অনেকের গায়ে টোকা দিলেই গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, বরিশাল, ঝিনাইদহ এসকল এলাকার গন্ধ পাওয়া যাবে। জীবন্ত ছাগল থেকে চামড়া তুলে নিলে যে অবস্থা হয়, এদের দশাও অনেকটা সে রকম। কোলকাতা শহরে থাকে বটে, কিন্তু মনের ভেতরে ঢেউ খেলছে পূর্ববাংলার দীঘল বাঁকের নদী, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, হাটঘাট, ক্ষেতফসল, গরুবাছুর। আমি গোসল করতে গেলেই নিজেরা বলাবলি করতো, কীভাবে একজনের বোনকে মুসলমান চেয়ারম্যানের ছেলে অপমান করেছে। অন্যজন বলতে পাশের গায়ের মুসলমানেরা এক রাতের মধ্যে ক্ষেতের সব ফসল কেটে নিয়ে গেছে।

ছোটোখাটো একটি ছেলে তো প্রায় প্রতিদিন উর্দু পড়াবার মৌলবীকে নিয়ে নতুন কৌতুক রচনা করতো। ভাবতাম আমাকে নেহায়েত কষ্ট দেয়ার জন্যই এরা এসব বলাবলি করছে। অথচ মনে মনে প্রতিবাদ করারও কিছু নেই। প্রায় প্রতিটি ঘটনাই অক্ষরে অক্ষরে সত্য। উঃ সংখ্যালঘু হওয়ার কি যন্ত্রণা! তাদের কথাবার্তার ধরন দেখে মনে হতো সুলতান মাহমুদ, আলাউদ্দিন খিলজী থেকে শুরু করে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত যতো অত্যাচার হিন্দুদের ওপর হয়েছে তার জন্য যেনো আমিই অপরাধী। মাঝে মাঝে ভাবতাম, বার্মা কি আফগানিস্তান কোথাও চলে যাওয়া যায় না।

এখন অবশ্য আমার নিজের মধ্যেই একটা পরিবর্তন এসেছে। যেখানেই পৃথিবীর দুর্বলের ওপর অত্যাচার হয়, মনে হয়, আমি নিজেও তার জন্য অল্প বিস্তর দায়ী। কেনো এসব অনুভূতি হয় বলতে পারবো না। এখন আমাকে সবাই সমাদর করে। আমি অসুস্থ মানুষ বলে কেউ কেউ আমাকে বালতিতে পানি ভরতি করে দিয়ে যায়। সম্যক পরিচয়ের অভাবই হচ্ছে মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষের মূল।

আমি গোসল সেরে এসে দেখি, নরেশদা কাপড়চোপড় পরে একমাত্র কাঠের চেয়ারখানার ওপরে ব্যালকনির দিকে মুখ করে বসে রয়েছেন। ঘরে আমার পূর্বপরিচিত জয়সিংহ ব্যানার্জী তাঁর যজমানের মেয়েটিকে নিয়ে মুখ নিচু করে বসে আছেন। এই জয়সিংহ ব্যানার্জীর সঙ্গে বাংলাবাজারে আমার পরিচয়। একটা ছোটো বইয়ের দোকান চালাতো। ব্রাহ্মণ জানতাম। কিন্তু যজমানি পেশাটাও একই সঙ্গে করছে, জানতে পারলাম কোলকাতা এসে। প্রিন্সেপ স্ট্রীটে দেখা, সঙ্গে একটি মেয়ে। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো যজমানকন্যা। নরেশদা বোধ হয় জয়সিংহ ব্যানার্জী মানুষটিকে ঠিক পছন্দ করতে পারেননি। এই অপছন্দের কারণ, জিগগেস করতে যেয়েও করতে পারিনি। কতোজনের কতো কারণ থাকে। ওদের আজকে যে আসার কথা দিয়েছিলাম, সে কথা মনেই ছিলো না। আমার পায়ের শব্দে নরেশদা পেছনে ফিরে তাকালেন। এতো দেরি করলে যে। আমি বললাম, দেরি আর কোথায় করলাম। ঘুম থেকে উঠতেই দেরি হয়ে গেলো। তার ওপর মাসুমের আস্ত একখানি লেকচার হজম করতে হলো। টিফিন করতে যাবে না? সে কি আপনি সকাল থেকে কিছু না খেয়েই বসে আছেন? তিনি বললেন, তুমি কি মনে করো? মনে করাকরি নিয়ে কাজ নেই। চলুন।

জয়সিংহ ব্যানার্জীকে বললাম, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, এই আমরা কিছু খেয়েই চলে আসবো। নরেশদা বললেন, উনারাও সঙ্গে চলুক। আমাকে তো রুম বন্ধ করে যেতে হবে আর তো কেউ নেই। পাহারা দেবে কে? আমি যাবো আমার কাজে, তোমাকেও বোধ হয় বেরোতে হবে। অতএব কাপড়চোপড় পরে একেবারে তৈরি হয়ে নেয়াই উত্তম। মনে আছে তো তিনটের সময় তোমাকে কোথায় যেতে হবে? আমার শরীরে একটা প্রদাহ সৃষ্টি হলো। বললাম, চলুন, চলুন। রাস্তার ওপাশের ছোট্টো অবাঙালি দোকানটিতে যেয়ে পুরি তরকারি খেয়ে নিলাম। জয়সিংহ ব্যানার্জী এবং তাঁর যজমানকন্যা কিছুতেই খেতে রাজি হলেন না। তাঁরা বসে বসে আমাদের খাওয়া দেখলেন।

ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই দেখছি আকাশে বড়ো বড়ো মেঘ দৌড়াদৌড়ি করছে। তখনো মাটির ভাঁড়ের চা শেষ করিনি। ঘন কালো মেঘে কোলকাতার আকাশ ছেয়ে গেছে। একটু পরেই বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি নেমে এলো। দেখতে দেখতে রাস্তায় জল দাঁড়িয়ে গেলো। আমাদের আর বেরুবার কোনো উপায় রইলো না। নরেশদা বললেন, এরপরে তুমি কোথায় যাবে? আমি বললাম, এদের নিয়ে প্রিন্সেপ স্ট্রীটে সোহরাব সাহেবের কাছে যাবো। তিনি যদি একটি স্লীপ ইস্যু করে দেন তাহলে এঁরা কোলকাতা শহরে থেকেই রেশন ওঠাতে পারবেন। তিনি জবাব দিলেন না। পাজামা অনেক দূর অবধি গুটিয়ে এই প্রচণ্ড বিষ্টির মধ্যেই, তোমরা একটু বসো, আমি ছাতাটি নিয়ে আসি-বলে বেরিয়ে গেলেন। গিয়ে আবার তিন চার মিনিটের মধ্যে ছাতাসহ ফিরে এলেন। জিগগেস করলাম, এতো বিষ্টির মধ্যে আপনি কোথায় চললেন? তিনি বললেন, শেয়ালদা। ওমা শেয়ালদা কেনো? মধ্যমগ্রামে গিয়ে প্রণব আর সুব্রত বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসি। আমার হাতে চাবি দিয়ে বললেন, ফিরতে একটু দেরি হতে পারে। চিত্তের সঙ্গে সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। দেখবে তক্তপোষের নিচে দু’টো বাটি আর টেবিলের ওপর একটি ব্যাগ। ওসব ব্যাগের মধ্যে ভরে নিয়ে যাবে। আস্ত ব্যাগটাই তায়েবার কাছে রেখে আসবে। আর ধরে এই ত্রিশটা টাকা রইলো। তিনি হাঁটু অবধি পাজামা গুটিয়ে তুমুল বিষ্টির মধ্যে অদৃশ্য। হয়ে গেলেন।

মধ্যমগ্রামের সুব্রত বাবু নরেশদাকে স্কুলে একটা চাকরি দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। সেই ভরসায় এই বিষ্টিবাদল মাথায় করে তিনি মধ্যমগ্রাম যাচ্ছেন। আমাদের বেঁচে থাকা ক্রমশ কঠিন এবং অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। ভেতর ভেতর কি তীব্র চাপ অনুভব করলেই না নরেশদার মতো আরামপ্রিয় স্থবির মানুষ শেয়ালদার রেলগাড়িতে এই ঝড়-জল তুচ্ছ করে ভিড় ঠেলাঠেলি উপেক্ষা করে মধ্যমগ্রাম পর্যন্ত ছুটে যেতে পারেন। বাইরে যতোই নির্বিকার হোন না কেনো, ভেতরে ভেতরে মানুষটা ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাচ্ছে।

নরেশদা চলে যেতেই আমরা তিনজন অপেক্ষাকৃত হালকা বোধ করলাম। তার উপস্থিতির দরুন জয়সিংহ ব্যানার্জী স্বাভাবিক হতে পারছিলেন না। আমরা টুকটাক কথাবার্তা বলছিলাম। বাইরে বিষ্টি পড়ছে বলে তো আর দোকানে বসে থাকা যায় না। দোকানের মালিকের আড়চোখে চাওয়ার উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আরো তিন ভড় চা চেয়ে নিলাম। একটু একটু করে চুমুক দিয়ে খাচ্ছিলাম। আমাদের ভাবখানা এই, বিষ্টি থামা অবধি এই ভাঁড় দিয়েই চালিয়ে যাবো। পঁচিশ পয়সা দামের চায়ের ভাড় তো আর সমুদ্র নয়। এক সময়ে শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু বিষ্টি থামলো না। দোকানী এবার রুদ্রমূর্তি ধারণ করে বললো, বাবুজী এবার উঠতে হোবে। আমার দোসরা কাস্টমারকে জায়গা দিতে হোবে। আমি বললাম, এই বিষ্টির। মধ্যে আমি যাবো কেমন করে। দোকানী মোক্ষম জবাব দিলো, বাবু বিষ্টি তো আমি মন্তর পড়ে নামায়নি। আপনারা বোলছেন যাবো কেমন করে, ওই দেখুন। মাথা বাড়িয়ে দেখলাম, শতো শতো মানুষ এই প্রবল বিষ্টির মধ্যেও এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে। ওদিক থেকে এদিকে আসছে। মেয়েদের শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট ভিজে শপ শপ করছে। ট্রাম বাস দাঁড়িয়ে গেছে, কিন্তু মানুষের নিরন্তর পথ চলার কোনো বিরাম নেই।

অগত্যা আমাদেরও উঠতে হলো। কিছুদূর গিয়ে একটা বাড়ির বোয়াকে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। তারপর আর কিছুদূর গিয়ে রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের বাঁকে ডঃ বিধান রায়ের বাড়ির কাছে চলে এলাম। কিন্তু বর্ষণের বেগ আমাদের থামতে দিচ্ছিলো না। আমরা আরেকটা চালার নিচে দাঁড়িয়ে চা খাওয়ার ছল করে আরেকটু আশ্রয় চুরি করলাম। চা খেতে খেতেই বিষ্টির বেগ একটু ধরে এলো। এই সুযোগেই আমরা প্রিন্সেপ স্ট্রীটের অফিসটিতে চলে এলাম। ভেতরে ঢোকার উপায় নেই। ঠেলাঠেলি, কনুই মারামারি করছে হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু কেউ কাউকে পথ দিচ্ছে না। সকলেই অসহায়। সকলেই একটুখানি আশ্রয় চায়। অফিস বিল্ডিংয়ের পাশের খালি জায়গাটিতে প্রতিরাতে হাজার হাজার বাংলাদেশের তরুণ ঘুমোয়। একখানি চাদর বিছিয়ে লুঙ্গিটাকে বালিশ হিসেবে ব্যবহার করে কেউ কেউ। যার তাও নেই, কাঁকর বিছানো মাটিকেই শয্যা হিসেবে মেনে নিয়ে রাত গুজরান করে। এদের মধ্যে ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমান তরুণ যেমন আছে, আছে ধাড়ী নিষ্কর্মার দল। চোরাচর, এমন কি কিছু কিছু সমকামী থাকাও বিচিত্র নয়। অন্যান্য দিন এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো। গোটা সংখ্যাটা এক সঙ্গে দেখা যেতো না। আজ বাসাভাঙ্গা কাকের মতো সবাই অফিস বিল্ডিংটিতে একটুখানি ঠাই করে নিতে মরীয়া হয়ে চেষ্টা করছে। যেদিকেই তাকাই না কেন শুধু মাথা, কালো কালো মাথা। ওপরে ওঠা প্রথমে মনে হয়েছিলো অসম্ভব। ভিড়ের মধ্যে একটি আঙুল চালাবার মতোও খালি জায়গা নেই। কেমন করে যাবো। একটি মেয়ে বয়সে যুবতী তার গায়ের কাপড় ভিজে গায়ের সঙ্গে আঁটসাট হয়ে লেগে গেছে। এই অবস্থায় এতোগুলো মানুষ তাকে দেখছে, দেখে আমি নিজেই ভয়ানক লজ্জা পেয়ে গেলাম। এরই মধ্যে দেখি মানুষ ওপরে উঠছে এবং নিচে নামছে।

আমরাও একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওপরে উঠে এলাম। কি করে ওপরে এলাম, সেটা ঠিক ব্যক্ত করা যাবে না। যে কষ্টকর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সন্তান মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হয়, তার সঙ্গে এই ওপরে ওঠার কিঞ্চিৎ তুলনা করা চলে। অফিসের খোপ খোপ কাউন্টারগুলোতে আজ আর কোনো কাজ চলছে না। সর্বত্র মানুষ গিস গিস করছে। এখানে সেখানে মানুষ ঝক ঝক মৌচাকের মতো জমাট বেঁধে আছে। জয়সিংহ ব্যানার্জীকে বললাম, এতো কষ্ট করে আসাটা বৃথা হয়ে গেলো। এই ভিড় ঠেলাঠেলির মধ্যে আমি সোহরাব সাহেবকে খুঁজবো কোথায়? এই সময়ে দেখা গেলো তিন তলার চিলেকোঠার দরোজার পাল্লা দুটো ফাঁক হয়ে একটা হাত বেরিয়ে এসেছে এবং ইশারা করে ডাকছে। কাকে না কাকে ডাকছে, প্রথমে বিশেষ আমল দেইনি। সিঁড়িতেও মানুষ, তিল ধারণের স্থান নেই। লোকজন এই জলঅচল ভিড়ের মধ্যে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো, এই যে, আপনাকে ওপরে ডাকা হচ্ছে। ওপরে গিয়ে দেখলাম সোহরাব সাহেব পাজামা হাঁটুর ওপর তুলে একটা হাতল ভাঙ্গা চেয়ারে বসে চারমিনার টানছেন আর শেখ মুজিবের মুণ্ডপাত করছেন। আমি অবাক হয়ে গেলাম। আজ বঙ্গবন্ধু শব্দটি তিনি উচ্চারণ করলেন না। আরেকজন ছাত্রনেতা নীরবে বসে বসে সোহরাব সাহেবের কথামৃত শ্রবণ করছে। ছাত্রনেতাটিরও হয়তো জরুরী কোনো ঠেকা আছে। অথবা হতে পারে সোহরাব সাহেবের খুব রিলায়েবল লোক। নইলে নির্বিবাদে এমন বিরূপ মুজিবচর্চা এই প্রিন্সেপ স্ট্রীটের অফিসে কেমন করে সম্ভব। আমি বললাম, চুটিয়ে তো নেতার সমালোচনা করা হচ্ছে। যদি আমি চিৎকার করে জনগণকে জানিয়ে দেই তখন বুঝবেন ঠেলাটা। তখখুনি আমার দৃষ্টি সোহরাব সাহেবের হাঁটুর দিকে ধাবিত হলো। যতোটুকু পাজামা গুটিয়েছেন, দেখা গেলো কালো কালো লোমগুলো সোজা দাঁড়িয়ে গেছে। একেবারে লোমের বন। ঘরে একজন মহিলা আছে দেখেও তিনি পাজামাটা ঠিক করে নিলেন না। বসার কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। স্বল্প পরিসর কক্ষটিতে তাই দাঁড়িয়ে রইলাম। সোহরাব সাহেব বললেন, নেতাকে বকবো না তো কাকে বকবো। নেতার ডাকেই তো ঘর ছেড়ে বেরিয়েছি। আজকে আসার সময় দেখলাম, বাচ্চাটার পাতলা পায়খানা হচ্ছে। যে ঘরটিতে থাকি পানি উঠেছে। আর কতো কষ্ট করবো। এখন পাকিস্তানের সঙ্গে একটা মিটমাট করে ফেললেই হয়। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাই। আমি বললাম, আপনি যদি একথা বলেন, তাহলে গোটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটা দাঁড়াবে কিসের ওপর।

সোহরাব সাহেব বললেন, সাধে কি আর এরকম কথা মুখ দিয়ে আসে। কতোদিকে কতো কাণ্ড ঘটছে সেসবের হিসেব রাখেন? আমি বললাম, কোনো হিসেবই রাখিনে সোহরাব সাহেব। কি করে রাখবো। সোহরাব সাহেব আমার হাতে একটা লিফলেট দিয়ে বললেন, আপনি হার্মলেস মানুষ, তাই বিশ্বাস করে পড়তে দিচ্ছি। লিফলেটটি আগরতলা থেকে বেরিয়েছে। সংক্ষেপে তার মর্মবস্তু এ রকমঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী সৈন্যের হাতে ধরা পড়বার আগে এক ঘরোয়া সভা ডেকেছিলেন। তাতে তিনি যদি পাকিস্তানী সৈন্যের হাতে ধরা পড়েন, কি কি করতে হবে সেসকল বিষয়ে আলোচনা হয়েছিলো। ওই সভায় একজন নাকি শেখ সাহেবের কাছে সাহস করে জিগগেস করছিলো, বঙ্গবন্ধু, আপনার অবর্তমানে আমরা কার নেতৃত্ব মেনে চলবো। শেখ সাহেব আঙুল তুলে শেখ মনিকে দেখিয়ে বলেছিলেন, তোমরা এর নেতৃত্ব মেনে চলবে। লিফলেটটা ফেরত দিলে তিনি পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে একটা জেন্ট সাইজের পকেট রুমালের মতো পত্রিকা বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, এই দাগ দেয়া অংশটুকু পাঠ করুন। তারপর বিশুদ্ধ বাঙাল উচ্চারণে বললেন, নেতাকে কি আর সাধে গাইল্যাই। পত্রিকাটিও পড়ে দেখলাম। সংক্ষেপে সারকথা এই আগরতলাতে নেতৃত্বের দাবিতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বি ছাত্রের দল একরকম সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছিলো। তার প্রতিবাদে আগরতলার মানুষ মিছিল করে জানিয়ে দিয়েছে ওই মাটিতে বাংলাদেশের মানুষদের মারামারি হানাহানি তারা বরদাস্ত করবে না। বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের মধ্যে হানাহানি করতে চায় নিজেদের দেশে গিয়ে করুক। কাগজটা ফেরত দিয়ে সোহরাব সাহেব আমাকে জিগগেস করলেন, ভালো লেখেনি? আমি মাথা নাড়লাম। অনেকক্ষণ এক নাগাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে পায়ে বাত ধরে গেছে। সুতরাং অধিক কথা না বাড়িয়ে বলে ফেললাম, সোহরাব সাহেব আপনার কাছে এদের জন্য একটা রেশনকার্ড ইস্যুর স্লীপ নিতে এসেছিলাম। আমি জয়সিংহ ব্যানার্জী এবং তার যজমানের মেয়ে সবিতাকে দেখিয়ে দিলাম। তিনি বললেন, আরে সাহেব আপনি আমায় মুসকিলে ফেললেন। এই ভিড় হট্টগোলের সময় আমি কাগজ কোথায় পাই, কি করে কলম জোগাড় করি। আমি পকেট থেকে কাগজ কলম বের করে বললাম, এই নিন, আপনি লিখে দিন। তিনি খসখস করে গদবাধা ইংরেজিতে লিখে দিলেন, প্লীজ ইস্যু রেশন কার্ড ফর মি, সো এন্ড সো… ইত্যাদি, ইত্যাদি। কাগজটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, বাঁদিকের কাউন্টারে যে লোক বসে তাকে দেখলে এই স্লীপটা দিয়ে দেবেন। ওরা চলে গেলো। আমরা আরো কিছুক্ষণ গল্পগাছা করলাম। এরই মধ্যে বিষ্টি ধরে এসেছে। তবে মেঘ কাটেনি। ঘড়িতে দেখলাম একটা বাজে। আমাকে উঠতে হলো। দোতলায় নেমে দেখি আবদ্ধ মানবণ্ডলীর মধ্যে চলাচলের একটা সাড়া পড়ে গেছে। একটানা অনেকক্ষণ আবদ্ধ থাকার পর মানুষের মধ্যে একটা চলমানতার সৃষ্টি হয়েছে। দেখতে দেখতে ভিড় অনেকটা হাল্কা হয়ে এলো। নিচে নেমে এলাম। রাস্তায় পানি নামতে অনেক সময় লাগবে, তাও যদি আবার বিষ্টি না হয়। এখন আমি কি করবো চিন্তা করছি। এমন সময় পিস্তলের আওয়াজের মতো একটা তীক্ষ্ণ তীব্র কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। এই যে দাদা আপনাকে একটা কথা জিগাইরার লাইগ্যা ডাক্তার রায়ের বাড়ি থেইক্যা ফলো করছি। আমি তাকিয়ে দেখলাম, লোকটার গাত্রবর্ণ ধানসেদ্ধ হাড়ির তলার মতো কৃষ্ণবর্ণ। মুখে দাঁড়িগোঁফ গজিয়েছে। পরনে একখানি ময়লা হাঁটু ধুতি। গায়ের জামাটিও ময়লা। একেবারে আদর্শ জয়বাংলার মানুষ। কিছুক্ষণ তাকিয়েও কোনো হদিশ করতে পারলাম না, কে হতে পারে। লোকটি বললো, আমারে আপনে চিনতে পারছেন না দাদা, আমি বাংলা বাজারের রামু। ওহ্ রামু, তুমি কেমন আছো? দাদা ভগবান রাখছে। তোমার মা বাবা সবাই ভালো। দাদা, মা বাবার কথা আর জিগাইবেন না। সব কটারে দেশের মাটিতে রাইখ্যা আইছি। রামু হু হু করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। প্রতিটি হিন্দু পরিবারেরই বলতে গেলে এরকম একেকটা করুণ ভয়ঙ্কর কাহিনী আছে। এসব কথা শুনতে বিশেষ ভালো লাগে না। কারণ আমি তো ভুক্তভোগী নই। তথাপি কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পরক্ষণেই রামু আমাকে ছেড়ে দিয়ে সটান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে সরাসরি জানতে চাইলো। দাদা জয়সিংহ ঠাকুরের লগে আপনার এতো পিরিত কিয়ের। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে মনে রামুকে ধন্যবাদ দিলাম। একটা পীড়াদায়ক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে রামু। বললাম, রামু পিরিত-টিরিত কিছু নয়। জয়সিংহ তাঁর যজমানের মেয়েকে নিয়ে খুব অসুবিধেয় পড়েছেন। আমাকে ধরেছেন একটা রেশন কার্ডের স্লিপ করিয়ে দেবার জন্য। তা করিয়ে দিলাম। মেয়েটির নাকি আর কোনো অভিভাবক নেই। তাই তাকে পোষার দায়িত্ব জয়সিংহের ঘাড়ে এসে পড়েছে। অন্যায় কিছু করেছি রামু? রামু এবারে রাগে ফেটে পড়লো। শালা বদমাইশ বাউন, মা আর বুন দুইডা ক্যাম্পে কাঁইদ্যা চোখ ফুলাইয়া ফেলাইছে। আর হারামজাদা মাইয়াডারে কইলকাতা টাউনে আইন্যা মজা মারবার লাগছে। আর ওই মাগীডাও একটা খানকী। বুঝলেন দাদা এই খবরটা আপনেরে জানান উচিত মনে কইর‍্যা পাছু ধরছিলাম। তারপর উত্তরের কোনো পরোয়া না করে রামু হাঁট ধুতিটা আরো ওপরে তুলে রাস্তায় পানির মধ্যে পা চালিয়ে হন হন করে চলে গেলো। হঠাৎ করে আমার খুব রাগ হচ্ছিলো। কাউকে খুন করে ফেলার ইচ্ছে জাগছিলো। করার মতো কিছু না পেয়ে রেগে দাঁতে অধর চেপে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরে থুতনির কাছে তরল পদার্থের অস্তিত্ব অনুভব করে আঙ্গুল দিয়ে দেখি, রক্ত। আমার অধর কেটে গিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় লাল রক্ত বেরিয়ে আসছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।

.

০৪.

হোস্টেলে পৌঁছুতে বেলা দুটো বেজে গেলো। ক্ষীতিশ কলেজ থেকে ফিরেছে। বললো, দাদা, মেজদা নাকি চিত্তকে কি সব রান্নাবান্না করার ফরমায়েশ দিয়ে গেছে। চিত্ত বারে বারে খুঁজছে। আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। নইলে নিজেই কবে খেয়ে নিতাম। ব্যাপার জানেন নাকি কিছু? বললাম, হ্যাঁ ক্ষীতিশ, একজন রোগীর জন্য কিছু খাবার রান্না করে নিতে হবে হাসপাতালে। যদি এরই মধ্যে রান্না হয়ে গিয়ে থাকে তুমি একটু কষ্ট করে ভাত আর মাছ আলাদা আলাদাভাবে এই বাটিটার মধ্যে ভরে দিতে বলল। তক্তপোষের তলা থেকে আমি ছোট্টো বাটিটা বের করে ক্ষীতিশের হাতে দিলাম। অল্পক্ষণ পর ক্ষীতিশ ভাত তরকারি ভর্তি বাটিটা নিয়ে এলে আমি পেটমোটা হাতব্যাগটা টেনে নিয়ে আস্ত বাটিটা ব্যাগের পেটের ভেতর ঢুকিয়ে রাখলাম। ক্ষীতিশ জিগগেস করলো, দাদা কি এখনই বেরুবেন। আমি বললাম, হা ক্ষীতিশ, আমাকে এখুনিই বেরুতে হচ্ছে। কতোদূর যাবেন? পিজি হাসপাতাল। ক্ষীতিশ বললো, শহরে কোনো ট্রাম বাস চলছে না, রাস্তায় এক কোমর জল। আকাশের দিকে চেয়ে দেখুন, যে কোনো সময়ে বিষ্টি নামতে পারে। ব্যালকনির দিকে দরোজা জানালা খুলে দিলো। কালো মেঘ কোলকাতার আকাশের চার কোণ ছেয়ে একেবারে নিচে নেমে এসেছে।ট্রাম বাস ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। হাতে টানা রিকশাগুলো ডিঙিনৌকার মতো চলাফেরা করছে। বাস্তবিকই পথে বেরুবার পক্ষে মোটেই অনুকূল নয়। তথাপি মানুষ চলাচল করছে। মহিলারা মাথায় ছাতা মেলে ধরছে বটে, কিন্তু অনেকেরই পরনের শাড়ি কোমর অবধি ভিজে গেছে। আমি বললাম, যেতেই হবে আমাকে। তুমি বরং একটা উপকার করো। নিচের কোনো দোকান থেকে সস্তায় একটা জয়বাংলা বর্ষাতি কিনে এনে দাও। বিশটি টাকা বের করে তার হাতে তুলে দিলাম। সে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে চলে গেলো।

ইত্যবসরে আমি একটা পুরোনো প্যান্ট পরে হাঁটু অবধি গুটিয়ে নিলাম। দেশ থেকে এক জোড়া জুতো এনেছিলাম। কোলকাতায় আসার পর বিশেষ পরা হয়নি। সেটা পরে নিলাম। স্যাণ্ডেল জোড়ার যে অবস্থা হয়েছে আশঙ্কা করছিলাম পানির সঙ্গে যুদ্ধে পেরে উঠবে না। ক্ষীতিশ বর্ষাতি কিনে এনে দিলে পরে নিয়ে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়লাম। পথে নামতেই আবার ঝম ঝম করে বিষ্টি নামলো। বর্ষণের বেগ এতো প্রবল, পাঁচ হাত দূরের জিনিসও ঝাপসা কুয়াশার মতো দেখাচ্ছে। ফুটপাত দিয়ে চলতে গিয়ে পর পর দু’জন পথচারীর সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়ে ফেললাম। রাস্তা পানিতে ফুলে ফেঁপে একটা ছোটো খাটো বাঁকা নদীর মতো দেখাচ্ছে। এই কোমর পানির মধ্যে চলতে গিয়ে আমার মনে হলো শরীরে মনে যেন আমি কিছুটা কাঁচা হয়ে উঠেছি। এই ধারাজল আমার শরণার্থী জীবনের সমস্ত কালিমা ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য একটা সুড়সুড়ি অনুভব করছিলাম। আমি যেনো আবার সেই ছোট্টো শিশুটি হয়ে গেছি। মনে পড়ে গেলো বাড়ির পাশের খালটিতে কি আনন্দেই না সাঁতার কাটতাম। ছাত করে মনে পড়ে গেলো। একবার ঝড়বিষ্টির মধ্যে ভিজেচুপসে তায়েবাদের গেন্ডারিয়ার বাড়িতে হাজির হয়েছিলাম। তায়েবা দরোজা খুলে আমাকে দেখে রবীন্দ্রনাথের সে গানটির দুটো কলি কি আবেগেই না গেয়ে উঠেছিলো–

‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরান সখা বন্ধু হে আমার’

সেদিন আর আজ। আমি রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছি। প্রতি পদক্ষেপে অতীত, আমার আর তায়েবার অতীত, মনের মধ্যে ঢেউ দিয়ে জেগে উঠছে।

ওর সঙ্গে আমার পরিচয় উনিশো আটষট্টি সালে। সেদিনটার কথা এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে। মৃত্যুর মুহূর্তেও ভুলতে পারবো না। আগস্ট মাসে একটা দিনে প্রচণ্ড গরম পড়েছিলো। আমি গিয়েছিলাম বাঙলা বাজারের প্রকাশক পাড়ায়। নানা কারণে মনটা বিগড়ে গিয়েছিলো। সুনির্মলদা আমাকে বললেন, চলো একটা জায়গা ঘুরে আসি। হেঁটে হেঁটে গেন্ডারিয়ার লোহারপুল পেরিয়ে বুড়িগঙ্গার পারের একটা ছোট্টো একতলা বাড়ির সামনে এসে সুনির্মলদা বললেন, তুমি এখানে একটু দাঁড়াও, আমি দেখি ভেতরে কেউ আছে কিনা। তিনি এগিয়ে গিয়ে দরোজায় কড়া নাড়তে লাগলেন। দরোজার পাল্লা দুটো ফাঁক হয়ে গেলো। সুনির্মলদা ভেতরে ঢুকলেন। আমাকে হাত নেড়ে ডাকলেন, এসো দানিয়েল। আমিও ভেতরে প্রবেশ করলাম। সুনির্মলদা বললেন, দেখো তায়েবা কাকে ধরে নিয়ে এসেছি। সাদা শাড়ি পরিহিতা উজ্জ্বল শ্যামল রঙের মহিলাটি আমাকে ঘাড়টা একটুখানি দুলিয়ে সালাম করলো। সুনির্মলদা তক্তপোষের সাদা ধবধবে চাঁদরের ওপর পা উঠিয়ে বসলেন। মহিলাটি বললেন, আপনিও পা উঠিয়ে বসুন। ক্ষুণ্ণকণ্ঠে বললাম, আমার পায়ে অনেক ময়লা। আপনার আস্ত চাদরটাই নষ্ট হয়ে যাবে, বরঞ্চ আমাকে একটা অন্যরকম আসন দিন। আপনি যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলি। আপনি পাটা ধুয়েই বসুন। আমি পানি এনে দিচ্ছি। এক বদনা পানি এনে দিলে আমি পা দু’টো রগড়ে পরিষ্কার করে বিছানার ওপর বসেছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন আমি একটা পাটভাঙ্গা সাদা পাঞ্জাবি পরেছিলাম। কি একখানা লাল মলাটের বই সারাক্ষণ বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরেছিলাম। ঘামেভেজা পাঞ্জাবির বুকের অংশে মলাটের লাল রঙটা গাঢ় হয়ে গিয়েছিলো। মহিলাটি আমার পাঞ্জাবির দিকে তাকিয়ে জিগগেস করলো, ওমা আপনার পাঞ্জাবিতে এমন খুন খারাবীর মতো রঙ দিয়েছে কে? আমি ঈষৎ অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, কেউ দেয়নি। কখন বইয়ের মলাটের রঙটা পাঞ্জাবিতে লেগে গেছে খেয়াল করিনি। লক্ষণ সুবিধের নয় বলে মহিলাটি সুন্দর সাদা দাঁত দেখিয়ে হাসলো। ফুলদানীতে একটি সুন্দর রজনীগন্ধার গুচ্ছ। তার হাসিটি রজনীগন্ধার মতো সুন্দর স্নিগ্ধ ঘাড়টাও রজনীগন্ধার মতো ঈষৎ নোয়ানো।

আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, ঘরে বিশেষ আসবাবপত্তর নেই। তক্তপোষের ওপর হারমোনিয়াম, তবলা এবং তানপুরা। পাশে পড়ার টেবিল। সামনে একখানি চেয়ার। শেলফে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু পাঠ্য বই। একেবারে ওপরের তাকে সেই চমকার চারকোণা ফুলদানিটি, যার ওপর শোভা পাচ্ছে সদ্যচ্ছিন্ন রজনীগন্ধার গুচ্ছ। মনে মনে অনুমান করে নিলাম, এ বাড়িতে গানবাজনার চল আছে। এ বাড়ির কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। এই ঘরজোড়া তক্তপোষটিতে নিশ্চয়ই একের অধিক মানুষ অথবা মানুষী ঘুমায়।

সুনির্মলদা বললেন, দানিয়েলের সঙ্গে এখনো পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়নি। দানিয়েল, এ হোল আমাদের বোন তায়েবা। আর ও হচ্ছে দানিয়েল, অনেক গুণ, কালে কালে পরিচয় পাবে। তবে সর্বপ্রধান গুণটির কথা বলে রাখি–ভীষণ বদরাগী। নাকের ওপর দিয়ে মাছি উড়ে যাওয়ার উপায় নেই, দু’টুকরো হয়ে যায়। তায়েবা সায় দিয়ে বললো, বারে যাবে না, যা খাড়া এবং ছুঁচোলো নাক। মহিলা আমার তারিফ করলো কি নিন্দে করলো সঠিক বুঝতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পরে আরো দু’জন মহিলা এসে ঘরে ঢুকলো। মুখের আদলটি তায়েবারই মতো। তবে একজনের রঙ একেবারে ধবধবে ফর্সা। তার পরনে শাড়ি। আরেক জন অতো ফর্সা নয়, কিছুটা মাজা মাজা। তার পরনে শালোয়ার কামিজ। তায়েবা পরিচয় করিয়ে দিলো। শালোয়ার পরিহিতাকে দেখিয়ে বললো, এ হলো আমার ইমিডিয়েট ছোটো বোন। নাম দোলা। বিএ পরীক্ষা দেবে। খেলাধুলার দিকে ওর ভীষণ ঝোঁক। আর ও হচ্ছে তার ছোটটি নাম ডোরা। গানবাজনা করে। সুনির্মলদা আপনারা কথাবার্তা বলুন, কিছু খাবার দেয়া যায় কি না দেখি।

সেদিন গেন্ডারিয়ার বাসা থেকে ফিরে আসার সময় দেখি আকাশে একখানা চাঁদ জ্বলছে। আমি পাঞ্জাবির বুকের লালিয়ে যাওয়া অংশটি বার বার স্পর্শ করে দেখছিলাম। একি সত্যি সত্যি বইয়ের মলাটের রঙ নাকি হৃদয়ের রঙ, রক্ত মাংস চামড়া ভেদ করে পাঞ্জাবিতে এসে লেগেছে। আমার মনে হয়েছিলো, ওই দূরের রূপালী আভার রাত আমার জন্যই এমন অকাতরে কিরণধারা বিলিয়ে হৃদয় জুড়োনো সুবাস ঢালছে। আজ সুনির্মলদার বিরুদ্ধে আমার অনেক নালিশ। তবু, আমি তাকে পুরোপুরি ক্ষমা করে দিতে পারবো, কেনোনা তিনি আমাকে বুড়ীগঙ্গার পাড়ে তায়েবাদের সে গেন্ডারিয়ার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন।

এসপ্ল্যানেড ছাড়িয়ে বাঁক ঘুরে রবীন্দ্রসদন অভিমুখী রাস্তাটা ধরতেই পানির প্রতাপ কমে এলো। বিষ্টি হচ্ছে, তথাপি রাস্তাঘাটে জল দাঁড়ায়নি। এতোক্ষণে কেমন ঝোঁকের মাথায় এতদূর চলে এসেছি। এখন নিজের দিকে তাকাতে একটু চেষ্টা করলাম। প্যান্টে নিশ্চয়ই পঁচাপানির সঙ্গে কোলকাতার যাবতীয় ময়লা এসে মিশেছে। লোমকূপের গোড়ায় গোড়ায় এখন থেকেই চুলকোতে শুরু করেছে। বর্ষাতিটা গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। সস্তার তিন অবস্থার এক অবস্থা প্রথম দিনেই প্রত্যক্ষ করা গেলো। এখানে সেখানে ছড়ে গেছে। পায়ের নীচের জুতো জোড়ার অবস্থা ভুলে থাকার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছিনে। প্রতি পদক্ষেপেই অনুভব করছি, বৃষ্টিতে গলে যাওয়া এঁটেল মাটির মতো সোলটা ফকফকে হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আরেকবার সামনে চরণ বাড়ালেই সোল দুটো আপনা থেকেই পাকা ফলের মতো খসে পড়বে। নিজের ওপর ভয়ানক করুণা হচ্ছিলো। সিগারেট খাওয়ার তেষ্টা পেয়েছে। প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট আর ম্যাচ বের করে দেখি ভিজে একবারে চুপসে গেছে। দুত্তোর ছাই, রাগ করে সিগারেট ম্যাচ দুটোই ড্রেনের মধ্যে ছুঁড়ে দিলাম।

হাসপাতালের গেট খুলতে এখনো প্রায় আধঘন্টা বাকি। এ সময়টা আমি কি করি। মুষলধারে বিষ্টি ঝরছে। ধারে কাছে কোনো রেস্টুরেন্টও নেই যে বসে সময়টা পার করে দেয়া যায়। মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। দারোয়ানের কাছে গিয়ে বললাম, ডঃ মাইতির সঙ্গে দেখা করতে যাবো। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে দারোয়ানের বুঝি দয়া হলো। সে ঘটা করে লোহার গেটের পাল্লা দুটো আলাদা। করলো। আমি ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

তায়েবার কেবিনে ঢুকে দেখি, সে শুয়ে আছে। পাশের বেডের উৎপলা আজও হাজির নেই। তায়েবা কি ঘুমিয়ে পড়েছে, নাকি এমনিতে চোখ বন্ধ করে আছে। মস্তবড়ো পড়ে পড়ে গেলাম। আয়া টায়া কিংবা নার্স জাতীয় কাউকে খোঁজ করার জন্য করিডোরের দিকে গেলাম। আমার সিক্ত জুতো থেকে ফাঁস ফাঁস হাঁসের ডাকের মতো এক ধরনের আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। আর প্যান্ট থেকে পানি পড়ে ধোয়া মোছা তকতকে মেঝে ভিজিয়ে দিচ্ছে। এ অবস্থায় কেউ আমাকে দেখে হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা নষ্ট করার অপরাধে যদি ঘাড় ধরে বের করে দেয় আমার বলার কিছুই থাকবে না। এক সময় তায়েবা চোখ মেলে জিগগেস করলো, কে? আমি তার সামনে যেয়ে দাঁড়ালে খুব গম্ভীর গলায় পরম সন্তোষের সঙ্গে বললো, ও দানিয়েল ভাই, আপনি এসেছেন তাহলে। আমি সেই পেটমোটা ব্যাগটা তার হাতে গছিয়ে দিয়ে বললাম, এর মধ্যে ভাত-মাছ রান্না করা আছে। সে ব্যাগটা স্টীলের মিটসেফের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলো। খুশিতে তার চোখজোড়া চিকচিক করে উঠলো। দানিয়েল ভাই বসুন, টুলটা দেখিয়ে দিলো। তারপর আমার আপাদমস্তক ভালো করে তাকাতেই শক লাগার মতো চমক খেয়ে বিছানার ওপরে উঠে বসলো। একি অবস্থা হয়েছে আপনার দানিয়েল ভাই, সব দেখি ভিজে একেবারে চুপসে গেছে। আমি বললাম, বারে ভিজবে না, রাস্তায় এক কোমর পানি ভেঙ্গেই তো আসতে হলো। তায়েবা জানতে চাইলো, এ বিষ্টির মধ্যে সব পথটাই কি আপনি হেঁটে এসেছেন। আমি বললাম, উপায় কি? ট্রাম বাস কিছুই তো চলে না। তাছাড়া ট্যাক্সীতে চড়া সেতো ভাগ্যের ব্যাপার। সহসা তার মুখে কোনো কথা জোগালো না। বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গিয়ে একটি বড়োসরো তোয়ালে আমার হাতে দিয়ে বললো, আপাততঃ গায়ের ওই কিম্ভুত কিমাকার জন্তুটা এবং পায়ের জুতো জোড়া খুলে গা মাথা ভালো করে মুছে নিন। আমি দেখি কি করা যায়। সে গোবিন্দের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে একেবারে করিডোরের শেষ মাথায় চলে গেলো। গায়ের বর্ষাতিটা খোলার পর ফিতে খুলে জুতাজোড়া বের করার জন্য যেই একটু মৃদু চাপ দিয়েছি অমনি সোল দুটো আপসে জুতো থেকে আলাদা হয়ে গেলো। আমার ভয়ানক আফশোস হচ্ছিলো। এই এক জোড়া জুতো অনেকদিন থেকে বুকের পাঁজরের মতো কোলকাতা শহরের জলকাদা-বিষ্টির অত্যাচার থেকে রক্ষা করে আসছিল। আজ তার পরমায়ু শেষ হয়ে গেলো। গা মোছার কথা ভুলে গিয়ে একদৃষ্টে খসে পড়া সোল দু’টোর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

এই সময়ের মধ্যে গোবিন্দকে সঙ্গে নিয়ে তায়েবা ফিরে এলো। সে গোবিন্দকে কি একটা ব্যাপারে অনুরোধ করছে। আর গোবিন্দ বারে বারে মাথা নেড়ে বলছে, না। দিদিমণি, সে আমাকে দিয়ে হবে না। দেখছেন কেমন করে বিষ্টি পড়ছে। দোকান পাট সব বন্ধ। তাদের কথা ভালো করে কানে আসছিলো না। আমি জুতো জোড়ার কথাই চিন্তা করছিলাম। তায়েবা গোবিন্দের কানের কাছে মুখ নিয়ে কি একটা বলতেই তাকে অনেকটা নিমরাজী ধরনের মনে হলো। বললো, টাকা আর ছাতার ব্যবস্থা করে দিন। আমার খুব ভয় লাগছিলো, পাছে তায়েবা আমাকে কোনো টাকা পয়সা দিতে বলে, আসলে আমার কাছে বিশ বাইশ টাকার অধিক নেই এবং টাকাটা খরচ করারও ইচ্ছে নেই। পঞ্চাশ নয়া পয়সা ট্রাম ভাড়া বাঁচাবার জন্য দৈনিক চার ছয় মাইল পথ অবলীলায় হেঁটে চলাফেরা করছি ইদানীং। আমার জুতোর খসে পড়া সোল দু’খানি তায়েবার দৃষ্টি এড়ালো না। জিগগেস করলো, কি হলো আপনার জুতোয়? আমি বললাম, কোলকাতায় পানির সঙ্গে রণভঙ্গ দিয়ে এই মাত্র জুতোজোড়া ভবলীলা সাঙ্গ করলো। সে বালিশের তলা থেকে একটা পার্স বের করে আপন মনে টাকা গুণতে গুণতে উচ্চারণ করলো, ও তাহলে এই ব্যাপার। কেবিনের বাইরে গিয়ে গোবিন্দের সঙ্গে নিচু গলায় আবার কি সব আলাপ করলো। ভেতরে ঢুকে আমাকে বললো, আপনার সেই জন্তুটা একটু দিন, গোবিন্দ একটু বাইরে থেকে আসবে। গোবিন্দের হাতে নিয়ে বর্ষাতিটা দিলো। গোবিন্দ হাঁটা দিয়েছে, এমন সময় ডাক দিয়ে বললো, গোবিন্দদা এক মিনিট দাঁড়াও। আমার কাছে এসে জানতে চাইলো আপনার তো সিগারেট নেই। আমি বললাম, না। কি সিগারেট যেনো আপনি খান। চারমিনার। এই ছাইভস্ম কেননা যে টানেন। সে দরোজার কাছে গিয়ে বললো, গোবিন্দ, ওখান থেকে পয়সা দিয়ে এক প্যাকেট চারমিনার আর একটা ম্যাচ আনবেন। তারপর তায়েবা বাথরুমে যেয়ে পা দুটো পরিষ্কার করে এসে কোনো রকমে নিজেকে বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিলো। স্যাণ্ডেল না পরে সে বেরিয়ে গিয়েছিলো, এটা সে নিজেই খেয়াল করেনি। এই হাঁটাহাঁটি ডাকাডাকিতে নিশ্চয়ই তার অনেক কষ্ট হয়েছে। সেদিন আমি ভুল করেছিলাম। আসলে তায়েবা সে আগের তায়েবা নেই। একটুকুতেই হাঁপিয়ে ওঠে। এখন সে বিছানায় পড়ে আছে শীতের নিস্তরঙ্গ নদীর মতো। চুপচাপ শান্ত স্থির।

আমার কেমন জানি লাগছিলো। খুব ম্লান কণ্ঠে ধীরে ধীরে বললো, দানিয়েল ভাই জানেন, জীবনে আপনি খুব বড়ো হবেন। তার গলার আওয়াজটা যেনো অনেক দূর থেকে ভেসে আসছিলো। কণ্ঠস্বরে চমকে গেলাম। তবুও রসিকতা করে বললাম, বড়ো তো আর কম হইনি, এখন বুড়ো হয়ে মরে যাওয়াটাই শুধু বাকি। আপনি সবসময় কথার উল্টো অর্থ করেন। থাক, আপনার সঙ্গে আর কথা বলবো না। এমনিতেও আমার বিশেষ ভালো লাগছে না। সে হাঁ করে নিশ্বাস নিতে লাগলো। আমি জানতে চাইলাম, তায়েবা আজ তোমার শরীরটা কি খুব খারাপ? না না অতো খারাপ নয়। দেখছেন না কি নোংরা বিষ্টি। তাছাড়া আমাকে আজ আবার ইঞ্জেকশন দিয়েছে। যেদিন ইঞ্জেকশন দেয় খুবই কষ্ট হয়। অনেকক্ষণ ধরে দিতে হয়তো। আমি বললাম, ঠিক আছে, কথা না বলে চুপ করে থাকো। সারাদিন তো চুপ করেই আছি। একবার মাত্র মাইতিদা এসেছিলেন সেই ইঞ্জেকশন দেয়ার সময়। তারপর থেকেই তো একা বসে আছি। কথা বলবো কার সঙ্গে। উৎপলার সঙ্গে টুকটাক কথা বলে সময় কাটাতাম। কাল শেষ রাত থেকে তার অসুখটা বেড়েছে তাই তাকে ইনটেনসিভ কেয়ারে নিয়ে গেছে। আজ সকালে আমাদের ওয়ার্ডের পঁয়তাল্লিশ নম্বরের হাসিখুশী ভদ্র মহিলাটি মারা গেছেন। আমার কি যে খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আমিও মারা যাবো। প্রতিদিন এখানে কেউ না কেউ মরছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ছুটে পালিয়ে যাই কোথাও। আমি বললাম, কোথায় যেতে চাও তায়েবা। সে জবাব দিলো জানিনে। হঠাৎ তায়েবা আমার ডান হাতখানা ধরে বললো, আচ্ছা দানিয়েল ভাই, আপনার মনে আছে একবার ঝড়বিষ্টিতে ভিজে সপসপে অবস্থায় আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আমি বললাম, কি আশ্চর্য তায়েবা, আসার সময় পথে সে কথাটি আমারও মনে পড়েছে। সে উৎফুল্ল হয়ে ওঠার চেষ্টা করে বললো, বুঝলেন দানিয়েল ভাই, আপনার সঙ্গে আমার মনের গোপন চিন্তার একটা মিল রয়েছে। তায়েবা গুনগুন অস্কুটস্বরে সে গানের কলি দু’টো গাইতে থাকলো। আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরান সখা বন্ধু হে আমার।

জানেন দানিয়েল ভাই, গেন্ডারিয়ার বাড়ির জন্য আমার মনটা কেমন আনচান করছে। গতরাতে স্বপ্নে দেখেছি আমাদের পোষা ময়নাটি মরে গেছে। পাশের কাঠ ব্যবসায়ীর বাড়িতে রেখে এসেছিলাম। সেই অবধি মনটা হু হু করছে। এরকম বিষ্টির সময় বুড়িগঙ্গা কেমন ফেঁপেফুলে অস্থির হয়ে ওঠে। পানির সে কেমন সুন্দর চীৎকার। তিন বোন পাশাপাশি এক সঙ্গে ঘুমোতাম। দিনাজপুর থেকে মা আর বড়ো ভাইয়া এসে থাকতো। ছোটো ভাইটি সারাক্ষণ পাড়ায় ঝগড়াঝাটি মারামারি করে বেড়াতো। এখন জানিনে কেমন আছে। একটা যুদ্ধ লাগলো আর সব কিছু ওলোট পালোট হয়ে গেলো। এখানে আমি পড়ে আছি। দোলা গেছে তার গ্রুপের মেয়েদের সঙ্গে ট্রেনিং নিতে সেই ব্যারাকপুর না কোথায়। মা দিনাজপুরে। বড়ো ভাইয়া কোথায় খবর নেই। ইচ্ছে করেই তায়েবা ডোরার নাম মুখে আনলো না, পাছে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বরাবর দেখে আসছি তায়েবার কাছে গোটা পৃথিবী একদিকে আর ডোরা একদিকে। রেডিও কিংবা টিভিতে ডোরার রবীন্দ্র সঙ্গীতের যেদিন প্রোগ্রাম থাকতো, সে রিকশাভাড়া খরচ করে চেনাজানা সবাইকে বলে আসতো আজকের রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রোগ্রামটা শুনবেন, আমার বোন ডোরা গান গাইবে। আর ডোরাও ছিলো তায়েবার অন্তপ্রাণ। অতো বড়ো ডাগর মেয়েটি, তবু তায়েবাকে জড়িয়ে ধরে না ঘুমোলে ঘুম আসতো না। তায়েবা কাছে না বসলে খাওয়া হতো না। মাঝে মাঝে ডোরার পেটে কি একটা ব্যথা উঠতো। তখন তায়েবাকে সব কিছু বাদ দিয়ে ডোরার বিছানার পাশে হাজির থাকতে হতো। আজ তায়েবার এই অবস্থায় ডোরা কি করে প্রায় বুড়ো একজন মানুষের সঙ্গে দিল্লীহিল্লী ঘুরে বেড়াচ্ছে আমি ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারিনে। তায়েবা দু’চোখ বন্ধ করে আছে আমি এক রকম নিশ্চিত যে, সে ভোরার কথাই চিন্তা করছে।

গলা খাকারীর শব্দে পেছন ফিরে তাকালাম। গোবিন্দ বাইরে থেকে ফিরে এসেছে। তার হাতে একটা প্যাকেট। ডাক দিলো, এই যে দিদিমনি, নিন আপনার জিনিসপত্তর। এর মধ্যে সব আছে। আর ওই নিন পাঁচ টাকা চল্লিশ নয়া পয়সা ফেরত এসেছে। তায়েবা বললো, অনেকতো কষ্ট করলেন, গোবিন্দদা, এই টাকাটা তুমিই রাখো। গোবিন্দের ভাঙ্গা চোরা মুখমণ্ডলে খুশীর একটা চাপা ঢেউ খেলে গেলো। তায়েবা তার বিছানার ওপর প্যাকেটটা উপুর করলো। ভেতরের জিনিসপত্তর সব বেরিয়ে এসেছে। একটা ধুতি, মাঝামাঝি দামের একজোড়া বাটার স্যাণ্ডেল, সিগারেট, ম্যাচ আর তার নিত্য ব্যবহারের টুকিটাকি জিনিস। আমার দিকে তাকিয়ে তায়েবা কড়া হুকুমের সুরেই বললো, দানিয়েল ভাই, তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢোকেন পরনের ওই প্যান্ট খুলে ফেলে এই সাবানটা দিয়ে যেখানে যেখানে রাস্তার পানি লেগেছে ভালো করে রগড়ে ধুয়ে ফেলুন। এ পানির স্পর্শ বড়ো সাংঘাতিক। স্কীন ডিজিজ-টিজিজ হয়ে যেতে পারে। তারপর এই স্যাণ্ডেল জোড়া পরবেন। দয়া করে আপনার জুতোজোড়া ওইদিকের ডাস্টবিনে ফেলে আসুন ওটা তো আর কোনো কাজে আসবে না। আমি বললাম, তায়েবা আমি যে ধুতি পরতে জানিনে। এবার তায়েবা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো, আপনি এখনো ক্ষেতের কুমড়োই রয়ে গেছেন। কিছুই শেখেননি। অতো আঠারো রকমের প্যাঁচ গোচের দরকার কি? আপনি দু’ভজ দিয়ে সোজা লুঙ্গির মতো করেই পরবেন। যান, যান বাথরুমে ঢোকেন, অতো কথা শুনতে চাইনে। এদিকে ভিজিটিং আওয়ারের সময় ঘনিয়ে এলো।

আর কথা না বাড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। আমি ধুতিখানা লুঙ্গির মতো করে পরে বাইরে এসে জিগগেস করলাম, এখন ভেজা প্যান্টটা নিয়ে কি করি। তায়েবা বললো, কোণার দিকে চিপেটিপে রাখুন, যাবার সময় ব্যাগের ভেতর পুরে নিয়ে যাবেন। তারপর আমাকে আবার বাথরুমে প্রবেশ করতে হলো। শরীর ঘসেমেজে লুঙ্গির মতো করে ধুতিপরা অবস্থায় আমাকে দেখে তায়েবা মুখ টিপে হাসলো। আয়নার সামনে গিয়ে দেখে আসুন, আপনাকে এখন ফ্রেশ দেখাচ্ছে। আপনার এমন একটা কুৎসিত স্বভাব, সবসময় চেহারাখানা এমন কুৎসিত করে রাখেন, মনে হয় সাত পাঁচজনে ধরে কিলিয়েছে। তাকিয়ে দেখলে ঘেন্না করতে ইচ্ছে হয়। তায়েবা এ । কথা কম করে হলেও একশোবার বলেছে। কিন্তু আমার চেহারার কোনো সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। আমি বললাম, তায়েবা আমি বোধ হয় মানুষটাই কুৎসিত। আমার ভেতরে কোনো সৌন্দর্য নেই বাইরে ফুটিয়ে তুলবো কেমন করে? তায়েবা আমার কথার পিঠে বললো, তাই বলে কি চব্বিশঘণ্টা এমন গোমড়া মুখ করে থাকতে হবে, তারও কি কোনো কারণ আছে? সব মানুষেরই এক ধরনের না এক ধরনের দুঃখ আছে, তাই বলে দিনরাত একটা নোটিশ নাকের ডগায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে নাকি? এই যে আমাকে এই অবস্থায় দেখছেন, আমার কি দুঃখের অন্ত আছে, কিন্তু বেশতো আছি। যাক, এ পর্যন্ত বলে তায়েবা হাঁফাতে থাকলো।

আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে একজন সিরিয়াস রোগীর সঙ্গে কথা বলছি। আসলে আমি কথা কাটাকাটি করছি বুড়ীগঙ্গার পাড়ের তায়েবার সঙ্গে। সে তায়েবা আর এ তায়েবা এক নয়, একথা বার বার ভুলে যাই। গেন্ডারিয়ার বাসায় ভাই-বোন পরিবেষ্টিত তায়েবার যে রূপ, তার সঙ্গে বর্তমান তায়েবার আর কি কোনো তুলনা করা যেতে পারে? বড়ো জোর বর্তমান তায়েবা গেন্ডারিয়ার তায়েবার একটা দূরবর্তী ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মাত্র। গেন্ডারিয়ার বাড়িতে তায়েবাকে যে দেখেনি কখনো তার আসল রূপ ধরতে পারবে না। খাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে, রাঁধছে, বাড়ছে, বোনদের তত্ত্ব তালাশ করছে, কলেজে পাঠাচ্ছে, নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে সর্বত্র একটা ঘূর্ণির বেগ জাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। কখনো খলখল হাসিতে অপরূপা লাস্যময়ী, কখনো দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ছে। একে ধমক দিচ্ছে, তাকে শাসাচ্ছে, সদা চঞ্চল, সদা প্রাণবন্ত। আবার কখনো চুপচাপ গম্ভীর। তখন তাকে মনে হয়, সম্পূর্ণ ধরাছোঁয়ার বাইরে, অত্যন্ত দূরের মানবী। কোনো পুরুষের বাহুবন্ধনে ধরা দেয়ার জন্য যেনো তার জন্ম হয়নি। কোনো শাসন বারণ মানে না। দুর্বার গতিস্রোতে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়, এক জায়গায় আটকে রাখে কার সাধ্য। চেষ্টা যে করিনি তা নয়। প্রতিবারই প্রচণ্ড আঘাত করে সে নিজের গতিবেগে ছুটে গেছে। আবার যখন তাকে ছেড়ে আসতে চেষ্টা করেছি, সে নিজেই উদ্যোগী হয়ে কাছে টেনে নিয়েছে। যখন সে নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আকাশের তারকারাজি কিংবা বুড়িগঙ্গাতে ভাসমান নৌকার রাঙ্গা রাঙ্গা পালগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতো, তখন তাকে তারকার মতো সুদূর এবং রহস্যময় নদীতে চলমান রাঙ্গাপালের একটা প্রতীক মনে হতো। যেন কারো কোনো বন্ধনে ধরা দেয়ার জন্য সে পৃথিবীতে আসেনি। তায়েবার অনেক ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে আমি এসেছি। কতোদিন, কতোরাত্রি তার সঙ্গে আমার একত্রে কেটেছে। এ নিয়ে বন্ধু বান্ধবেরা আমাকে অনেক বিশ্রী ইঙ্গিত করেছে। তায়েবার নিজের লোকেরাও কম হাঙ্গামা হুজ্জত করেনি। এমনকি, তার অভিভাবকদের মনেও ধারণা জন্মানো বিচিত্র নয় যে আমি তাকে গুণ করেছি।

আমি কিন্তু তায়েবাকে কখনো আমার একথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। তার সঙ্গে সম্পর্কের ধরনটা কি, অনেক চিন্তা করেও নির্ণয় করতে পারিনি। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে আছে সে। চোখ দুটো সম্পূর্ণ বোজা। নিঃশ্বাস ফেলার সঙ্গে সঙ্গে নাকের দু’পাশটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার ডান হাতটা আমার মুঠোর মধ্যে। এই যে গভীর স্পর্শ লাভ করছি তাতে আমার প্রাণের তন্ত্রীগুলো সোনার বীণার মতো ঝঙ্কার দিয়ে উঠছে। এই স্পর্শ দিয়ে যদি পারতাম তার সমস্ত রোগবালাই আমার আপন শরীরে শুষে নিতাম। তার জন্য আমার সব কিছু এমন অকাতরে বিলিয়ে দেয়ার এই যে সহজ সরল ইচ্ছে- ওটাকে কি প্রেম বলা যায়? যদি তাই হয় আমি তাহলে তায়েবার প্রেমে পড়েছি। দানিয়েল ভাই, কথা বললো তায়েবা। তার চোখ দু’টো এখনো বোজা। কণ্ঠস্বরটা খুবই ক্ষীণ, যেনো স্বপ্নের ভেতর তার চেতনা ভাষা পেতে চেষ্টা করছে। আমি তার দুটো হাতই টেনে নিলাম। দানিয়েল ভাই, আবার ডাকলো তায়েবা। এবার তার কণ্ঠস্বরটি অধিকতরো স্পষ্ট। আমি বললাম, তায়েবা বলো। সে চোখ দুটো খুললো, শাড়ির খুঁটে মুছে নিলো। তারপর ধীরে, অতি ধীরে উচ্চারণ করলো, দানিয়েল ভাই, এবার যদি বেঁচে যাই, তাহলে নিজের জন্য বাঁচার চেষ্টা করবো। আমার বুকটা কেঁপে গেলো। বললাম, এমন করে কথা বলছো কেন? দানিয়েল ভাই, আমার অসুখটি এতো সোজা নয়। আপনি ঠিক বুঝবেন না, মৃত্যু আমার প্রাণের দিকে তাক করে আছে। এক সময় বোটা শুদ্ধ আস্ত হৃদপিণ্ডটি ছিঁড়ে নেবেই। বললাম, ছি ছি তায়েবা, কি সব আবোল তাবোল প্রলাপ বকছো। দানিয়েল ভাই, এই মুহূর্তটিতে এই কথাটিই আমার কাছে সব চাইতে সত্য মনে হচ্ছে। সারা জীবন আমি আলেয়ার পেছনে ছুটেই কাটিয়ে গেলাম। মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব সকলের সুখে হোক দুঃখে হোক একটা অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আমি তো হাওয়ার ওপরে ভাসছি। তারা হয়তো সুখ পাবে জীবনে, নয়তো দুঃখ পাবে, তবু সকলে নিজের নিজের জীবনটি যাপন করবে। কিন্তু আমার কি হবে, আমি কি করলাম? আমি যেনো স্টেশনের ওয়েটিং রুমেই গোটা জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। প্রতিটি মানুষ একটা জীবন নিয়েই জন্মায়। সে জীবনটাই সবাইকে কাটাতে হয়। কিন্তু জীবনযাপনের হিসেবে যদি ফাঁকি থাকে তাহলে জীবন ক্ষমা করে না। ডাক্তারেরা যাই বলুন, আমি তো জানি আমার অসুখের মূল কারণটা কি? এক সময় আমার জেদ এবং অভিমান দুইই ছিলো। মনে করতাম আমি অনেক কিছু ধারণ করতে পারি।

এখন চোখের জলে আমার সে অভিমান ঘুচেছে। দশ পনেরো বছর থেকে তো বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছি। এখন সেই বাংলাদেশ যুদ্ধ করছে, কিন্তু আমি কোথায়? আমার সব কিছু তো চোখের সামনেই ছত্রখান হয়ে গেলো। আমার মা কোথায়, ভাই-বোনেরা কোথায়, এখানে আমি একেবারে নিতান্ত একাকী। আপন রক্তের বিষে একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি। তার দু’চোখের কোণায় দু’ফোঁটা পানি দেখা দিলো, আমি রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিলাম। তায়েবা বললো, জানেন দানিয়েল ভাই, আগে আমি কোণাকানচি হিসেব করে চিন্তা করতে ঘৃণা করতাম। এখন নানা রকম চিন্তা আমার মাথায় ভর করে। মানুষ মরলে কোথায় যায়, মাঝে মাঝে সে চিন্তাও আমার মনে উদয় হয়। উৎপলা বলছে মানুষ মরলে তার আত্মা পাখি হয়ে যায়। আবার আরতিদি বলেন, এক জন্মে মানুষের শেষ নয়। তাকে বার বার জন্মাতে হয়। এসব বিশ্বাস করিনে, তবে শুনতে ভালোই লাগে। ধরুন কোনো কারণে আরো একবার যদি আমি জন্মগ্রহণ করি, তাহলে নিতান্ত সাধারণ মেয়ে হয়েই জন্মাবো। পরম নিষ্ঠা সহকারে নিজের জীবনটাই যাপন করবো। ঢোলা জামা পরা আঁতেলদের বড়ো বড়ো কথায়, একটুও কান দেবো না। আমি পেটুকের মতো বাঁচবো। খাবো, পরবো, সংসার করবো। আমার ছেলেপুলে হবে, সংসার হবে, স্বামী থাকবে। সেই সংসারের গণ্ডির মধ্যেই আমি নিজেকে আটকে রাখবো। কখনো বাইরে পা বাড়াবো না।

তায়েবার এ সমস্ত কথা আমার ভালো লাগছিলো না। বরাবরই জেনে এসেছি, সে বড়ো শক্ত মেয়ে। কখনো তাকে এরকম দেখিনি। এ কোন্ তায়েবার সঙ্গে কথা বলছি? জোর দিয়ে বলতে চাইলাম, তায়েবা এখনো সামনে তোমার ঢের জীবন পড়ে আছে, যেভাবে ইচ্ছে কাটাতে পারবে। কিন্তু আমার নিজের কানেই নিজের কণ্ঠস্বর বিদ্রুপের মতো শোনালো। তায়েবা বললো, না দানিয়েল ভাই, আপনাকে নিয়ে আর পারা গেলো না। আপনি দেখতে মিনমিনে হলে কি হবে, বড়ো বেশি একরোখা এবং গোঁয়ার। নিজে যা সত্য মনে করেন সকলের ওপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। সে জন্যই ভয় হয়, আমার মতো আপনার কপালেও অনেক দুঃখ আছে। আমার শরীরের খবর আমার চাইতে কি আপনি বেশি জানেন? আমি জানতে চাইলাম, আচ্ছা তায়েবা, তোমার অসুখটা কি? তায়েবা এবার ফোঁস করে উঠলো। কখনো জানতে চেয়েছেন আমার অসুখটা কি? আর অসুখের ধরন জেনে লাভ নেই, অসুখ অসুখই। তবু একটা ডাক্তারি নাম তো আছে। সেটা আমাকে বিরক্ত না করে ডঃ মাইতির কাছে জিগগেস করুন না কেনো। বললাম, ডঃ মাইতির কাছে গতকাল আমি জানতে চেয়েছিলাম, তোমার কি অসুখ। উল্টো তিনি আমাকেই প্রশ্ন করলেন, আমি জানি নাকি তোমার কি অসুখ। সেটা আপনি ডঃ মাইতির সঙ্গে বোঝাঁপড়া করুন গিয়ে। বিরক্ত হয়ে তায়েবা বিছানার উপর শরীরটা ছেড়ে দিলো।

ডঃ মাইতি আবার কি করলো হে? হাতে স্টেথেসকোপ দোলাতে দোলাতে ডঃ মাইতি কেবিনে প্রবেশ করলেন। দানিয়েল সাহেব, হাতখানা একটু বাড়িয়ে দিন, হ্যান্ডশেক করি। এই ঘোরতররা বিষ্টির মধ্যে চলে আসতে পেরেছেন। বাহ! সোজা মানুষ তো নয়। বোঝা গেলো চরিত্রের মধ্যে স্টার্লিং কোয়ালিটি আছে। শেকহ্যান্ডের পর বললাম, আপনার রোগির কি অনিষ্ট করলাম? নিশ্চয়ই, তাহলে ধরে নিচ্ছি আপনি গতকালের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন। আমি হাসলাম। তারপর তায়েবার দিকে তাকিয়ে জিগগেস করলেন, গিলছো না এখনো বাকি আছে। মাইতিদা ভাতের কথা তো একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। এতোক্ষণ দানিয়েল ভাইতে আমাতে ঝগড়া চলছিলো। ডঃ মাইতি বললেন, ঝগড়ার বিষয়বস্তু কি আগে বলো। তায়েবা বললো, মাইতিদা আপনি যেনো কেমন, ঝগড়া করতে গেলে আবার বিষয়বস্তুর দরকার হয় নাকি। যে ঝগড়ার বিষয়বস্তু নেই, তা আমি শুনবো না। ওসব কথা এখন রাখো। ওয়ার্ডে ডঃ ভট্টাচার্যির পা দেয়ার আগে তোমার বায়না করে আনা ওই ভাত মাছ তাড়াতাড়ি গিলে ফেলল। উনি এসে পড়লে একটা অনর্থ বাধাবেন। হঠাৎ আমার পরিধেয় বস্ত্র দেখে ডঃ মাইতির চোখজোড়া কৌতুকে ঝিকমিকিয়ে উঠলো। বাহ! দানিয়েল সাহেব দেখছি আপনার উন্নতি ঘটে গেছে। আমি একটুখানি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। বললাম, আমি সেই বৌবাজার থেকে এক কোমর পানির মধ্যে দিয়ে হেঁটে এসেছি তো। তিনি জিগগেস করলেন, এই ঘোলাজলের সবটুকু পথ কি আপনি নিজের পায়ে হেঁটে এসেছেন? আমি মাথা দোলালাম। এখানে এসে দেখি প্যান্ট ময়লায় ভরে গেছে, আর পা থেকে জুতো নামাতেই সোলদুটো খসে পড়লো। তায়েবা টাকা দিয়ে হাসপাতালের গোবিন্দকে পাঠিয়ে এই ধুতি আর স্যান্ডেল জোড়া কিনে এনেছে। তাহলে দিদিমনির দান দক্ষিণে করারও অভ্যেস আছে। বাহ! বেশ বেশ। তার কথাতে কেমন জানি লজ্জা পাচ্ছিলাম। এই লজ্জার হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যই বলে বসলাম, ধুতি প্যাঁচগোচ দিয়ে পরতে জানিনে। তাই দু’ভাঁজ করে লুঙ্গির মতো করে পরেছি। ঠিক আছে, বেশ করেছেন, আজ হাসপাতাল থেকে যাওয়ার পথে আমার বাসা হয়ে যাবেন, আপনাকে ধুতি পরা শিখিয়ে দেবো। এ সুযোগে আপনার সঙ্গে একটু গপ্পোটপ্লোও করা যাবে। হ্যাঁ কি বলেন। বললাম, আমি তো আপনার কোয়ার্টার চিনিনে, কি করে যাবো। আরে মশায়, অতো উতলা হচ্ছেন কেননা, একটু ধৈর্য ধরুন প্রথমে আমি চিনিয়ে দেবো। তারপর তো আপনি যাবেন। ওই যে হাসপাতালের গেট। তার অপজিটে লাল দালানগুলো দেখছেন তার একটার দোতলাতে আমি থাকি। নাম্বারটা মনে রাখবেন একুশের বি। এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা দোতলায় উঠে বেল টিপবেন। আপনার জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকবো। কি চিনতে পারবেন তো? আমি বললাম, মনে হচ্ছে পারবো। মনে হচ্ছে কেন? আপনাকে পারতেই হবে। এটুকুও যদি না পারেন, কর্পোরেশনের লোকজনদের লিখবো যেনো আপনাকে শহর থেকে বের করে দেয়।

ডঃ মাইতি তায়েবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি খেতে আরম্ভ করো। আমি ওই দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। ডঃ ভট্টাচার্য যদি এসে পড়েন, আমি হাততালি দেবো। তুমি অমনি সব লুকিয়ে ফেলে বাথরুমে ঢুকে পড়বে। একেবাবে সব ধুয়েই তাঁর সামনে আসবে। দানিয়েল সাহেব যান, জলটল দিয়ে সাহায্য করুন। আমি একটা প্লেট ধুয়ে এনে দিলে তায়েবা মিটসেফ থেকে ব্যাগটা বের করলো, তারপর বাটিটা টেনে নিলো। ভাতগুলো প্লেটে নিয়ে অন্য বাটিটা থেকে কিছুটা মাছের তরকারি ঢেলে নিলো। তার মুখে একটা খুশি খুশি ভাব। জানেন, দানিয়েল ভাই, কতোদিন পরে আজ মাছভাত মুখে দিচ্ছি। বললাম, গতোকাল বলেছিলে এক মাস। হ্যাঁ সেরকম হবে। এক গ্রাস ভাত মুখে তুলে নিলো। তারপর হাতখানা ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। আমি বললাম, চুপ করে অমন হাত ঠেকিয়ে আছে, খাচ্ছো না কেনো? না, খাবো না এই খাবার কি মানুষে খায়? কি রকম বিচ্ছিরি রান্না, মুখটা তেতো হয়ে গেলো। আহ্ মাইতিদা। ডাক্তার কেবিনের ভেতরে ঢুকলেন, কি হলো তায়েবা, ভাত খেতে চাইছিলে খাও। খেতে যে পারছিনে, সব তেতো লাগে যে। তার আমি কি করবো। তেলমশলা ছাড়া শুধু হলুদজিরের রান্না আপনি খেতে পারবেন, দানিয়েল ভাই। মাছগুলো লবণমরিচ দিয়ে ভাজা করে আনতে পারলেন না। আপনি কিছুই বোঝেন না। আমি বললাম, তা ঠিক আছে। কাল মাছ ভেজে এনে দেবো। হ্যাঁ তাই দেবেন। তায়েবা হাত ধুয়ে ফেললো। ডঃ মাইতি বললেন, আপনার ভাত মাছ বিজনেস এখানেই শেষ। তারপরেও এসকল জিনিস এ কেবিনে যদি আবার আসে, তাহলে আপনার হাসপাতালে আসাটাই বন্ধ করতে হয়। তায়েবা চুপচাপ রইলো। আমার ধারণা ডঃ মাইতির ব্যবস্থাটি মেনে নিয়েছে। ডঃ মাইতি আমাকে বললেন, এক কাজ করুন, এই ভাতমাছ যা আছে সব বাটির ভেতর ভরে ওধারের ডাস্টবিনের ফেলে দিয়ে আসুন তাড়াতাড়ি। আমি বাক্যব্যয় না করে তাঁর নির্দেশ পালন করলাম। বাটি প্লেট সব ধুয়ে নেয়ার পর ডঃ মাইতি বললেন, এবার আমি চলি দানিয়েল সাহেব, মনে থাকে যেনো। সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার সময়। আমি বললাম, থাকবে। উনি চলে গেলাম।

আমি তায়েবাকে জানালাম, ডঃ মাইতি সাতটা সাড়ে সাতটার সময় আমাকে তাঁর কোয়ার্টারে যেতে বলেছেন। যাবো? অবশ্যই যাবেন। তিনি আর দীপেনদা আমার জন্য যা করছেন দেশের মানুষ আত্মীয়স্বজন তার এক ছটাক, এক কাচ্চাও করেনি। আমি জানতে চাইলাম, দীপেন লোকটি কে? তায়েবা বললো, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই তো আমাকে চেষ্টা তদবির করে এ হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। আপনি চিনবেন কেমন করে। আর আপনারা সব নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। আমি মারা গেলাম, বেঁচে রইলাম, তাতে কার কি এসে যায়। আমি জবাব দিলাম না। তায়েবার অনেক রাগ, অনেক অভিমান। তাকে ঘাটিয়ে লাভ নেই। অনাবশ্যক রাগারাগি করে অসুখটা বাড়িয়ে তুলবে। এখন তো প্রায় ছ’টা বাজে। তোমার ডাক্তার আসার সময় হয়েছে। আজ আমি আসি। আবার আসবেন। আমি বললাম, আসবো। প্যান্ট আর বাটিসহ ব্যাগটা নিয়ে যাই। প্যান্ট নিয়ে এখন আর কাজ নেই। নতুন একটা বাসায় যাচ্ছেন। আমি গোবিন্দদাকে দিয়ে কাল লঞ্জিতে পাঠিয়ে দেবো। এক কাজ করুন। ব্যাগ বাটি এসবও রেখে যান। বরং কাল এসে নিয়ে যাবেন।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে দেখলাম, মাত্র সোয়া ছটা। ডঃ মাইতির কোয়ার্টারে সাত থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে যে কোনো সময়ে গেলে হবে। আমার ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। সেই আড়াইটার সময় বেরিয়ে এতোটা পথ হেঁটে এসেছি। তারপর এতোক্ষণ সময় কাটালাম। পেটে কিছু পড়েনি। সারাটা সময় এরকম ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা ভুলেই ছিলাম। একটা খাবার দোকান তালাশ করতে লাগলাম। এদিকে দোকানপাটের সংখ্যা তেমন ঘন নয়। তাই বাঁক ঘুরে ভবানীপুর রোডে চলে এলাম একটা সুবিধেজনক খাবার ঘরের সন্ধান করতে। হাজরা রোডের দিকে ধাওয়া করলাম। যে দোকানেই যাই, প্রচণ্ড ভিড়। ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়তে আমার কেমন জানি প্রবৃত্তি হচ্ছিলো না। নিশীথে পাওয়া মানুষের মতো আমি পথ হাঁটছি। অবশ্য বিশেষ অসুবিধে হচ্ছে না। অনেক আগেই বিষ্টি ধরে গেছে। এদিকটাতে রাস্তাঘাটের অবস্থা একেবারে খটখটে শুকনো। কোলকাতার টুকরো টুকরো খণ্ড খণ্ড আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে তারা জ্বলছে। দু’পাশের দোকানপাটে ধুমধাম কেনাবেচা চলছে। ঢ্যাকর ঢ্যাকর করে ট্রাম ছুটছে। বাস, লরি,ট্রাক, কার এসব যন্ত্রযানের বাঁশি অনাদ্যন্ত রবে বেজে যাচ্ছে। মানুষের স্রোততো আছেই। তারা যেনো অনাদিকাল থেকেই শহর কোলকাতার ফুটপাতের ওপর দিয়ে উজানভাটি দুই পথে ক্রমাগত প্রবাহিত হচ্ছে। মোড়ের একটা স্যান্ডউইচের দোকানে গিয়ে দু’খানা প্যাটিস আর ঢক ঢক করে পানি খেয়ে নিয়ে ডঃ মাইতির কোয়ার্টারের উদ্দেশ্য হাঁটতে লাগলাম। কোন দিকে যাচ্ছি খেয়াল নেই। শুধু পা দুটো আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কোলকাতায় আসার পর থেকে আমার পা দুটোর চোখ ফুটে গেছে।

সাতটার ওপরে বোধ করি কয়েক মিনিট হবে। আমি ডঃ মাইতির কোয়ার্টারে এসে বেল টিপলাম। একটি ছোকরা চাকর দরোজা খুলে দিয়ে জানতে চাইলো, কাকে চান? আমি জানতে চাইলাম, ডঃ মাইতি আছেন? আছেন, আমি ভেতরে প্রবেশ করে একটা বেতের সোফায় বসে সিগারেট জ্বালালাম। বসবার ঘরের আসবাবপত্তরের তেমন বাহুল্য নেই। কয়েকখানি বেতের সোফা এবং একই ধরনের চাদর ও খাটের ওপর পাতা চাদরটি খুবই সুন্দর এবং মধ্যিখানে একটি বেতের টেবিল। টেবিলের ওপর পাতা চাদরটি খুবই সুন্দর এবং একই ধরনের চাদরও খাটের ওপর পাতা দেখলাম। ওপাশে পুরোনো একটি ক্যাম্প খাট দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে। দেয়ালে একজোড়া বুড়োবুড়ির ছবি টাঙ্গানো। চিনতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, ডঃ মাইতির মা বাবা। তাছাড়া আছে রবীন্দ্রনাথের একটা বড়ো আকারের ছবি। রবীন্দ্রনাথের বিপরীতে বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ এবং মহাত্মা গান্ধীর ছবি। ওষুধ কোম্পানীর দু’টো ক্যালেন্ডার, উত্তর দক্ষিণের দু’টি দেয়ালে পরস্পরের দিকে মুখ করে ঝুলছে। এ ছাড়া এনলার্জ করা একটি গ্রুপ ফটো আছে। গাউন পরা একদল যুবকের ছবি। একটুখানি চিন্তা করলেই মনে পড়ে যাবে মেডিক্যাল কলেজের সার্টিফিকেট গ্রহণ করার সময় এই ছবিখানি ওঠানো হয়েছিলো। একেবারে কোণার দিকে হাতঅলা একটি চেয়ার এবং সামনে একটি টেবিল। ডঃ মাইতি জিগগেস করলেন, চিনতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো। আমি বললাম, না। তিনি ডাক দিলেন, অনাথ। আবার সে ছেলেটি এসে দাঁড়ালে বললেন, চা দাও। আর শোনো এই বাবু আমাদের সঙ্গে খাবেন এবং রাত্তিরে থাকবেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কৌতুক মিশ্রিত স্বরে বললেন, দেখলেন তো কেমন, বাড়িতে এনে গ্রেপ্তার করে ফেললাম। সহসা আমার মুখে কোনো উত্তর যোগালো না। তিনি ফের জিগগেস করলেন, আপনার কি তেমন জরুরী কাজ আছে। আজ রাত্তিরে এখানে থাকলে কোনো বড়ো ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে কি? জবাব দিলাম, না, তেমন কোনো কাজ নেই। আপনার কি আজ রাতটা আমার সঙ্গে গল্প করে কাটাতে আপত্তি আছে? বারে আপত্তি থাকবে কেনো, এখন আমাদের যে অবস্থা, কে আবার আমার খবর নেবে। দানিয়েল সাহেব, এভাবে কথা বলবেন না। মনে রাখবেন, আপনারা একটি মুক্তিসংগ্রাম করছেন। আমি ডাক্তার মানুষ অধিক খোঁজ খবর রাখতে পারিনে। তায়েবাকে দেখতে হাসপাতালে যেসব ছেলে আসে, তাদের অনেকের দৃষ্টির স্বচ্ছতা এবং অদম্য মনোবল লক্ষ্য করেছি। আপনাদের গোটা জাতি যে ত্যাগতিতিক্ষার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। মানুষের সব চাইতে মহত্তম সম্পদ তার চরিত্র, সে বস্তু আপনার দেশের অনেক যুবকের মধ্যে আমি বিকশিত অবস্থায় দেখেছি। কোনো কোনো সময়ে আপনাদের প্রতি এমন একটা আকর্ষণ অনুভব করি, ভুলে যাই যে, আমি একজন ভারতীয় নাগরিক। আমি কখনো বাংলাদেশে যাবো না। পুরুষানুক্রমে আমরা পশ্চিমবাংলার অধিবাসী। পদ্মার সে পাড়ের মানুষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কখনো ছিলো না। কিন্তু আপনার দেশের মুক্তিসংগ্রাম শুরু হওয়ার পর থেকে আমার নিজের মধ্যেই একটা পরিবর্তন অনুভব করছি। একদিনে কিন্তু সে পরিবর্তন আসেনি। ক্রমাগত মনে হচ্ছে আমি নিজেই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের একটা অংশ। এখন আমার ভারতীয়সত্তা আর বাঙালিসত্তা পরস্পরের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এখন বাঙালি বলে ভাবতে আমার খুব অহঙ্কার হয়। আপনার দেশ যুদ্ধে না নামলে আমার এ উপলব্ধি জন্মাতো কিনা সন্দেহ। কথাগুলো লিটারেল অর্থ ধরে নেবেন না। এটা জাস্ট একটা ফিলিংয়ের ব্যাপার।

আমি বললাম, বাংলা এবং বাঙালিত্বের প্রতি পশ্চিমবাংলার সকল শ্রেণীর মানুষের একটা অতুলনীয় সহানুভূতি এবং জাগ্রত মমত্ববোধ আছে বলেই এখনো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শিরদাঁড়া উঁচু করে থাকতে পেরেছে। পশ্চিমবাংলার বদলে যদি গুজরাট কিংবা পাঞ্জাবে বাংলাদেশের জনগণকে আশ্রয় গ্রহণ করতে হতো, ভারত সরকার যতো সাহায্যই করুক না কেনো, আমাদের সংগ্রামের অবস্থা এখন যা তার চাইতে অনেক খারাপ হতো। পশ্চিম বাংলার মানুষের প্রাণের আবেগ, উত্তাপ এবং ভালোবাসা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে প্রাণবন্ত এবং সজীব রেখেছে। ছেলেটা চা দিয়ে গেলো। আপনার কাপে কচামচ চিনি এবং কতোটুকু দুধ দেবো বলুন। বললাম, দুধ আমি খাইনে! দু কি আড়াই চামচ চিনি দেবেন। হো হো করে হেসে উঠলেন, ডঃ মাইতি। একটা বিষয়ে দেখছি আপনার সঙ্গে আমার চমৎকার মিল আছে। আমিও চায়ের সঙ্গে দুধ খাইনে।

চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, আমি মুখ মানুষ। প্রোফেশনের বাইরে গেলেই নাচার হয়ে পড়ি। আপনার মতো একজন স্কলার মানুষের সঙ্গে কি নিয়ে কথা বলবো, মশায় সাবজেকট খুঁজে পাচ্ছিনে। আবার সেই হো হো হাসি। আমি বললাম, আপনিও তাহলে তায়েবার কথা বিশ্বাস করে আছেন। এসএসসি থেকে এমএ পর্যন্ত সবগুলো পরীক্ষায় কখনো বিশের মধ্যে থাকার ভাগ্যও আমার হয়নি। তায়েবা যাদেরকে চেনেজানে একটুখানি খাতির করে। তাদের সম্পর্কে বাড়িয়ে বলে, এটাই তার স্বভাব। আমার ব্যাপারে এই পক্ষপাতটুকু এতোদূর মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো যে আমার নিজের কান পর্যন্ত গরম হয়ে উঠেছিলো। এনিয়ে তার সঙ্গে আমার অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছে। ডঃ মাইতি বললেন, আপনার ব্যাপারে তার একটা লাগাম ছাড়া উচ্ছ্বাস এরই মধ্যে আমি লক্ষ্য করেছি। আপনাকে স্কলার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়, আপনি বিষ্টিতে কাপড়জামা ভিজিয়ে এলে বাজার থেকে লোক পাঠিয়ে নতুন কাপড়জামা কিনে আনে। এগুলো কি একজন রোগির পক্ষে বাড়াবাড়ি নয়? আসলে আপনাদের সম্পর্কটা কী রকম। আপনি যদি জবাব না দেন আমি অবাক হবো না।

বললাম, ডঃ মাইতি জবাব দেবো না কেনো? লোকে তো বন্ধুজনের কাছেই প্রাণের গভীর কথা প্রকাশ করে। আপনাকে আমি একজন বন্ধুই মনে করি। তায়েবার সঙ্গে আমার সম্পর্কের ধরনটা কি নিজেও আমি ভালো করে নির্ণয় করতে পারিনি। আমার ধারণা সে আমাকে করুণা করে। এই যুদ্ধটা না বাধলে, বিশেষ করে বলতে গেলে এই অসুখটা না হলে তার সঙ্গে আমার দেখা হতো কিনা সন্দেহ। সে তার পার্টির কাজকর্ম নিয়ে থাকতো। আমি আমার কাজ করতাম। তিনি ফের জানতে চাইলেন, আপনাদের মধ্যে একটা হৃদয়গত সম্পর্ক আছে এবং সেটা গভীর, একথা কি অস্বীকার করবেন? ডঃ মাইতি, ও বিষয়টা নিয়ে নিজেও অনেক চিন্তা করেছি, কিন্তু কোনো কুলকিনারা পাইনে। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে একটা গভীর সম্পর্ক আছে, কিন্তু পরক্ষণে মনে হয়েছে, না কিছুই নেই। সকাল বেলার শিশির লাগা মাকড়সার জাল যেমন বেলা বাড়লে অদৃশ্য হয়ে যায়, এও অনেকটা সেরকম। সে তার পার্টি ছাড়তে পারবে না। কেনোনা তার অস্তিত্বের সবটাই তার পার্টির মধ্যে প্রোথিত। আর আমার চরিত্র এমন কোনো বিশেষ পার্টির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো মোটেই উপযুক্ত নয়। এতে সব গোঁজামিলের মধ্যে হৃদয়গত একটা সম্পর্ক কেমন করে টিকে থাকতে পারে, আমার তো বোধগম্য নয় ডাঃ মাইতি। ডাক্তার হাততালি দিয়ে উঠলেন, এই খানেই তো মজা। মানুষ ভয়ানক জটিল যন্ত্র। তার হৃদয় ততোধিক জটিল। অতো সহজে কিছু ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। আচ্ছা দানিয়েল সাহেব, আপনি কি রাজনীতি করেন? বললাম, মানুষ সব সময়ে তো একটা না একটা রাজনীতি করে আসছে। আমি তা এড়াবো কেমন করে? কিন্তু আমি কোনো পার্টির মেম্বার নই। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যদি আমার যথাসর্বস্ব দাবি করে, না দিয়ে কি পারবো? আমি সহজ মানুষ, অতো ঘোরপ্যাঁচ বুঝিনে।

ডঃ মাইতি টেবিলে একটা টোকা দিয়ে বললেন, এমনিতে আমি সিগারেট খাইনে। কিন্তু আপনার কথা শুনে একটা সিগারেট টানতে ইচ্ছে করছে। একটা চারমিনার জ্বালিয়ে টান দিয়ে খক খক করে কেশে ফেললেন। মশায়, বললেন তো খুব সহজ মানুষ। আসলে আপনি জটিল এবং দুর্বোধ্য মানুষ। কিন্তু বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। হয়তো তাই, সব মানুষই একটা না একটা দিকে দুর্বোধ্য, আমরা খেয়াল করিনে। আরে মশায় ওসব গভীর কথা এখন তুলে রাখুন। আপনাকে একটা সিম্পল প্রশ্ন জিগগেস করি, ইচ্ছে করলে আপনি জবাব নাও দিতে পারেন। আমি বললাম, নিশ্চয়ই জবাব দেবো, বলুন আপনার প্রশ্নটা। ডঃ মাইতি স্থির চোখে তাকিয়ে বললেন, তায়েবার সঙ্গে পরিচয়ের পর অন্য কোনো নারীকে কি আপনি। ভালোবেসেছেন? আমি বললাম, না তা হয়নি। কেনো বলুন তো? হয়তো পরিবেশ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি বলেই। অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসার কথা কখনো আপনার মনে এসেছে? না, তাও আসেনি। আচ্ছা মেনে নিলাম, অন্য কারো সঙ্গে প্রেমে পড়ার কথা চিন্তা করতে পারেননি। অন্ততঃ বিয়েটিয়ের ব্যাপারে কখনো সিরিয়াস হতে চেষ্টা করেছেন কি? আমি বললাম, তাও করিনি। আত্মীয়স্বজন বার বার চাপ দিয়েছে বটে, কিন্তু আমি বার বার এড়িয়ে গেছি। ধরে নিন, এটা এক ধরনের আলসেমী। আপনি একজন পূর্ণবয়স্ক যুবক মানুষ। আপনার কোনো খারাপ অসুখটসুখ নেই তো? কিছু মনে করবেন না। আমি একজন ডাক্তার। ডাক্তারের মতো প্রশ্ন করছি। আমি বললাম, শরীরের ভেতরের ব্যাপারস্যাপার সম্পর্কে তো স্থির নিশ্চিত হয়ে কিছু বলার ক্ষমতা আমার নেই। এমনিতে কোনো রোগটোগ আছে বলে তো মনে হয় না।

ডঃ মাইতি বললেন, এবার আমার কথা বলি। দয়া করে একটু শুনবেন কি? নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, আপনি বলুন। তাহলে শুনুন, প্লেন এ্যান্ড সিম্পল টুথ। তায়েবার প্রতি আপনার মনের অবচেতনে গভীর ভালোবাসা রয়েছে বলে অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসা বা বিয়ে করার কথা আপনি চিন্তাও করতে পারেননি। তার দিক থেকে হোক, আপনার দিক থেকে তোক বাস্তব অসুবিধে ছিলো অনেক, যেগুলো ডিঙোবার কথা ভাবতেও পারেননি। আমি বললাম, নদীতে বাঁধ দেয়ার কথা বলা যায়, কেনোনা নদীতে বাঁধ দেয়া সম্ভব। কিন্তু সমুদ্র বন্ধন করার কথা কেউ বলে না, কেনোনা তা অসম্ভব। আমার আর তায়েবার ব্যাপারটিও অনেকটা তাই।

ডঃ মাইতি বললেন, তায়েবা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে প্রায় এক মাস হয়। আপনি তো মাত্র গতকাল থেকেই দর্শন দিচ্ছেন। এই এক মাসে তার সম্পর্কে ডাক্তার হিসেবে আমার কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এসে ধরে বসলেন, বাংলাদেশের একজন রোগিকে ভর্তি করতেই হবে। ডঃ ভট্টাচার্যি কিছুতেই রাজী হচ্ছিলেন না। কারণ, হাসপাতালে খালি বেড ছিলো না। শেষ পর্যন্ত আমার অনুরোধেই তিনি রাজী হলেন। মেয়েটাকে প্রথম থেকেই দেখে আমার কেমন জানি অন্যরকম মনে হয়েছিলো। এক মাস খুব দীর্ঘ সময় নয়। তবু এ সময়ের মধ্যে তাকে নানাভাবে জানার সুযোগ আমার হয়েছে। সত্যি বলতে কি, এ রকম স্বার্থবোধ বর্জিত মেয়ে জীবনে আমি একটিও দেখিনি। আমি বললাম, আমিও দেখিনি। এ ব্যাপারেও দেখেছি আপনার মতের সঙ্গে আমার মতের কোনো গরমিল নেই। সে যাক, শুনুন। তায়েবাকে দেখতে হাসপাতালে নানারকম মানুষ আসে। তার যতো কমপ্লেইন থাকুক, সকলের সঙ্গে যথা সম্ভব প্রাণখোলা কথাবার্তা বলে, হাসি ঠাট্টা করে। কখনো কারো কাছ থেকে কিছু দাবি করতে দেখিনি। দেখলাম, একমাত্র আপনার কাছেই তার দাবি। আপনাকেই ভাতমাছ রান্না করে আনতে বললো। আপনার কথা প্রায় প্রতিদিন আমাকে বলেছে। তবুও আপনি যখন এলেন দেখলাম আপনার সঙ্গেই ঝগড়া করছে। যদি আমি ধরে নেই যে তায়েবা আপনাকেই ভালোবাসে, তাহলে কি আমি অন্যায় করবো? আমি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তারপর হাসতে চেষ্টা করলাম। হয়তো, হবেও বা। ধন্যবাদ, ফুল চন্দন পড়ুক আপনার মুখে ডঃ মাইতি। আপনি মশায় চমৎকার কথা বলতে জানেন। কথার মারপ্যাঁচে ফসকে যাবেন তেমন সুযোগ আপনাকে দিচ্ছিনে। আপনি কি ভেবেছেন শুধু শুধুই আপনাকে বাড়িতে ডেকে এনেছি। আপনার সঙ্গে আমার মস্ত দরকার। যাক, ডঃ মাইতি আপনি আমার নিজের মূল্যটা আমার কাছে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিলেন। এই কোলকাতা আসা অবধি কেউ আমাকে বলেনি, আমার সঙ্গে কারো দরকার আছে। নিজের দরকারেই সকলের কাছে সকালসন্ধ্যা ঘুরে বেড়াচ্ছি। তা বলুন, আপনার দরকারটা কি? শুনে হৃদয় ঠাণ্ডা করি। মশায় অতো রাগ কেনন? শুনবেন, শুনবেন অতো তাড়াহুড়া কিসের? আগে রাতের খাবারটা খান। এখনো তো সবে ন’টা বাজে। তারপর ডাক দিলেন, অনাথ। সে ছেলেটি এসে দাঁড়ালো। খাবার হয়েছে রে। ডালটা এখনো নামানো হয়নি। যা তাড়াতাড়ি কর।

আমি জিগগেস করলাম, ডঃ মাইতি আপনি কোয়াটারে একাই থাকেন? একা মানুষ, একাই তো থাকবে। আপনি বিয়ে করেননি? না মশায়, সে ফাঁদে আজো পা দেইনি। আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন? ভালোবাসাটাসা আমাকে দিয়ে পোষাবে না। হঠাৎ করে কাউকে বিয়ে করে ফেলবো। এখনো করেননি কেনো? প্লেন এ্যাণ্ড সিম্পল টুথ হলো, এখনো সবগুলো বোনের বিয়ে দেয়া হয়নি। মশায় আপনি আর কোনো কিছু জিগগেস করবেন না। আপনাকে আমার প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য নেমন্তন্ন করে এনেছি। আপনি যদি আমার কথা শুনতে চান যেয়ে সব কথা বলে আসবো। আমি বললাম, ডঃ মাইতি, আমাদের থাকার কোনো স্থির ঠিকানা নেই। কোথায় আপনাকে ডাকবো? তিনি বললেন, যখন আপনার দেশ স্বাধীন হবে তখন ডাকবেন। আমার যত কথা সব জানিয়ে আসবো। আর আপনার দেশটাও দেখে আসবো। আচ্ছা, বাই দ্যা বাই, তায়েবার মা, ভাই, বোন উনারা কোথায় আছেন বলতে পারেন? আমি বললাম, তার ইমিডিয়েট একটা ছোটো বোনের বিয়ে হয়েছিলো, সেটি ছাড়া আর মোটামোটি সকলের সংবাদ পেয়েছি। তায়েবার ছোটো ভাইটি ঢাকায়। বড়ো ভাই দিনাজপুরে ছিলেন শুনেছি। সেখান থেকে শুনেছি সীমান্ত অতিক্রম করেছে। আর ওরা তো তিন বোন কোলকাতা এসেছে। এক বোন ব্যারাকপুর না কোথায় অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে ট্রেনিং নিচ্ছে। একেবারে ছোট্টোটি একটা এক্সিডেন্ট করে বসেছে। কি নাম বলুন তো দানিয়েল সাহেব, আই থিঙ্ক আই নো হার। আমি বললাম, ডোরা। ডোরা তো একজন বুড়ো মতো ভদ্রলোককে নিয়ে মাঝে মাঝে হাসপাতালে তায়েবাকে দেখতে আসে। হঠাৎ করে আমি মেজাজ সংযম করতে পারলাম না। তাহলে ডোরাসহ ভদ্রলোক এখনো তায়েবার কাছে আসতে সাহস করেন? একটুখানি চোখলজ্জাও নেই। আরে মশায় আপনি ক্ষেপে গেলেন যে! আগে কি ব্যাপার বলেন তো। আমি বললাম, ঐ যে ভয়ঙ্কর ভদ্রলোক দেখেছেন তিনি ডোরাকে বিয়ে করে ফেলেছেন। ঢাকাতে ঐ ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রী ছিলেন তায়েবাদের অভিভাবক। মহিলা শশীকান্ত নামের তার মেয়ের এক গৃহশিক্ষককে নিয়ে শান্তিনিকেতনে ললিতকলা চর্চা করতে গেছেন। আর এদিকে ইনি পাল্টাব্যবস্থা হিসেবে ডোরাকে বিয়ে করে বসে আছেন। আমার বিশ্বাস তায়েবার অসুখ বেড়ে যাওয়ার এটাই একমাত্র কারণ। তাছাড়া আমি আরো শুনেছি মুখের অন্ন জোটাবার জন্য তায়েবাকে অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনটে করে ট্যুইশনি করতে হয়েছে। এই মানুষেরা সে সময় কোথায় ছিলেন? তায়েবার কি অসুখ আমি সঠিক বলতে পরবো না, তবে কথাটা সঠিক বলতে পারি অমানুষিক পরিশ্রম না করলে এবং কাণ্ডটি না ঘটালে তার আজ এ অবস্থা হতো না। এই লোকগুলোর নিষ্ঠুরতার কথা যখন ভাবি মাথায় খুন চেপে যায়। অথচ এরাই ঢাকাতে আমাদের কাছে আদর্শের কথা প্রচার করতো। আপনি অনেক আনকোরা তরুণের মধ্যে জীবনের মহত্তর সম্ভাবনা বিকশিত হয়ে উঠতে দেখেছেন, একথা যেমন সত্যি, তেমনি পাশাপাশি একথাও সত্য যে যুদ্ধের ফলে অনেক প্রতিষ্ঠিত মহাপুরুষের খোলস ফেটে খান খান হয়ে পড়েছে এবং আমরা এতোকালের ব্যাঘ্ৰ চৰ্মাবৃত ছাগলের চেহারা আপন স্বরূপে দেখতে পাচ্ছি। শরণার্থী শিবিরগুলোতে আমাদের মানুষের দুর্দশার সীমা নেই। ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোতে আমাদের তরুণ ছেলেরা হাজার রকমের অসুবিধের সম্মুখীন হচ্ছে। দেশের ভেতরের কথা না হয় বাদই দিলাম। এখানে কোলকাতায় সাদা কাপড়চোপড় পরা ভদ্রলোকের মধ্যে স্থলন, পতন, যতো রকমেই নৈতিক অধঃপতন হচ্ছে, তার সবগুলোর প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি। এখানে যত্রতত্র শুনতে পাচ্ছি, বুড়ো, আধবুড়ো মানুষেরা যত্রতত্র বিয়ে করে বেড়াচ্ছে। পাকিস্তানী সৈন্যদের নিষ্ঠুরতার কথা আমাদের জানা আছে। মাঝে মাঝে এই ভদ্রলোকদের তার তুলনায় কম নিষ্ঠুর মনে হয় না। আমি নিশ্চিত বলতে পারি তায়েবার সঙ্গে এরা কসাইয়ের মতো ব্যবহার করেছে। আমি জানি সে আমাকে কোনোদিন সেসব কথা জানতে দেবে না। এমন কি হাজার অনুরোধ করলেও না। আর আমিও জিজ্ঞেস করবো না। তবে একথা সত্যি যে তায়েবা যদি মারা যায় সেজন্য এঁরাই দায়ী। কিন্তু দুনিয়ার কোনো আদালতে সে মামলার বিচার হবে না।

ডঃ মাইতি নিঃশ্বাস ফেললেন। আপনার অনুমান অনেকটা সত্য। অতিরিক্ত পরিশ্রম এবং টেনশনই তার অসুখটার বাড়াবাড়ির কারণ। যাকগে, যা হয়ে গেছে তার ওপর আপনার তো কোনো হাত নেই। কিন্তু এখন কথা হচ্ছে তায়েবাকে নিয়ে। তার জন্য আপনি কি করতে পারেন? আমি বললাম, মাইতিদা নিজের চোখেই তো দেখতে পাচ্ছেন আমি কি অসহায়। আজ রাতে যেখানে ঘুমাই, কাল রাতে সেখানে যেতে পারি না। এখানে স্রোতের শেওলার মতো আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি। পঞ্চাশ পয়সা ট্রাম ভাড়া বাঁচাবার জন্য ছয় সাত মাইল পথ হাঁটতে আমাদের বাধে না। আজ যদি চোখের সামনে তায়েবা মারাও যায়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য অবলোকন করা ছাড়া আমার করার কি থাকবে? তবে একটা দুঃখ থেকে যাবে। তায়েবা আপন চোখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারবে না। স্বাধীনতা-অন্ত প্রাণ ছিলো তায়েবার। আলাপে আলোচনায় কথাবার্তায় দেখে থাকবেন, তার নামটি কি রকম কম্পাসের কাঁটার মতো স্বাধীনতার দিকে হেলে থাকে। উনিশশো উনসত্তরের আয়ুববিরোধী আন্দোলনে তায়েবা নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করেছিলো। আমার ব্যক্তিগত লাভক্ষতি সেটা ধর্তব্যের বিষয় নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সে দেখে যেতে পারবে না, এটাই আমার বুকে চিরদিনের জন্যে একটা আফশোসের বিষয় হয়ে থাকবে। আমি মিনতি করে জানতে চাইলাম, আচ্ছা মাইতিদা, আপনি কি দয়া করে জানাবেন, তায়েবার অসুখটা কি ধরনের? খুব কি সিরিয়াস? তিনি বললেন, আমি তো ভেবেছিলাম আপনি শক্ত মানুষ। এখন দেখছি মেয়ে মানুষের চাইতে দুর্বল। আগে থেকে কাঁদুনি গাইতে শুরু করেছেন। আচ্ছা ধরুন, তায়েবা মারা গেলো। তখন আপনি কি করবেন? আত্মহত্যা করবেন? আমি জবাব দিলাম, তা করবো না, কারণ সে বড়ো হাস্যকর হয়ে দাঁড়াবে। তাহলে কি করবেন? বসে বসে কাঁদবেন? আমি বললাম, তাও বোধ হয় সম্ভব হবে না। এইখানে এই কোলকাতা শহরে বসে বসে কাদার অবকাশ কোথায়? বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মানুষের কাদবার যথেষ্ট সঙ্গত কারণ আছে। অনেকেই তাদের প্রিয়জন হারিয়েছে। আমিও না হয় তাদের একজন হয়ে যাবো। আপনি তাহলে কিছুই করতে যাচ্ছেন? ডঃ মাইতি ফের জানতে চাইলেন। আমি বললাম, কি করবো, কি করতে পারি? আপনার দিন কাটবে কেমন করে? আমি বললাম, দিন তো একভাবে না একভাবে কেটে যাবে, শুধু মাঝে মাঝে বুকের একপাশটা খালি মনে হবে। মশায় এততক্ষণে আপনি একটা কথার মতো কথা বলেছেন। অনিবার্যকে মেনে নিতেই হবে। এই কথাটা বলার জন্য আপনাকে ডেকে আনা হয়েছে। এখন তায়েবার রোগ সম্বন্ধে আপনি জিগ্‌গেস করতে পারেন, আমি জবাব দিতে প্রস্তুত। আমি বললাম, বলুন। ডাক্তার ভাবলেশহীন কণ্ঠে জানালেন, লিউক্যামিয়া। জিগগেস করলাম, ওটা কি ধরনের রোগ। তিনি বললেন, ক্যান্সারের একটা ভ্যারাইটি। জিগগেস করলাম, খুব কি কঠিন ব্যাধি। হ্যাঁ, খুবই কঠিন। আমি বললাম, অন্তত যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত তায়েবা বেঁচে থাকবে তো। সে কথা আমি বলতে পারবো না। আমি একজন জুনিয়র ডাক্তার। ডঃ ভট্টাচার্য তাঁর টেস্টের রিপোর্ট বাঙ্গালোরে পাঠিয়ে অপেক্ষা করছেন। জানেন তো সেখানে ক্যান্সার ট্রিটমেন্টের একটা ওয়েল ইকুইপ সেন্টার আছে। সেখান থেকে এ্যাডভাইজ না আসা পর্যন্ত আমাদের বলার কিছু নেই। দিন একটা চারমিনার। আপনার সঙ্গে থাকলে আমাকেও চেইনস্মোকার হয়ে উঠতে হবে দেখছি। চলুন, খাবার দিয়েছে। কথায় কথায় অনেক রাত করে ফেললাম। আমি নীরবে তাকে অনুসরণ করলাম।

ডঃ মাইতির কোয়ার্টারে আমার চোখে এক ফোঁটা ঘুম আসেনি। সারারাত বিছানায় হাসফাস করেছি। কেমন জানি লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো আমার সামনে একটা দেয়াল আচানক মাটি খুঁড়ে দাঁড়িয়ে গেছে। আমার খুব গরম বোধ হচ্ছিলো। মাঝে মাঝে মশারির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে টেবিলে রাখা বোতল থেকে ঢেলে ঢক ঢক করে পানি খাচ্ছিলাম। আর একটার পর একটা সিগারেট টানছিলাম। দূরের রাস্তায় ধাবমান গাড়ির আওয়াজে আমার কেমন জানি মনে হচ্ছিলো। কোথাও যেনো কেউ ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।

শেষরাতের দিকে একটু তন্দ্রার মতো এসেছিলো। সেই ঘোরেই স্বপ্ন দেখলাম আমার আব্বা এসেছেন। স্কুল হোস্টেলে থাকার সময়ে আমি যে বাড়িতে পেয়িংগেস্ট হিসেবে খেতাম, সে বাড়ির সামনে পথ আলো করে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পরনে শান্তিপুরের চিকন পাড়ের ধুতি। গায়ে আদ্দির পাঞ্জাবি, গলায় ঝোলানো মক্কা শরীফ থেকে আনা ফুলকাটা চাদর। আর মাথায় কালো থোবাযুক্ত চকচকে লাল সুলতানী টুপী। আমি জিগ্‌গেস করলাম, আব্বা এতো সুন্দর কাপড়চোপড় পরে আপনি কোথায় চলেছেন? আমার প্রশ্নে তিনি খুবই অবাক হয়ে গেলেন। বেটা তুমি জানো না বুঝি, আজ তোমার বিয়ে। আমিও অবাক হলাম। কারণ আমি সত্যি সত্যি জানিনে। বাবা বললেন, কখনো কখনো এমন কাণ্ড ঘটে যায়। আমি বললাম, আব্বাজান আমার ঈদের চাপকান কই। অন্তত একখানা শাল এ উপলক্ষে আপনিতো আমাকে দেবেন। আব্বা সস্নেহে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বেটা সাদা ধুতি পরো। আমি বিয়ের সময় সাদা ধুতি পরেই বিয়ে করেছিলাম। তোমার ভাইকেও ধুতি পরিয়ে বিয়ে দিয়েছি। তিনি আমার হাতে একখানা ধুতি সমর্পন করলেন। আমি বললাম, আব্বা আমি যে ধুতি পরতে জানিনে। বেটা বেহুদা বকো না। পরিয়ে দেয়ার মানুষের কি অভাব! যাও তাঞ্জামে ওঠো। আমি বললাম, এ শুভদিনে আপনি অন্তত একখানা ঘোড়ারগাড়ি ভাড়া করবেন না? আব্বা বললেন, বেটা মুরুব্বীদের সঙ্গে বেয়াদবি করা তোমার মজ্জাগত অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে দেখছি। যাও, তাঞ্জামে ওঠো। তারপর তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কোথাও তাকে দেখলাম না। তারপর দেখলাম, চারজন মানুষ আমাকেই একটা খাঁটিয়ায় করে আমাদের গ্রামের পথ দিয়ে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের কাউকে আমি চিনিনে। লোকগুলো আমার খাঁটিয়া বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় সুর করে বলছে, বলো মোমিন আল্লা বলো। তাদের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে রাস্তার লোকেরাও বলছে, আল্লা বলো। আমি মনে মনে বললাম, এ কেমন ধারা বিয়ে গো। বাজী পোড়ে না, বাজনা বাজে না। অমনি পায়ের দিকে বহনকারী দু’জন লোক কথা কয়ে উঠলো। এই লাশটা পাথরের মতো ভারী। একে আমরা বয়ে নিয়ে যেতে পারবো না। মাথার দিকের বাহক দু’জন বললো, না না চলো। আর তো অল্প পথ। তোমরা যাও আমরা পারবো না। তারা কাঁধ থেকে কাত করে আমাকে রাস্তার ওপর ঢেলে দিলো। আমি ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলাম। তন্দ্রা টুটে গেলো। হাঁটুতে প্রচণ্ড চোট লেগেছে। চোখ মেলে চাইলাম, আমি ফ্লোরের ওপর শুয়ে আছি। আর শরীরে সত্যি সত্যি ব্যথা পেয়েছি। কাঁচের জানালার শার্সি ভেদ করে শিশুসূর্যের দু’তিনটে রেখা ঘরের ভেতরে জ্বলছে। খুব পিপাসা বোধ করছিলাম। আবার খাটে ওঠার কোনো প্রবৃত্তি হলো না। তিন চার মিনিট তেমনি পড়ে রইলাম। চোখ বন্ধ করে তার মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে মনে মনে সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করছি। ডঃ মাইতি আমার কাঁধ নাড়া দিয়ে বললেন, একি দানিয়েল সাহেব, আপনি নীচে কেনো? আমি আস্তে আস্তে বললাম, স্বপ্নের ঘোরে খাট থেকে পড়ে গিয়েছি। বাঃ চমৎকার! আপনার মনে এখনো স্বপ্ন আসে, সুতরাং দুর্ভাবনার কোনো কারণ নেই। আশা করি দাড়ি কাটতে এবং স্নান করতে অমত করবেন না। আমি মৃদুস্বরে বললাম, না। তিনি বললেন, বাথরুমে শেভিং রেজার, সাবান ইত্যাদি দেয়া আছে। যান তাড়াতাড়ি যান, এখখুণি খাবার দেয়া হবে। বাথরুমে যেয়ে গালে সাবান ঘষতে ঘষতে দেখি থুতনির কাছে আট দশটা পাকা দাড়ি উঁকি দিচ্ছে। দু’কানের গোড়ায়ও অনেকগুলো বাঁকা চোরা রূপালী রেখা। চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইছিলো। আহা আমার যৌবন শেষ হতে চলেছে। আমি বুড়োত্বের দিকে এগুচ্ছি। এতোদিন চোখে পড়েনি কেনো। এক মাসের মধ্যেই কি ম্যাজিকটা ঘটে গেলো।

ডঃ মাইতির সঙ্গে খাবার টেবিলে গেলাম। চুপচাপ লুচি, হালুয়া, ডিম এবং চা খেয়ে গেলাম। আমার কথাবার্তা বলার কোনো প্রবৃত্তি হচ্ছিলো না। তিনিও বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন না। সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে হঠাৎ তার চোখে চোখে পড়ে যাই। মনে হলো তিনি যেনো কি একটা গভীর বিষয় নিয়ে চিন্তা করছেন। ডঃ মাইতির সঙ্গে আমার একটা সহজ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু এই এক রাতের মধ্যে তাতে যেনো একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। আমার মনের এরকম একটা অবস্থা, যা ঘটুক আমি কেয়ার করিনে। চারপাশের লোকজন এদের আমি চিনিনে, চিনতেও চাইনে। ডঃ মাইতি আমাকে জিগগেস করলেন, সকালবেলা তায়েবাকে একবার দেখে যাবেন কি? আমি নিস্পৃহভাবে বললাম, চলুন। কোনো ব্যাপারে আর উৎসাহ নেই। গতরাতে তায়েবা যদি ঘুমের মধ্যে মরেও গিয়ে থাকে, আমি যদি হাসপাতালে যেয়ে তার মরা শরীর দেখি, তবু কেঁদে বুক ভাসাবো না। আমি কি করবো, আমার করার কি আছে।

সে যাক, ডঃ মাইতির পেছন পেছন আমি তায়েবার ওয়ার্ডে প্রবেশ করলাম এবং অবাক হয়ে গেলাম। এই সাত সকালে জাহিদুল এবং ডোরা তায়েবার বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্য সময় হলে বোধ করি আমি নিজের মধ্যে হলেও প্রচণ্ডভাবে ক্ষেপে উঠতাম। আজকে সে রকম কোনো অনুভূতিই হলো না। বরঞ্চ মনে হলো, ওরা আসবে একথা আমার মনের অবচেতনে জানা ছিলো। আমিও চুপচাপ তায়েবার মাথার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে পেছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছে। এখনো মুখ ধোয়নি। ফ্যানের বাতাসে মাথার চুল উড়াউড়ি করছে। তার চোখেমুখে বেদনামথিত স্নিগ্ধ প্রশান্তির দীপ্তি। আমাকে দেখামাত্রই তার মুখে কথা ফুটলো। এই যে দানিয়েল ভাই, আসুন। আপনি কি কাল মাইতিদার কোয়ার্টারে গিয়েছিলেন? নইলে এতো সকালে আসবেন কেমন করে? আমি মাথা নাড়লাম, তারপর নীরবে জাহিদুলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

জাহিদুলের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেলো না। তায়েবাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর থেকেই একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করে আসছি। আমরা পাশাপাশি বসে কথা বলতে দেখলে ভুকুটি জোড়া মেলে ধরতেন। তিনি আমাদের পরিচয় আর মেলামেশা কখনো সহজভাবে নিতে পারেননি। এমনকি একাধিকবার মন্তব্য করেছেন, আমি ভীষণ নারীলোলুপ মানুষ। নানা গুণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আমি তাঁকে ভড়ং সর্বস্ব একটা ফাঁকা মানুষ জ্ঞান করে আসছি। আর সুযোগ পেলে কখনো ছেড়ে কথা বলিনি। আজকে তিনিও মৃদু হেসে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। সব কিছুর এমন পরিবর্তন ঘটলো কি করে? সকলেই কি তায়েবার ভাবী পরিণতি সম্পর্কে জেনে গেছে?

জাহিদুল সামনের দিকে ঝুঁকে একটা ব্যাটারিচালিত টেপরেকর্ডার বাজিয়ে তায়েবাকে কি সব গান শোনাচ্ছিলেন। আমার আচমকা উপস্থিতিতে সেটা অনেকক্ষণ বন্ধ ছিলো। তায়েবা বললো, রিউইন্ড করে আবার প্রথম থেকে বাজান জাহিদ ভাই। দানিয়েল ভাইও শুনুক। আমাকে বললো, দানিয়েল ভাই শুনুন, ডোরা দিল্লীতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের একটি একক প্রোগ্রাম করেছে। গান বাজতে থাকলো। দেয়ালে হেলান দিয়ে তায়েবা চোখ বন্ধ করে রইলো। বাংলাদেশে থাকার সময়ে ডোরা রেডিও, টিভিতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে গান গাইতো। যখন গান বাজতো তখনো এমনি করে তায়েবা বিদ্যুতবাহিত স্বরতরঙ্গের মধ্যে নিজের সমস্ত চেতনা বিলীন করে দিত। “তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতো দূরে আমি ধাই, কোথাও মৃত্যু, কোথাও বিচ্ছেদ নাই।” ডোরার কণ্ঠ অত্যন্ত সুরেলা। তাতে যেনো বিষাদের একটুখানি ছোঁয়া আছে। এই ছোঁয়াটুকুর স্পর্শেই সঙ্গীতের সুদূরের আহ্বানটি যেনো প্রাণ পেয়ে জেগে উঠে। ডোরা জাহিদুলের কাছে গান শিখেছে। তাঁর সম্পর্কে যার যতোই নালিশ থাকুক, কিন্তু একটি কথা সত্য, যাকে গান শেখান প্রাণমন দিয়ে শেখান। আবার বেজে উঠলো “আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি, আমার যতো বাক্য প্রভু, আমার যতো বাণী।” এমনি করে এক ঘণ্টার প্রোগ্রাম ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজতে থাকলো। সবগুলো গান যেনো তায়েবার বর্তমান অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই নির্বাচন করা হয়েছে। তাহলে ডোরাও কি জেনে গেছে অন্তিম পরিণতিতে তায়েবার কি ঘটতে যাচ্ছে। মনের মধ্যে একটুখানি খুঁতখুঁতোনি অনুভব করছিলাম। তায়েবার সেই প্রিয়গান দুটো ডোরা বাদ দিয়েছে কেনো? ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ এবং দাঁড়াও আমার আঁখির আগে। সকলে সবদিক দিয়ে তায়েবাকে যেনো অন্তিমযাত্রার জন্য প্রস্তুত করে তুলছে। ডোরা যে পার্ক সার্কাসের বাসায় তায়েবাকে সংজ্ঞাহীন রেখে দিল্লীতে জাহিদুলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলো, তাও বোধকরি এ জমজমাট নাটকের শেষ দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার জন্য নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করেই করা হয়েছিলো।

ক্যাসেট শেষ হলে তায়েবা চোখ খুললো। তার ঠোঁটে হাসি খেলে গেলো। ডোরার গানের শেষে এমনি গর্বের হাসি তার চোখেমুখে খেলে যেতে পূর্বে আমি অনেকবার দেখেছি। তায়েবা খুব ক্ষীণকণ্ঠে জিগগেস করলো, লোকে কেমনভাবে নিয়েছে তোর গান ডুরি। বলাবাহুল্য তায়েবা ডোরাকে ডুরি নামেই ডাকে। এবার ডোরা মুখ খুললো। সে এক আজব ব্যাপার বাপ্পা। নানা জায়গা থেকে গান করার এতো অফার আসতে লাগলো যে গোটা মাসেই শেষ করা যেতো না। ডোরা তায়েবাকে বাপ্পা বলেই ডাকে। কি কারণে বড় বোনকে বাপ্পা বলে সম্বোধন করে তার ইতিকথা আমি বলতে পারবো না। তায়েবা বললো, কয়েকটা অনুষ্ঠান করে এলেই পারতিস। এতো তাড়াতাড়ি কেননা চলে এলি। দিল্লী কতো বড়ো শহর, কতো জ্ঞানীগুণীর ভীড় সেখানে। হাতেরলক্ষ্মী পায়ে ঠেললি। ডোরা দু’হাতে তায়েবার গলা জড়িয়ে ধরলো। বাপ্পা তোমার শরীরের ওই অবস্থায়, সে হু হু করে কেঁদে ফেললো। তায়েবা গভীর আগ্রহে তার পিঠে হাত বুলোতে লাগলো। আমার অসুখতো লেগেই আছে, কিন্তু তোর সুযোগ তো আর প্রতিদিন আসবে না। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, জানেন দানিয়েল ভাই, কালকে আপনার যাওয়ার পর থেকে আমি সারারাত বমি করেছি। একবার তো বাথরুমে পা পিছলে পড়েই গিয়েছিলাম। ভাগ্য ভালো আয়াটা ছিলো। নইলে সারারাত পড়ে থাকতে হতো। তায়েবার কথা শুনে ডোরা আমার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে রইলো। জাহিদুলের সে পুরোণো ভুকুটি জোড়া জেগে উঠলো। তিনি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন, তার অর্থ করলে এরকম দাঁড়ায় যে জানতাম, তুমি এলেই একটা অঘটন ঘটবে। তিনি তায়েবাকে জিগ্‌গেস করলেন, কি হয়েছিলো, বমি হতে শুরু করলো কেনো, কখন পড়ে গিয়েছিলে, কই কিছুতো বলোনি। কিছু কুপথ্য মুখে দিয়েছিলে কি? তায়েবা বললো, না না, সে সব কিছুই না। সন্ধ্যের পর থেকে আপনাআপনি বমি হতে শুরু করলো। এক সময় পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম, আমার মনে হলো, এ নাটকে যা ঘটবে সব দেখে যেতে হবে। পালন করার কোনো ভূমিকা থাকবে না। এমনকি একটা ফালতুরও নয়। অগত্যা আমি উঠে যেতে উদ্যত হলাম। তায়েবার দিকে তাকিয়ে বললাম, তাহলে এখন আসি। পরে না হয় একবার আসবো। না না দানিয়েল ভাই, যাবেন না। আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে, বরঞ্চ ডোরা তোরা যা। প্রোগ্রাম শেষ হলে যাবার পথে খবর দিয়ে যাস। ডোরা এবং জাহিদুল চলে গেলো। সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমাদের ডোরা খুব গুণী। এরই মধ্যে দিল্লীতে প্রোগ্রাম করে এলো, আজ মহাজাতি সদনে গান গাইবে। আমার শরীরটা হয়েছে একটা মস্তবড়ো বোঝা। নইলে আমিও গান শুনতে যেতাম। অনুষ্ঠানে গাইবার সময় ডোরার গান শুনেছি কতোদিন হয়। মা শুনলে কি যে খুশী। হবে। দানিয়েল ভাই, আপনি একটু উঠে দাঁড়ান। আপনার কাঁধে ভর দিয়ে আমি একটু বাথরুমে গিয়ে মুখটা ধুয়ে নেবো। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। আজ দশটায় আবার ডঃ ভট্টাচার্য এসে টেস্টফেস্ট কি সব করবেন। আর সহ্য হয় না। আমি তাকে ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে গেলাম। সে ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে মুখে সাবান ঘষলো। তারপর মুখ ধুয়ে নিলো। চিরুনি নিয়ে চুল আঁচড়াতে চেষ্টা করলো। তায়েবা বললো, আমার পা দুটো কাঁপছে, দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনে। আমি বেসিনে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াবো। আপনি আমাকে একটা টুল এনে দিন। আমি টুলটা এনে দিয়ে বসিয়ে দিলে সে হাঁপাতে লাগলো। তার মুখমণ্ডলে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিলো। দানিয়েল ভাই, আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। খাটের বাজুতে দেখবেন একটা প্লাস্টিকের ঝুড়ি আছে। সেখান থেকে খোঁজ করে একটা তাঁতের শাড়ি, পেটিকোট এবং ব্লাউজ এনে দিন না। এখনো বাসী কাপড় পরে রয়েছি। আমার গা কুটকুট করছে। গেন্ডারিয়ার বাসাতেও দেখেছি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঘরদোর পরিষ্কার করে গোসল সেরে একটা ধোয়া কাপড় পরেছে। আমি প্লাস্টিকের ঝুড়ি থেকে খোঁজ করে শাড়ি, ব্লাউজ এবং পেটিকোট বের করে তায়েবার হাতে দিলাম। সে বললো, এখন টুলটা টেনে ওই দরোজার কাছে নিয়ে কাপড়চোপড়গুলো পরতে হবে। আর আপনি একটু ওপাশে গিয়ে দাঁড়ান। তাকে বসিয়ে রেখে ওপাশে এসে আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। তায়েবা কোন্ কৌশলে এই অল্প পরিসর টুলের ওপর বসে কাপড় চোপড় পরবে আমি ভেবে ঠিক করতে পরছিলাম না।

কাপড় পরা শেষ হলে তায়েবা আমাকে ডাকলো। আমি দরজা খুলোম। কাপড়চোপড় পরেছে বটে, কিন্তু আঁচলটাকে সামলাতে গিয়ে ভারী অসুবিধে হচ্ছিলো। কাঁধ থেকে খসে মেঝেতে পড়ে আঁচলটা ভিজে গেলো। তায়েবা বললো, আপনি ভীষণ অপয়া। আমার আঁচলটা ভিজে গেলো। আঁচল তুলে নিয়ে সে পানি চিপে বের করে নিলো। আরেকবার আপনাকে কষ্ট করতে হবে। আমার শিথানে একটি ক্রীম আছে। কাপড় উঠালেই পাবেন। প্লিজ, সেটা গিয়ে একটু নিয়ে আসুন । আমি ক্রীমটাও নিয়ে তার হাতে দিলাম। সে আঙুলের ডগায় ক্রীম তুলে নিয়ে হাতের তালুতে ঘষে ঘষে মুখমণ্ডলে এবং ঘাড়ের কাছাকাছি লাগালো। এখন আপনি আবার আগের মতো দাঁড়ান। আমি দাঁড়ালাম। কিন্তু সে পায়ের ওপর ভর করে আর উঠতে পারলো না। উঃ দানিয়েল ভাই! আমি বললাম, কি তায়েবা। আমার হাঁটু দু’টো ঠক ঠক করে কাঁপছে। শরীরের সমস্ত শক্তি কাপড় পরতেই শেষ হয়ে গেছে। আপনি আমাকে পাঁজাকোলা করে বিছানায় রেখে আসুন না। আমি দুহাত দিয়ে তাকে উঠিয়ে নিলাম। সে একটি হাত আমার ঘাড়ের ওপর রাখলো। কাজটি শেষ হতে দু’মিনিট সময়ও ব্যয় হয়নি। তায়েবার সঙ্গে আমার পরিচয় চার বছর। কিন্তু এভাবে আত্মসমর্পন সে কখনো করেনি।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে কয়েকবার হা করে শ্বাস ফেললো। বুঝলাম, তার অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে। বেশ কয়েক মিনিট পর আমাকে জিগগেস করলো, দানিয়েল ভাই, আপনি কি ডোরার গান শুনতে যাবেন? যান তো একখানা টিকিট দিতে পারি। আমি বললাম, না, কারণ যেখানে থাকি সেখানে যেতে হবে। তারপর পত্রিকা অফিসে গিয়ে লেখার কিস্তিটি পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলো। তারপর নীরবতা ভঙ্গ করে বললো, আপনি ডুরির প্রতি এতো বিরূপ কেনো? ও কি সংসারের কিছু বোঝে? ঝোঁকের মাথায় একটা কাজ করে এসেছে, তা এমন সিরিয়াসলি না নিলেও তো পারেন। তার যখন জন্ম হয়েছিলো তখন মার ভয়ানক অসুখ ছিলো। আমি নিজের হাতেই সেবাযত্ন করে এতো ডাগরটি করেছি। একবার তো মরতেই চলেছিলো। উঃ তখন আমার ওপর কি ধকলটাই না গেছে! গায়ে গতরে বেড়েছে বটে। আসলে ওর কি বয়স হয়েছে? আপনি ওর দিকে একটু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তাকাতে পারেন না। মানুষের ভুলটাকে অতো বড়ো করে দেখেন কেনো?

০৫-৬. হাসপাতাল থেকে

হাসপাতাল থেকে আমি সবটা পথ হেঁটেই বৌবাজারের হোস্টেলে এলাম। ট্রাম-বাসে চড়ার ইচ্ছেও মনের মধ্যে জাগ্রত হয়নি। মনে হচ্ছে আমি একেবারে কাঙাল বনে গেছি। আমার চিন্তা করার কিছু নেই, আকাক্ষা করারও কিছু নেই, ভরসা করার কিছু নেই। তবু হোস্টেলে আসতে পারলাম কেমন করে, সে আমি বলতে পারবো না। গেটের গোড়ায় এসে দেখি ভূড়িঅলা দারোয়ানটির বদলে দুবলা পাতলা দারোয়ানটি দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে বসে খৈনি টিপছে। আমাকে দেখতে পেয়ে পান খাওয়া গ্যাটগ্যাটে দাঁত দেখিয়ে হেসে বললো, বাবু কোটিমে যাইয়ে আজ, হাওয়া বুহুত গরম আছে। কোনো উত্তর না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলাম।

যে রুমে আমরা থাকি, সেখানে মাঝারি রকমের একটা কনফারেন্স বসে গেছে। বাংলাদেশের ছেলেদের অধিকাংশই হাজির আছে। তাছাড়া আছেন কোলকাতার সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। ইনি পোস্টাফিসে চাকরি করেন। ফর্সাপনা সুন্দর চেহারার সদানন্দ মানুষটি। সবসময় পরিষ্কার পাজামাপাঞ্জাবি পরেন এবং দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কেটে থাকেন। অবসর সময়ে কবিতা লিখেন, কিন্তু কোলকাতার কাগজগুলো, এমন কি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকেরাও তাঁর প্রতি এমন নির্দয় যে কবিতা কেউ ছাপতে চান না। বিশ্বাসের দিক দিয়ে তিনি বিপ্লবীও বটেন। কি কারণে বলতে পারবো না, কোনো বিপ্লবী পার্টির সদস্য হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। কথাবার্তা বলে দেখেছি পশ্চিমবাংলার বিপ্লবী পার্টিগুলোর নীতি আদর্শের প্রতি তার ভীষণ রকম অনাস্থা এবং নেতৃবৃন্দের প্রতি সুমন্তবাবুর ভয়ানক রাগ। কথায় কথায় তিনি অবজ্ঞা প্রকাশ করেন। অবশ্য ইদানীং সুমন্তবাবুর বেশ পুষিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের এইসব ভাসমান কর্মহীন উদ্দেশ্যহীন ঘরহারা লক্ষ্মীছাড়া ছেলেদের সঙ্গে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত মার্কামারা সত্যিকার একটি গণবিপ্লবের তাত্ত্বিকভিত্তি নিয়ে হামেশা আলাপ আলোচনা করে থাকেন। তার ধারণা পশ্চিমবাংলা হেজেমজে গেছে। সমাজকে নিয়ে কিছু যদি করার থাকে, তা বাংলাদেশের ছেলেদের দিয়েই সম্ভব। তত্ত্বের জঙ্গলে ওদের ধ্যান ধারণা এখনো পথ হারিয়ে ফেলেনি। বাংলাদেশের প্রতিটি ছেলেকেই সুমন্তবাবু তার আকাঙ্ক্ষিত গণবিপ্লবের একেকজন সৈনিক হিসেবে দেখেন। এরই মধ্যে উদ্যোগী হয়ে বাংলাদেশের ছেলেদের নিয়ে তিন তিনটে কবিতার সংকলন প্রকাশ করে ফেলেছেন। তিনটিতেই সুমন্তবাবুর তিনটি কবিতা সগৌরবে স্থান করে নিয়েছে। মানুষটি রসগোল্লার মতো। মনে হয় টিপলেই রস বেরুবে। কি কারণে বলতে পারবো না, আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয়টা মামুলিপনা অতিক্রম করে হৃদ্যতার স্তরে পৌঁছুতে পারেনি। আমার পরনে ধুতি দেখে মাসুমই প্রথম ফোড়ন কাটলো। দানিয়েল ভাই, বলুন দেখি কোলকাতার হাওয়া এখন কার গায়ে লাগছে? মাসুম কোলকাতার মানুষের মতো টানটোন লাগিয়ে ঢাকার বাংলা ভাষাটি বলতে চেষ্টা করছে আজকাল। একবার সেদিকে ইঙ্গিত করেছিলাম। আজ আমার পরনে ধুতি দেখে মাসুম তার শোধ দিতে চেষ্টা করছে। মাসুমের কথার পিঠে কথা বলার মতো মনের অবস্থা ছিলো না। নীরবে নরেশদার পাশে গিয়ে একটা বালিশ টেনে নিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম। নরেশদা জিগগেস করলেন, কি খবর? আমি বললাম, ভালো নয়। কি রকম বলো দেখি। এসব শেষ হোক, পরে বলবো। আমি চোখ দুটো বন্ধ করে রইলাম। মনে হচ্ছিলো একটা প্রচণ্ড সংজ্ঞাহীনতা আমাকে এখুনি গ্রাস করে ফেলবে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়তে পারছিলাম না। এক ভদ্রলোক যিনি আমার সম্পূর্ণ অচেনা, অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে ঘরভর্তি মানুষের সামনে কথা বলছিলেন। বোধকরি তিনি আগের থেকেই কথা বলছিলেন। আমার আগমনে হঠাৎ করে তাঁর কথায় ছেদ পড়ে থাকবে। বাংলাদেশের ফ্রিডম ওঅরের কথা শুনে লেখাপড়া ছেড়ে ইংল্যাণ্ড থেকে কোলকাতা এসেছি আজ পঁচিশ দিন। কিন্তু এখানে এসে কি দেখেছি? দেখেছি থিয়েটর রোডে যারা বসে আছে তাদের অধিকাংশই এ বাঞ্চ অফ রাস্কেলস। খাচ্ছে দাচ্ছে মজা করছে এভাবে নাকি ফ্রিডম ওয়রের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ভয়ঙ্কর ডিজ-ইলুশনড হয়ে গেছি। মাও সে তুংও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আপনারা নিশ্চয়ই লংমার্চের খবর জানেন!

আপনার মাও সে তুং এখন বাংলাদেশের ব্যাপারে কি করছেন, সে খবর রাখেন? পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে খুন, জখম, হত্যা, ধর্ষণ সবকিছু অবলীলায় চালিয়ে যাচ্ছে। আর আপনার মাও সে তুং সে ইয়াহিয়ার জল্লাদসৈন্যদের ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য জাহাজ ভর্তি করে বোমা, কামান, অস্ত্রশস্ত্র পাঠাচ্ছে। লংমার্চ তো অতীতের ঘটনা, হালের খবর বলুন। আমার মনে হলো, প্রশ্নকারীর কণ্ঠস্বরটি আমার পরিচিত। ওহ মনে পড়েছে। গান্ধী পিস ফাউণ্ডেশনের মনকুমার সেন একবার যিনি এখানে এসেছিলেন, এই ভদ্রলোক তাঁরই বড়ো ছেলে। নামটি মনে আসছে না। অমর্তসেন না কি একটা হবে। তার বাড়িতে একবার খেতে গিয়েছিলাম। সকলেই কথা বলছে। কোনো আগামাথা নেই। কোথায় শুরু এবং শেষ কোথায় হচ্ছে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। বাংলাদেশের সালাম এবার মুখ খুললো। মাওলানা ভাসানী মাও সে তুং এবং চৌ এন লাইয়ের কাছে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন, যাতে চীন পাকিস্তানের এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে কোনো রকম সহায়তা না করে। আরে থোন ফালাইয়া, আপনার মাওলানা ভাসানীর টেলিগ্রাম দুইখান চৌ এন লাই আর মাও সে তুং যতন কইর‍্যা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে থুইয়া রাখছে। মাওলানা এখন ইন্ডিয়া কেনো আইছে হেইডা কইবার পারেন? তাবিজ দেয়ার মৌলবী, আপনেরা তারে বিপ্লবী লিডার বানাইছেন। কথাগুলো খুরশিদের। খুরশিদ সম্পর্কে একটু পরিচয় দিতে হয়। সে সব জায়গায় ঘটা করে আওয়ামী লীগের লোক বলে প্রচার করে। জায়গা বুঝে মাঝে মাঝে হাই কম্যাণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, একথা বলতেও পেছ পা হয় না। তবে মুশকিল হলো আওয়ামী লীগের লোকেরা তাকে পাত্তা দেয় না। সত্যিকার আওয়ামী লীগের কাছে ঘেঁষতে না পেরে খুরশিদ আমাদের ডেরায় এসে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের মুণ্ডুপাত করে। ইংল্যান্ড প্রত্যাগত ভদ্রলোক জিগ্‌গেস করলেন, বাই দ্যা বাই, ক্যান এ্যনি ওয়ান অব ইউ টেল মি হোয়ার মাওলানা ইজ নাউ। উয়ি হিয়ার দ্যাট হি ওয়াজ আন্ডার অ্যারেস্ট। মাওলানা ভাসানীকে ধরে লাল কেল্লায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আরেকজন বললো, অ্যারেস্ট করা হয়েছে একথা সত্যি নয়। তবে তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। আমি নিজে অবশ্য শুনেছি পয়লা মাওলানাকে বালিগঞ্জের একটা বাড়িতে রাখা হয়েছিলো। মাওলানা সন্ধ্যে হলেই সে বাড়ির ছাদের ওপর পায়চারি করতেন। তাঁর লম্বা দাড়ি, পাঞ্জাবি, বেতের টুপি এসব দেখেই আশেপাশের মানুষের সন্দেহ হতে থাকে যে, এ মাওলানা ভাসানী না হয়ে যান না। তাছাড়া মাওলানার আরেকটা একগুয়ে স্বভাবের জন্য ভারত সরকার তাঁকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর তা এই, সন্ধ্যেবেলা সব সময়ে আজান দিয়ে ছাদে চাদর বিছিয়ে মাগরেবের নামাজ পড়তেন।

এক সময় মাওলানা ভাসানী প্রসঙ্গ চাপা পড়ে গেলো। আলোচনা শুরু হলো শেখ মুজিবকে নিয়ে। খুরশিদ বললো, থিয়েটর রোডের যে সকল মাস্তান আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙ্গিয়ে সব কিছু লুটপাট করে খাচ্ছে, এখানে বঙ্গবন্ধু হাজির থাকলে পেঁদিয়ে তাদের পিঠের ছাল তুলে ফেলতেন। সালাম ঠোঁট উল্টে জবাব দিলো, আরে রাখো তোমার বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানীদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেই ধরা দিয়েছে। পৃথিবীর কোনো বিপ্লবী সংগ্রামে নেতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তোমার ওই বঙ্গবন্ধুর মতো শক্রর কাছে সগৌরবে আত্মসমর্পণ করেছে তার কোনো নজীর আছে কি? শেখ মুজিব সব সময় স্যুটকেশ গুছিয়ে রাখতেন। আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্বেই জেলে চলে যেতেন, আর আন্দোলন শেষ হয়ে গেলে বিজয়ী বীরের বেশে জেলখানা থেকে বেরিয়ে ক্রেডিটটুকু নিতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে। শেখ পাকিস্তানের জেলে আর আমরা এখানে কোলকাতার পথে পথে ভেরেণ্ডা ভেজে চলছি। এই অবস্থাটার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী তোমার ওই শেখ মুজিব এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ। শেখের মতো এতো বড়ো জাতীয় বেঈমান আর দ্বিতীয়টি নেই। খুরশিদ হুঙ্কার দিয়ে উঠলো, খবরদার সালাম, ছোটো মুখে বড়ো কথা বলবে না। অন্য লোকের নাম বললে কিছু মনে করতাম না। বঙ্গবন্ধুর নামে কিছু বললে মুখের বত্রিশটি দাঁতের একটিও আস্ত রাখবো না। সালাম এবং খুরশিদ উঠে দাঁড়িয়ে পরস্পর শক্তি পরীক্ষার মাধ্যমে একটা মীমাংসায় পৌঁছার উপক্রম করলে সকলে ধরাধরি করে দু’জনকে থামিয়ে দিলো।

এ ধরনের ঘটনা হামেশাই ঘটে থাকে। এ রকমের একটা বিস্ফোরণের পর আলোচনা আর স্বাভাবিক খাতে এগুচ্ছিলো না। ইংল্যান্ড প্রত্যাগত ভদ্রলোক বললেন, সরি, আমার একটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। সুতরাং এখুনি আমাকে উঠতে হবে। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে সুমন্তবাবুও উঠে গেলেন। বোঝা গেলো, ইংল্যান্ড প্রত্যাগত ভদ্রলোকটি সুমন্তবাবুই সংগ্রহ করে এনেছিলেন। আসরের একেকজন করে উঠে যাচ্ছিলো। ওমা এমনি করে সবাই উঠে গেলে চলবে কেনো? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এখনো তোলাই হয়নি। মাসুমকে কথা বলতে শুনলাম। ‘গুরুত্বপূর্ণ’ শব্দটি মনে হয় সকলের মনে একটু দাগ কাটলো। মাসুম খোঁচা খোঁচা কাঁচা পাকা দাড়িঅলা এক ভদ্রলোকের দিকে ইঙ্গিত করে বললো, নাহিদ ভাই, এবার আপনার কাহিনীটা একটু বলুন। তিনি যে দুঃখে পড়েছেন চেহারাসুরত দেখলেই মনে হয়। উড্রান্তের মতো চোখের দৃষ্টি। জামার একটি হাতা গুটানো, অন্যটি ছেড়ে দেয়া। ভদ্রলোক কথা শুরু করতে গিয়ে একটু একটু করে কাঁপছিলেন। গলার স্বরটিও কাঁপছিলো। যাহোক তিনি তাঁর কাহিনীটা বলতে আরম্ভ করলেন। বগুড়া দখল করার পর আমরা দেড় মণ সোনা স্টেট ব্যাংকের স্ট্রং রুমের সেফটি ভল্ট ভেঙ্গে এখানে নিয়ে আসি। আমরা তিনজন সোনাসহ নৌকোতে করে বর্ডারে এসে পৌঁছোই। সেখান থেকে গাড়িতে করে কোলকাতা এসে দু’টো স্যুটকেশ কিনে সোনাগুলো ভাগাভাগি করে রাখি। তারপর তিনজন শেয়ালদার কাছে একটা হোটেলে উঠি। একদিন না যেতেই অন্য দু’জন বললো, আমাদের পেছনে ভারত সরকারের স্পাই লেগেছে। যদি কোনো রকমে জানতে পারে সোনা আছে, সবকিছু কেড়েকুড়ে নেবে এবং আমাদের জেলে পুরে রাখবে। পরামর্শ দিলো মাল সরিয়ে দেয়া প্রয়োজন। দু’জন হোটেল ছেড়ে স্যুটকেশ দুটো নিয়ে অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলো। আমাকে বলেছিলো, তিনজন এক সঙ্গে গেলে কেউ সন্দেহ করতে পারে। আমি সরলভাবে তাদের কথা বিশ্বাস করেছি। তারা কোনো সেফ জায়গায় ওঠার পর আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে।

সেই যে গেলো আর কখনো তাদের দেখা আমি পাইনি। নরেশদা বললেন, এই সোনা তো বাংলাদেশের জনগণের সম্পত্তি। আপনারা এখানে নিয়ে এলেন কেনো। থিয়েটর রোডের কর্তাব্যক্তিদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো নালিশ টালিশ করেননি। নাহিদ সাহেব বললেন, থিয়েটর রোডে অনেক ঘোরাঘুরি করেছি। কেউ আমার কথা কানেও তুলতে চান না। যে তিনজন আমরা সোনা নিয়ে এসেছিলাম, তার মধ্যে একজন এমপি-র আপন ছোটো ভাই। আরেকজন স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্টের শালা। তারা এখন কোথায় আছে, কি করছে কিছু জানিনে। অথচ এদিকে শুনতে পাচ্ছি সেই সোনা ইতিমধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেছে। দেখছেন তো এই অবস্থায় আমার কথা কে গ্রাহ্য করে তিনি নিজের দীনদশার প্রতি ইঙ্গিত করলেন। সত্যিই তো এরকম একজন মানুষ দেড় মণ সোনা বয়ে নিয়ে এসেছে, শুনলে এখন কে বিশ্বাস করবে। ভদ্রলোক বললেন, এখন আমি কি করি বলুন তো, পথে-ঘাটে বের হওয়া এক রকম অসম্ভব হয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কোলকাতার এবং বাংলাদেশের চেনা অচেনা মানুষ ভয় দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি যদি কোলকাতা শহর ছেড়ে না যাই, তাহলে আমাকে খুন করা হবে। অথবা পাকিস্তানের গুপ্তচর বলে ভারতের পুলিশের কাছে তুলে দেয়া হবে। আমি এখন কি করবো বুঝতে পারছিনে। আপনারা কি আমাকে কোথাও আশ্রয় দিতে পারেন? তার গল্পটি কেউ অবিশ্বাস করলো না। কেনোনা এরকম ঘটনা এই একটি নয়। আকছার ঘটছে। মুখে মুখে অনেক সহানুভূতিও প্রকাশ করা হলো। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। খুরশিদ কিন্তু নাহিদ সাহেবকে একটা পাকা আশ্বাস দিয়ে ফেললো। কাল এই সময়ে আপনি এখানে আসবেন। থিয়েটর রোডে নিয়ে গিয়ে তাজুদ্দীন সাহেবকে সব কিছু খুলে বলে বদমায়েশদের শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করবো। আজ বাড়ি চলে যান। নাহিদ সাহেব বললেন, এখানে আমার বাড়ি কোথায় যে যাবো? খুরশিদ বললো, যেখানে থাকেন, চলে যান। আমার তো থাকার কোনো জায়গা নেই। খুরশিদ বিরক্ত হয়ে বললো, কাল কোথায় ঘুমিয়েছিলেন। কালতো গোটা রাত শেয়ালদা স্টেশনে কাটিয়েছি। দূর মশায় আপনাকে নিয়ে আর পারা গেলো না। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলো। আমার চোখ দুটো ঘুমে ঢুলে আসছিলো। এতে ক্লান্তশ্ৰান্ত অবস্থায় কি করে যে এতোসব কথাবার্তা নীরবে শুনে আসছিলাম, তার কারণ কি ঠিক বলতে পারবো না। সবাই চলে গেলে নরেশদা জিগগেস করলেন, গতরাতে কি তোমার ঘুম হয়নি? আমি বললাম, না। এখন কি ঘুমোবে? বললাম, হ্যাঁ। কিছু খাবে না। ঘুম জড়ানো অস্পষ্ট গলায় জবাব দিলাম, খেয়ে এসেছি।

বেলা তিনটের দিকে আমার ঘুম ভাঙলো। দেখি রুমে আর কেউ নেই। নরেশদা বসে বসে সুবলচন্দ্র মিত্র এবং হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের অভিধান দুটো নিয়ে কিসব করছেন। অভিধান পাঠ করা এবং একটার সঙ্গে একটা মিলিয়ে দেখা তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যেস। ঢাকায় থাকার সময়ে আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম, বছর তিনেকের মধ্যে তিনি নিজে একখানা অভিধান জন্ম দিতে যাচ্ছেন। জিগ্‌গেস করলেন, দানিয়েল গতরাতে কোথায় ছিলে? আমি বললাম, তায়েবার ডাক্তার মাইতিবাবুর কোয়ার্টারে। তায়েবার রোগ সম্পর্কে ডাক্তার কিছু বললেন? বললাম, হ্যাঁ লিউক্যামিয়া। ওটা নাকি ক্যান্সারের একটা ভ্যারাইটি। ডাঃ মাইতি বললেন, এ ধরনের রোগির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তাই নাকি? গলার স্বরটা চমকে গেলো। তিনি অভিধান দুটো বন্ধ করে গালে হাত রেখে কি সব ভাবলেন। এখন তুমি কোথায় যাবে? আমি বললাম, গোল পার্কের কাছে অর্চনাদের বাড়ি আছে না সেখানেই যাবো। অর্চনা তো চাকরি করে কলেজে। তিনি কি কলেজে যাননি? এখন গেলে পাবে? আমি বললাম, আজ অফিসে আসবে না। গিয়ে দেখি পেলেও পেতে পারি। সেকি খাবে না? আপনি খেয়েছেন? হ্যাঁ, আমাকে খেতে হয়েছে। রাজার মঠ থেকে দাদা এসেছিলেন। তাঁকে সহ খেয়ে নিয়েছি। মা বাবার কোনো খবর টবর পেলেন? হ্যাঁ, মা বাবা আজ তাঁর বাড়িতে এসে পৌঁছেছেন। আমি বললাম, ভালো খবর। তিনি এখন কোথায়? খবরটা দিয়েই চলে গেছেন আবার। কাপড় চোপড় পরে আমি জিগগেস করলাম, নরেশদা আপনার কাছে টাকা আছে? বললেন, কতো? এই ধরুন পনেরো বিশ। তিনি আমার হাতে বিশ টাকার একখানি নোট দিলেন। আমি বেরিয়ে আসছি, তিনি ডাক দিলেন, একটু দাঁড়াও তায়েবার হাসপাতালের ওয়ার্ড নম্বর এবং বেড নম্বরটি লিখে দিয়ে যাও। আমি কাগজ নিয়ে লিখে দিলাম।

.

০৬.

অর্চনার সঙ্গে আমার পরিচয় অনেকদিনের। চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছিলো। উনিশশো আটষট্টির দিকে অর্চনা একখানি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলো। ওতে আমার একটি গল্প ছাপা হয়েছিলো; আমি এমন আহামরি লেখক নই। তথাপি কি কারণে বলতে পারবো না, লেখাটি অর্চনার মনে ধরেছিলো। তখন থেকেই সম্পর্ক। অবশ্য চোখের দেখা হয়নি। এখানে আসার পূর্বে পশ্চিমবঙ্গে অর্চনাই ছিলো একমাত্র পরিচিত ব্যক্তি। বাড়ির ঠিকানা খোঁজ করে তাকে পেতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি। বড়ো আশ্চর্য মেয়ে অর্চনা। এখানকার একটি কলেজে ফিলসফি পড়ায়। এক সময় নকসাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলো। অধ্যাপক সুশীতল রায় চৌধুরী, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের মূর্তি ভাঙ্গার প্রতিবাদ করে দলের লোকদের হাতে নিহত হওয়ার পর থেকেই অর্চনা নিজেকে আন্দোলন থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। দলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত নয়, কিন্তু অনেকের সঙ্গে ওঠাবসা আছে। ছাত্র পড়িয়ে দিন কাটাচ্ছে বটে, কিন্তু একটা অস্থিরতা সর্বক্ষণ মনের মধ্যে ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে। তা আমি অনুভব করতে পারি। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই ভোলামেলা। আমরা পরস্পরকে তুমি সম্বোধন করি। মাঝে মাঝে আমার অবস্থা যখন খুবই অসহ্য হয়ে ওঠে, কয়েক ঘণ্টা ওদের ওখানে কাটিয়ে মনটাকে ঝরঝরে করে তুলি।

আজও প্রাণের ভেতর থেকে একটা গভীর তাগিদ অনুভব করছিলাম। পা দু’টো আপনা থেকেই চলতে আরম্ভ করলো। বাসে গড়িয়াহাটা পর্যন্ত এসে বাকি পথটা টানা রিকশায় গেলাম। এ অবস্থায় এটা একটা বিলাসিতা বটে, কিন্তু হাঁটার মতো পায়ে কোনো জোর পাচ্ছিলাম না।

গোল পার্কের বাড়িতে গিয়ে বেল টিপতেই অর্চনা নিজে এসে দরোজা খুলে দিলো। আমাকে দেখে তার চোখ জোড়া খুশীতে চকচক করে উঠলো। জানো দানিয়েল, আজ ভেবেছিলাম বৌবাজার গিয়ে তোমাকে খুঁজে বের করবো। হোস্টেলটা চিনিনে বটে। তবে ঠিকানাতো ছিলোই। খুঁজে বের করতে কতোক্ষণ। বাংলাদেশের ছেলেদের একটা সারপ্রাইজ দিতাম। আমি বললাম, যাওনি যখন সে কথা বলে আর লাভ কি? সে বললো, আমি তো প্ল্যান করেছিলাম যাবোই। মাঝখানে বৌদি পাকড়ে ফেলে তার বোনের বাড়িতে নিয়ে গেলো। সেখান থেকে এসেই দেখি মা রামকৃষ্ণ মিশনে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছেন। যেই আমি বাড়িতে পা দিয়েছি, অমনি মা ঘরের মধ্যে বন্দি করে নিজে বেরিয়ে গেলেন। মিশনে অক্ষরানন্দ নামে এক মহারাজ এসেছেন। আর তাঁর মুখের বচন নাকি ভারী মিষ্টি। তা কি আর করা। আমি বেচারি বাড়িতে বসে বসে ভেরেণ্ডা ভাজছি। অর্চনা নিতান্ত আটপৌরে কথাও সুন্দর করে বলতে জানে। আমি বললাম, অর্চনা এক কাপ চা খাওয়াবে? ওমা চা তো খাবেই। সে অনুচ্চস্বরে ডাকলো, শোভা, এই শোভা। কাজের মেয়েটি এলে বললো, দুকাপ চা করে নিয়ে আয়। আর দেখো খাবার কিছু আছে কিনা। আমি বললাম, অর্চনা শুধু চা আর কিছুর প্রয়োজন নেই। অর্চনা বুদ্ধিমতী মেয়ে। বললো, দানিয়েল নিশ্চয়ই তোমার একটা কিছু হয়েছে। মুখটা ভয়ানক শুকনো দেখাচ্ছে। জবাবে বললাম, কিছু একটা না হলে শুধু শুধু তো আর তোমার কাছে আসিনে। সে বললে, বাপু কথা না বাড়িয়ে সেটা বলে ফেললো না। আমার সে পরিচিতা বান্ধবী যার কথা তোমাকে বলেছি, গত পরশু তার দেখা পেয়েছি। তাহলে তো পেয়েই গেছো, আমাদের এখানে এসেছো কেনো? আচ্ছা যাক, তোমার সে ভদ্র মহিলার গল্প শুনি। আমি বললাম, বলার মতো আর কোনো গল্প নেই। সেকি, দেখা না হতেই ঝগড়া বাধিয়ে বসে আছো নাকি। আমাকে বুঝি মধ্যস্থতা করতে হবে। আমাকে বলতেই হলো, তার মারাত্মক অসুখ। ডাক্তার বলছে ক্যান্সার। ওমা সেকি! এখন কোথায় আছে। আমি বললাম, পিজি হাসপাতালে। তুমি কেমন করে খুঁজে বের করলে? সে কথা থাকুক অর্চনা। খুঁজে বের করে কি লাভটা হলো। সে ফোঁস করে উঠলো, তোমরা বেটাছেলেরা ভয়ানক নেমকহারাম। সব সময় লাভ খুঁজে বেড়াও। এরই মধ্যে চা এসে গেলো। চুমুক দিতে দিতে টুকটাক কথাবার্তা হলো। অর্চনা জিগগেস করলো, তুমি এখন কি করবে? কি করবো সেটাই প্রশ্ন। ওসব হেয়ালী রাখো। বাস্তবে কি করবে সেটাই বলো। আমি বললাম, যা ঘটবার ঘটে যাবে, আমাকে শুধু দেখে যেতে হবে। বাস এর বেশি আর কিছু না। দানিয়েল তুমি ভয়ানক ভেঙ্গে পড়েছে। বেটাছেলেদের একটু শক্ত হতে হয়। এসময় শক্ত হওয়াই প্রয়োজন। ঠাণ্ডা মাথায় স্থির করো কি করবে। আমি বললাম, স্থির করাকরির আর কিছু নেই। তার পার্টির লোকেরা হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। সেখানে চিকিৎসা হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে চিকিৎসাতে ফল হবে না। সে মারা যাবেই। অর্চনা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো। তুমি নেগেটিভ সাইডটা সব সময় বড়ো করে দেখো। মাথা ঠাণ্ডা করো একটু। আগে রোগি দেখি। তারপর স্থির করা যাবে, কি করতে হবে। আমি অনেক কষ্টে হাসতে চেষ্টা করালাম। বললাম, অর্চনা তোমাকে ধন্যবাদ। সব রকমের বিপদে আপদে সব সময়ে তোমার মুখ থেকে চমৎকার সান্ত্বনার বাণী বেরিয়ে আসে।

এ সময়ে আবার কলিং বেল। অর্চনা উঠে দরোজা খুলে দিলো। দুজন ভদ্রলোক ঘরে প্রবেশ করলেন। তাদের একজন হ্যাংলা মতো। গায়ের রঙ ফর্সা, তবে কিছুটা জ্বলে গেছে। পরনে ধুতি আর সাদা সার্ট। ভদ্রলোকের চেহারার একটা আকর্ষণ আছে। মাথার চুল লম্বা কোঁকড়ানো। সঙ্গের অন্য ভদ্রলোকটি বেটে খাটো। চকোলেট রংয়ের প্যান্ট এবং নীল হাওয়াই সার্ট পরনে। প্রথম দৃষ্টিতেই মনে হবে, এ ভদ্রলোক অত্যন্ত গোছালো। ওঁরা দুজন সোফায় বসলে অর্চনা বললো, এসো দানিয়েল তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে সত্যব্রত আমার কলিগ এবং বন্ধু। আমি ধুতি পরা হ্যাংলাপনা ভদ্রলোকের সঙ্গে হাত মেলালাম। আর উনি হলেন অনিমেষদা। আশা করি দেখে চিনে নিতে তোমাদের অসুবিধে হবে না।

এ হচ্ছে দানিয়েল, আমার বাংলাদেশের বন্ধু। তার সম্পর্কে তো তোমাদের অনেক বলেছি। সত্যব্রতবাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, আরে দানিয়েল সাহেব, আপনার সম্পর্কে অৰ্চনার কাছে এতো শুনেছি যে বলতে গেলে আপনার সমস্ত কিছু মুখস্ত হয়ে গেছে। তাঁর কথায় হাসলাম। তিনি ফের জিগগেস করলেন, আপনি কেমন আছেন, এখানে কোথায় উঠছেন, আর আপনাদের মুক্তিসংগ্রামের সংবাদ কি? আমি আমার নিজের কথা বলতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সম্বন্ধে জানতে চাইলে কেমন নার্ভাস এবং অপ্রস্তুত বোধ করতে থাকি। মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে আমি কতোটুকু বলতে পারি। দেশের ভেতরে কি হচ্ছে কিছু জানিনে। সীমান্তে যা ঘটছে তারও খবর ঠিকমতো পাইনে। থিয়েটর রোডের কর্তাব্যক্তিরা কি আমার সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন? আমি সমস্যাতাড়িত অস্তিত্বের ভারে পীড়িত একজন অতি অসহায় মানুষ। আমার কাছে মানুষ জানতে চাইলে জবাব দিতে গিয়ে কেমন বাধো বাধো ঠেকে। অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশে একটি মুক্তিযুদ্ধ চলছে এবং এই যুদ্ধের কারণেই কোলকাতা মহানগরীর নাভিশ্বাস উঠছে। ভারত পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের জন্য সাজো সাজো রব উঠছে। আমি সেই বিরাট কর্মকাণ্ডের একটা ছিটকে পড়া অংশ। যতোই বিব্রত বোধ করি না কেন, এ জাগ্রত জ্বলন্ত সত্যকে এড়িয়ে যাই কেমন করে। সত্যব্রতবাবু পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা আমাকে দিলেন এবং একটা নিজে ধরালেন। তারপর একটুখানি হেসে বললেন, আমরা আশা করেছিলাম, আপনারা অন্য রকমের একটা ঘটনা ঘটাবেন। মার্চ মাসের প্রাথমিক দিনগুলোতে পশ্চিমবাংলার হাজার হাজার ছেলে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে বাংলাদেশে গিয়ে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলো। আপনারা যুদ্ধের সমস্ত মাঠটা পাকিস্তানী সৈন্যদের ছেড়ে এককেবারে চূড়ান্ত নাজুক অবস্থায় ইন্দিরা সরকারের অতিথি হয়ে ভারতে চলে এলেন, এটা আমরা আশা করিনে। কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না, কিন্তু কিছু না বলাটাও অশোভন। তাই আমাকে বলতে হলো, পাকিস্তানী আর্মির ক্র্যাক ডাউনের এক সপ্তাহ আগেও আমরা ধারণা করতে পারিনি যে আমাদের এভাবে এখানে চলে আসতে হবে। কিন্তু দেখতে পারছেন তো এসে গেছি। এখন করার বেশি কিছু কি আছে? সত্যব্রতবাবু অনেকটা আফশোসের ভঙ্গিতে বললেন, আপনাদের দেশ এবং জনগণের ভাগ্য এখন আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মধ্যে আটকা পড়ে গেছে। দুনিয়ার সমস্ত দেশ চাইবে আপনাদের উপলক্ষ করে দাবায় নিজের চালটি দিতে। মাঝখানে আপনারা চিড়ে চ্যাপটা হয়ে যাবেন। আমার মনে হয় কি জানেন, আপনাদের ওই শেখ মুজিব মানুষটি হাড়ে হাড়ে সুবিধেবাদী অথবা আস্ত একটা বোকারাম। কি সুবর্ণ সুযোগই না আপনাদের হাতে ছিলো। একটা চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো, সেটা বুকের ভেতর জমিয়ে রাখলাম। অর্চনা বললো, তোমরা আলাপ করো, আমি দেখি চা দেয়া যায় কিনা। সে বাড়ির ভেতর চলে গেলো।

অনিমেষবাবু মুখ খুললেন, আচ্ছা দানিয়েল সাহেব, একটা কথা বলুন তো। আমি শুনেছি শেখ মুজিব নাকি বলেছিলেন, বাংলাদেশে কমিউনিস্ট বিপ্লব ঠেকাতে হলে সবাইকে তার ওপর নির্ভর করতে হবে। কথাটা কতদূর সত্যি। বললাম, কথাটা আমিও শুনেছি। নিশ্চয়ই সত্যি হবে। তিনি বললেন, আমার অনুমানটা সত্যি হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হবে। বাংলাদেশ হয়তো স্বাধীনতা পাবে, কিন্তু কোন্ স্বাধীনতা? আখেরে জনগণের কোনো লাভ হবে না। দোদুল্যমান বিপথগামী নেতৃত্ব দেশের জনগণকে সম্পূর্ণ একটা অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। অর্চনা ট্রেতে করে চা নিয়ে এলো। সকলে চায়ের কাপ তুলে নিয়েছে, এই সময়ে অর্চনা কথা বললো, বাংলাদেশের কথা বাদ দাও। পশ্চিমবাংলার কথা চিন্তা করে দেখো। তোমাদের গলাকাটা এবং মূর্তিভাঙ্গা প্রোগ্রামটার কি হাল হয়েছে কখনো কি তলিয়ে দেখেছো? অনিমেষদা আমার তো ইচ্ছা হয়, তোমাদের সবাইকে একটা করে আয়না কিনে দেই। যাতে করে নিজেদের চেহারা নিজেরা ভালো করে দেখতে পারো। দিনে দিনে যে অবস্থা দাঁড়াচ্ছে পশ্চিমবাংলায়ও কি শ্বাস নিতে কষ্ট হয় না? ভুল শুধু বাংলাদেশের নেতারা করেছে আর তোমরা করোনি, এটা কি সত্যি?

সত্যব্রতবাবু বললেন, বাংলাদেশ সেন্টিমেন্ট এক্সপ্লয়েট করে শাসক কংগ্রেস এখানকার পরিস্থিতি এমন ঘোলাটে করে তুলেছে যে সত্যিকার বিপ্লবীদের চেহারা দেখানোই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ঠং করে পেয়ালাটা পিরিচের ওপর রেখে অর্চনা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো, সত্যব্রত তুমি সত্যিকার বিপ্লবী কাদের বলছো! যারা মূর্তি ভেঙ্গেছে, গ্রাম গঞ্জের জোতদার মহাজনের গলা কেটেছে, চীনের চেয়ারম্যানকে আমাদের চেয়ারম্যান বলেছে, তারাই কি সত্যিকারের বিপ্লবী? আজকে তোমরা বাংলাদেশের ছেলেদের দায়ী করছো। তোমাদের বন্ধুরা কি অবগত আছেন, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার জন্য তাঁরা কম দায়ী নন। পশ্চিমবাংলার বিপ্লবী আন্দোলন বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলো একটা সময় পর্যন্ত জাতীয় সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেনি। তোমাদের নেতাদের মতো তারাও বলেছে চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান! যেহেতু পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্ব আছে তাই বামপন্থী কতিপয় দল এখনো পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে আসতে তোমাদের ভ্রান্তনীতি কি সহায়তা করেনি? আগে নিজেদের দোষগুলো দেখো তারপর বাংলাদেশের দোষ ধরতে যেয়ো। দুঃখ এই জায়গায় যে কেউ সহজ বিষয় সহজভাবে দেখছে না।

বাহ্ চমৎকার আড্ডা হচ্ছে দেখছি। সুনীলদা ঘরে ঢুকলেন। দরোজা খোলাই ছিলো। তিনি অর্চনার বড় ভাই। একটি বিদেশী কোম্পানীতে এক্সিকিউটিবের চাকরি করেন। সব সময়ে হাসিখুশি থাকার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে সুনীলদার । তিনি ঘরে ঢুকতেই মনে হলো, দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিয়েছে কেউ। অনিমেষ, সত্যব্রত, দানিয়েল সবাই একসঙ্গে, বাহ্ চমৎকার। তিনি হাতের ব্যাগটা রেখে এক সঙ্গে বসে গেলেন। কি নিয়ে কথা হচ্ছিলো তোমাদের। অর্চনা বললো, দাদা তুমি তো অফিস থেকে এই মাত্র এলে। কাপড়চোপড় বদলে মুখহাত ধুয়ে তারপর বসো না। এখনতো তুমি ক্লান্ত। আরে রাখো, ক্লান্ত হবো কেননা । আমার নার্ভের মধ্যে জীবনযাপনের ঝকমারী ছাড়া অন্য কোনো ট্যানশন নেই। তাই আমি ক্লান্ত হইনে। তোদের মতো অতো পঁাচগোচ তো আমি বুঝিনে। আমার ওই একটাই কথা, যে কেউ নিজের শরীরের চাইতে বড় কোনো কিছুর জন্য আত্মদান করবে, যতো ভুলই করুক, আলবত একটা ফলবে। এই ধরো না বাংলাদেশের কথা, সেখানে এতো মানুষ প্রাণ দিচ্ছে তার একটা সুফল আসবেই। আবার ধরো শয়ে শয়ে নকশাল ছেলে সিআরপি এবং পুলিশের হাতে প্রতিদিন খুন হচ্ছে তারও একটা ফল হবে। হয়তো তুমি আমি যেভাবেই চাই সেভাবে হবে না, কিন্তু ফল একটা অবশ্যই হবে। সত্যব্রতবাবু বললেন, সুনীলদা আপনার একটা সুবিধে কি জানেন? আপনি সমস্ত জাগতিক এবং সামাজিক দ্বন্দ্ব আকাশে টেনে নিয়ে একটা সমাধান টেনে আনতে পারেন। এ ব্যাপারে আপনি হেগেলেরও এক কাঠি ওপরে। পরম সত্তার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে সমস্ত জাগতিক দ্বন্দ্বের অবসান করে ফেলতে পারেন। সুনীলদা বললেন, তোমার ওই হেগেল টেগেল বুঝিনে। আমি অত্যন্ত সহজ মানুষ এবং সাদা চোখে দুনিয়াটা দেখি। সুনীলদা অন্য রকমের মানুষ। উনাদের সঙ্গে আলোচনায় তিনি বেমানান এ কথাটা দু’পক্ষই বুঝতে পারে। তাই সত্যব্রতবাবু বললেন, চলুন অনিমেষদা যাই। সুনীলদা বললেন, সে কি তোমরা এরই মধ্যে চলে যাবে? তা কেমন করে হয়। বসো গল্প করি। চা খাও। অনিমেষ বাবু বললেন, চা খেয়েছি। আরেকদিন না হয় আসবো আজ চলি। সুনীলদা বললেন, রোববার ছুটির দিন আছে, সকাল বেলা এসো, চুটিয়ে গল্প করা যাবে।

উনারা দু’জন চলে গেলে সুনীলদা আমার কাছে ঘেঁষে বসলেন। ধরো দানিয়েল, তোমাকে একটা ভালো সিগারেট দেই। টেনে দেখো যদি ভালো লাগে আস্ত একটি প্যাকেটই প্রেজেন্ট করবো। আজ এক পার্টি আমাকে আস্ত একটা কার্টুন গিট করেছে। তিনি সিগারেটে টান দিয়ে আরাম করে ধোয়া ছেড়ে বললেন, দুনিয়াতে বিস্তর ভালো জিনিস আছে, মাঝে মাঝে চেখে না দেখলে জীবনটাই বিস্বাদ হয়ে যায় বুঝলে দানিয়েল। তারপর তিনি জুতো জোড়া এবং গায়ের জামাটি খুলে টেবিলের ওপর পা দুটি তুলে দিয়ে বললেন, কিছু মনে করো না দানিয়েল। ইচ্ছে হলে তুমিও তুলে দাও। এখন বলো তোমার যুদ্ধের সংবাদ। আমি বললাম, চলছে। সুনীলদা আসলে কথা বলার একটা উপলক্ষ চাইছিলেন। তারপর বলতে থাকলেন। দেখবে একদিন তোমাদের জয় হবেই। এ তোমাদের ন্যায়যুদ্ধ। জানো তাৈ, যথা ধর্ম তথা। জয়। ধর্ম তোমাদের পক্ষে। একদিন আমি তোমাকে বিজয়দার কাছে নিয়ে যাবো। এসব কথা তিনি আমার চাইতে আরো ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে পারবেন। বিজয়দা এখন রামকৃষ্ণ মিশনে থাকেন। মনে করো না, তিনি ধর্মকর্ম নিয়ে ডুবে থাকেন। মোটেই সত্যি নয়। দেখবে কি রকম বিচক্ষণ মানুষ। জগৎ-সংসারের সব খবর রাখেন। আধুনিক ফিজিক্সের জটিল সব তত্ত্ব ক্যাট মানে বেড়ালের মতো করে বুঝিয়ে দিতে পারেন। দেখে বিশ্বাসই হবে না এই মানুষটি যৌবনে বাঘা যতীনের সঙ্গে বালেশ্বরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বললেন, মানুষের মনের এই যে ট্যানশন তার পেছনে দু’টি কারণ, একটি হলো লোভ, অন্যটি অনিশ্চয়তা। মনের ভেতর থেকে এই দু’বস্তুর অবসান ঘটাতে পারলে দেখবে জীবন অনেক ফলবান এবং পৃথিবী অনেক সুন্দর হয়ে উঠবে। সুনীলদার বক্তৃতাটি আরো দীর্ঘ হতে পারতো। কাজের মেয়েটি খবর দিয়ে গেলো, কে একজন তাঁকে টেলিফোনে ডাকছে। আমি বললাম, সুনীলদা আজ আমার একটু কাজ আছে, সুতরাং চলি। আরেকদিন না হয় আসবো। তিনি জোর করলেন না।

আমার সঙ্গে অর্চনা বড়ো রাস্তার গোড়া পর্যন্ত এলো। বললো, কোনো কথা হলো । দানিয়েল, আমি খুবই দুঃখিত। বললাম, অর্চনা, দুঃখিত হওয়ার কারণ নেই। যা ঘটবার ঘটে যাবে, সত্যিকার অবস্থাটি ভুলে থাকতে পারলে আমি খুশি হই। কিন্তু পারি কই? অর্চনা আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, এক কাজ করো। তোমার বান্ধবীর নাম এবং হাসপাতালের ওয়ার্ড নাম্বারটি লিখে দাও। কলেজ থেকে আসার পথে একবার দেখে আসবো। একটা কাগজ নিয়ে আমি তায়েবার ওয়ার্ড নাম্বার লিখে দিলাম। বাইরে পা বাড়িয়ে আমার বুকের ব্যথাটি মোচড় দিয়ে উঠলো। এই অবস্থার সঙ্গে একটি ঘটনা আমার মনে আছে। একবার দাঁতের খুব ব্যথা হয়েছিলো, যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলাম। এই সময়ে দেখি পাশের বাড়িতে মারামারি লেগেছে। থামাতে গিয়ে তিন ঘণ্টার মতো প্রাণান্তকর যন্ত্রণা ভুলে গিয়েছিলাম। বড়ো রাস্তার ধারে ধারে টিউব লাইটগুলো জ্বলে উঠেছে। গাড়িগুলো তীব্রবেগে ছুটছে। আমি ফুটপাত ধরে হাঁটছি। কোনো কিছুর প্রতি খেয়াল নেই। ছাড়া ছাড়াভাবে নানা কিছু আমার মনের মধ্যে হানা দিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে তায়েবার মুখখানা ভেসে উঠলো। কিছুদিনের মধ্যে সে জগৎ-সংসারের হিসেব চুকিয়ে নেই হয়ে যাবে। তার মায়ের কথা মনে হলো। ওঁরা কি এখনো দিনাজপুরে আছেন? আমার মা, গ্রামের বাড়িঘর, আত্মীয় পরিজন, ঢাকার বন্ধুবান্ধব কখনো কি আবার সকলের সঙ্গে দেখা হবে? আমার সমস্ত স্মৃতির পেছনে আপনা থেকেই মুক্তিযুদ্ধটি এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এই যুদ্ধের জয়পরাজয়ের সঙ্গে আমার অস্তিত্বও যেনো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ কোলকাতা শহরে যে আমি ছায়ার মতো বেড়াচ্ছি, তা যেনো আমার সমগ্র সত্তার একটি প্রক্ষিপ্ত টুকরো মাত্র। সেই সংগ্রামের মূল শরীরটির সঙ্গে আমি যুক্ত হতে পারছিনে কেনো? ঘুরে ঘুরে কথাগুলো মনে বেজে যেতে থাকলো। কিন্তু জবাব দেবে কে?

০৭-৮. তারপরদিন সকালবেলা

তারপরদিন সকালবেলাও আমাকে হাসপাতালে যেতে হলো। তখন বোধ হয় বেলা দশটা এগারোটা হবে। তায়েবার মা, বড়ো ভাই, ডোরা, জাহিদুল হক এবং দোলা সবাই তায়েবার বিছানার চারপাশে ভিড় করে আছে। দরজার পর্দা সরিয়ে ভেতরে পা দিতেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমি কেমন অন্য রকম হয়ে যাই। এই পারিবারিক সম্মেলনে আমার তো কোনো ভূমিকা থাকার কথা নয়। স্বভাবতই আমি ভীরু এবং লাজুক প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু চলে আসাটা ছিলো আরো অসম্ভব। আমার দিকে প্রথম দৃষ্টি পড়লো তায়েবার। এই যে দানিয়েল ভাই, আসুন, ইতস্তত করছেন কেন? দেখতে পাচ্ছেন না মা এবং বড়ো ভাইয়া এসেছেন। আমি কেবিনে ঢুকে তায়েবার মাকে সালাম করলাম। মহিলা আমার মাথায় হাত রাখলেন। সহসা মুখে কোনো কথা যোগালো না। এ মহিলাকে তায়েবার বন্ধু বান্ধবেরা সবাই মা বলে ডাকে। আমিও চেষ্টা করেছি মা ডাকতে। কিন্তু বলতে পারবো না, কি কারণে জিভ ঠেকে গেছে। যা হোক, তিনি জিগ্‌গেস করলেন, কেমন আছো বাবা। আমি স্মিত হেসে বললাম, ভালো। তায়েবার বড়ো ভাইয়া তাঁকে আমরা হেনা ভাই ডেকে থাকি। জিগগেস করলেন, দানিয়েল তোমার সব খবর ভালো তো! তারপর বললেন, চলো, একটু বাইরে যাই। কেবিন থেকে বেড়িয়ে দু’জনে গেটের কাছের মহানিম গাছটির গোড়ায় এলে হেনা ভাই বললেন, চলো এখানে শানের ওপর একটু বসি। বসার পর জিগগেস করলেন, তোমার পকেটে সিগারেট আছে? ভুলে আমি প্যাকেটটা ফেলে এসেছি। নীরবে পকেট থেকে চারমিনার বের করে দিলাম। মুখে একটুখানি অপ্রিয় ভঙ্গি করে হেনা ভাই বললেন, আঃ চারমিনার খাচ্ছো। ভালো সিগারেটের প্রতি হেনা ভাইয়ের মস্ত একটা অনুরাগ আছে। মনক্ষুণ্ণ হলেও তিনি একটা চারমিনার ধরালেন। হেনা ভাই সিল্কের পাঞ্জাবি পরেছেন। সারা গায়ে পাউডার মেখেছেন। চুলটাও বোধকরি আগের দিন কেটেছেন। আমাদের জীবনকে ঘিরে এতো সব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো যেন তাকে কিছু মাত্র স্পর্শ করেনি। আপাতত তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে গেন্ডারিয়ার বাড়ির খোস গল্প করার মুডে রয়েছেন। এ সময়ে তাঁর পায়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। তিনি বললেন, এ বিদ্যাসাগরী চটি জোড়া গতকাল কলেজ স্ট্রীট মার্কেট থেকে কিনলাম। জানো তো বিদ্যাসাগরী চটির মাহাত্ম্য। নীলদর্পন নাটকে নীলকর সাহেব যখন ক্ষেত্রমণিকে লুট করে নিয়ে যাচ্ছিলো বিদ্যাসাগর মহাশয় রাগে ক্ষোভে অন্ধ হয়ে পায়ের চটি জোড়া ছুঁড়ে মেরে ছিলেন। তা পরবর্তী দৃশ্যে গিরিশ ঘোষ যিনি নীলকর সাহেবের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, চটিজোড়া মস্তকে ধারণ করে হল ভর্তি দর্শকের সামনে এসে বলেছিলেন, জীবনে আমি অভিনয় করে অনেক পুরস্কার পেয়েছি। তবে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চটি জোড়ার মতো এতো বড়ো পুরস্কার কোনোদিন পাইনি এবং পাবোও না। তারপর তো ড্রপসীন পড়ে গেলো। হল ভর্তি লোকের সেকি বিপুল করতালি। দৃশ্যটা একবার কল্পনা করতে চেষ্টা করো।

কেবিনে এসে দেখি ভাইবোন সবাই মিলে ডোরার রবীন্দ্র সঙ্গীতের গল্প করছে। জাহিদুল তাতে আবার মাঝে মধ্যে ফোড়ন কাটছে। উৎসাহটাই মনে হচ্ছে তায়েবার অধিক। এমন খোস গল্প করার আশ্চর্য প্রশান্তি এরা সকলে কেমন করে আয়ত্ব করলেন, আমি ভেবে অবাক হয়ে যাই। তায়েবা জীবন মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। ডোরা তার জীবনের মারাত্মক দুর্ঘটনাটি ঘটিয়ে বসে আছে। আমাদের সকলের অস্তিত্ব চেকন সূতোয় ঝুলছে। এই ধরনের অবস্থায় নির্বিকার মুখ ঢেকে এঁরা রবীন্দ্র সঙ্গীতের আলোচনা কি করে করতে পারেন! জীবন সম্ভবত এ রকমই। আঘাত যতো মারাত্মক হোক, দুঃখ যতো মর্মান্তিক হোক, এসময় জীবন সব কিছু মেনে নেয়। দুনিয়াতে সব চাইতে আশ্চর্য মানুষের জীবন।

তায়েবার মা তায়েবার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। ভদ্রমহিলার তেজোব্যঞ্জক মুখমণ্ডলে এক পোঁচ ঘন গাঢ় বিষাদের ছায়া। সকলেই কথা বলছে, তিনি বড়ো বড়ো চোখ মেলে তাকিয়ে আছেন। সাদা কালো চুলের রাশি এক পাশে হেলে পড়েছে। অসাধারণ ব্যক্তিমণ্ডিত চেহারা। যৌবনে কি সুন্দরীই না ছিলেন। মহিলার দিকে একবার তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। চেহারায় এমন একটা আকর্ষণী শক্তি আছে, বারবার তাকাতে বাধ্য করবে। আপাতত মাধুর্যমণ্ডিত মনে হলেও ধারালো কঠিন কিছু আত্মগোপন করে আছে। অনেকবার এই মহিলার কাছাকাছি এসেছি। কিন্তু খুব কাছে যেতে সাহস পাইনি। মহিলার প্রতি যেমন গভীর আকর্ষণ অনুভব করতাম, তেমনি আবার ভয়ও করতাম।

উনারা যখন উঠলেন, তখন বেলা সাড়ে এগারোটা হবে। আমি কি করবো স্থির করতে না পেরে উশখুশ করেছিলাম। তায়েবার মা বলে বসলেন, বাবা দানিয়েল, তুমি আমার সঙ্গে এসো। আমি সসংকোচে জানতে চাইলাম, কোথায়? তিনি বললেন, ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে আমার দেওরের বাসায়। আর কেউ যাবে না? না দোলা যাবে ক্যাম্পে। হেনা দিনাজপুরে লোকদের সঙ্গে থাকে। ডোরার কোথায় রিহার্সেল না কি আছে। তায়েবা কলকলিয়ে উঠলো, যান দানিয়েল ভাই, মার সঙ্গে যেয়ে চাচার সাথে পরিচয়টা করুন। আপনার অনেক ভালো হবে। চাচার সঙ্গে খাতির করতে পারলে উর্দু ভাষাটা তাড়াতাড়ি শিখে নিতে পারবেন। চাচাঁদের বাড়িতে কেউ বাংলা ভাষায় কথা বলে না। যান আপনার একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে।

আমি একটা টানারিক্সা চেপে তায়েবার মাকে নিয়ে পথ দিলাম। যেতে যেতে তিনি আমাকে বললেন, আমার দেওরের বাসা যেখানে নিয়ে যাচ্ছি, সেখানে একটু সাবধানে কথাবার্তা বলতে হবে। ওরা কেউ বাংলা ভাষায় কথাবার্তা বলে না, এমন কি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে প্রাণের থেকে ঘৃণা করে। তথাপি আমি থাকছি, কারণ আমার অন্য কোথাও থাকার জায়গা নেই। ওরা আমাদের থাকতে জায়গা দিয়েছে। কারণ এই বাড়িটার অর্ধেকের দাবিদার ছিলাম আমরা। কিন্তু সে কথা আমরা কখনো উত্থাপন করিনি। ওদের জীবনের এমন একটা ধাঁচ তার সঙ্গে আমার একেবারেই মেলে না। আর আমাদের মধ্যে কি সব ঘটছে না ঘটছে সে বিষয়ে তাদের সামান্যতম জ্ঞান নেই। যেই কথাগুলো বললাম, মনে রাখবে। তোমাকে এই বাড়িটাতে অনেকবার আসতে হবে। তায়েবাদের পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে আবছা আবছা অনেক কথা শুনেছি। সেগুলো কানে নেয়ার বিশেষ প্রয়োজন বোধ করিনি। শুনেছিলাম তাদের বাবার পরিবারের কেউ বাংলা ভাষায় কথাবার্তা বলেন না। বর্ধমান তাদের স্থায়ী নিবাস হলেও হাঁড়ে-মাংসে, অস্তি-মজ্জায় তায়েবার বাবা চাচারা মনে করেন তারা পশ্চিমদেশীয়। বাংলামুলুক তাদের পীরমুরিদী ব্যবসার ঘাঁটি হলেও অত্যন্ত যত্নে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের ভেদ চিহ্নগুলো ঘষে মেঝে তকতকে ঝকঝকে করে রাখে। এ ব্যাপারে উর্দু ভাষাটা তাঁদের সাহায্য করেছে সবচাইতে বেশি। স্থানীয় মুসলিম জনগণ তাদের এই বিচ্ছন্নতাবাদী মাসসিকতাকে অত্যন্ত পবিত্র জ্ঞান করে মেনে নিয়েছে। কারণ পীর বুজুর্গরা উর্দু ভাষার মাধ্যমে ধর্মোপদেশ দেবেন, কোরান কেতাবের মানে বয়ান করবেন এটাতো স্বাভাবিক। সাথে সাথে তারা যদি দৈনন্দিন কাজকর্মে ঐ ভাষাটিকে ব্যবহার করেন, তাতে তো দোষের কিছু নেই, বরং স্থানীয় জনগণের চোখে তাঁদের সম্ভ্রম অনেকগুণে বেড়ে যাওয়ার কথা। এই পরিবারটিতে তায়েবার মায়ের মতো একজন মহিলার বিয়ে হওয়া সত্যিকারের বিস্ময়ের ব্যাপার। কিন্তু পৃথিবীতে অনেক অঘটন ঘটে যায়।

তায়েবার মা শ্বশুর বাড়িতে প্রবেশ করে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা পরিবেশ থেকে। তাঁদের বাড়ি ছিলো বোলপুরের কাছাকাছি। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের একেবারে সন্নিকটে। তায়েবার মা বালিকা বয়সে পাঁচ ছয় বছর শান্তিনিকেতনে পড়ালেখা করেছেন। বিয়ে হওয়ার পর শ্বশুর বাড়িতে এসে একটা প্রকাণ্ড সমস্যার মধ্যে পড়ে গেলেন। নতুন বৌ উর্দু ভাষায় কথা বলে না। এমনকি পারিবারিক ভাষাটি শিক্ষা করার কোনো চারও নতুন বৌয়ের নেই। দীর্ঘ ইতিহাস সংক্ষেপ করে বলতে গেলে শ্বশুর বাড়িতে স্বামী এবং দাসী চাকর ছাড়া আর কেউ তার সাথে কথা বলে না। এই অবস্থাটা অনেকদিন কেটেছে। এই সময়ে ভারতবর্ষ দু টুকরো হয়ে হিন্দুস্থান পাকিস্তান হলো। নতুন বউ স্বামীকে অনেক করে বুঝিয়ে সুজিয়ে বর্ধমান এবং কোলকাতার সমস্ত স্থাবর সম্পত্তির দাবি ছেড়ে দিয়ে পূর্বপাকিস্তানের দিনাজপুরে এসে নতুন সংসার পেতে বসেন।

নতুন সংসারে থিতু হয়ে বসার পর মহিলা তাঁর পুত্রকন্যাদের গড়ে তোলায় মনোযোগ দিলেন। শ্বশুর বাড়ি থেকে মুসলিম সমাজ সম্বন্ধে একটা প্রচণ্ড ভীতি নিয়ে এসেছিলেন। দিনাজপুরে বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে অনেকদিন বসবাস করার পরও সে ভীতি তাঁর পুরোপুরি কাটেনি। সমাজে বাস করতেন বটে, কিন্তু একটা দূরত্ব সব সময় রক্ষা করতেন সে কারণে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য সব সময় হিন্দু শিক্ষক নিয়োগ করতেন। তাছাড়া বালিকা বয়সে তাঁর মনে শান্তিনিকেতনে যে সংস্কৃতির রঙ লেগেছিলো, অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সেও তা ফিকে হতে পারেনি। ছেলেমেয়েদের রবীন্দ্রনাথের গান শেখানো এবং রবীন্দ্রসাহিত্য পড়ানোর একটা অনমনীয় জেদ মহিলাকে পেয়ে বসে। এই ফাঁক দিয়ে প্রগতিশীল রাজনীতি, কমিউনিস্ট পার্টি এসব একেবারে বাড়ির অন্তঃপুরে প্রবেশ করে। তিনি নিজেও এসবের মধ্যে জড়িয়ে পড়েন। মহিলার স্বামী নির্বিরোধ শান্তশিষ্ট মানুষ। সংসারের সাতে পাঁচে থাকেন না। অধিকন্তু মহিলা তার ইচ্ছাশক্তির সবটুকু পরিকল্পনার পেছনে বিনা বাধায় ব্যয় করতে পেরেছিলেন।

তায়েবারা তিন বোন যখন একটু সেয়ানা হয়ে উঠলো তিনি তাদের স্থায়ীভাবে ঢাকায় রেখে লেখাপড়া গানবাজনা ইত্যাদি শেখাবার একটা উপায় উদ্ভাবন করলেন। বিনিময় করে দিনাজপুরে যে ভূসম্পত্তিটুকু পেয়েছিলেন, তার একাংশ বিক্রি করে ঢাকা শহরে গেন্ডারিয়ায় এই ছোট্টো বাড়িটা কিনলেন। বাড়ির পেছনের খালি জায়গাটিতে দু’টি কাঠচেরাই কল বসালেন এবং ছোট্টো ছেলেটাকে তার দেখাশোনার দায়িত্ব দিলেন। সেই সময়ে ঢাকা শহরে জাহিদুলরা রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রচার প্রসার নিয়ে আন্দোলন করছিলেন। এই রবীন্দ্র সঙ্গীতের সূত্র ধরেই জাহিদুল এবং রাশেদা খাতুনের সঙ্গে তায়েবাদের পরিচয়ের সূত্রপাত। তায়েবার মা তো জাহিদুলদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলেন। এতোদিন তিনি মনে মনে এমন সুরুচিসম্পন্ন কাউকে সন্ধান করছিলেন, যার ওপর তাঁর অবর্তমানে মেয়েদের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তবোধ করতে পারবেন। একথা মানতেই হবে যে অনেকদিন পর্যন্ত জাহিদুল এবং রাশেদা খাতুনেরা সে দায়িত্ব। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আসছিলেন। আমি নিজের চোখেই দেখেছি রাশেদা খাতুন আপন পেটের মেয়েটির চাইতে ভোরার প্রতি অধিক যত্নআত্তি করেছেন। আর জাহিদুল প্রতিদিন তাদের খবরাখবর নিচ্ছে। কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস! আজ রাশেদা খাতুন আর ভোরা পরস্পরের সতীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাহিদুল ডোরাকে বিয়ে করেছে, আর জাহিদুলকে দেখিয়ে দেয়ার জন্যে রাশেদা খাতুন শশীভূষণকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে চলে গেছেন। এই সবকিছুর জন্য কি একটা যুদ্ধই দায়ী? দেশে যদি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতো তাহলে এই জীবনগুলো কি এমনভাবে বেঁকে চুরে যেতো? কি জানি জীবন বড়ো আশ্চর্য জিনিস। জীবনের বিস্ময়ের অন্ত নেই।

এই মহিলা যার পাশে আমি বসে আছি, যার তেজোব্যঞ্জক মুখমণ্ডলে চিন্তার বড়ো বড়ো গভীর বলিরেখা পড়েছে, যাকে দেখলে সব সময় সিংহীনির কথা মনে উদয় হয়েছে, জানিনে তিনি কি ভাবছেন তিনি সারা জীবন যে সমস্ত বস্তুকে মূল্যবান মনে করে লড়াই করে এসেছেন, সেগুলো কি এখনো তাঁর মনে কাজ করে যাচ্ছে? সমস্ত জীবন ধরে যে অপার আগ্রহ নিয়ে আকাশ দেখবেন বলে অক্লান্ত জঙ্গল কাটার কাজ করেছেন, আজ সেই নীল নির্মেঘ আকাশ থেকে তাঁর মাথায় বজ্র ঝরে পড়লো। তিনি দোষ দেবেন কাকে? দায়ী করবেন কাকে? তায়েবার মার পাশাপাশি রিকশা চেপে যাচ্ছি। আমি জানি তিনি আমার কাছে কিছু জিগগেস করবেন না। আমিও কিছু জানতে চাইবে না। হঠাৎ গলায় ঘর্ঘর শব্দটি শুনতে পেলাম। ভদ্রমহিলার হাঁপানি ছিলো সেটি জাগতে চাইছে। ভদ্রমহিলা প্রাণপণ শক্তিতে ঠোঁট দুটো চেপে ধরে বললেন, এই রিকশা বাঁয়ে রাখো। এরই মধ্যে আমরা ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে এসে দাঁড়ালাম। বাড়িটার গঠনশৈলী দেখে মনে হবে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে যে ধরনের বাড়ি হতো এটি তার একটি। প্রকাণ্ড চওড়া দেয়াল। লাল ইটগুলো বিবর্ণ হয়ে গেছে। দরোজা জানালাগুলো আকারে আয়তনে বেশ বড়োসরো। কার্ণিশের কাছে দু’তিনটে অশ্বথ গাছের চারা বেশ উঁচু হয়ে উঠেছে। কতোকাল সংস্কার হয়নি কে জানে।

তায়েবার মা আমাকে বললেন, তুমি এখানে দাঁড়াও আমি ভেতরে যাই। যা বলছি মনে থাকে যেনো। তোমার তো আবার অস্থির মেজাজ। একটু বুঝে শুনে। কথাবার্তা বলবে। আমার তো মনে হচ্ছে এখানে আমাকে অনেকদিন থাকতে হবে। মহিলা পেছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন। আমার মনে হলো এই বাড়িতে এখনো সদর অন্দর মেনে চলা হয়।

একটু পর বুড়ো মতো দাড়িঅলা এক লোক এসে বললো, আপ মেরে সাথ আইয়ে। লোকটির পেছন পেছন আমি তিন তলা দালানের একটি ঘরে প্রবেশ করলাম। ছাদটি অনেক উঁচু। বিরাট বিরাট লোহার বীমের ওপর বসানো রয়েছে ছাদ। দরোজা জানালায় খুব দামী মোটা কাপড়ের পর্দা টাঙ্গানো আছে। কিন্তু সেগুলো এতো ময়লা যে দেখতে ইচ্ছে করে না। ঘরে হাল আমলের একজোড়া সোফা সেট আছে বটে। কিন্তু না থাকলেই যেনো অধিক মানানসই হতো। দেয়ালে মক্কা শরীফ, মদিনা শরীফ, বাগদাদ শরীফ ও আজমীর শরীফের ছবি মোটা মোটা দামী ফ্রেমে টাঙ্গানো। সোনালী অক্ষরে আরবীতে আল্লার নাম, মুহম্মদের নাম বাঁধিয়ে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়েছে। তাছাড়া দেওবন্ধ থেকে প্রকাশিত একখানা ইসলামী ক্যালেন্ডার দেয়ালে ঝুলছে। সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে হলো আমি অন্য একটা জগতে এসে প্রবেশ করেছি। অবাক হয়ে সবকিছু লক্ষ্য করছি। এই সময়ে খুবই মোলায়েম ভঙ্গিতে সালাম দিয়ে এক ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন। তাকিয়ে দেখলাম, দোহারা চেহারার অত্যন্ত দীর্ঘকায় গৌরকান্তি এক ভদ্রলোক। মুখে অল্প অল্প দাড়ি। হঠাৎ করে দেখলে বাঙালি বলে মনে হতে চায় না। আমি উঠে দাঁড়ালাম, তিনি বললেন, বসেন বসেন, আমি তায়েবার চাচা। আমার নাম আসগর আলী শাহ্। বুঝতে পারলাম ভদ্রলোকের মাতৃভাষা বাংলা নয়।

ভদ্রলোক বললেন, ভাবীর মুখে আপনার কথা শুনেছি। আপনি কেমন আছেন, তবিয়ত ভালো তো। আমি উপস্থিত মতো কিছু একটা বলে ভদ্রতা রক্ষা করলাম। তারপরে ভদ্রলোক মৃদু হাততালি দিলেন। সেই আগের লোকটি দেখা দিলো। তিনি আদেশ দিলেন, মেহমান কি লিয়ে শরবত আওর নাশতা লে আও। কিছুক্ষণ পর লোকটি খাঞ্চায় করে নাস্তা এবং শরবত নিয়ে এলো। খাঞ্চাটি রূপোর এবং ওপরে ফুলতোলা কাপড়ের ঢাকনা দেয়া, গেলাসটি মজবুত এবং কারুকাজ করা। এই বাড়িতে সব কিছুই পুরোনো। এমনকি তায়েবার চাচা যিনি আমার বিপরীতে বসে আছেন, বসনেভূষণে অপেক্ষাকৃত একালের সম্ভ্রান্ত মুসলমান ভদ্রলোক মনে হলেও কোথায় একটা এমন কিছু আছে আমার মনে হতে থাকলো ভদ্রলোকের সঙ্গে উনবিংশ শতাব্দীর একটা যোগ রয়েছে। ভদ্রলোক সেটা ঢেকে রাখার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করছেন না। সে যা হোক, ভদ্রলোক ঢাকনা উঠিয়ে বললেন, নাস্তা নিন। আমি তো দেখে অবাক। পাঁচ ছটা বিরাট বিরাট পরোটা, আবার তার সঙ্গে পেয়ালা ভর্তি খাসির মাংস, হালুয়া, শরবত এতোসব খাবো কি করে। পেটে জায়গা থাকতে হবে তো। তাছাড়া আমি সকাল বেলা খেয়ে বেরিয়েছি। তিনি বললেন, কিছু মুখে দিয়ে দেখেন। একেবারে না করতে নেই। আমিও বুঝতে পারলাম একেবারে না খেলে তিনি অপমানিত বোধ করবেন। এক টুকরো পরোটা ছিঁড়ে মুখে দিলাম। পরোটা মাংসের স্বাদ পেয়ে মনে হলো আমি যে প্রথমে পেটে ক্ষুধা নেই মনে করেছিলাম সেটা সত্যি নয়। দেখতে দেখতে চারটা পরোটা, পেয়ালার সমস্ত মাংস খেয়ে ফেললাম। সেই লোকটি আমাকে চিলুমচিতে হাত ধুইয়ে দিলেন। আমি চামচ দিয়ে কেটে কেটে প্লেটের সব হালুয়া খেয়ে শেষ করলাম। ভদ্রলোক এক দৃষ্টে আমার খাওয়া দেখতে লাগলেন। হালুয়া খাওয়া শেষ হলে ভদ্রলোক শরবতের গেলাসটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, শরবত পান করেন। আমি ঢকঢক করে শরবতটাও খেয়ে নিলাম। ভদ্রলোক আমার খাওয়ার ধরন দেখে কিছু একটা মনে করেছেন। সেটা আমি বুঝতে পারলাম। আমাকে লজ্জা থেকে উদ্ধার করার জন্যই বললেন, ভাবী বলেছেন, আপনি অনেক এলেমদার মানুষ। অনেক কেতাব লিখেছেন। তা এখন আপনাদের খবর কি? যুদ্ধ কেমন চলছে? আমি একটুখানি মুশকিলে পড়ে গেলাম। ভদ্রলোককে কি জবাব দেই। জানতে পেরেছি ভদ্রলোক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘোরতরো বিরোধী। এই ফ্রী স্কুল এলাকাটিও ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক স্থান। এখানকার কশাইরা ছেচল্লিশে হিন্দু মুসলমানের রায়টে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো। এখনো ভারত পাকিস্তানে কোনো ধরনের গোলযোগ হলে এই ফ্রি স্কুল স্ট্রীট থেকে শহরের রাজপথে পাকিস্তানের সপক্ষে মিছিল বের হয়ে যায়। উনিশশো পঁয়তাল্লিশ ছেচল্লিশ সালের সেই বিখ্যাত শ্লোগানঃ কান মে বিড়ি মুমে পান, লেড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের রেশ এখানকার মানুষের মন থেকে একেবারে অবসিত হয়ে যায়নি। তথাপি ভদ্রলোককে সন্তুষ্ট করার জন্যে কিছু একটা বলতে হয়। তাই বললাম, সবটাতো আমি জানিনে তবে এটা নিশ্চিত যে একদিন আমরা জিতব। জিতবেন তো বটে, তবে আপনারা নয়, জিতবে হিন্দুস্থান এবং হিন্দুরা। আপনারা তো জানেন না, লাখো জান কোরবান করে মুসলমানেরা পাকিস্তান কায়েম করেছে। আর আপনারা সেটা ভেঙ্গে ফেলতে যাচ্ছেন। ভদ্রলোক আমার হাত ধরে বললেন, একটু এদিকে আসুন। তিনি আমাকে জানালার পাশে নিয়ে গেলেন। তারপর একটা একতলা বাড়ির দিকে অঙুলি প্রসারিত করে বললেন, ওই যে দেখছেন ওটা আবদুল ওয়াহেদের বাড়ি। আবদুল ওয়াহেদ কে ছিলো জানেন? জবাবে আমি অজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তিনি অবাক হয়ে গেলেন। আপনি আবদুল ওয়াহেদের নাম শুনেননি? আমি আবার অজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তিনি দু’হাতে তালি দিলেন। সেই বুড়ো লোকটি দেখা দিলে তিনি বললেন, হান্নান সাহেবকো বোলাকে লে আও।

কিছুক্ষণ পর একজন পৌঢ় ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে সালামালায়কুম দিলেন। ভদ্রলোক বেশ বুড়ো। চোখের ভূরু পর্যন্ত পেকে গেছে। শাহ আসগর আলী সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। আমাকেও দাঁড়াতে হলো। শাহ সাহেব বললেন, ইনি হান্নান সাহেব, আবদুল ওয়াহেদের চাচা। উনার সঙ্গে কথাবার্তা বলুন। তারপর পৌঢ় হান্নান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ইয়ে জয় বাংলাকা আদমী হ্যায়। তাজ্জব কা বাত ইয়ে হ্যায় কভি আবদুল ওয়াহেদ কো নাম নেহি শুনা।

হান্নান সাহেবের সঙ্গে আমাকে বসিয়ে দিয়ে শাহ আসগর আলী সাহেব কাজের দোহাই দিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন। হান্নান সাহেব আমার সঙ্গে বিশুদ্ধ বাংলায়। কথা বলতে আরম্ভ করলেন। তিনি বলতে থাকলেন, এই কোলকাতা শহরে এক সময়ে তাঁরা মিষ্টির দোকানে বসে মিষ্টি খেতে পারতেন না। দোকানের বাইরে মুসলমানদের দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। ভদ্রলোক আমার মাথায় হাত দিয়ে বলতে লাগলেন, তখনো আপনাদের জন্ম হয়নি। সে জন্য পাকিস্তান কি চীজ বুঝতে পারবেন না। আমি বিনীতভাবে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, পাকিস্তান কি বস্তু সে বিষয়ে কিছুটা কঠিন জ্ঞান আমাদের হয়েছে। পাকিস্তানীরা তিরিশ বছর আমাদের ওপর শোষণ করেছে। বিগত পঁচিশে মার্চ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত তারা আমাদের দেশের লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে। স্মৃতি ভারাতুর বৃদ্ধকে যতোই বোঝাতে চেষ্টা করিনে কেন, তিনি তার স্মৃতি স্বপ্নের জগৎ থেকে এক তিলও অগ্রসর হতে রাজী নন। ফের তিনি বলে যেতে লাগলেন, জিন্নাহ সাহেব পাকিস্তানের ডাক দিয়েছেন। কিছু কিছু এলেমদার মানুষকে সংগঠিত করবার কোনো লোক ছিলো না, আমার ভাইপো ওয়াহেদ মিয়া ছাড়া। ওই যে আপনাদের শেখ মুজিব। তিনিও তো আমার ভাইপোর পেছন পেছন ঘোরাফেরা করতেন। তখন টিঙটিঙে ছোকরা শেখ মুজিবকে চিনতো কে? ওয়াহেদের চেষ্টার ফলেই তো তিনি অল বেঙ্গল স্টুডেন্টস মুসলিম লীগের সামনের কাতারের একজন নেতা বনে গেলেন। ওই যে একতলা বাড়িটা দেখছেন, ওখানে শেখ মুজিব কতোদিন কলোরাত কাটিয়েছেন। ওই বাড়িতে শুধু শেখ মুজিব কেনো, ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, স্যার নাজিমুদ্দীন, আবুল হাশিম প্রমুখ মুসলিম লীগের বড়ো বড়ো নেতারা তশরিফ আনতেন। একবার তো স্বয়ং কায়েদ-ই-আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্ অসুস্থ আবদুল ওয়াহেদকে দেখতে এসেছিলেন। আমি অনুভব করতে পারলাম, ফ্রি স্কুল স্ট্রীটের বাসিন্দাদের চোখে এই বাড়িটা অত্যন্ত পবিত্র। কেননা এই বাড়িতে এমন একজন মানুষের জন্ম হয়েছিলো যিনি পাকিস্তান নামক একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে শ্রম, স্বপ্ন সব ব্যয় করে অকালে প্রাণত্যাগ করেছিলেন। পাকিস্তানের আদর্শের প্রতি এই সমস্ত লোক এতো অনুগত, তথাপি তারা অন্যদের মতো পাকিস্তানে বসবাস করতে যাননি কেনো? সত্যিই তো এটা একটা গভীর প্রশ্ন। আমি হান্নান সাহেবকে জিগগেস করলাম, আপনারা পাকিস্তানকে এতো ভালোবাসেন, তবু বসবাস করতে পাকিস্তান যাননি কেনো? এই সময়ে তায়েবার চাচা শাহ আসগর আলী ঘরে প্রবেশ করলেন। তিনিও শুনলেন প্রশ্নটা। জবাবে বললেন, হ্যাঁ এটা একটা কথার মতো কথা বটে। শুরুতে আমরা ধরে নিয়েছিলাম, কোলকাতা পাকিস্তানের মধ্যে পড়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত কোলকাতা তো হিন্দুস্থানের অংশ হয়ে গেলো। আমরা সাত পাঁচ পুরুষ ধরে এই কোলকাতায় মানুষ। এর বাইরে কোথাও যেতে হবে সে কথা চিন্তাও করতে পারিনি। তাছাড়া আমার মনে বরাবর একটা সন্দেহ ছিলো। পূর্বপাকিস্তানের মুসলমানেরা সত্যিকারের ইসলামী আহকাম মেনে চলে একথা বিশ্বাস করতে মন চাইতো না। আমার কিছু কিছু আত্মীয়স্বজন পূর্বপাকিস্তানে বসবাস করতে গেছেন। তাঁদের চলাফেরা দেখে মনটা দমে গিয়েছিলো। দেখে শুনে আমার ধারণা হয়েছিলো, তামাম হিন্দুস্থানের মুসলমানেরা লড়াই করে যে পাকিস্তান কায়েম করেছে এই মানুষগুলো সেই রাষ্ট্রটিকে টিকে থাকতে দেবে না। বাংলা ভাষার নামে কোনো মুসলমান এতো হল্লাচিল্লা করতে পারে, তাতো ছিলো আমার ধারণার অতীত। বলুন, এসব হিন্দুদের চক্রান্ত নয়? তখন পাকিস্তান ধ্বংসের আলামত স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম। হিজরত করতে পারতাম। কিন্তু লাভ হতো না। এখন যেমন হিন্দুস্থানে আছি তখনো হিন্দুস্থানে থাকতে হতো। আপনাদের বাংলাদেশ তো আরেকটা হিন্দুস্থান হতে যাচ্ছে, সেখানে সত্যিকার মুসলমানদের স্থান কোথায়? এঁদের সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন। পাকিস্তান কি বস্তু বাস্তব অর্থে তাঁর কোনো প্রত্যক্ষ ধারণা এদের নেই। এঁরা আছেন তাঁদের স্বপ্ন এবং স্মৃতির জগতে। যেহেতু তারা মনের থেকে হিন্দুদের ঘৃণা করেন, সেজন্য তাঁদের একটা কল্পস্বর্গের প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যবশতঃ ভারতীয় মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ট অংশের চিন্তাভাবনা এই একই রকম। তারা ভারতে বসবাস করবেন, কিন্তু মনে মনে চাইবেন পাকিস্তানটা টিকে থাকুক। আমি ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে তায়েবার চাচার বাড়িতে এসেছি কোনো বিষয়ে বিতর্ক করার জন্য নয়। এ ব্যাপারে তায়েবার মা আমাকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন। সুতরাং শাহ আসগর আলী এবং হান্নান সাহেব পাকিস্তানের পক্ষে যা বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ করে শুনে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর রইলো না। ইচ্ছে হচ্ছিলো ছুটে পালিয়ে আসি। কিন্তু পারছিলাম না তায়েবার মার কথা ভেবে। যেখানে আমার এক দণ্ড অপেক্ষা করতে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে সেই পরিবেশে এই মহিলা কি করে দিবসরজনী যাপন করছেন, সে কথা চিন্তা করে চুপ করে রইলাম। এই পুঁতিগন্ধময় অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মহিলা সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। উনিশশো সাতচল্লিশ সালে স্বেচ্ছায় এই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অনিশ্চিতের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। তাঁর মনে অগাধ অটুট বিশ্বাস ছিলো। তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের জন্য ভিন্ন রকমের একটা সুন্দর জীবন নির্মাণ করতে পারবেন। সামাজিক আচার সংস্কার দু’পায়ে দলে যা শ্ৰেয় উজ্জ্বল সুন্দর বলে মনে হয়েছে, সেদিকে সমস্ত কর্মশক্তিকে ধাবিত করেছেন। আজকে আবার তাঁকে সেই বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছে। এ যেনো বয়স্ক সন্তানের মাতৃগর্ভে ফিরে যাওয়ার মতো ব্যাপার। যে অবস্থায় তিনি এই বাড়ি এই আত্মীয়-স্বজনদের ছেড়ে গিয়েছিলেন সেই বাড়ির অবস্থা এখনও তেমনই আছে, তিল পরিমাণ পরিবর্তন হয়নি। আত্মীয় স্বজনেরা সেই স্মৃতির স্বপ্নের জগতে বসবাস করছেন। মাঝখানের তিরিশটি বছর যেনো কিছু নয়। চেষ্টা করলে তিনি অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করতে পারতেন। এ বাড়িতে কেনো উঠলেন তা আমার বোধবুদ্ধির সম্পূর্ণ বাইরে। আমি বাইরের মানুষ। আমার কাছে এরা যেভাবে কথাবার্তা বললেন, তার মধ্যে গভীর একটা ঘৃণার রেশ রয়েছে। মহিলা কি উঠতে বসতে প্রতিনিয়ত আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হচ্ছেন না? এইসব কথা ঢেউ দিয়ে মনে বার বার জেগে উঠছিলো। তায়েবার মা আমাকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছেন, নিশ্চয়ই তাঁর কোনো উদ্দেশ্য আছে।

অনেক কথাবার্তার পর শাহ আসগর এবং হান্নান সাহেব আমাকে রেহাই দিলেন। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। উঠে যাওয়ার সময় শাহ সাহেব বললেন, আপনি আরাম করে বসুন। ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে দিলেন। ভাবী সাহেবা বোধ করি আপনার সঙ্গে কি আলাপ করবেন। উনারা চলে গেলে তায়েবার মা ঘরে প্রবেশ করেন। আমার মাথায় হাত দিয়ে জিগেস করলেন, কি বাবা দানিয়েল, তোমার কি খুব খারাপ লেগেছে? এঁরা এ রকমই। সে কথা তো তোমাকে আগে বলেছি। আশা করি আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন সম্বন্ধে তোমার একটা ধারণা হয়েছে। আমি ঈষৎ হাসলাম। তিনি আমার উল্টোদিকে বসলেন। তারপর ঠোঁট ফাঁক করে একটুখানি হাসবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হাসিটা ভারী মলিন দেখালো। তিনি বললেন, তোমাকে বাবা ডেকে এনেছি একটু কথাবার্তা বলার জন্য। দেখছে না চারপাশে কেমন দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। কথা না বলে না বলে ভীষণ হাঁফিয়ে উঠেছি। এভাবে কিছুদিন থাকলে আমি নিজেও অসুখে পড়ে যাবো। এখন যে এখানে সেখানে অল্প-স্বল্প হেঁটে চলে বেড়াচ্ছি সেটিও আর সম্ভব হবে না। আসলে মহিলা কোন্ কথাটির অবতারণা করতে যাচ্ছেন। সেটি আমি অনুমান করতে চাইলাম। আমি জানতাম তার স্বভাব বড়ো চাপা। খুব প্রয়োজন না হলে মনের কথা কখনো মুখে প্রকাশ করবেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি জানতে চাইলেন, আমি কোলকাতা এসেছি কবে এবং চট্টগ্রামে আমার মাও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের কোনো বিপদ হয়েছে কিনা। তারপর তিনি এদিক ওদিক ভালো করে তাকিয়ে জিগগেস করলেন, তায়েবার অসুখটা কি জানো? আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ জানি। তিনি এ নিয়ে আর কথা বাড়ালেন না। ডোরার খবরও কি পেয়েছো? আমি বললাম, হ্যাঁ পেয়েছি। মহিলা বললেন, আমার হয়েছে কি বাবা জানো চারদিক থেকে বিপদ। কাউকে কইতেও পারছিনে, আবার সইতেও পারছিনে। জাহিদুলটা এমন একটা কাণ্ড ঘটাবে তা আমি কখনো বিশ্বাসই করতে পারিনি। তার সততা এবং ভালো মানুষীর ওপর আমি বড়ো বেশি নির্ভর করেছিলাম। ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লেন। তিনি আবার জিগ্‌গেস করলেন, হেনার খবর শুনেছো কিছু? বললাম, হেনা ভাই সম্পর্কে আমি কিছু জানিনে। আজ সকালে হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। জানো হেনা একটা বিয়ে করে ফেলেছে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এরই মধ্যে হেনা ভাই আবার বিয়ে করে ফেললেন? মনের ঝাঁঝ কথার মধ্যে প্রকাশ হয়ে পড়লো। চেপে রাখতে পারলাম না। আমার মনোভাব টের পেয়ে মহিলা হেনা ভাইয়ের পক্ষ সমর্থন করে বললেন, বিয়েটা করে হেনা মানুষের পরিচয় দিয়েছে। মেয়েটির স্বামীকে পাকিস্তানী সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করেছে। দেখাশুনা করার কেউ ছিলো না। কচি মেয়ে কোথায় যাবে? তাই বিয়ে করে এখানে নিয়ে এসেছে এবং বালুহাক্কাক লেনে আলাদা বাসা করে থাকছে। আমি মনে করি হেনা ভাই আরো কিছুকাল পর বিয়েটা করলে শোভন হতো। কি করবো ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়ে গেলে কি আর মা বাবার কথার বাধ্য থাকে! আমার হয়েছে কি বাবা জানো সমূহ বিপদ। কোথাও গিয়ে শান্তি পাইনে। মনে সর্বক্ষণ একটা উথাল পাতাল ঝড় বইছে। দু’দণ্ড স্থির হয়ে বসবো সে উপায় নেই। এরই মধ্যে আবার হাঁপানির জোরটা অসম্ভব রকম বেড়ে গিয়েছে। আমার বড়ো মেয়েটি যে ছিলো আমার সব রকমের ভরসার স্থল, এখন হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে। আমার বুকে ভীষণ ব্যথা, ভীষণ জ্বালা। কোথায় যাবো, কি করবো পথ খুঁজে পাচ্ছিনে। ভদ্রমহিলার দু’চোখ ফেটে ঝর ঝর করে পানি বেরিয়ে এলো। বুকটা কামারের হাপরের মতো ফুলে ফুলে উঠতে লাগলো। মাত্র অল্পক্ষণ। অত্যন্ত ক্ষিপ্রতা সহকারে আঁচলে চোখ মুছে নিয়ে অপেক্ষাকৃত শান্ত হয়ে বসলেন। আশ্চর্য সংযম। ভদ্রমহিলা স্বাভাবিক কণ্ঠে নিচু স্বরে বললেন, লোকে মনে করতে পারে এই ছেলেমেয়েরা আমার গর্ভের কলঙ্ক। কিন্তু মায়ের কাছে ছেলেমেয়ে তো ছেলেমেয়েই। তারা যতো ভুলই করুক আমি কিছু মনে করিনে। কথাগুলো নিজেকে না আমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য বললেন, বুঝতে পারলাম না।

মহিলা আমার আরো কাছে ঘেঁষে এলেন। আমার হাত দুটি ধরে বললেন, বাবা আমার একটি অনুরোধ রাখবে? আমি বললাম, বলুন। তিনি বললেন, আগে কথা দাও রাখবে। আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ। তোমার প্রতি তায়েবার একটা অন্ধ আকর্ষণ আছে। তুমি হাসপাতালে তাকে দেখতে এলে সে বড়ো খুশি হয়। তোমরাও খুব সুখে নেই জানি। তবু সময় করে যদি একটু ঘন ঘন দেখতে যাও। বলো মায়ের এই অনুরোধটা রক্ষা করবে? জবাব দিতে গিয়ে আমার চোখে পানি বেরিয়ে গেলো। তিনিও আমার মাথাটা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললেন। আমরা দু’জন দু’জনকে বুঝতে পেরেছি। তবু আমি আমতা আমতা করে বললাম, কেউ যদি কিছু মনে করে। আমি হাসপাতালে যাই ওটা অনেকে সুনজরে দেখে না। কারো মনে করাকরি নিয়ে বাবা কিছু আসে যায় না। কথাবার্তা শেষ করে ফ্রি স্কুল স্ট্রীট থেকে বেরিয়ে এলাম। মনে হলো মধ্যযুগীয় অন্ধকার গুহা থেকে মুক্তি পেলাম।

.

০৮.

ফ্রি স্কুল স্ট্রীট থেকে বৌ বাজারের হোস্টেলে এসে অবাক হয়ে গেলাম। ঘরের মধ্যেই মাদুর বিছিয়ে খাওয়া দাওয়া চলছে। খাসির মাংস, ভাত, ডাল সব দোকান থেকে আনা হয়েছে। খেতে বসেছেন নরেশদা, খুরশিদ, মাসুম, বিপ্লব এবং অপর একজন, যাকে আমি চিনিনে। বয়স তিরিশ টিরিশ হবে, গায়ের রঙ রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। প্রথম দৃষ্টিতেই মনে হবে উনি কোনো ক্যাম্প থেকে এসেছেন। খুরশিদই পরিচয় করিয়ে দিলো। ক্যাপ্টেন হাসান। মুর্শিদাবাদের লালগোলার কাছাকাছি একটি মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে এসে থাকবেন। উনারা খেতে বসেছেন, শেকহ্যান্ড করার উপায় ছিলো না। একটা ব্যাপার আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি। বাংলাদেশ থেকে যতো মানুষ কোলকাতায় এসেছে, তাদের একটা অংশ কি করে জানিনে আমাদের এই আস্তানাটা শিগগির কি বিলম্বে চিনে ফেলেছে। আমাদের সঙ্গে কি করে জানিনে নানা জাতের, নানা পেশার অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তাদের মধ্যে গায়ক আছে, এ্যাকটর আছে, সাংবাদিক, শিল্পী, ভবঘুরে বেকার, পেশাদার লুচ্চা, বদমায়েশ, চোরাচরও আছে। সকলের একটাই পরিচয় আমরা বাংলাদেশের মানুষ।

এই সময়ের মধ্যে আমাদের আস্তানাটির কথা গোটা কোলকাতা শহরে প্রচার হয়ে গেছে। আমরা সব ভাসমান কর্মহীন মানুষ। একে অপরকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করি। বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশের মানুষের কাছে না যাবে তো কোথায় যাবে? তারপরেও খুরশিদের কৃতিত্বটা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। প্রায় প্রতিদিন নিত্য নতুন মানুষকে এই হোস্টেলে নিয়ে আসার কৃতিত্ব মুখ্যত খুরশিদের। সে বাইরে বড়ো গলা করে নিজেকে আওয়ামী লীগের লোক বলে ঘোষণা করে। পেছনে অবশ্য কারণও আছে। আওয়ামী লীগের ছোটো বড়ো মাঝারি নেতাদের অনেককেই খুরশিদ চেনে এবং তাঁরাও খুরশিদকে চেনেন। পারতপক্ষে তাকে তারা এড়িয়েও চলেন। তাই কার্যত খুরশিদ আমাদের ডেরায় এসে তার আওয়ামী লীগত্ব জাহির করে। আজকের ক্যাপ্টেন হাসান ভদ্রলোককেও নিশ্চয়ই খুরশিদ নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। এতোসব খাবারদাবারের আয়োজনের পয়সা এসেছে কোত্থেকে। নির্ঘাত টাকাটা ক্যাপ্টেনের পকেট থেকে গেছে এবং এতে খুরশিদের শিল্পকলার সামান্য অবদান থাকা বিচিত্র নয়।

নরেশদা বললেন, কাপড়চোপড় ছেড়ে মুখ হাত ধুয়ে তুইও বসে যা। যা খাবার আছে তাতে আরো দু’জনের হয়ে যাবে। আমি মুখ হাত ধুয়ে এসে খেতে বসে গেলাম। আজ খুরশিদের মেজাজটি ভয়ঙ্কর রকম উষ্ণ হয়ে আছে। এমনিতেও উত্তেজনা ছাড়া খুরশিদের জীবন ধারণ এক রকম অসম্ভব। একটা না একটা ঝগড়া বিবাদের বিষয়বস্তু খুঁজে আবিষ্কার করতে তার কোনো জুড়ি নেই। আজকে তার অসন্তোষটা অন্যান্য দিনের চাইতে পরিমাণে অনেক অধিক। আমি তাই কৌতূহলী হয়ে জিগ্‌গেস করলাম, খুরশিদ আজ তোমার আলোচ্য বিষয়সূচী কি? নরেশদা জবাব দিলেন, খোন্দকার মুশতাক আহমেদ। মুশতাকের মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ মানুষও তোমার বিষয় হতে পারে, এতো আমি কল্পনাও করতে পারিনি। হলোই বা ভারতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিদেশ মন্ত্রী। আমি তো তোমাকে আরো ওপরের তরিকার মানুষ বলে মনে করতাম।

আমার কথায় খুরশিদের মেজাজের কোনো পরিবর্তন হলো না। সে প্রায় ধমক দেয়ার সুরে বললো, আরে মশায় শুনবেন তো। শালার বেটা শালা, নেড়িকুত্তার বাচ্চা কি কাণ্ডটা করে বসে আছে। এইখানে এই কোলকাতায় বসে বসে বেটা হেনরী কিসিঞ্জারের সঙ্গে এতোকাল যোগাযোগ করে আসছিলো। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামী হিসেবে ভান করে মুক্তিসগ্রামকে পেছন থেকে ছুরিকাহত করাই ছিলো তার প্ল্যান। তলায় তলায় আমেরিকার মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে আপোষের চেষ্টা করছিলো। শালা, মেনিবিড়াল কোথাকার। ফন্দি টন্দি এঁটে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার নাম করে ভারত থেকে বেরিয়ে পড়তে পারলেই ঝুলির ভেতর থেকে সবগুলো বেড়াল বের করবে এটাই ছিলো তার ইচ্ছা। মাঝখানে ভারতের ইনটিলিজেন্স তার সমস্ত ষড়যন্ত্রের কথা উদ্ঘাটন করে ফেলেছে। তাজুদ্দিন তার নিউইয়র্কে যাওয়া আটকে দিয়েছেন। তাজুদ্দিনকে যতোই অপবাদ দিক আসলে কিন্তু মানুষটা খাঁটি। দেশের প্রতি টান আছে।

ক্যাপ্টেন হাসান হাত ধুয়ে এসে তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, তাজুদ্দিন বলুন, মুশতাক বলুন থিয়েটর রোডে যারা বসে তারা সকলে একই রকম। নিজেদের মধ্যে দলাদলি করছে, সর্বক্ষণ একজন আরেকজনকে ল্যাঙ মারার তালে আছে। দেখছেন একেকজনের চেহারার কেমন খোলতাই হয়েছে। খাচ্ছে দাচ্ছে, আমোদ-ফুর্তি করছে। সবাই তোফা আরামে আছে। যুদ্ধটা কি করে চলছে সেদিকে কারো কি কোনো খেয়াল আছে? কেউ কি কখনো একবার গিয়ে দেখেছে ক্যাম্পগুলোর কি অবস্থা? সাহেব আমরা যে অবস্থায় এখন থাকছি, বনের পশুও সে অবস্থায় পড়লে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। আমাদের বলা হয়েছে যুদ্ধ করো। কিন্তু কি দিয়ে যুদ্ধ করবে আমাদের ছেলেরা? শুধু হ্যান্ডগ্রেনেড দিয়ে কি পাকিস্তানী সৈন্যের দূরপাল্লার কামানের সঙ্গে পাল্লা দেয়া যায়? আমরা প্ল্যান করি ভারতীয়রা সে প্ল্যান নাকচ করে। নালিশ করে প্রতিকারের কথা দূরে থাকুক, কোনো উত্তর পর্যন্ত পাওয়া যায় না। আমরা ছেলেদের সব জেনেশুনে প্রতিদিন আত্মহত্যা করতে পাঠাচ্ছি। একেকটা সামান্য অস্ত্র জোগাড় করতেও প্রতিদিন কত দুয়ারে ধন্না দিতে হয়। মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর দুঃখ হয়, এতো কষ্ট করে আফগানিস্তানের ওপর দিয়ে কেনো মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে এখানে এলাম। ক্যাম্পে থাকলে তবু ভালো থাকি। ছেলেদের সঙ্গে এক রকম দিন কেটে যায়। কিন্তু কোলকাতা এলে মাথায় খুন চেপে বসে। ইচ্ছে জাগে এই ফর্সা কাপড় পরা তথাকথিত নেতাদের সবকটাকে গুলি করে হত্যা করি। এ্যায়সা দিন নেহি রহেগা। একদিন আমরা দেশে ফিরে যাবো। তখন এই সব কটা বানচোতকে গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে মারবো। দেখি কোন্ বাপ সেদিন তাদের উদ্ধার করে। কোলকাতায় নরোম বিছানায় ঘুমিয়ে পোলাও কোর্মা খাওয়ার মজা ভালো করে দেখিয়ে দেবো। ক্যাপ্টেন হাসান চেয়ারের হাতলে তোয়ালেখানা রেখে পকেট থেকে ইন্ডিয়া কিং এর প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালেন এবং নরেশদাকে একটা দিলেন।

থিয়েটর রোডের লোকদের বিরুদ্ধে এসব নালিশ নতুন নয়। সবাই নালিশ করে। কিন্তু তাদের করবার ক্ষমতা কততদূর তা নিয়ে কেউ বিশেষ চিন্তাভাবনা করে বলে মনে হয় না। আমি মনে মনে তাজুদ্দিনের তারিফ করি। ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। আমার বিশ্বাস সবদিক চিন্তা করে দেখার ক্ষমতা তাঁর আছে। কিন্তু তিনি কতোদূর কি করবেন। আওয়ামী লীগারদের মধ্যে অনেকগুলো উপদল। ভারত সরকার সবক’টা উপদলকে হাতে রাখার চেষ্টা করছে। আবার তাদের অনেকেই তাজুদ্দিনকে প্রধান মন্ত্রীত্বের আসন থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে। পাকিস্তানী এবং আমেরিকান গুপ্তচরেরা এখানে ওখানে ফাঁদ পেতে রেখেছে। তাদের খপ্পরে আওয়ামী লীগারদের একটা অংশ যে পড়ছে না, একথাও সত্যি নয়। এই প্রবাসে অন্য একটি সরকারের দয়ার ওপর নির্ভর করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে। ভারত সরকারের মর্জিমেজাজ যেমন মেনে চলতে হয়, তেমনি অজস্র উপদলীয় কোন্দলের মধ্যে একটা সমঝোতাও রক্ষা করতে হয়। ভারত সরকারের বিশেষজ্ঞদের আবার একেকজনের একেক মত। কেউ মনে করেন এদলকে হাতে রাখলে ভালো হবে। আবার আরেকজন মনে করেন, আখেরে এই উপদলের টিকে থাকার ক্ষমতা নেই। সুতরাং অন্য দলটিকে ট্রেনিং, অস্ত্র শস্ত্র, টাকা পয়সা দিলে উপকার হবে। দেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্যুত অবস্থায় সবকটা উপদলই মনে করছে তারাই প্রকৃত ক্ষমতার দাবিদার। কোনো নেতা ক্ষমতা দাবি করছেন, কেনোনা তিনি শেখ মুজিবের আত্মীয়। আরেক নেতা ক্ষমতা দাবি করছেন, কারণ তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মীয়-স্বজনদের দু’চোখে দেখতে পারেন না। হয়তো আরেক নেতা মনে মনে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরোধিতা করেন বলেই ক্ষমতা অধিকার করতে চান। ধৈর্য ধরে সবকিছু দেখে যাওয়া ছাড়া তাজুদ্দিনের আর করবার কি আছে?

সবাই মুখ হাত ধুয়ে বসে বসে পান চিবুচ্ছি। এমন সময়ে হন্তদন্ত হয়ে মাসুম ঘরে প্রবেশ করে বললো, নরেশদা, দানিয়েল ভাই শিগ্‌গির চলুন রেজোয়ান আত্মহত্যা করেছে। মাসুমের মুখে সংবাদটি শুনে আমরা সকলেই অভিভূত হয়ে গেলাম। দু’চারদিন আগেও আমাদের আড্ডায় এসেছিলো, সর্বক্ষণ অপরকে হাসাতো। সব সময়ে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা নবদ্বীপ হালদারের কমিক মুখস্ত বলতো। এই যুদ্ধ, দেশত্যাগ, খুন, জখম, বীভৎসতা কিছুই যেনো তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, মানুষ এতো হাসে কেমন করে? স্বীকার করতে আপত্তি নেই, রেজোয়ানের প্রতি মনের কোণে একটুখানি বিদ্বেষ পুষে রাখতাম।

প্রথম বিস্ময়ের ধাক্কাটি কেটে গেলে মাসুমের মুখে রেজোয়ানের আত্মহত্যার কারণটা জানতে পারলাম। কিছুদিন আগে রেজোয়ানদের আড্ডায় কুমিল্লা থেকে মজিদ বলে আরেকটি ছেলে আসে। রেজোয়ানরা থাকতো রিপন স্ট্রীটে। মজিদ আর রেজোয়ান দু’জনেই কুমিল্লার কান্দিরপাড় এলাকার একই পাড়ার ছেলে। মজিদ কোলকাতা এসে সকলের কাছে রটিয়ে দেয় যে রেজোয়ানের যে বোনটি উম্যান্স কলেজের প্রিন্সিপাল, সে একজন পাকিস্তানী মেজরকে বিয়ে করে ফেলেছে। এই সংবাদটা পাওয়ার পর রেজোয়ান দু’দিন ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকে। কারো সঙ্গে একদম কথাবার্তা বলেনি। অনেক চেষ্টা করেও কেউ তাকে কিছু খাওয়াতে পারেনি। অবশেষে রাত্রিবেলা ঘুমের ঔষধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। সকালে সে বিছানা ছেড়ে উঠছে না দেখে রুমের অন্যান্যরা ঘুম ভাঙ্গাতে চেষ্টা করে দেখে মরে শক্ত হয়ে গিয়েছে। আর মুখের লালা পড়ে বালিশ ভিজে গেছে। তার মাথার কাছে পাওয়া গেলো একটি চিরকুট। তাতে লিখে রেখেছে, বড়ো আপা, যাকে আমি বিশ্বাস করতাম সবচাইতে বেশি, সে একজন পাকিস্তানী মেজরের স্ত্রী হিসেবে তার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমোচ্ছে, একথা আমি চিন্তা করতে পারিনে। দেশে থাকলে বড়ো আপা এবং মেজরকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতাম। এখন আমি ভারতে। সুতরাং সে উপায় নেই। অথচ প্রতিশোধ স্পৃহায় আমার রক্ত এতো পাগল হয়ে উঠেছে শেষ পর্যন্ত নিজেকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেই। যার আপন মায়ের পেটের বোন দেশের চরমতম দুর্দিনে, দেশের শত্রুকে বিয়ে করে তার সঙ্গে একই শয্যায় শয়ন করতে পারে তেমন ভাইয়ের বেঁচে থেকে লাভ কি? কি করে আমি দেশের মানুষের সামনে কলঙ্কিত কালো মুখ দেখাবো। আমার মতো হতভাগ্যের বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। সকলকে কষ্ট দিতে হলো বলে আমি দুঃখিত এবং সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। ইতি রেজোয়ান।

শুনেই আমি, নরেশদা এবং খুরশিদ রিপন স্ট্রীটে ছুটলাম। সেখানে গিয়ে শুনি রেজোয়ানের লাশ থানায় নিয়ে গেছে। অগত্যা থানায় যেতে হলো। ময়না তদন্ত ছাড়া লাশ বের করে আনতে কম হ্যাঙ্গামাহুজ্জত পোহাতে হলো না। এতে সমস্যার শেষ নয়। তারপরেও আছে কবর দেয়ার প্রশ্নটি। আমরা কোলকাতা শহরে সবাই ভাসমান মানুষ। মৃত ব্যক্তিকে এখানে কোথায় কবর দিতে হয়, কি করে কবর দিতে হয়, এসব হাজারটা কায়দাকানুনের কিছুই আমরা জানিনে। তাছাড়া আমাদের সকলের পকেট একেবারে শূণ্য। টাকা থাকলে বুকে একটা জোর থাকে। সেটাও আমাদের নেই। কি করি। আমাদের একজন ছুটলো কাকাবাবু মুজফফর আহমদের কাছে। তিনি নিজে অসুস্থ মানুষ। তাঁকে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হয়। তিনি এক সময়ে বাংলাদেশের মানুষ ছিলেন, এই দাবিতে আমরা সময়ে অসময়ে তার কাছে গিয়ে হাত পেতেছি। তিনি সাধ্যমতো আমাদের দাবি পূরণ করেছেন। এই রকম একটা ব্যাপার নিয়ে তাঁকে বিব্রত করা ঠিক হবে কিনা এ নিয়ে আমাদের মনে যথেষ্ট দ্বিধা ছিলো। তবু তাঁর কাছে যেতে হলো। তিনি তাঁর পার্টির একজন মানুষকে বলে গোবরা কবরস্থানে কবর দেয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। তারপরেও আমাদের টাকার প্রয়োজন। লাশকে গোসল দিতে হবে, কাফন কিনতে হবে, কবর খুঁড়তে হবে, কবরস্থানে নিয়ে যেতে হবে, জানাজা পড়াতে হবে-এসবের প্রত্যেকটির জন্য টাকার প্রয়োজন। টাকা কোথায় পাওয়া যাবে। আমাদের আরেকজন ছুটলো প্রিন্সেপ স্ট্রীটে অধ্যাপক ইউসুফ আলির কাছে। তিনি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাহলেও আমাদের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক আছে। ইচ্ছে করলে তিনি টাকাটা ম্যানেজ করে দিতে পারেন। আমাদের অনুমানই সত্য হলো। ইউসুফ সাহেব কাফন দাফনের টাকাটা ব্যবস্থা করলেন। ক্ষেত্র বিশেষে জীবিত মানুষের চাইতে মৃত মানুষের দাবি অধিক শক্তিশালী।

রেজোয়ানকে গোসল ইত্যাদি করিয়ে কবর দিতে দিতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো। আমার ধারণা হয়েছিলো মৃত্যু আর আমাকে বিচলিত করে না। পঁচিশে মার্চের পর থেকে ভারতে আসার পূর্ব পর্যন্ত মৃত্যু তো কম দেখিনি। আমি নীলক্ষেত দেখেছি, রাজারবাগ দেখেছি, শাঁখারি বাজার দেখেছি। আমার নিজের কানের পাশ দিয়েও পাকিস্তানী সৈন্যের রাইফেলের গুলি হিস হিস করে চলে গেছে। কিন্তু রেজোয়ানের মৃত্যুটি একেবারে অন্যরকম। আমার সমস্ত সত্তার মধ্যে একটা আলোড়ন জাগিয়ে দিয়ে গেছে। যার বোন পাকিস্তানী মেজরকে বিয়ে করেছে, তাকে আত্মহত্যা করতে হয়। সেদিন আমাদের সকলের হৃদয় এমন গভীর বিষাদে ভারাক্রান্ত ছিলো যে কেউ কারো সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলতে পারিনি।

রেজোয়ানকে কবর দিয়ে সকলে চলে এলো। আমার সকলের সঙ্গে ফিরতে ইচ্ছে হলো না। নরেশদা বললেন, কিরে দানিয়েল যাবিনে। আমি বললাম, আপনারা যান আমি পরে আসছি। সকলের অন্তঃকরণ গভীর ভাবাবেগে পরিপূর্ণ। কেউ কাউকে টেনে নিয়ে যাবার মতো অবস্থা ছিলো না। আমি রেজোয়ানের কাঁচা কবরের কাছে ছাতাধরা একটি পাথরের বেঞ্চির ওপর বসে রইলাম। চারপাশে সারি সারি কবর। গোবরা কবরস্থানে চারদিক থেকে চরাচরপ্লবী অন্ধকার নেমে আসছে। হাজার হাজার মৃত মানুষ ঘুমিয়ে আছে। আমি একা হাতের ওপর মাথা রেখে চুপচাপ বসে আছি। কেবল কেয়ারটেকারের কুকুরটি অদূরে দু’পায়ের ওপর বসে আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। বোধ করি ভাবছে কবরস্থানে এই ভরসন্ধ্যায় জীবিত মানুষ কেনো? মানুষের জীবন মৃত্যু এসব ছায়াবাজির খেলা বলে মনে হলো। নিজের অস্তিত্বটাও অর্থহীন প্রতীয়মান হলো। আকাশে ছায়াপথে লক্ষ লক্ষ তারা মানুষের পৃথিবীর গুরুত্ব কতোটুকু। আমার আগে পৃথিবীতে কতো মানুষ এসেছে, তারা কতো কি কাজ করেছে, চিন্তা করেছে, কতো যুদ্ধবিগ্রহ করেছে, তারপরে সকলে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। মানুষের সুখ দুঃখ, দ্বন্দ্ব বিবাদ ওই সুদূরের তারকারাজি অনাদিকাল থেকে সব কিছু মুগ্ধ চোখে দেখে আসছে। আমি যেনো মৃত মানুষদের চুপি চুপি সংলাপ শুনতে পাচ্ছিলাম। তাদের অভিশপ্ত কামনা বাসনার ঢেউ যেনো আমার বুকে এসে আছড়ে পড়ছে। কেবল রেজোয়ানের কাঁচা কবরটির অস্তিত্ব কাটার মতো যন্ত্রণা দিচ্ছিলো। ছেলেটা দুদিন আগেও আমাদের সঙ্গে হাঁটাচলা করেছে। অবিশ্রাম হেসেছে, অপরকে হাসিয়েছে। এতো সকালে তার মরার কথা নয়। বাংলাদেশের যুদ্ধটা না লাগলে হয়তো ছেলেটাকে এমন অকালে মরতে হতো না। আমার মগজের মধ্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বদলে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের যুদ্ধটা চক্কর দিতে লাগলো। বড়ো ভাগ্যহীন এই বাঙালি মুসলমান জাতটা। আবহমানকাল থেকে তারা ভয়ঙ্করভাবে নির্যাতিত এবং নিষ্পেষিত। সেই হিন্দু আমল, বৌদ্ধ আমল, এমনকি মুসলিম আমলেও তারা ছিলো একেবারে ইতিহাসের তলায়। এই সংখ্যাগুরু মানবমণ্ডলি কখনো প্রাণশক্তির তোড়ে সামনের দিকের নির্মোক ফাটিয়ে এগিয়ে আসতে পারেনি। যুগের পর যুগ গেছে, তাদের বুকের ওপর দিয়ে ইতিহাসের চাকা ঘর ঘর শব্দ তুলে চলে গেছে। কিন্তু তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। রেজোয়ান ছেলেটা যে অকালে মারা পড়লো তার মধ্যে ইতিহাসের দায়শোধের একটা ব্যাপার যেনো আছে।

বাঙালি মুসলমানেরাই প্রথম পাকিস্তান চেয়েছিলো। পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্থান, সীমান্ত প্রদেশ কোথায়। লোকে পাকিস্তানের কথা বলতো। জিন্নাহ সাহেব বাংলার সমর্থন এবং আবেগের ওপর নির্ভর করেই তো অপর প্রদেশগুলোকে নিজের কজায় এনেছিলেন। যে বাঙালি মুসলমানদের অকুণ্ঠ আত্মদানে পাকিস্তান সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিলো, সেই পাকিস্তানই তিরিশ বছর তাদের ওপর বসে তাদের ধষর্ণ করেছে। একটা জাতি এতোবড়ো একটা ভুল করতে পারে? কোথায় জানি একটা গড়বড়, একটা গোঁজামিল আছে। আমরা সকলে সেই গোঁজামিলটাই ব্যক্তিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে অদ্যাবধি বহন করে চলেছি। পাকিস্তানের গণপরিষদে তো পূর্বপাকিস্তানের সদস্যরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাভাষার দাবিটি তো তারা সমর্থন করতে পারতেন। হলেনই বা মুসলিম লীগার। তবু তারা কি এদেশের মানুষ ছিলেন না? তাদের সাত পুরুষ বাংলার জলহাওয়াতে জীবন ধারণ করেননি? তবু কেন, বাংলাভাষার প্রতিষ্ঠার জন্যে আমাদের ছাত্র তরুণদের প্রাণ দিতে হলো? পূর্বপুরুষদের ভুল এবং ইতিহাসের তামাদি শোধ করার জন্য কি এই জাতিটির জন্ম হয়েছে?

উনিশশো আটচল্লিশ থেকে সত্তর পর্যন্ত এই জাতি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। আর চূড়ান্ত মুহূর্তটিতে আমাদের সবাইকে দেশ ও গ্রাম ছেড়ে ভারতে চলে আসতে হয়েছে। আমাদের হাতে সময় ছিলো, সুযোগ ছিলো। কোলাহল আর চিৎকার করেই আমরা সে সুযোগ এবং সময়ের অপব্যবহার করেছি। পাকিস্তানের কর্তাদের আমরা আমাদের বোকা বানাতে সুযোগ দিয়েছি। তারা সৈন্য এনে ক্যান্টনমেন্টগুলো ভরিয়ে ফেলেছে এবং সুযোগ বুঝে পাকিস্তানী সৈন্য আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। আমরা আমাদের যুদ্ধটাকে কাঁধে বয়ে নিয়ে ভারতে চলে এসেছি। হয়তো যুদ্ধ একদিন শেষ হবে। তারপর কী হবে? আমাদের যুদ্ধটা ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার মন বলছে পাকিস্তান হারবে, হারতে বাধ্য। কিন্তু আমরা কি পাবো? ইতিহাসের যে গোঁজামিল, আমরা বংশপরম্পরা রক্তধারার মধ্য দিয়ে বহন করে চলেছি তার কি কোনো সমাধান হবে? কে জানে কি আছে ভবিষ্যতে।

ঢেউ দিয়ে একটা চিন্তা মনে জাগলো। যাই ঘটুক না কেন, আমার বাঙালি হওয়া ছাড়া উপায় কি? আর কি-ই বা আমি হতে পারি? দুনিয়ায় কোন জাতিটি আমাকে গ্রহণ করবে। গোরস্থানের কেয়ারটেকার এসে বললো দশটা বেজে গেছে। এখখুনি গেট বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং আমাকেও চলে আসতে হলো।

তারপরের দিন আমার পক্ষে হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব হয়নি। পয়সার ধান্ধায় কোলকাতার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত অবধি ছুটে বেড়াতে হয়েছে। তাছাড়া এক সঙ্গে আমরা অনেক মানুষ থাকি। যৌথ জীবনযাপনের নানা সমস্যা তো আছেই। আমাদের কাজ নেই, কর্ম নেই, তবু জীবন প্রতিনিয়ত সমস্যার সৃষ্টি করে যায়। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াবচসা, অভিমান এসব তো লেগেই আছে। সে সবের ফিরিস্তি দিয়ে বিশেষ লাভ হবে না।

রোববার দিনটিতে আমি সন্ধ্যের একটু আগেই হাসপাতালে গেলাম। গিয়ে দেখি জমজমাট ব্যাপার। ডোরা এসেছে, দোলা এসেছে। তায়েবার মাও এসেছেন। আর তায়েবা বালিশে হেলান দিয়ে বসে অর্চনার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। আজকে তায়েবাকে খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। চমৎকার একটা ধোয়া সাদা শাড়ি পরেছে। খোঁপায় বেলী ফুলের মালা জড়িয়েছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিলো গেন্ডারিয়ার বাড়িতে আনন্দঘন সময় কাটাচ্ছে। আমাকে প্রথম দেখতে পেলো অর্চনা। সে কলকল করে উঠলো, এই যে দানিয়েল, কাল থেকে টিকিটিরও দেখা নেই কেন। আমি হেসে বললাম, আটকে গিয়েছিলাম। তায়েবাদি হাসপাতালে, আর তুমি গা ঢাকা দিয়ে আছে। আমি জিগগেস করলাম, অর্চনা তুমি কালও এসেছিলে নাকি? অর্চনাদি কালও এসেছিলেন এবং অর্ধেকদিন আমার সঙ্গে কাটিয়ে গেছেন। আজকে আমার জন্য বেলী ফুলের মালা নিয়ে এসেছেন। খোঁপা থেকে মালাটা খুলে হাতে নিয়ে দেখালো। কি ভালো অর্চনাদি। তার সঙ্গে কথা বললে মনটা একেবারে হাল্কা হয়ে যায়। অর্চনা কৃত্রিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো, বাজে বকোনা তায়েবাদি, তোমার মতো এতো প্রাণখোলা মেয়ে এতোদিন হাসপাতালে পড়ে আছো এ খবর আমি আগে পাইনি কেন? দু’মহিলার এই পারস্পরিক প্রশস্তি বিনিময় শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হলো। তায়েবার মা আমার কাছে জানতে চাইলেন, বাবা দানিয়েল, কাল কি তোমার কোনো অসুখবিসুখ হয়েছিলো। তোমাকে খুব দুর্বল এবং বিমর্ষ দেখাচ্ছে। আমি মাথা নেড়ে বললাম, না আমি সুস্থই ছিলাম। তাহলে তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো। মা, তুমি যেনো একটা কি। মনে করতে চেষ্টা করো, তাঁকে কখন তুমি সুস্থ মানুষের মতো দেখেছিলে। সব সময় তো একই রকম দেখে আসছি। গোসল করবে না, জামাকাপড় পরিষ্কার রাখবে না, দাড়ি কাটবে না–আর এমন একটা মেক আপ করে থাকবেন, দেখলে মনে হবে রোগি অথবা সাতজন পাঁচজনে ধরে কিলিয়েছে। কথা বলা অবান্তর। এই নালিশটি তায়েবা আমার সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকেই করে আসছে। তায়েবার কথা শুনে ডোরা খিলখিল করে হেসে উঠলো। ডোরার এই হাসিটিও আমার পরিচিত। গেন্ডারিয়ার বাসায় তায়েবা অপরিচ্ছন্ন থাকার অনুযোগ করলেই ডোরা এমন করে হেসে উঠতো। আশ্চর্য ডোরা আজও তেমন করে নির্মলভাবে হাসতে পারে? নানা অঘটন ঘটে যাচ্ছে। তবু মনে হচ্ছে সকলে ঠিক আগের মতোই আছে। কিন্তু আমি একা বদলে যাচ্ছি কেন? বোধ করি মানুষের ভালো মন্দ সব কিছুর বিচারক সেজে বসি বলেই কি আমার এ দুরাবস্থা। মানুষের কৃতকর্মের বিচারক সেজে বসার আমার কি অধিকার? তায়েবার মা কথা বললেন, কি বাবা হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে গেলে কেন? ডোরা ফোড়ন কেটে বললো, একটুখানি গম্ভীর না দেখালে লোকে ইন্টেলেকচুয়াল বলবে কি করে? কথাটা তায়েবার, ডোরা ধার করে বললো। কোলকাতা এসে দেখেছি ডোরার মুখ খুলে গেছে। সে কায়দা করে কথা বলতে শিখে গেছে। এবার দোলা মুখ খুললো। বেচারিকে তোমরা খেপাচ্ছো কেন? আসলে দানিয়েল ভাই খুব সরল-সহজ ভালো মানুষ। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় নাক সিধে চলেন, ডানে বামে তাকান না। তার দোষ ঐ একটাই, তিনি রসিকতা বোঝেন না। আজকে হাসপাতালে এসে আমার একটা ভিন্নরকম ধারণা হলো। এতোদিন মনে করে এসেছি এরা তায়েবার এই ভয়ঙ্কর অসুখটিকে কোনো রকম গুরুত্ব না দিয়ে সবাই নিজের নিজের তালে আছে। আজকে মনে হলো, সবাই তায়েবাকে তার মারাত্মক অসুখটির কথা ভুলিয়ে রাখার জন্যই এমন হাসিখুশি এমন খোশগল্প করে। মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ ঘনিয়ে উঠলো। আমিই তো প্রথম থেকে তায়েবাকে তার একান্ত ব্যথার জায়গাটিতে আঘাত করে আসছি। হাবে ভাবে আচার আচরণে তায়েবাকে তার ভাই বোন আত্মীয় স্বজন থেকে আলাদা করে ফেলার একটা উগ্র আকাক্ষার প্রকাশ ক্রমাগত দেখিয়ে এসেছি। এটা কেমন করে ঘটলো? তায়েবার ওপর আমার কি দাবি? যদি বলি তায়েবাকে আমি প্রাণের গভীর থেকে ভালোবাসি। তাহলে ভালোবাসার এমন উদ্ভট দাবি কেমন করে হতে পারে যে আমি তাকে তার ডাল মূল থেকে আলাদা করতে চাইবো। আমি নিশ্চিত জানি সে মারা যাবেই। প্রতিদিন একটু একটু করে তার জীবনপ্রদীপের তেল শুকিয়ে আসছে। তথাপি আমার মনের অনুক্ত আকাক্ষা এই মৃত্যু পথযাত্রী তায়েবার সবটুকুকে আমি অধিকার করে ফেলবো। পারলে তার স্মৃতি থেকেও নিকটজনের নামনিশানা মুছে ফেলবো। নিজের মনেরে ভেতর জমাটবাঁধা একটা ঈর্ষার পিণ্ড যেনো দুলে উঠলো। এই প্রথম অনুভব করলাম, আমি একটা পশু, একটা দানব। যা পেতে চাই সব কিছু ভেঙ্গে চুরে ছত্রখান করে গুঁড়িয়ে পেতে চাই। অথচ মনে মনে একটা ভালো মানুষীর আত্মপ্রসাদ অনুভব করে দুনিয়ার তাবৎ মানুষকে আসামী বানিয়ে বিচারক সেজে বসে আছি। সেই সন্ধ্যেয় হাসপাতালে আমার মনের এই কুৎসিত দিকটির পরিচয় পেয়ে ক্রমশ নিজের মধ্যেই কুঁকড়ে যেতে থাকলাম। স্বাভাবিকভাবে কোনো কথাবার্তা বলতে পারছিলাম না।

হাসপাতালের শেষ ঘণ্টা বেজে উঠলো। অর্চনা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তায়েবাদি আজ আসি। শিগগির আবার আসবো। সে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, শোনো দানিয়েল, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। থাক্ ভালোই হলো, কথাটা মনে পড়লো। পারলে এরই মধ্যে একবার সময় করে আমাদের বাড়িতে আসবে, একটা জরুরী ব্যাপার আছে। জরুরী ব্যাপারের কথা শুনে আমি অর্চনার পিছু পিছু করিডোর পর্যন্ত এলাম। জানতে চাইলাম, আসলে ব্যাপারটা কি? অর্চনা বললো, জানো আমার এক দূর সম্পর্কীয় দাদা এসেছেন ফ্রান্স থেকে। তিনি এক সময়ে অনুশীলন দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারপর নেতাজী সুভাষ বোসের সঙ্গে আজাদ হিন্দুফৌজে যোগ দিয়েছিলেন। আমরা অনেকদিন তার কোনো সংবাদ পাইনি। অনেক বছর পরে জানতে পারলাম, তিনি ফ্রান্সে চলে গিয়েছেন এবং এক ফরাসী মহিলাকে বিয়ে করেছেন। আমরা তো তাঁর। কথা একদম ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি তো তাকে কোনোদিন চোখেও দেখিনি। হঠাৎ করে গত সপ্তাহে তিনি আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। বাড়ির লোকজন কলিযুগেও এমন আশ্চর্য কাণ্ড ঘটতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছে। তিনি সংবাদপত্রে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সংবাদ পাঠ করে আর টেলিভিশন রিপোর্ট দেখে সোজা কোলকাতা চলে এসেছেন। একেই বলে বিপ্লবী। তিনি এখন আমাদের বাড়িতেই আছেন। তুমি একদিন আসবে। তোমার সঙ্গে কথা বললে দাদা ভীষণ খুশি হবেন । অর্চনা চলে গেলো।

অর্চনাকে বিদায় করে তায়েবার কেবিনে ঢুকে দেখি জাহিদুল এবং হেনা ভাই দু’জন এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে সহজভাবে কথাবার্তা বলতে পারলাম। আমি নিজের ভেতরে সহজ হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছি বলেই যেনো চারপাশের জগতটা আমাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে আরম্ভ করেছে। দোলা, ডোরা এবং তায়েবার মা উনারাও উঠে দাঁড়ালেন। দোলাকে যেতে হবে ধর্মতলা। সেখান থেকে অন্য মেয়েদের সঙ্গে দমদম তার ক্যাম্পে ফিরে যেতে হবে। ডোরা, জাহিদুলের সঙ্গে কোনো বাড়িতে গান গাইতে যাবে। আর মাকে হেনা ভাই ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে রেখে তারপর নিজের ডেরায় চলে যাবেন। আমি নিজে খুব অস্বস্তি অনুভব করছিলাম। সকলে গেলো, অথচ আমি রয়ে গেলাম। ভাবলাম, চলেই যাই। কিন্তু তায়েবাকে বলা হয়নি। কথাটা কিভাবে তাকে বলবো, চিন্তা করছিলাম। কেবিনে আর কেউ নেই। উৎপলাকে বোধ হয় অন্য কোথায় শিফট করা হয়েছে। মাঝখানে শুনছিলাম, তার অসুখটির খুব বাড়াবাড়ি চলছে। জিগগেস করতে ইচ্ছে হয়নি। পাছে একটা খারাপ জবাব শুনি। তায়েবাই নীরবতা ভঙ্গ করে প্রথম কথা বললো। আচ্ছা দানিয়েল ভাই, একটা কথা জিগগেস করি। আমি বললাম, বলো। আপনি এতো অপরিষ্কার থাকেন কেন? এটা বহু পুরোনো কথা। সুতরাং জবাব দিলাম না। সে বললো, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখুন ঝটার শলার মতো দাড়িগুলো কি রকম খোঁচা খোঁচা হয়ে আছে। এভাবে গালভর্তি বিশ্রী দাড়ি নিয়ে ঘোরাফেরা করতে আপনার লজ্জা লাগে না। চুপ করে রইলাম। আজকাল ওর কথার পিঠে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছি। কি চুপ করে রইলেন যে, কথা বলছেন না কেন। তার কথার মধ্যে দিয়ে আঁঝ বেরিয়ে এলো। অগত্যা আমি বললাম, তায়েবা, লজ্জাবোধ সকলের সমান নয়।

সে বিছানা থেকে সটান সোজা হয়ে বসলো। আমার চোখে সরাসরি চোখ রেখে বললো, আপনি আমাকে খুব সোজা মেয়ে পেয়েছেন তাই না, সব সময় যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেন। অর্চনাদির মতো কোনো শক্ত মহিলার পাল্লায় পড়লে দু’দিনে আপনার মাথার ভূত ঝেটিয়ে একেবারে সিধে করে দিতো। আমি আর কদিন। আল্লার কাছে মুনাজাত করি অর্চনাদির মতো কোনো শক্ত মহিলার সঙ্গে যেনো সারা জীবন আপনাকে ঘর করে কাটাতে হয়। তায়েবা ঠাট্টাচ্ছলে কথাগুলো বললো বটে, কিন্তু আমি সহজভাবে নিতে পারছিলাম না। সে অর্চনাকে নিয়ে কি অন্য রকম একটা ভাবনা ভাবতে আরম্ভ করেছে? আমি বললাম, এর মধ্যে অর্চনার কথা আসবে কেন? তার সঙ্গে আগে যোগাযোগ ছিলো, কিন্তু চাক্ষুস পরিচয় তো এই কদিনের। তায়েবা বললো, অর্চনাদির কথা বললে আপনি অতো আঁতকে উঠেন কেন? তার কথা আমি বার বার বলবো। একশো বার বলবো। অত্যন্ত ভালো মেয়ে। আমার ভীষণ মনে ধরেছে।

আমি উসখুস করছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে, শেষ ঘণ্টা বেজে গেছে। তারপরেও হাসপাতালে যদি থাকি কেউ কিছু বলতে পারে। এখানকার নিয়মকানুন বড়ো কড়া। কি কারণে বলতে পারবো না, আমি চলে আসতে চাই, একথাটা তায়েবাকে বলতে পারছিলাম না। কোথায় একটা সংকোচ বোধ করছিলাম। এই দোদুল্যমানতা কাটাবার জন্য একটা চারমিনার ধরাবো স্থির করলাম। কেবিনের বাইরে পা দিতেই তায়েবা অনুচ্চস্বরে বললো, কোথায় যাচ্ছেন? আমি বললাম, একটা সিগারেট খেয়ে আসতে যাচ্ছি। বাইরে যেতে হবে না। এখানে ওই উৎপলার বেডে বসে খান। আমি ইতস্তত করছিলাম। তায়েবা বললো, আপনার ভয় নেই। মনের সুখে সিগারেট খেতে পারেন। ডাঃ ভট্টাচার্য আজ কোলকাতার বাইরে গেছেন। থাকার মধ্যে আছেন মাইতিদা, তাঁকে আমি সামাল দেবো। আমি সত্যি সত্যি উৎপলার বেডে বসে একট সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলাম। সে বললো, বুঝলেন দানিয়েল ভাই, তাড়াতাড়ি চলে যাবেন না। আজকে আপনার সঙ্গে অনেক্ষণ গল্প করে কাটাবো। হোস্টেলে এক ভদ্রলোককে নয়টার সময় আসতে বলেছি। তার সঙ্গে আমার টাকা-পয়সার একটা ব্যাপার আছে। এসে যদি ভদ্রলোক ফেরত যান, আবার কবে দেখা হয় বলা সম্ভব নয়। তাছাড়া প্রয়োজনটা আমার। আমারই প্রয়োজনে ভদ্রলোককে আমি অনুরোধ করেছি আসতে। তাই মনে মনে একটুখানি দমে গেলাম। তায়েবা সেটা বুঝতে পারলো। কি, আপনার সঙ্গে গল্প করতে চাই সেটি বুঝি পছন্দ হলো না। পছন্দ না হয় তো চলে যান। আমি আপনাকে আটকে রাখিনি। আমি তো অর্চনাদি নই যে জরুরী প্রয়োজনে আপনাকে নির্দেশ দিতে পারি।

আমি সিগারেটটা ফেলে দিয়ে টুলটা টেনে তার বিছানার পাশে এসে বসলাম। বললাম, ঠিক আছে গল্প করো আমি আছি। কতোক্ষণ থাকবেন? আমি বললাম, যতোক্ষণ গল্প করো। আমি সারারাত গল্প করতে চাই, সারারাত আপনি থাকবেন? সারারাত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থাকতে দেবে? সে মাথার বেণীটি দুলিয়ে বললো, সে দায়িত্ব আমার। এবার সে সত্যি সত্যি রহস্যময়ী হয়ে উঠলো। জানেন দানিয়েল ভাই, আপনার সঙ্গে কথা বলতে ঘেন্না হয়, আপনি এতো বিষণ্ণ এবং অপরিষ্কার থাকেন। মাঝে মাঝে তো বমি বেরিয়ে আসতে চায়। এটাতো ভূমিকা মাত্র। আসলে তায়েবা গোটা রাত কিসের গল্প করতে চায়, সেটা আমাকে ভয়ানক কৌতূহলী করে তুললো। আমি ভুলে গেলাম যে সে একজন মৃত্যুপথযাত্রী রোগী। সে যেমন করে হঠাৎ বিছানা থেকে উঠে বসেছিলো, তেমনি হঠাৎ আবার বিছানার ওপর নেতিয়ে পড়লো। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলতে লাগলো। আমি কেমন যেনো ভয় পেয়ে গেলাম। এই অবস্থায় কি করি। ডঃ মাইতিকে ডাকবো কিনা চিন্তা করছিলাম। কিছুক্ষণ পর তার শ্বাসপ্রশ্বাস প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হয়ে এলো। চোখ মেলে আমার দিকে তাকালো। আহ্ দানিয়েল ভাই। আপনি আরেকটু এগিয়ে এই আমার মাথার কাছটাতে বসুন এবং হাতখানা দিন। ডান হাতখানা এগিয়ে দিলে দু’হাতে মুঠি করে ধরে দু’তিন মিনিট চুপ করে রইলো। স্বপ্নের মধ্যে কথা বলছে এমনি ফিস ফিস করে বললো, জানেন এবার আমি সাতাশে পা দিয়েছি। রাঙ্গা আমার দু’বছরের ছোটো। তার একটি মেয়ে আছে। গোলগাল পুতুলের মতো। আঃ কি সুন্দর! দেখলে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। রাঙ্গার বয়সে বিয়ে হলে এতোদিনে আমারও ছেলেমেয়ে থাকতো। গোটা জীবনটা কি করে কাটালাম, ভাবলে দুঃখে বুক ফেটে যেতে চায়। তায়েবার এসমস্ত কথার প্রত্যুত্তর আমার জানা নেই। বুকটা ভারাক্রান্ত হয়ে আসছিলো। বহু কষ্টে চোখের পানি চেপে রাখলাম। কিছু বললাম না। তায়েবা বলে যাক যা মন চায়। তার প্রাণ পাতালের তলা থেকে যদি অবরুদ্ধে কামনা বাসনার স্ফুলিঙ্গগুলো বেরিয়ে আসতে চায়, আসুক। এতোকাল মনে হয়েছিলো তায়েবা ঠিক মানবী নয়। সাধারণ মেয়েদের মতো সে কামনা বাসনার ক্রীতদাসী নয়। অন্য রকম। আজ এই সন্ধ্যেয় ওপরের নির্মোক বিদীর্ণ করে তার অন্তরালবর্তী নারী পরিচয় এমন স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হতে দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। আমি তার মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। দানিয়েল ভাই, আমার সারা শরীরে প্রচণ্ড আগুনের তাপ। আমি জ্বলে যাচ্ছি, পুড়ে যাচ্ছি। আর বুকে কি ভয়াবহ তৃষ্ণা, মনে হয় সমুদ্র শুষে নিতে পারি। তৃষ্ণা, তৃষ্ণা, তৃষ্ণার তাপে আমি জ্বলে পুড়ে মরছি। আর বেশিদিন নয়, শিগগিরই আমি মারা যাবো। তারপর সবকিছুর শেষ হবে! ও মা! আপনি অতো দূরে কেনো? কাছে আসুন, আপনি এত লাজুক এবং ভীতু কেনো? কই আপনার হাত দুটি কোথায়? সে আমার দু’হাত টেনে নিয়ে বুকের ওপর রাখলো। স্তন দুটি কবুতরের ছানার মতো গুটিসুটি মেরে বসে আছে। আমার বুকের মধ্যে যেমন একটা ভূমিকম্প হচ্ছিলো, তেমনি একটা পুলকপ্ৰবাহও রি রি করে সমস্ত লোমকূপের গোড়ায় গোড়ায় কাঁপছিলো। এই নারী, এতোকাল যাকে মনে করে আসছি ধরাছোঁয়ার বাইরে, সমস্ত জ্ঞানবুদ্ধির অতীত, কতো সহজে আমার কাছে নিজেকে উন্মোচন করেছে। মুসা নীলনদের তল দেখেও কি এতোটা পবিত্র পুলকে শিউরে শিউরে উঠেছিলেন? দানিয়েল ভাই শব্দটা বাদ দিয়ে শুধু আমার নামটা ধরে ডাকলো। জানো তোমাকে ভালোবাসি। এতোদিন বলিনি কেনো জানো? আমি অনেকদিন আগে থেকে, এমনকি তোমার সঙ্গে পরিচয়ের পূর্ব থেকেই আমার অসুখটার কথা জানতাম। আমার ভয় ছিলো, জানালে কেটে পড়বে। আর তোমাকে ভালোবাসি একথা জানাতে পারিনি, একটা কারণে পাছে তুমি মনে করো, আমি প্রতারিত করেছি। এ দোটানার মধ্যে বহু কষ্টে আমার জীবন কেটেছে। আজকে আমার কোনো দ্বিধা কোনো সংশয় নেই। দুনিয়া শুদ্ধ মানুষের সামনে বলতে পারি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আজ আমার কোনো ভয়, কোনো ডর নেই। আমার ভেতর বাইরে এক হয়ে গেছে। আজ কোনো দ্বিধা, কোনো সংশয় নেই। আহঃ তোমাকে আমি দেখতে পারছিনে! ওইখানে যেয়ে একটু আলোর কাছে বসো। ভালো করে দেখি। আমি আলোর কাছে সরে বসলাম। আহঃ চুলে পাক ধরতে আরম্ভ করেছে! মনে আছে, যেদিন প্রথম আমাদের গেন্ডারিয়ার বাড়িতে গিয়েছিলে গায়ে একটা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি ছিলো। বুকের কাছটিতে রঙ লেগে লাল হয়ে গিয়েছিলো। মনে হয় গতোকাল এঘটনা ঘটে গেছে।

জুতো মচমচিয়ে ডঃ মাইতি কেবিনে প্রবেশ করলেন। আমাকে দেখতে পেয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আরে দানিয়েল সাহেব যে। আসুন আপনার হেন্ডসেক করি। আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম। করমর্দনের পালা সাঙ্গ হলে ডঃ মাইতি বললেন, এবার দানিয়েল সাহেব আপনাকে একটা কৈফিয়ত দিতে হবে। আমি বললাম, কিসের কৈফিয়ত ডঃ মাইতি। আপনার তো থাকার কথা নয়, হাসপাতালে ছ’টার পরে কাউকে থাকতে দেয়া হয় না। এখন আটটা বেজে তিরিশ মিনিট। মাইতিদা উনি চলে যেতে চেয়েছিলেন, আমি এক রকম জোর করেই রেখে দিয়েছি। জবাব দিলো তায়েবা। ভালো করোনি। এখানকার একটা ডিসিপ্লিন তো আছে। সেটা যদি জোর করে ভেঙ্গে ফেলো আমরা টলারেট করবো কেনো? তায়েবা ডঃ মাইতির কথায় কোনো জবাব না দিয়ে বললো, ঠিক আছে দানিয়েল ভাই, চলে যান। আমিও চলে আসার জন্য পা বাড়িয়েছিলাম। এমন সময় ডঃ মাইতি তায়েবার হাত ধরে হো হো করে হেসে উঠলেন। দিদি তোমার আচ্ছা রাগ তো। এটা যে হাসপাতাল, বাড়ি নয়। সে কথা তোমাকে কেমন করে বোঝাই । ঠিক আছে, সাহেব আর দশ মিনিট বসুন। বিছানার একপাশে বসলাম। এখনো তায়েবার রাগ কমেনি। দানিয়েল সাহেব আপনি কেমন আছেন? আমি বললাম, ভালো। সে রাতের পর আপনার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। মাঝে মধ্যে সময় হলে গরীবের দরোজায় একটু টোকা দেবেন। সে রাতের পর থেকে কেন জানিনে আমি ডঃ মাইতির মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কেমন ভয় ভয় করে। তায়েবা বললো, কালকে আসবেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। আমাকে হাসপাতাল থেকে চলে আসতে হলো।

০৯-১০. আগস্ট মাসের চৌদ্দ তারিখ

সেদিনটি ছিলো আগস্ট মাসের চৌদ্দ তারিখ। চারদিকে ভারতের স্বাধীনতা দিবস পালনের তোড়জোর চলছে। সকাল বেলা ঢাকা রেডিও ধরেছিলাম। গোটা বাংলাদেশে আজ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপিত হচ্ছে। ইয়াহিয়া খানের কণ্ঠস্বর শুনলাম। জঙ্গীলাট পাকিস্তানের দু’অংশের ঐক্য কেয়ামতের দিন পর্যন্ত অটুট থাকবে, এ ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদ প্রকাশ করে ঘোষণা করছেন, কোনো দুশমন পাকিস্তানের এক ইঞ্চি মাটি একজন পাকিস্তানী বেঁচে থাকতেও দখল করতে পারবে না। পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ শব্দটি উচ্চারণ করে ইয়াহিয়া খান তার উর্দু বক্তৃতা শেষ করলেন। পর পর ইংরেজি এবং বাংলায় তাঁর বক্তৃতা অনুবাদ করে শোনানো হলো। ইয়াহিয়া খানের বক্তৃতার পরে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের একজন অধ্যাপক পাকিস্তানকে সমর্থন করে এমন জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিলেন, শুনে আমার শিরার সমস্ত রক্ত চট করে মাথায় এসে জমা হলো। এই ভদ্রলোকটির কাছ থেকে আমরা দেশপ্রেমের প্রথম পাঠ গ্রহণ করেছিলাম। হয়তো অধ্যাপক শখ করে পাকিস্তানকে সমর্থন করার জন্য রেডিওতে বক্তৃতা দিতে আসেননি। সৈন্যরা বন্দুক দেখিয়ে বাড়ি থেকে টেনে বের করে রেডিওর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তবু আমার ভীষণ খারাপ লাগতে আরম্ভ করলো। আগস্ট মাসের এই সকালটি অত্যন্ত সুন্দর। শিশুসূর্যের প্রাণপূর্ণ উত্তাপে প্রাসাদ নগরী কোলকাতা যেনো ভেতর থেকে জেগে উঠেছিলো। মনটা অকারণে খুশিতে ছেয়ে গিয়েছিলো। রবীন্দ্রনাথের সে গানটির কলি মনের ভেতর আসা যাওয়া করছিলো। “আজি প্রভাত স্বপনে শরত তপনে, কি জানি পরান কিযে চায় গো, শেফালীর শাখে কি বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কি যে গায় গো”। ঢাকা রেডিও শুনে সব কিছু অশ্লীল মনে হতে লাগলো। বন্ধ করে দিলাম। এই কান্তিমান দিনের সমস্ত আলো, উত্তাপ প্রতিশ্রুতি আমার কাছে একেবারে অর্থহীন হয়ে দাঁড়ালো। আজ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। আগামীকাল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। আর আমরাও একটি স্বাধীনতা সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আকাশে বাতাসে সর্বত্র শাড়ির আঁচলের মতো স্বাধীনতা যেনো দুলে দুলে খেলা করছে। হায়রে স্বাধীনতা!

আমার মনে কৃষ্ণবর্ণ পুষ্পের মতো একটা বিশ্রী অনুভূতি জন্ম নিয়েছিলো, বিষয়টা আরো বেড়ে গেলো। ঘরের বন্ধুদের কারো কাছে এ অনুভূতি আমি প্রকাশ করতে পারিনে। এমন কি নরেশদাকেও না। কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না। কণ্ঠনালী দিয়ে একটার পর একটা তেতো ঢেকুর উঠে আসতে চাইছিলো। সকালে নাস্তা খাওয়া হয়নি। রুমে একটা তুমুল বিতর্ক চলছে। ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের ব্যাপারে সিরিয়ািস কোনো পদক্ষেপ নেবেন না। ইত্যাদি ইত্যাদি। শ্রীমতি গান্ধী যা ইচ্ছে করুন। আমি প্যান্ট শার্ট পরে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু গেটের কাছে এসে চিন্তা করলাম, কোথায় যাওয়া যায়। সত্যি সত্যি কোলকাতা শহরে যাওয়ার মতো জায়গা খুবই অল্প আছে। হঠাৎ করে মনে পড়ে গেলো এ্যান্টনী বাগান লেনে মজহারুল ইসলামের বাড়িতে গেলে মন্দ হয় না! সকালের নাস্তাটাও ওখানে খেয়ে নেয়া যাবে। আর ইসলামের কাজকর্মের একটু ফাঁক থাকলে তাকে নিয়ে অর্চনার ফ্রান্স থেকে আগত দাদার কাছে গিয়ে আলাপ করা যাবে।

আমি যখন এ্যান্টনী বাগান এসে পৌঁছলাম, ইসলামেরা সবেমাত্র নাস্তার টেবিলের চারপাশে এসে বসেছেন। এখনো কেউ খেতে আরম্ভ করেননি। আমাদের দেখে ইসলাম হাসতে হাসতে বললেন, আরে মশায় আপনার উৎপাতে দেখছি সকাল বেলাটাও নিরাপদে কাটানো যাবে না। বলেন কোন্ মহাপ্রয়োজনে এই সকাল বেলা বাড়িতে এসেছেন। আমি বললাম, কাজ না থাকলে কি আর আসি। আপনারা বাংলাদেশের মানুষেরা বেশ আছেন, গোটা কোলকাতা শহরে একেকজন ধর্মের ষাঁড়ের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একেক মহাপুরুষের সুকীর্তির কাহিনী শুনতে শুনতে কানে পঁচন ধরে গেছে। আপনারা তো ইন্দিরা সরকারের অতিথি হিসেবে দিব্যি আছেন। এদিকে ইন্দিরাজী আমাদের কোন্ হাল করেছেন, সেটার কি খোঁজখবর রাখেন? গতোকাল এই পাড়ায় আমাদের পার্টির যতো কর্মী ছিলো সবাইকে এ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে। আমি বাসায় ছিলাম না। তাই আপনার সঙ্গে দেখা হলো। মজহারুল ইসলাম সিপিআইএম-এর ডেডিকেটেড ওয়ার্কার। এখন পশ্চিমবঙ্গে সিদ্ধার্থ শংকরের কংগ্রেস সরকারের সমস্ত রোষ সিপিআইএম-এর বিরুদ্ধে। কেনোনা জ্যোতিবসু এবং প্রমোদ দাস গুপ্তের নেতৃত্বাধীন সিপিআইএম-ই হলো কংগ্রেসের পয়লা নম্বরের দুশমন। প্রতিদিন কর্মীদের দলে দলে গ্রেফতার করছে। কেউ নিজের বাড়িতে থাকতে পারছে না। মজবুত ঘাঁটিগুলো একে একে কংগ্রেসের হাতে গিয়ে পড়ছে। বাইরে থেকে ঠিক বোঝার উপায় নেই। এখনো কংগ্রেস সরকার একটি ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে।

মজহার সুযোগ পেলেই আমাদের খোঁচা দিতে ছাড়েন না। তাঁর অভিযোগটির মর্মবস্তু অনেকটা এরকম, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কৌশলে ফঁপিয়ে ফুলিয়ে বাংলাদেশ ইস্যুটি অস্বাভাবিক বড়ো করে জনমত সেদিকে আকর্ষণ করে রাখতে চাইছেন। আর সে সুযোগটি পুরোপুরি নিয়ে বিরোধী দলের অস্তিত্ব একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য অবিরাম হামলা করে চলেছেন। তিনি এবং তাঁর মতো অনেকেই মনে করেন আমরা এখানে এসে শ্রীমতী গান্ধীর হাতে একটি মারাত্মক অস্ত্র তুলে দিয়েছি। তথাপি সিপিআইএম-এর লোকদের আমাদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি আছে। নকশাল ছেলেরা তো সরাসরি মনে করে আমরা জনগণের বিপ্লবের জানী দুশমন। আর ভারতীয় গোঁড়া মুসলমানেরা বাংলাদেশের মানুষদের হিন্দুদের খেলার পুতুল ছাড়া কিছু মনে করেন না। সে যাক, আমি মজহারকে বললাম, আপনাকে মশায় আমার সঙ্গে যেতে হবে।

মজহার প্রথমে যেতে চাননি। একাজ সেকাজের অছিলা করে পিছলে যেতে চেষ্টা করছিলো। আমি যখন চাপাচাপি করতে থাকলাম, শেষ পর্যন্ত রাজী না হয়ে উপায় ছিলো না। নাস্তা করার পর দু’জনে বেরিয়ে পড়লাম। আমি ভাবলাম গরিয়াহাটা অবধি বাসে যাবো। কিন্তু মজহার রাজী হলেন না। তিনি বললেন, মশায় এখন ট্রামে যাওয়া চলবে না। গতোরাতে পাড়া থেকে আমাদের পার্টির সমস্ত ওয়ার্কারকে তুলে নিয়ে গেছে। আপনার সাধ হয়েছে আমায় কিছু পয়সা খরচ করাবেন। তা আর কি করা যাবে। অপেক্ষা করুন ট্যাক্সি আসুক।

ট্যাক্সি এলে দু’জনে উঠে বসলাম। ডানদিকে বেরিয়ে শিয়ালদার মোড়ে এসে জানজটের মধ্যে আটকে গেলো ট্যাক্সি। মজহার বললেন, আপনি মশায় মানুষটাই অপয়া… দিন একখান চারমিনার। আর তো কিছু করার উপায় নেই! বসে বসে ধোয়া ছাড়ি। আমি সিগারেট বের করে দিলাম। তিনি দেয়ালে সাঁটা পোষ্টারের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, দেখুন, ইন্দিরা গান্ধীকে কেমন চিতা বাঘিনীর মতো দেখাচ্ছে না? আমার কিন্তু তেমন মনে হলো না। ইন্দিরা গান্ধীকে ইন্দিরা গান্ধীর মতোই মনে হচ্ছিলো। বোধ হয় চিতা বাঘিনীর ছাপটি মজহারের মনে আছে। তাঁকে তুষ্ট করার জন্য বললাম তা দেখাচ্ছে বটে, আপনাদের পোষ্টার? হ্যাঁ, ছবিটা কে এঁকেছে জানেন? ছবিটা হলো গিয়ে দেব্রত দাশ গুপ্তের। বদিক থেকে তাকিয়ে দেখুন একেবারে অবিকল চিতা বাঘিনী। তাকিয়ে দেখার পর আমারও কেমন চিতা বাঘিনী মনে হলো। এই সময়ে জানজট হালকা হয়ে এলো।

গোলপার্কে এসে ট্যাক্সি থেকে নামলাম দু’জনে। দরজায় বেল টিপতেই অর্চনা নিজে এসে দোর খুলে দিলো। অর্চনা স্নান করেছে, পিঠের ওপর আধভেজা চুলের বোঝ ছড়িয়ে আছে। তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। চশমা না পরলে তাকে সত্যি সত্যি সুন্দর দেখা যায়। মজহারকে সামনে ঠেলে দিয়ে বললাম, তোমার প্যারিস ফেরত দাদার সঙ্গে পরিচয় করে দেবার জন্য এক বন্ধুকে ধরে নিয়ে এসেছি। মাথা নীচু করে আদাব জানিয়ে জিগগেস করলো, আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন? মজহার বললেন, না, আমার বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলায়। তবে দু’পুরুষ ধরে কোলকাতা স্থায়ীভাবে বসবাস করছি এবং কলেজ স্ট্রীট মার্কেটে একখানা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চালাই।

আপনারা বসুন আমি চা নিয়ে আসি। প্রমোদদা ততোক্ষণে এসে পড়বেন। আমি জানতে চাইলাম তিনি কি এখন বাড়িতে নেই? অর্চনা বললেন, খুব সকাল বেলা উঠে তিনি একাকি বেরিয়ে পড়েন। ঘুরে ঘুরে পুরোনো আড্ডার জায়গাগুলো দেখেন। রোদটা তেঁতে উঠলেই চলে আসেন বাসায়। আসার সময় প্রায় হয়ে এলো। চায়ে মুখ দিয়েছি, এমন সময় বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থামার শব্দ শোনা গেলো। অর্চনা উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলতে খুলতে বললো, এই বুঝি দাদা এলেন।

লম্বা চাওড়া ফর্সা চেহারার এক ভদ্রলোক ঘরে প্রবেশ করলেন। দেখতে ঠিক বাঙালি মনে হয় না। এখন বেলা অধিক হয়নি। তবু ভদ্রলোকের শরীর ঘেমে এক রকম ভিজে গেছে। অর্চনা তাড়াতাড়ি একটা তোয়ালে এনে দিলো এবং ফ্যানটা অন করে স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে জিগ্‌গেস করলো, দাদা আপনার প্রাতকালীন তীর্থদর্শন আর কতোদিন চলবে? সারা জীবন দেখলেও মনে হচ্ছে শেষ হবে না। ভদ্রলোকের অনভ্যস্থ জিহ্বায় বাংলা ভাষাটা ঠিকমতো আসতে চায় না। হঠাৎ করে বয়স্ক মানুষের মুখে শিশুর মতো বাংলা ভাষা শুনলে কানটা আচমকা খুব খুশি হয়ে ওঠে। তিনি বললেন, বিদেশে এ কোলকাতা শহরের অনেক অপবাদ শুনেছি। কোলকাতা নোংরা, ঘিঞ্জি আর দুর্গন্ধময় এসব আর কি। ঘুরে ঘুরে দেখতে কিন্তু আমার বেশ লাগে।

শেয়ালদার মোড়ে নোংরা জঞ্জাল আর আবর্জনার স্তূপ দেখে অর্চনা আমার কি মনে হলো জানিস? যেনো আবার নতুন করে জন্মাচ্ছি। কি জানি দাদা আপনি দার্শনিক মানুষ। আপনার দেখার ধরনটাই আলাদা। আমরা কিন্তু নোংরা আবর্জনাকে আবর্জনাই দেখি। প্রমোদবাবু হেসে উঠলেন হো হো করে। এসবের সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক তোকে আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। আহ্ কতদিন পরে আবার কোলকাতা দেখছি। নিজের মাটি, নিজের মানুষ কি জিনিস যদি বুঝতে চাস তো একটানা কয়েক বছর দেশের বাইরে কাটিয়ে আয়, তারপর বুঝতে পারবি। এ মাটি মানুষ ছেড়ে বিদেশে আপনি তো একটানা দু’যুগেরও অধিক সময় কাটিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, মাঝে মাঝে আমি নিজেও অবাক হয়ে ভাবি এতোটা সময় কি করে কাটিয়ে দিলাম। কোনো সন্ধ্যেবেলা অথবা রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ভাবতাম, আর, ঢের হয়েছে। এবার সব ছেড়ে ছুঁড়ে দেশে ফিরে গিয়ে ছোটো নাগপুরের ওদিকে একটা কুটির তৈরি করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবো। কিন্তু আর হলো কৈ? দেশে আসতে চাইলেও আসতে দিচ্ছে কে? আমি ফ্রেঞ্চ সিটিজেন হয়ে গেছি। তাছাড়া তোমার বৌদি আছে, ছেলেমেয়েরা আছে। তারা সকলে ওদেশটার জীবনধারায় অভ্যস্থ। সব কটাকে এখানে নিয়ে এলে ডাঙ্গার মাছের মতো অবস্থা হবে। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মানুষের সব সাধ কি পূর্ণ হয়? তবু ভাগ্য ভালো বলতে হবে। বাংলাদেশের ফ্রিডম ওয়ারটা শুরু হলো। আর নিজেকে আটকে রাখা গেলো না। ছুটে চলে এলাম। অর্চনা বললো, অন্তত একটা সাধ তো আপনার মিটলো। পুরনো দিনের কারো সঙ্গে দেখা হলো? প্রমোদ বাবু বললেন, দেখো, তোকে আসল খবরটাই বলা হয়নি। আমার সঙ্গে গেলো পরশুদিন অনুকূলদার দেখা হয়েছে। তিনি পূর্বের মতো শক্ত সমর্থ আছেন। শুধু মাথার চুলটাতেই একটু পাক ধরেছে। এ ধরনের চিরতরুণ মানুষকে দেখলে ঈর্ষা হয়। এখনো তিনি সমাজের কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা মোল আঠারো বছর বয়সে যেভাবে তার কাছে ঝাঁক বেঁধে যেতাম, তেমনি এখনো তার ঘরে ষোল আঠারো বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। দেখলে বিস্ময়ে অবাক হয়ে যেতে হয়। জানিস অর্চনা, অনুকূলদা পুরোনো বিপ্লবীদের জড়ো করে বেঙ্গল ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স পার্টি গড়েছেন। তাঁর দলের ছেলেরা কোলকাতা শহরের সব জায়গায় বড়ো বড়ো করে লিখেছে, দু’বাংলার চেক পোস্ট উড়িয়ে দাও-দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। অনুকূলদাদের বিএনভিপি ফান্ডে তিনশো ডলার ডোনেট করলাম।

প্রমোদবাবুর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে অর্চনা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো, দাদা আপনি এতোদিন বাদে দেশে এসে আবার বিএনভিপি-র পাল্লায় পড়েছেন? ছি, কি কেলেঙ্কারীর কথা। কেনো, বিএনভিপি কি দোষটা করলো? ওরা ভাঙা বাংলাকে আবার জোড়া লাগাতে বলছে। একি চাট্টিখানি কথা। জানো, এই বাংলা বিভাগ সহ্য করতে না পেরে উনিশশো সাতচল্লিশে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। অর্চনা বললো, আপনি যেনো একটা কি দাদা। এই বিএনভিপি-র মতো প্রতিক্রিয়াশীল দল গোটা পশ্চিমবাংলায় আর একটিও নেই। আপনি চেনেন না বটে। ওদের আমরা হাড়ে হাড়ে চিনি। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার এমন চমৎকার ডিপো আর একটাও খুঁজে পাবেন না। আপনি গিয়ে তাদের খপ্পরে পড়লেন? একদিক দিয়ে হিসেব করলে আপনি বিশেষ ভুল করেননি। মানুষের বাচ্চা বয়সে চোট লাগলে বুড়ো বয়সে সেটা আবার চাড়া দিয়ে ওঠে? আপনার কৈশোর এবং যৌবনকাল কেটেছে অনুশীলন দলের বিপ্লবীদের সংস্পর্শে। মাঝখানে পঁচিশ তিরিশ বছরের মতো বিদেশে কাটিয়েছেন। কিন্তু আপনার মন ওই জায়গাটিতেই এখনো আটকে রয়েছে। মাঝখানের দু’দুটি যুগ অতিবাহিত হয়ে গেছে। সমাজের কতো পরিবর্তন ঘটে গেছে, রাজনীতির ধরনধারণ কতো পাল্টে গেছে। আপনার অগ্নি যুগের বিপ্লবীদের স্মৃতি এখন অতীত যুগের দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু নয়। অর্চনা অধিক কথা না বাড়িয়ে বললো, যাকগে, আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য আমার এক বাংলাদেশের বন্ধুকে ডেকে এনেছি। ওর নাম দানিয়েল। আপনাকে ঢাকার সমস্ত খবরাখবর বলতে পারবে। প্রমোদবাবু নমস্কারের ভঙ্গিতে জোড়হাত করলেন। তারপর জিগ্‌গেস করলেন, আপনি ঢাকায় থাকেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, উয়ারি চেনেন? বললাম, ঢাকায় থাকি উয়ারি চেনবো না কেন? আচ্ছা আপনি জানেন উয়ারিতে একটা র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীট আছে। আমাকে বলতে হলো, হ্যাঁ, উয়ারিতে একটা র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীট আছে। ওই র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীটের ৩২ নম্বরের বাড়িতে ছোটোবেলায় আমি থেকেছি। জিগেস করলাম, ওটা কি আপনাদের বাড়ি ছিলো? জবাবে প্রমোদবাবু বললেন, ঠিক আমাদের বাড়ি নয়। আমি জন্মেছি গ্রামে। ঢাকা শহর থেকে বেশি দূরে নয়। বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পাড়ে শুভাড্যায়। র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীটের বাড়িটি ছিলো আমার দাদামশায় রায় বাহাদুর নলিনাক্ষ চৌধুরীর। তিনি ছিলেন জমিদার। অসাধারণ প্রতাপশালী মানুষ। আপনি কি কখনো রায় বাহাদুর নলিনাক্ষ চৌধুরীর নাম শুনেছেন? আমাকে বলতেই হলো, এরকম কোনো নাম শুনেছি বলে মনে পড়ে না। তিনি একটুখানি নিরাশ হলেন মনে হলো। তারপর জানতে চাইলেন, আচ্ছা র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীটের ৩২ নম্বর বাড়িটি আপনি দেখেছেন? আমি বললাম, র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীটটি চিনি বটে, কিন্তু কোন্ বাড়িটির কথা বলছেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনে। প্রয়োদ বাবু বললেন, বাড়িটি দোতলা। সামনে একটা লোহার গেট। গেটের কাছে একটি বেল গাছ। বাড়ির পেছন দিকে একসার নারকেল গাছ। এবার চিনতে পারলেন? এতো বিশদ করে বলার পরও বাড়িটি আমার চেনার বাইরে থেকে গেলো। ভদ্রতার খাতিরে বলতে হলো, আমি থাকি র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীট থেকে অনেক দূরে। সে কারণে বাড়িটির সঙ্গে পরিচয় ঘটে উঠতে পারেনি। ভদ্রলোক একটু দমে গেলেন। পকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে তিনি ফের জানতে চাইলেন। আপনি কি ফরাশগঞ্জের সত্যানন্দ সিংহের নাম শুনেছেন, এক সময়ে যিনি ঢাকার অনুশীলন সমিতির সর্বেসর্বা ছিলেন। এবারেও আমাকে অজ্ঞতা প্রকাশ করতে হলো।

প্রমোদবাবু সিগারেটের ছাই ঝেড়ে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বললেন, এটা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার, আপনি ঢাকায় থাকেন অথচ সত্যানন্দ সিংহের নাম শোনেননি। আমাদের সময়ে সত্যানন্দ সিংহকে সকলে এক ডাকে চিনতো। বৃটিশ সরকার তার মাথার ওপর দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। আপনারা মুক্তিযুদ্ধ করছেন, অথচ অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের নাম পর্যন্ত জানেন না, এটা কেমন করে হয়। আমি মনে মনে রেগে গেলাম। কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করলাম না। বললাম, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের নাম জানার কোনো সম্পর্ক আছে কি? তিনি বললেন, বারে, সম্পর্ক থাকবে না কেনো? সব ব্যাপারে একটা ধারাবাহিকতা থাকা তো প্রয়োজন।

উত্তরে আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না। অর্চনা এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করলো। সে প্রমোদবাবুকে জিগ্‌গেস করলো, আচ্ছা দাদা বলুন দেখি, আপনি দেশ ছেড়েছেন কতোদিন। প্রমোদবাবু মাথা চুলকে বললেন, তা হবে সাতাশ আটাশ বছর। অর্চনা ফের জানতে চাইলে অগ্নিযুগের যেসকল বিপ্লবীকে চিনতেন দেশ ছাড়ার সময়ে সকলের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিলো? প্রমোদবাবু বললেন, তা ছিলো না- কে কোথায় ছিটকে পড়েছিলেন তার কি কোনো ঠিক ঠিকানা আছে? কেবল অনুকূলদার সঙ্গে সম্পর্কটা ছিলো। আপনি প্রায় তিরিশ বছর পূর্বে যোগাযোগ রাখতে পারেননি। এই বেচারি যদি আপনার চেনাজানা মানুষদের চিনতে না পারে তাহলে কি খুব অন্যায় হবে? মধ্যিখানে কতো কিছু ঘটে গেলো। দেশ বিভক্ত হলো। জন্ম নিলো হিন্দুস্থান, পাকিস্তান। আবার সেই পাকিস্তানও এখন ভেঙ্গে যেতে লেগেছে। আপনার দশা হয়েছে রিপভ্যান উইঙ্কলের মতো। আপনি যে ঢাকার কথা বলছেন, সে হলো আপনার স্মৃতি এবং স্বপ্নের ঢাকা শহর। এখনকার ঢাকা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। শুনেছি রাস্তাগুলো প্রশস্ত চওড়া। লেখাপড়া শিক্ষা সংস্কৃতিতে ঢাকা এখন অনেক এগিয়ে গেছে। কোনো কোনো দিক দিয়ে কোলকাতাকেও ছাড়িয়ে গেছে।

হঠাৎ প্রমোদবাবু আমার চোখে চোখ রেখে জিগগেস করলেন, আচ্ছা এখনো কি ঢাকা শহরে পঙ্খিরাজ গাড়ি আছে? কথা শুনে আমার হাসি পাওয়ার দশা। বললাম, এখন কি আর পঙ্খিরাজের যুগ আছে? আমার কথায় তিনি বোধ করি খানিকটে আহত হলেন। সে কি আপনারা এমন সুন্দর জিনিসটি উঠিয়ে দিলেন? জবাবে বললাম, কেউ উঠিয়ে দেয়নি, কালের প্রভাবে আপনা আপনিই উঠে গেছে। তারপর আমার কাছে জানতে চাইলেন, আপনাদের মুক্তিসংগ্রামের সংবাদ বলুন। ফ্রেঞ্চ টেলিভিশনে প্রায় প্রতিদিনই খবর থাকতো। মনে করেছিলাম, বাংলাদেশে একটি বড়ো ঘটনা ঘটছে? অনেকদিন থেকেই দেশে আসবো আসবো ভাবছিলাম, তবে ইনারশিয়া কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। টিভিতে বাংলাদেশের সংবাদ শুনে শুনে নিজের মধ্যে এমন একটা হ্যাচকা টান অনুভব করছিলাম আর স্থির থাকতে পারলাম না, চলে এলাম।

এরই মধ্যে চা-বিস্কুট এসে গেছে। ভদ্রলোক একটা বিস্কুটের কোণায় কামড় দিয়ে এক চুমুক চা পান করলেন। সেই সময়ে তাঁর দৃষ্টি মজহারুল ইসলাম সাহেবের ওপর পড়লো। লজ্জা পেয়ে বললেন, আরে আপনার সঙ্গে তো কথাই বলা হয়নি। আপনিও কি বাংলাদেশের। ইসলাম বললেন, না আমার বাড়ি মুর্শিদাবাদ। তবে আমরা দু’পুরুষ ধরে কোলকাতায় বসবাস করছি। আপনি কি করেন? ইসলাম বললেন, আমি এখানে কলেজ স্ট্রীটে একখানা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চালাই। আপনার নাম? ইসলাম বললেন, মজহারুল ইসলাম। আপনি মুসলমান? ইসলাম জোর দিয়ে বললেন, হ্যাঁ মুসলমান। প্রমোদবাবু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। অর্চনা বুদ্ধিমতী মহিলা। কথার খেই ধরে জিগগেস করলো, আপনার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নামটি কিন্তু এখনো জানা হয়নি। ইসলাম বললেন, নব জাগৃতি’। কেমন চলছে আপনার ব্যবসা? অর্চনার কৌতূহল মেটাবার জন্য বললেন, বর্তমানে ব্যবসার অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। আমরা তো মার্কসিস্ট বইপত্র ছেপে থাকি। শ্রীমতী গান্ধীর সরকার বর্তমানে মার্কসিস্ট সবকিছুর ওপর অত্যন্ত খাপ্পা হয়ে আছেন। কোনো কোনো সপ্তাহে দোকান খোলাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমার তো আবার ডবল রিক্স। নামে মুসলমান, তার ওপর মার্কসীয় বইপত্রের প্রকাশক। অর্চনা সোজা হয়ে বসেছিলো। একটুখানি ঝুঁকে পড়ে চায়ের পেয়ালাটা তুলে নিলো। তার চোখেমুখে সহানুভূতি মিশ্রিত লজ্জার ছায়া ঘনিয়ে এসেছে। আপনি মুসলিম বলে ব্যবসাপত্র করতে অসুবিধে হয় কি? ইসলাম বললেন, সব সময়ে নয়, মাঝে মাঝে বেশ বিপদে পড়তে হয়। এই দেখুন না, আমার দোকানটা ছিলো পুরবী সিনেমার কাছে। গেলো রায়টের সময় গোটা দোকানটাই জ্বালিয়ে দেয়া হয়, একটি পৃষ্ঠাও বাঁচাতে পারিনি। শুনে সহসা অর্চনার মুখে কোনো কথা যোগালো না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, এটা ভারী লজ্জা এবং দুঃখের। ভারতের নেতৃবৃন্দ যারা প্রকাশ্য জনসভায় বড়ো বড়ো কথা বলেন, তাঁদের গলায় দড়ি দিয়ে মরা উচিত। ইসলাম বললেন, আমাদের দেশে খারাপ লোকের সংখ্যা নেহায়েতই মুষ্টিমেয়। তারা ক্ষমতাসীনদের সহায়তাতেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। গড়পড়তা সাধারণ মানুষ খুবই ভালো। এই ভালো মানুষেরা আছে বলেই এখনো পর্যন্ত টিকে আছি। আমি ধরে নিয়েছি, ওটা একটা এ্যাকসিডেন্ট। তাই আমার কোনো রকম নালিশ বা অনুযোগ নেই।

প্রমোদবাবু হাতের পেয়ালাটা নামিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। তারপর বললেন, অর্চনা, বোধ করি তোর কথা সত্যি। এরই মধ্যে এতোসব পরিবর্তন হয়ে গেছে আমি তার বিন্দুবিসর্গও জানিনে। আমার মন সে সাতচল্লিশ আটচল্লিশে থিতু হয়ে আছে। এখানে এসে দেখতে পাচ্ছি প্রচণ্ড রকমের ওলোট পালোট হয়ে গেছে। এই উপমহাদেশটি কোন্ দিকে যাচ্ছে? একবার দেশ ভাগ হয়ে হিন্দুস্থান পাকিস্তান হলো। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ যদি সফল হয় পাকিস্তান আরার খণ্ড হবে। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবতে চেষ্টা করি, সব মিলিয়ে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে। গোটা ভারত উপমহাদেশে বাংলার স্থান কোথায়? বৃটিশ তাড়ানোর সংগ্রামে বাংলা দিয়েছে সব চাইতে বেশি, পেয়েছে সব চাইতে কম। বাঙালির ভাগ্য কি হবে বলতে পারেন? আমি চুপ করে রইলাম। অর্চনা বললো, দাদা, আমার ক্ষমতা থাকলে রাজনৈতিক কুষ্ঠি তৈরি করতাম। আপাতত যখন সে ক্ষমতা নেই, সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়াই উস্কৃষ্ট কর্ম মনে করি। অতো ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন কি? যা ঘটবার তাতো ঘটবেই। তিনি অর্চনার কথা কানে না নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিগগেস করলেন, আপনাদের শেখ মুজিবুর রহমানটি কেমন মানুষ আমার জানতে খুব ইচ্ছে হয়। মুক্তিযুদ্ধ যদি জয়যুক্ত হয় ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জানেন এটা বিরাট ব্যাপার। বাংলার ইতিহাসে আমি যতোদূর জানি, এই ভূখণ্ডে বিক্ষোভ বিদ্রোহের অন্ত নেই। কিন্তু বাঙালি আপন প্রতিভা বলে নিজেদের মেরুদণ্ডের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা রাষ্ট্রযন্ত্র সৃষ্টি করেছে, তেমন কোনো প্রমাণ নেই। বাংলাদেশ যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারে তাহলে একটা অভিনব ব্যাপার হবে। কোলকাতায় খোঁজখবর নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে যেটুকু জেনেছি, তা থেকে স্থির কোনো ধারণা গঠন করা সম্ভব নয়। আমাকে কেউ কেউ বলেছেন মুজিব একজন গোঁড়া সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের সময় সোহরাওয়ার্দীর চ্যালা ছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তিনি মহাত্মাজীর মন্ত্রশিষ্য। অহিংস অসহযোগনীতি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এই বিরাট গণসংগ্রাম রচনা করেছেন। দু’চারজন কমিউনিস্ট বন্ধুর কাছে জিগগেস করে যা জেনেছি তাতে সংশয়টা আরো বেড়ে গেলো। মুজিব নাকি ঘোরতরো কমিউনিস্ট বিরোধী। মুজিব লোকটা কেমন, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন কি সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারেননি। আমার কাছে সবটা ধোঁয়া ধোয়া ছায়া ছায়া মনে হয়। কিন্তু একটা বিষয় দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। মানুষটার ভেতর নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে। নইলে তাঁর ডাকে এতোগুলো মানুষ বেরিয়ে এলো কেমন করে। আমি টিভিতে মুজিবের অনেকগুলো জনসভার ছবি দেখেছি। দেখার সময় শরীরের পশম সোজা হয়ে গিয়েছিলো। এ রকম মারমুখি মানুষের ঢল আমি কোথাও দেখেছি মনে পড়ে না। মনে মনে কল্পনা করতাম অনুশীলন, যুগান্তর এ সকল বিপ্লবী পার্টির প্রভাবে এই গণসংগ্রাম জন্ম নিয়েছে। এখন বুঝতে পারছি, আমার মধ্যে যথেষ্ট ইনফর্মেশন গ্যাপ ছিলো। ফ্রান্সে আমার এক ইন্ডিয়ান বন্ধু আছে। তাঁর ছোটো ভাই ওয়েস্ট বেঙ্গল কংগ্রেসের এক হোমড়াচোমড়া ব্যক্তি। বেলেঘাটার দিকে বাড়ি। গত পরশুদিন তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন জিন্নাহর দ্বি-জাতিতত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে এবং পাকিস্তান আর টিকে থাকতে পারছে না। আমি তাঁর সরল বিশ্বাসের কোনো প্রতিবাদ করিনি। রকম সকম দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যে সামান্য অধিকার আমার আছে, তা দিয়েই বলতে পারি ভারতবর্ষের ব্যাপারে এক জাতিতত্ত্ব এবং দ্বি-জাতিতত্ত্ব কোনোটাই খাটে না। আসলে ভারতবর্ষ বহু জাতি এবং বহু ভাষার একটি মহাদেশ। উনিশশো সাতচল্লিশে ধর্মের প্রশ্নটি মুখ্য হয়ে অন্য সব প্রশ্ন ধামাচাপা দিয়েছিলো। আরো একটা কথা, নানা অনগ্রসর পশ্চাৎপদ জাতি এবং অঞ্চলের জনগণ তাদের প্রকৃত দাবি তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছিলো বলেই আপাত সমাধান হিসেবে ভারত পাকিস্তান রাষ্ট্র দু’টির জন্ম হয়েছিলো। পরিস্থিতি যে রকম দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তান ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশ একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নিতে যাচ্ছে। একথা যদি বলি আশা করি অন্যায় হবে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। তারপরে ভারতকে একই সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। আঞ্চলিক, জাতিগত, ধর্ম এবং ভাষাগত বিচ্ছিন্নতার দায় মেটাতে গিয়ে ভারতবর্ষের কর্তাব্যক্তিদের হিমসিম খেতে হবে। এমনকি ভারতের ঐক্যও বিপন্ন হতে পারে।

মনে মনে আমি ভীষণ অস্বস্থি বোধ করছিলাম। এই কোলকাতা শহরে ক্ষুধা তৃষ্ণার অধীন আমি একজন বিপন্ন ব্যক্তি মাত্র। আপন অন্তর্গত বেদনার ভারে সর্বক্ষণ কুঁজো হয়ে আছি, আপন হৃদয়ের উত্তাপে সর্বক্ষণ জ্বলছি। কোথাও পালিয়ে গিয়ে দুঃখগুলো নাড়াচাড়া করবো সে রকম কোনো ঠায় নেই। কেউ আমাকে নিছক আমি হিসেবে দেখতে রাজী নয়। যেখানেই যাই ভারত পাকিস্তান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এসব এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। এ এমন জটাজাল, ছাড়াতে চাইলেও ছাড়াতে পারিনে। হাম কমলি কো ছোড়নে মাংতা, মগর কমলি হামকো নেহি ছোড়। আমি যেখানেই যাই বাংলাদেশের যুদ্ধের কথা ওঠে। বাংলাদেশের কথা উঠলেই চীন, রাশিয়া, বৃটেন, আমেরিকার কথা আপনিই এসে পড়ে। বাংলাদেশের এক কোটির মতো মানুষ ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে ভারতে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, তার জন্য যেনো আমি দায়ী। চীনা অস্ত্রে পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশের জনগণকে হত্যা করছে, সেজন্যও আমি ছাড়া দায়ী কে? বিশ্ববিবেক বাংলাদেশের এই দুঃখের দিনে কোনো রকমের সাড়া দিচ্ছে না, তার জন্যও আমাকে ছাড়া কাকে দায়ী করবো? আমি হলাম গিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সমস্যা সঙ্কটের অঙ্কুর। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার যদি জন্ম না হতো।

তায়েবা হাসপাতালে পড়ে আছে। তার সাংঘাতিক ক্যান্সার, ডাক্তার বলছে সে বাঁচবে না। এই বেদনার ভার আমি কি করে হালকা করি। যতোই চেষ্টা করি না কেনো আমার ভেতরের সঙ্গে বাইরের কিছুতেই মেলাতে পারিনে। পৃথিবী চলছে তার আপন নিয়মে। মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে রক্ত আসতে চায়। কি করবো স্থির করতে পারিনে। ঘটনা স্রোত আমার সমগ্র অস্তিত্বকে এমন একটা গহ্বরের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছে, সারাজীবন চেষ্টা করলেও বোধ করি বেরিয়ে আসতে পারবো না। সময় তার জটাজাল প্রসারিত করে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে।

এরই মধ্যে সুনীলদা বাজার সেরে এসে আলোচনায় যোগ দিয়েছেন। মজহার, সুনীলদা, অর্চনা, প্রমোদবাবু উনারা কথা বলে যাচ্ছিলেন। আমার কিছু বলতে প্রবৃত্তি হচ্ছিলো না। ইচ্ছে হচ্ছিলো উঠে একদৌড়ে কোথাও পালিয়ে যাই। কিন্তু যাবো কোথায়? প্রায় অর্ধেক কোলকাতা শহর ঘুরে একটুখানি সান্ত্বনার প্রত্যাশায় তো এ বাড়িতে এলাম। অর্চনার আজকের রকম সকম দেখে মনে মনে ভীষণ ব্যথিত হলাম। আমি জানি তায়েবা মারা যাচ্ছে। কারো করার কিছু নেই। আমারও না, অর্চনারও না। তবু অর্চনা যখন আগ্রহী হয়ে তায়েবার অসুখের কথা জিগগেস করে, আমাকে মিথ্যে আশ্বাসে আশ্বস্থ করে, আমি মনে মনে শান্তি পাই। আমি শান্তি পেলে কি তায়েবা বাঁচবে? না বাঁচবে না। সে মারা যাবে, তাকে মারা যেতেই হবে। মারা যাবার জন্যই সে অতি কষ্টে সীমান্ত অতিক্রম করে কোলকাতা শহরে এসেছে। আসলে সংকট আমার ভেতরে। তায়েবাকে উপলক্ষ করে একটা আবরণ তৈরি করে নিজের কাছ থেকে নিজে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। সুনীলদা এক পর্যায়ে সমস্ত আলোচনাটা তাঁর সেই সুবিখ্যাত শান্তির থিয়োরর দিকে টেনে নিলেন। জানেন প্রমোদদা, ভেতরের ট্যানশনই হলো দুনিয়ার সমস্ত অশান্তির উৎস। যুদ্ধ, বিভীষিকা, মানুষে মানুষে সংঘাত এসব হলো ভেতরের ট্যানশনের বাহ্যিক প্রকাশ মাত্র। এগুলো থেকে মুক্তি না পেলে পৃথিবীর অসুখ কখনো সারবে না, আর মানুষও কোনোদিন শান্তি পাবে না। ক্ষণিক ঘটনার দিকে না তাকিয়ে সমস্যার মূলটাই আমাদের দেখা উচিত।

প্রমোদবাবু ফস করে জিগগেস করে বসলেন, কি রকম। এই যে ধরুন মানুষের রিপুগুলো আছে না তারাই তো মানুষকে সংঘাতের শান্তিনাশা পথে টেনে নিয়ে যায়। সুতরাং মানুষের প্রথম লক্ষ হওয়া উচিত এই সব রিপু থেকে মুক্ত হওয়া। প্রমোদবাবু বললেন, তার কোনো পথ আছে কি? আছে, আছে প্রমোদ দা। তা হলে তো মানুষ থাকবে না, সব দেবতা হয়ে যাবে। প্রমোদদা মানুষ তো আসলে দেবতাই, জ্ঞানদৃষ্টি দিয়ে জগতকে বার করতে পারে না বলেই সে পশু হয়ে যায়। প্রমোদবাবু বললেন, সুনীল তোমার কথাগুলো অত্যন্ত চমৎকার। আমি অনেক বছর ইউরোপে থেকেছি। সুতরাং আস্থা স্থাপন করতে পারবো না। অর্চনা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো, দাদা তুমি প্রমোদদার সঙ্গে চুটিয়ে শান্তি চর্চা করতে থাকো। রান্না হওয়ার দেরী আছে। আমি দানিয়েলকে নিয়ে গেলাম। বেচারী কষ্ট পাচ্ছে। তারপর ইসলামের দিকে তাকিয়ে বললেন, দয়া করে আপনি কিছু মনে করবেন না, আমি একটু দানিয়েলকে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছি।

অৰ্চনা আমাকে ভেতরের ঘরে বসিয়ে ফ্যানটা ছেড়ে দিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, দানিয়েল, তোমার খবর বলো। কোনো দুঃসংবাদ নেই তো। কেমন আছেন তায়েবাদি? আমি বললাম, যেমন দেখেছিলে সে রকমই আছে। তা তোমার মুখ চোখ অমন শুকনো কেনো? এই সময়ে তোমাকে তো শক্ত হতে হবে। আমি বললাম, শক্তই তো আছি যতোটুকু থাকা যায়। অর্চনা ভু কুঁচকে বললো, তোমার চোখ মুখ কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। বললাম, আমার পক্ষে কোথাও স্থির থাকা সম্ভব হচ্ছে না। চারদিক থেকে এমন একটা চাপ এসে আমার ওপর পড়ছে আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিনে। অর্চনা আমার কাঁধে হাত দিয়ে কণ্ঠস্বরটা খুবই নামিয়ে অনেকটা ফিসফিস করে জিগগেস করলো, দানিয়েল, তুমি তায়েবাদিকে খুবই ভালোবাসো, তাই না? তার কথার জবাব দিতে গিয়ে আমার মুখে কথা আটকে গেলো। সহসা কোনো কিছু বলতে পারলাম না। অর্চনা আমার মানসিক অবস্থাটা আঁচ করে বললো, দানিয়েল, তুমি বরং আরেক কাপ চা খাও এবং একটু শান্ত হয়ে বসো। আমি একটু ভেতর থেকে আসি। বড়ো জোর দশ মিনিট। তার বেশি নয়।

শোভা মেয়েটি চা দিয়ে গেলো। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মনে হলো বাইরের গরম ভেতরের গরমকে অনেকখানি কাবু করে ফেলেছে। আমার ভাবাবেগ অনেকখানি প্রশমিত হয়ে এসেছে। আমি সমস্ত বিষয় অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা মাথায় বিচার করতে পারছি। বাইরের ঘরের টুকরো টুকরো আলাপ কানে আসছে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, হিন্দু, মুসলমান, চীন, রাশিয়া, আমেরিকা, বাঙালি, অবাঙালি, শেখ মুজিব, ভাসানী, ইন্দিরা গান্ধী, নকশাল, কংগ্রেস, সিপিএম এসকল বিষয় আলোচনায় বার বার ঘুরে ঘুরে আসছে। আমি যেখানেই যাই সেখানেই মাটি খুঁড়ে একটি বিতর্ক জেগে ওঠে। আমার জন্মই যেনো একটা মস্ত বড়ো বিতর্কের বিষয়। আমি যদি জন্ম না নিতাম, এতোগুলো মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতে আসতো না, তায়েবার অসুখ হতো না, যে সকল সংকটু সমস্যা পৃথিবীর স্বাভাবিক জীবন প্রবাহের গতিরোধ করে দাঁড়িয়েছে, তার কিছুই ঘটতো না। দুনিয়াতে যেখানে যা কিছু ঘটছে তার জন্য যেনো আমিই দায়ী। আমাকে নিন্দা করতে হয়, পক্ষ নিতে হয়। মনে হচ্ছে আমি দুনিয়া জোড়া প্রসারিত একটা শক্ত মাকড়সার জালের মধ্যে পড়ে গেছি। হাজার চেষ্টা করেও তার নাগপাশ ছিন্ন করতে পারবো না।

অর্চনা ভেতরের ঘর থেকে এসে জিগগেস করলো, চা খেয়েছো? আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলাম। সে আমার দিকে কবার চোরা চোখে তাকালো এবং তারপর বললো, তায়েবাদির অসুখটা বেশ জটিল। খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন এমন তো মনে হয় না। তুমি কি মনে করো? জবাব দিলাম, তায়েবা আর অসুখ। থেকে কোনোদিনই সুস্থ হয়ে উঠবে না এবং এটাই তার শেষ অসুখ। সে আমি বিলক্ষণ জানি, তায়েবা জানে এবং তার মা বোন আত্মীয়স্বজন সকলেই জানে। কোন দিনটিতে সে মারা যাবে সে সংবাদটি আমরা কেউ জানিনে। সেটাই হয়েছে চূড়ান্ত সমস্যার বিষয়। অর্চনা আমার চোখে চোখ রেখে বললো। দানিয়েল, তুমি সময় বিশেষে ভয়ানক নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারো। আমি বললাম, তুমি এর মধ্যে নিষ্ঠুরতার কি পেলে? যে কথাটি সকলে জানে শুধু সঙ্কোচবশে প্রকাশ করছে না, সে কথাটিই আমি বলেছি। আচ্ছা দানিয়েল, তোমাকে একটা কথা জিগ্‌গেস করবো। আমি বললাম, হ্যাঁ করো। ধরো যদি তায়েবাদির কিছু একটা ঘটে যায় তুমি কি খুব কষ্ট পাবে? একথা কেননা জানতে চাইছো। তোমার আর তায়েবাদির সম্পর্কটা ভারী অদ্ভুত। আমার কি মনে হয় জানো, হঠাৎ করে তায়েবাদি যদি এ অসুখটাতে না পড়তেন, তোমরা যে একে অন্যকে ভালোবাসো, সেটা এমন করে অনুভব করতে পারতে না। অর্চনার কথা শুনে সহসা আমার মুখে কোনো কথা জোগালো না। আমি চুপ করে বসে ভাবতে লাগলাম। তায়েবার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কি ধরণের। সেকি আমাকে ভালোবাসে? আমিও কি তাকে ভালোবাসি? তার সঙ্গে আমার পরিচয় চার বছরেরও অধিক। কখনো এমন করে আমাদের দুজনের সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে হয়নি। আজকে অর্চনার কথা শোনার পর আমাকে নিজের ভেতর ডুবে যেতে হলো। তায়েবার সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে আমাদের মধ্যে যা যা ঘটেছে একে একে মনের মধ্যে খেলে যেতে থাকলো। খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠতে থাকলো। আমি স্পষ্টই অনুভব করলাম, সব সময়ই আমার মন তায়েবার দিকে বলগাহারা অশ্বের মতো ছুটে গিয়েছে, কিন্তু যখনই কাছাকাছি গিয়েছি, থমকে দাঁড়াতে হয়েছে, হৃদয় মন রক্তাক্ত করে ফিরে আসতে হয়েছে। তার সমস্ত অস্তিত্ব তার পার্টির ভেতর প্রোথিত। বারবার মনে হয়েছে সে যেনো সপ্তরথী পরিবেষ্টিত একটা মানবদুর্গের মধ্যে স্বেচ্ছাবন্দী এক নারী। এই দুর্গ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার কথা সে যেমন চিন্তা করতে পারে না। আমিও তার ভেতর প্রবেশ করবো কখনো মেনে নিতে পারিনি। আমরা পরস্পরের প্রতি যতদূর আকর্ষণ অনুভব করেছি, ঠিক সমান পরিমাণ বিকর্ষণ আমাদেরকে আলাদা করে রেখেছে। তারপরও তায়েবা যখন ডেকেছে ছুটে গেছি, হৃদপিণ্ডটা ছিঁড়ে নিয়ে তার পায়ে অঞ্জলি দেবো ভেবেছি। কিন্তু পরক্ষণেই এমন কিছু ঘটেছে, আমাকে ক্ষুব্ধ ব্যথিত হয়ে বুকের ভেতর একটা জখম নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে অর্চনা জিগগেস করলো, দানিয়েল কি ভাবছো? আমি বললাম, আর ভাবাভাবির কি আছে, যা ঘটবার ঘটে যাবে। শোনো দানিয়েল, একটা কথা তোমাকে বলি। তায়েবাদির হাসপাতালে তোমার আরো বেশি সময় থাকা উচিত। তুমি থাকলে উনি খুবই হাসিখুশি থাকেন। আমি বললাম, তার কাছাকাছি থাকতে পারলে ভালো লাগে। কিন্তু তার পার্টির মানুষেরা আমার দিকে এমন চোখে তাকায়, আমি খুবই বিব্রত বোধ করি। উনারা চোখেমুখে এমন একটা ভঙ্গি করেন যেনো আমি তায়েবাকে দেখতে এসে মস্ত একটা অপরাধ করে ফেলেছি। আর তার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে দেখা হলেই একটা না একটা খোটাখুটি লেগে যায়। শেষে তায়েবার ওপর সব কিছুর চাপটা গিয়ে পড়ে। তার রোগের যন্ত্রণাটা বেড়ে যায়। এটা এমন একটা জটিল এবং বিদ্ঘুটে ব্যাপার তোমাকে সবটা খুলে বোঝাতে পারবো না। অর্চনা বললো, কিছু কিছু বুঝতে পারি। তবু একটা কথা বলবো, তুমি ভয়ানক একরোখা এবং জেদী, নিজের দিকটা ছাড়া আর কিছু দেখো না। বিশেষ বিশেষ সময়ে মানুষকে নমনীয় হতে হয়। আমি বললাম, তুমি আমাকে আমি যা নই তা হতে বলছো, সে তো সম্ভব নয়। দূর দানিয়েল, আমি কি বলতে চাইছি তুমি কিছুই বুঝতে পারোনি। যাক্, এখন তুমি কি করতে চাও, সেটা বলো। আমি তোমার কাছে একটা বিশেষ অনুরোধ করবো বলে এসেছি। অর্চনা বললো, বলে ফেলো। তায়েবা তোমার খুব তারিফ করেছে। তার কথা শুনে মনে হয়েছে, সে মনের ভেতর থেকে তোমাকে খুবই পছন্দ করে। যে সমস্ত মানুষজন ওখানে আসে তার বেশিরভাগই তাকে একভাবে না একভাবে জখম না করে ছাড়ে না। অথচ সে কাউকে কিছু বলতে পারে না। সমস্ত পরিস্থিতিটাই এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোথাও থেকে একটি সান্ত্বনার বাক্য শোনার সুযোগ নেই। তার যারা একেবারে কাছের মানুষ, তাদের দেখলে সে মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে উঠে। তুমি যদি এক আধটু সময় করে হাসপাতালে যাও, এটা ওটা বলে তার মনটা একটু হালকা রাখতে চেষ্টা করো, ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই কৃতজ্ঞ থাকবো।

অর্চনা বললো, দানিয়েল, তোমার বলার প্রয়োজন ছিলো না। আমি তো এমনিতেই তায়েবাদিকে দেখতে প্রতিদিন যাচ্ছি। তাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। একেবারে খড়খড়ে মহিলা। কোথাও কোনো স্যাঁতস্যাঁতে নেই। কিন্তু তুমি যে বললে আমি এটা ওটা বলে তার মনটা হালকা করতে পারবো, এটা বোধ করি সত্যি নয়। আমি জিগেস করলাম, তুমি একথা বললে কেন? অর্চনা বললো, আজ দুপুরে আমাদের এখানে খেয়ে যাও। আমি বললাম, না অর্চনা, তা হয় না। আমাকে বাংলাদেশের ছেলেদের সঙ্গেই খেতে হবে। আর তাছাড়া ইসলাম সাহেবের কাছে প্রমোদবাবু তাঁর কৈশোর-যৌবনের স্মৃতিচারণ করছেন। এই ফ্রান্স প্রত্যাগত ভদ্রলোকটিকে আমার মনে ধরেছে। ভদ্রলোকের সঙ্গে হয়তো কোনো ব্যাপারে আমার মতের মিল হবে না। কিন্তু তাঁর চরিত্রের একটি দিক আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। প্রমোদবাবু এখনো মনে করেন, জাতি হিসেবে বাঙালির একটি স্বাধীন অবস্থান সৃষ্টি হবে। এটা সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি বড়ো ঘটনা। যদিও নানা পরস্পর বিরোধী মতামতের দ্বন্দ্ব দেখে তাঁর মনে নানা রকম সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আমি বললাম, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুবই খুশি হলাম। আরেকদিন সময় করে এসে গল্প করে যাবো। প্রমোদবাবু বললেন, কাল আমি আপনাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প দেখতে সীমান্ত এলাকায় যাবো। হয়তো দু’চারদিন থেকে যেতে হবে। আমি বাড়িতে আছি কিনা খবর নিয়ে আসবেন। আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করার ইচ্ছে। আমি বললাম, আপনি একা একা সীমান্ত এলাকায় যাবেন কোনো অসুবিধে হবে না। তিনি জবাবে বললেন, ত্রিগুনা সেন হলেন তার এক বন্ধুর মামা। ত্রিগুনাবাবু তাঁকে বিএসএফ-এর এক কর্ণেলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন। কর্ণেল সাহেবই তাঁকে নিয়ে যাবেন।

অর্চনাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে চড়ার পর মজহারুল ইসলাম সাহেব বললেন, মশায় আপনাদের নিয়ে আর পারা গেলো না। একবার ইসলামের ধুয়ো তুলে দেশ ভাগ করলেন। আবার এখন বাঙালিত্বের ধুয়ো তুলে কি সমস্ত বিষাক্ত মতামত এখানে ওখানে ছড়াচ্ছেন। দুনিয়াতে পাগলের সংখ্যা তো অল্প নয়, বস্তাপচা বাঙালি জাতীয়তার কথায় বিশ্বাস করে এমন মানুষও দেখি পাওয়া যায় ভূড়ি ভূড়ি। আমি বললাম, পাওয়া যাবেনা কেন? মশায় দেখছি আপনারা আমাদের অনেক জ্বালাবেন। আমি বললাম, আল্লাহ, আমাদের জ্বালাবার ক্ষমতাটুকুই শুধু দিয়েছেন। তিনি একটা চারমিনার ধরিয়ে বললেন, রাখেন আপনার আল্লাহ, আজকের গোটা দিনটিই নষ্ট হলো।

.

১০.

দেখতে দেখতে সেপ্টেম্বর মাস চলে এসেছে। হাসপাতালে যাওয়া আমার নিত্যিদিনের অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেছে। অন্য কোনো কাজকর্ম না থাকলে দিনে দু’বারও যাই। রোজই দেখতে পাচ্ছি তায়েবার প্রাণশক্তি আস্তে আস্তে থিতিয়ে আসছে। এখন সে নিজের শক্তিতে বিছানা থেকে উঠতে পারে না, তাকে তুলে বসাতে হয়। ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যেতে হয়। কোলকাতায় আমাদের জীবনধারণ কঠিন হয়ে উঠেছে। তায়েবার মা, দু’বোন, বড়ো ভাই সকলেই কোলকাতায় আছেন। তার পার্টির কর্মীরাও নিয়মিত আসে, দেখাশোনা করে। কিন্তু তায়েবা শুয়ে থাকে। বড়ো বড়ো চোখ পাকিয়ে সব কিছু দেখে। খুব কমই কথা বলে। আগে যে তায়েবাকে দেখেছে, এ অবস্থায় দেখলে মনে হবে এই মধ্যে আগের তায়েবার কিছুই অবশিষ্ট নেই। সে যখন শুয়ে থাকে, দেখলে আমার মরা নদীর মতো মনে হয়। গতি নেই, স্পন্দন নেই। আমার বুকটা ধক করে উঠে। কি যে বেদনার স্রোত বয়ে যায় সে আমি ভাষায় বর্ণনা করতে পারবো না। এখনো জাহিদুল আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। ডোরা দেখলে অপ্রস্তুত বোধ করে। এমন একটা জিজ্ঞাসাচিহ্ন ফুটিয়ে তোলে, তার অর্থ দাঁড়ায় তুমি এখানে কেন?

কারো কোনো মন্তব্য আমি আর গায়ে মাখিনে। আমার সঙ্গে কেউ কথা বলুক, না বলুক আমার কিছু যায় আসে না। আমি যখন তার কেবিনে ঢুকি, দেখামাত্রই তায়েবার ঠোঁটে একটা ক্লান্ত সুন্দর হাসির রেখা জেগে উঠে। তার এই হাসিটাই আমাকে সবকিছু অগ্রাহ্য করতে শিখিয়েছে। আমার ইচ্ছে করে তার হাত পায়ে হাত বুলিয়ে দিই। মাথার উড়ো উড়ো রুক্ষ চুলগুলো ঠিক করে রাখি। খসে পড়া সাপের খোলসের মতো এলোমেলো শাড়িটা গুছিয়ে ঠিক করে পরিয়ে দেই। কিছুই করতে পারিনে আমি। সব সময় ঘরভর্তি মানুষ তাকে পাহারা দিয়ে রাখে। আমাকে মনের বেদনা মনের ভেতর চেপে রাখতে হয়।

আমাদের বেঁচে থাকাটাই একটা সগ্রাম। পরের বেলার ভাত কিভাবে জোটাবো সে জন্য অনেক ফন্দিফিকির করতে হয়। ভাগ্যগুণে একটা থাকার জায়গা পেয়েছি। সেখানে যারা থাকে সকলের অবস্থাই আমার মতো। যেখান থেকে যে পয়সা সংগ্রহ করে আনি, ও দিয়ে সকলে মিলে ভাত খাওয়া সম্ভব হয় না। প্রায় সময় আমাদের মাদ্রাজি দোকানে দোসা খেয়ে কাটাতে হয়। তার ওপর আমার আবার সিগারেট খাওয়ার নেশা। রোজ তায়েবার পেছনে কম করে পাঁচটি টাকা সংগ্রহ করতে কি পরিমাণ বেগ পেতে হয় বলে বোঝানো সম্ভব নয়। এখানে সেখানে লেখালেখি করে অল্পস্বল্প অর্থ আমি আয় করেছি। তার পরিমাণ খুবই সামান্য। বাংলাদেশের নানা চেনাজানা মানুষ কিছু টাকা পয়সা দিয়েছে। অস্বীকার করবো না, প্রিন্সেপ স্ট্রীটে অস্থায়ী সরকারের অফিস থেকেও নানা সময়ে কিছু টাকা আমাকে দেয়া হয়েছে। কোলকাতার মানুষেরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কিছু টাকা আমার হাতে তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষক সহায়ক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ চক্রবর্তী অল্পস্বল্প কাজ করিয়ে নিয়ে সে তুলনায় অনেক বেশি টাকা আমাকে দিয়েছেন। কিন্তু টাকার এমন ধর্ম, পকেটে পড়ার সাথে সাথে উধাও হয়ে যায়। যেদিকেই তাকাই প্রয়োজন গিলে খাওয়ার জন্য হাঁ করে ছুটে আসে।

আমি কিছু কাজ করতে চেয়েছিলাম। বেশি নয়, অন্ততঃ দিনে পাঁচটা টাকা জোটাবার জন্য আমি কিছু কাজ করতে চাই। তিন ঘণ্টা কুলিগিরি করেও যদি পাঁচটি টাকা পাই আমি করতে রাজি। ওই টাকাটি না পেলে আমার পক্ষে তায়েবার হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব হবে না। আর ইদানিং একটা সঙ্কোচবোধ আমাকে ভয়ানক আড়ষ্ট করে ফেলেছে। তায়েবার অসুখের কথা বলে চাইলে ওই টাকাটা হয়তো আমি কারো না কারো কাছ থেকে আদায় করতে পারি। আমার চেনাজানা মানুষের সংখ্যা নেহায়েত অল্প নয়। নানা সময়ে আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তাদের কাছে হাত পেতে চেয়ে নিতে কোনো রকমের কুণ্ঠা বোধ করিনি। তায়েবার অসুখের নাম করে কারো কাছে টাকা চাওয়া গেলেও আমার পক্ষে সম্ভবত নেয়া হবে না। দু’তিন দিন আগে অর্চনা হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে রেস্টুরেন্টে চা খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলো। ওখানেই সে আমার হাতে পাঁচশো টাকার একটি নোট দিয়ে বলেছিলো, দানিয়েল, টাকাটা রাখো। এ সময়টাতে তোমার বোধ হয় খুবই টানাটানি চলছে। আমি হাতে স্বর্গ পেয়ে গিয়েছিলাম। এই সময়ে পাঁচশো টাকা অনেক টাকা। তথাপি অর্চনার টাকাটি গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ধন্যবাদ দিয়ে বলেছিলাম, টাকাগুলো তোমার কাছে থাকুক, আমার যখন খুব প্রয়োজন পড়বে চেয়ে নেবো। অর্চনা বললো, তুমি বরাবর একগুয়ে। আর তাছাড়া…। তাছাড়া কি? তুমি আমাকে বন্ধু মনে করো না। আমি বললাম, অর্চনা আমি তোমাকে ঠিকই বন্ধু মনে করি, এই কোলকাতা শহরে তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই যার কাছে আমার মনের বোঝা হালকা করতে পারি। তুমি না থাকলে নিঃসন্দেহে আমার কষ্ট অনেকগুণে বেড়ে যেতো। আমার টাকার ভীষণ প্রয়োজন, তথাপি তোমার টাকাটি গ্রহণ করতে পারবো না। দয়া করে কিছু মনে করো না লক্ষ্মীটি। অর্চনা টাকা ব্যাগে রাখতে রাখতে বললো, বক্তৃতাটি কি একটু দীর্ঘ হয়ে গেলো না? আমি কোনো কথা না বলে গড়িয়াহাটার ট্রামে না ওঠা পর্যন্ত তাকে সঙ্গ দিলাম।

আমি যে কিছু কাজ করতে চাই একথা বন্ধুবান্ধব অনেককেই বলেছি। সেদিন সন্ধ্যেবেলা হাসপাতাল থেকে বৌ বাজারের হোস্টেলে ফেরার পর নরেশদা জানালেন। সৌগতবাবু একটা কাজের খবর দিয়ে গেছেন। শুনে আমিতো অবাক হয়ে গেলাম। সৌগত বন্দ্যোপাধ্যায় লোকটিকে আমি কখনো পছন্দ করিনি। তাই তাঁর সঙ্গে আন্তরিকভাবে আলাপ পর্যন্ত করা হয়নি। আজ তিনি আমার চূড়ান্ত বিপদের সময় এতো বড়ো একটা উপকার করলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজের সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া করার চেষ্টা করলাম। নরেশদা এক টুকরো কাগজ আমার হাতে তুলে দিলেন। দেখলাম, লেখা রয়েছে অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্পাদক সাপ্তাহিক নতুন খবর, ৯১ নম্বর মঠলেন, কোলকাতা-৯১। নরেশদাকে জিগ্‌গেস করলাম, নতুন খবর নামে কোলকাতায় একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা আছে তাতো জানতাম না। আমাকে কি ধরনের কাজ করতে হবে কিছু বলেছেন নাকি। তিনি জবাবে বললেন, না সেসব কিছু বলেননি। শুধু তোমাকে আগামীকাল সাড়ে ন’টার সময় তৈরি থাকতে বলেছেন, তিনি এসে তোমাকে নিয়ে যাবেন। সেদিনও বাংলাদেশের ছেলেরা কেউ হোস্টেলে ছিলো না। সকলে মিলে হাওড়াতে একটা অনুষ্ঠান করতে গেছে। ঘর ফাঁকা। আমার ঠিক কি হয়েছে খুলে বলতে পারবো না। যখন অধিক লোকজন থাকে একটুখানি নির্জনতার জন্য মন উতলা হয়ে ওঠে। আর যখন লোকজন থাকে না নির্জনতা বোঝার মতো বুকের ওপর চেপে বসে। নরেশদার ভেতর কি ঘটছে অনেকদিন জিগগেস করা হয়নি। অঞ্জলি কোলকাতা আসতে চায় কিনা। তার বাবা মা এখন রাজার মঠে বড়ো ভায়ের বাসায় কি অবস্থায় আছেন, ভদ্রতার খাতিরে হলেও এসকল সংবাদ জিগ্‌গেস করা প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু আমার কোনো কথা বলার প্রবৃত্তি হলো না। তিনি জিগগেস করলেন, এখন কি করবি? আমি বললাম, ঘুমোবো। কাল সৌগতবাবুর সঙ্গে যাবি? হ্যাঁ বলে মশারিটা নামিয়ে দিয়ে আমি শুয়ে পড়লাম।

পরের দিন ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে নটার সময় সৌগতবাবু এসে হাজির। বললেন, তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নিন। অনিমেষদা আবার সময়নিষ্ঠ মানুষ। তাঁকে কথা দিয়েছি ঠিক দশটার সময় আমরা আসবো। অধিক কথা না বাড়িয়ে জামা কাপড় পরে সৌগতবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে এলাম। বাসের জন্য বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হলো। আমরা যখন মঠলেনে এসে নামলাম দশটা প্রায় বাজে। প্রচণ্ড ভিড়ে ঘেমে একেবারে নেয়ে উঠেছি। নতুন খবরের অফিসে পৌঁছতে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নিলো না। মঠলেন বড়ো ঘিঞ্জি জায়গা, আমাদেরকে প্রায়ান্ধকার সিঁড়ি বেয়ে একটি সেকেলে লাল ইট বের হওয়া দালানের তিন তলায় উঠতে হলো। সিঁড়ির বাঁদিকে ছোটো একটি নেমপ্লেট লাগানো। দরোজা ভোলাই ছিলো। আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। অফিস কামরাটি খুব বড়ো নয়। একপাশে দেখলাম দু’জন কম্পোজিটর কম্পোজ করছে। টাইপের খাঁচার পাশ ঘেঁষে একটা চেকন লম্বা টেবিল পাতা। একজন অল্পবয়েসী মানুষ বসে বসে পুফ কাটছে। মাঝখানটিতে সম্পাদক অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের টেবিল। একটা ছোটো সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে ভদ্রলোক রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন। ভদ্রলোকের খুব ধারালো চেহারা। নাকটি তীক্ষ্ণ এবং বাঁকানো। গোঁফজোড়া ছুঁচোলো করে ছাটা। পরনে ধুতি এবং মটকার পাঞ্জাবি। ভদ্রলোকের চোখজোড়া ভীষণ উজ্জ্বল। বয়েস কতো হবে বলা মুশকিল। পঁয়তাল্লিশ হতে পারে, আবার পঞ্চাশও হতে পারে। কিছু মানুষ আছে যাদের চেহারা দেখে বয়েস আন্দাজ করা যায় না।

সৌগত বন্দ্যোপাধ্যায় নমস্কার করে বললেন, এই যে অনিমেষদা, দেখলেন তো কাঁটায় কাঁটায় দশটায় এসে হাজির হয়েছি। অনিমেষবাবু তাঁর রিভলভিং চেয়ারে একটুখানি নড়ে চড়ে বসলেন। টেবিল থেকে পেপার ওয়েটটা তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করলেন। তারপর বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে বললেন, বসো বসো সৌগত, একটা কাজের মতো কাজ করে বসে আছো দেখছি। জীবনে তোমাকে এই প্রথম সময় রক্ষা করতে দেখলাম। তারপর তোমার পকেট বিপ্লবী দলের সংবাদ কি। এই বুঝি তোমার নতুন কমরেড।

সৌগত অনিমেষবাবুর অন্যসব কথার জবাব না দিয়ে বললেন, আপনি একজন অনুবাদক চেয়েছিলেন। আমার ধারণা ইনি ভালো অনুবাদ করতে পারবেন। ভদ্রলোক বাংলাদেশ থেকে এসে ভীষণ অসুবিধেয় পড়ে গেছেন। তার এক নিকট আত্মীয়ার ভীষণ অসুখ। আপনি যদি কিছু সাহায্য করতে পারেন। এবার তিনি আপাদমস্তক আমাকে একবার ভালো করে দেখে নিলেন। তারপর জানতে চাইলেন, আপনি বংলাদেশ থেকে এসেছেন? আমি মাথা নাড়লাম। ভদ্রলোক বললেন, বাংলাদেশ মানেই তো অসুবিধে। ওই মুসলমানের দেশে এতোদিন পড়েছিলেন, আগে চলে আসেননি কেনো? ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি একরকম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আমার চোখমুখ লাল হয়ে গেলো। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। কি বলতে হবে খুঁজে না পেয়ে সৌগতবাবুর দিকে তাকালাম। দেখি তিনিও মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। তিনি আমার চাইতে কম অবাক হননি।

সৌগতবাবু আমতা আমতা করে বলতে চেষ্টা করলেন, আপনি অনুবাদ করার লোক চেয়েছিলেন, আমার ধারণা ইনি ভালো অনুবাদ করবেন, আপনি টেস্ট করে দেখতে পারেন। আরে রাখো তোমার টেস্ট, আগে কথাবার্তা বলতে দাও। তারপর অনিমেষবাবু আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, কি মশায়, চুপ করে আছেন, আগে চলে আসেননি কেন? আমি মৃদুকণ্ঠে বললাম, আগে চলে আসবো কেমন করে? তিনি ফের জিগগেস করলেন, এখন কি করে চলে আসতে পারলেন? আমি বললাম, পাকিস্তানী মিলিটারি আক্রমণ করে বসলো, তাই বাধ্য হয়ে…। আমার মুখের কথা শেষ হওয়ার আগে ভদ্রলোক কণ্ঠস্বর চড়িয়ে বললেন, মুসলমানদের লাথি আঁটা এতোদিন খুব মধুর লেগেছিলো তাই না, এখন মুসলমানে মুসলমানে লাঠালাঠি লেগেছে, আপনারা সকলে একসঙ্গে হুড়মুড় করে আমাদের ওপর চড়ে বসেছেন। অগত্যা আমাকে। বলতে হলো আমিও মুসলমান। তাঁর মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। হলেনই বা মুসলমান। তাতে এমন কি এসে গেলো। আমি মশায় সাফ কথার মানুষ। হিন্দু মুসলমানের ভিত্তিতে যখন দেশ ভাগ হয়েছে, হিন্দুদের সে দেশ থেকে অনেক আগেই চলে আসা উচিত ছিলো। দেড় কোটিরও বেশি হিন্দু পূর্বপাকিস্তানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার জন্য দশ কোটি মুসলমানকে আমাদের সহ্য করতে হচ্ছে। দেশ ভাগের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুরা ভারতবর্ষে চলে এলে আমরা মুসলমানদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করতাম। সব সমস্যার সাফ সাফ সমাধান হয়ে যেতো। ওই হিন্দুরা পূর্বপাকিস্তানে থেকে যাওয়ার জন্যই ভারতকে মুসলমানে মুসলমানে মারামারি কাটাকাটিতে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। ভারতের কি আর কোনো সমস্যা নেই? সে কথাও থাকুক। ভারতবর্ষ হিন্দুদের দেশ বলেই না হয় হিন্দুরা ভারতবর্ষে এসেছে। কিন্তু আপনারা কোন্ মুখে দলে দলে চলে এলেন? আমি অনিমেষ বাবুর কথায় রাগ করতে পারলাম না। আমার লেগেছে একথা সত্যি। তারপরেও মনে মনে ভদ্রলোকের প্রশংসা না করে পারলাম না। তার মধ্যে আর যাই হোক কপটতার বালাই নেই।

আমি মনে করলাম, আর বসে থেকে লাভ কি? অন্ততঃ একটা নতুন অভিজ্ঞতা তো হলো। আমি স্যাণ্ডেলে পা গলিয়ে বললাম, তাহলে আমি আসি। সৌগতবাবুকে আমার সঙ্গে আসতে বলবো কিনা ভাবনায় পড়ে গেলাম। অনিমেষবাবু বললেন, আপনার খারাপ লেগেছে বুঝতে পারি। কিন্তু আমি মশায় যা ভাবি বলে ফেলি। আমার ভেতর ঢাক ঢাক গুড় গুড় কিছু পাবেন না। বসুন, চা খান। চলে যাবেন কেন, আপনি তো কিছু কাজ চেয়েছিলেন। আমার তো একজন অনুবাদক প্রয়োজন। তারপর তিনি কম্পোজিটরদের একজনকে ডেকে বললেন, ভূপতি যাও নিচে থেকে, চা এবং সিঙ্গারা নিয়ে এসো। উঠি উঠি করেও উঠতে পারলাম না। সৌগতবাবু বললেন, অনিমেষদা, চা আনতে তো কিছু সময় লাগবে, ততোক্ষণে আপনি দানিয়েল সাহেবকে টেস্ট করে দেখেন, অনুবাদে হাত আছে কিনা। অনিমেষবাবু ধমক দিয়ে বললেন, সৌগত নড়াচড়া করবে না। ঠিক হয়ে বসো। আমি তোমাদের শখের কমিউনিস্টদের মতো হিপোক্র্যাট নই। আমার অনুবাদের মানুষ দরকার, উনি যদি ভালোভাবে করতে পারেন, অবশ্যই কাজ দেবো। সহজ কথাটা সহজভাবে বলি বলে মনে করো না, আমার কোনো ভদ্রতাজ্ঞান নেই।

এবার অনিমেষবাবু অপেক্ষাকৃত সহজ ভঙ্গিতে আমার সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। তিনি জানতে চাইলেন আমার বাড়ি কোথায়। আমি বললাম, চট্টগ্রাম। তিনি বললেন, আমাদের বাড়িও একসময় ওদিকে ছিলো। পঞ্চাশের রায়টের পর সবকিছু বেচেকিনে চলে এসেছি। আমি তাঁর বাড়ি চট্টগ্রাম কোথায় জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, না চট্টগ্রাম নয়, তবে সীমান্তের অপর পাড়েই তাঁদের বাড়ি। যশোর জেলার নড়াইল মহকুমায়। এরই মধ্যে চা এলো, সিঙ্গারা এলো। আমার দিকে প্লেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, খান। চা খাওয়া শেষ হলে একটা সিগারেট খাওয়া যাবে কিনা অনুমতি চাইলাম। তিনি বললেন, ফিল ফ্রি। সংবাদপত্রের অফিসে আবার কেউ সিগারেট খাওয়ার অনুমতি চায় নাকি। তারপর তিনি আমাকে ইংরেজি টাইপ করা একটি প্রবন্ধ দিয়ে বললেন, একটা পৃষ্ঠা অনুবাদ করে দেখান, দেখি আপনার হাত কেমন। আমি একটু সরে বসে অনুবাদ করতে লেগে গেলাম। প্রবন্ধটির শিরোনাম হলো আর্যদের আদি নিবাস। স্বামীজী বিরূপাক্ষ হলেন লেখক। তিনি প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন, ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা আর্যদের বহিরাগত প্রমাণ করে যে সকল বইপুস্তক লিখেছেন, সেগুলো একেবারেই প্রমাণসিদ্ধ নয়। আর্যদের আদি নিবাস হলো ভারতবর্ষে। এই ভারতবর্ষ থেকেই আর্যরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমার একটা পৃষ্ঠা অনুবাদ করতে আধ ঘণ্টার মতো সময় লাগলো। তারপর আমি অনুবাদ করা অংশটি নিয়ে অনিমেষবাবুর টেবিলে রাখলাম। তিনি চশমা খুলে পড়ে দেখলেন। বললেন, আপনি তো মোটামুটি ভালোই অনুবাদ করেন। শুধু একটি শব্দ আমি পাল্টাচ্ছি। যেখানে সিন্ধুনদের পানি বলেছেন,আমি পানি কেটে জল শব্দটি বসাচ্ছি। আমি বললাম, জল পানিতে আমার কিছু আসবে যাবে না।

সৌগতবাবু বললেন, দেখি অনিমেষদা। তারপর মূলপ্রবন্ধ এবং অনূদিত অংশ টেনে নিয়ে দেখতে লাগলেন। অনুবাদের অংশটি পড়া শেষ করে বললেন, তাহলে এখন থেকে আপনি আর্যদের আদি নিবাস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এই ধরনের প্রবন্ধের পাঠক এখনো পশ্চিমবঙ্গে আছে নাকি। আপনার কাগজ কেউ পড়ে? সৌগত, তুমি একটা আস্ত আহামক। শখের কমিউনিস্টগিরি করে বেড়াও বলে দেখতে পাওনি। দশ বছর থেকেই প্রতি সপ্তাহে আট হাজার কাগজ ছেপে আসছি। বাজারে দেয়ার প্রয়োজন হয় না, গ্রাহকদের বাড়িতে আমি কাগজ পাঠিয়ে দেই। তারা আমাকে ডাকে চাঁদা পাঠান। তোমার ভুলে যাওয়া উচিত নয়, তোমার মতো পশ্চিম বাংলায় সকলে বিটকেলে জাতখোয়ানো বামুন নয়। কিছু খাঁটি এবং সৎ ব্রাহ্মণ এখনো আছেন। সৎ হিন্দুও অনেক আছেন। তারা অনেকদিন থেকেই আমার কাগজ নিয়মিত পাঠ করে আসছেন। তুমি যদি দেখতে চাও আমি গ্রাহক লিস্ট দেখাতে পারি। অনিমেষবাবুর খোঁচা খেয়ে সৌগত একটু নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, বুঝলাম, সৎ হিন্দুরা আপনার কাগজ পড়েন। কিন্তু আপনি কাগজে কি লিখেন? কেননা আমি হিন্দুদের কথা লিখি। হিন্দুদের মহান ঐতিহ্যের কথা লিখি। স্বার্থের কথা লিখি। হিন্দুরা যে মহান জাতি সে কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেই। অনিমেষবাবুর কথার মধ্যে কোনো জড়তা নেই। যে কেউ তাঁর কথা শুনলে বুঝতে পারবেন, তার মন এবং মুখের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। অনিমেষবাবু বললেন, সৌগত, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তোমার বাংলাদেশের কমরেডের সঙ্গে কথাবার্তাটা আগে ফয়সালা করে নেই। প্রতি হাজার শব্দে আমি পঁচিশ টাকা করে দিয়ে থাকি। আমাদের যিনি অনুবাদ করতেন, তিন চার মাস যাবত অসুস্থ। বাঁচবেন কিনা সন্দেহ। তোমার বন্ধু যদি রাজি থাকেন, তাঁকে কাজটা দিতে আমি প্রস্তুত। সৌগত বাবু বললেন, কিন্তু দাদা আমার একটা খটকা থেকে গেলো। আপনার কাগজ হিন্দুদের কাগজ। একজন মুসলিম যদি অনুবাদ করে আর সে লেখা যদি আপনি ছাপেন, তাতে কোনো দোষ হবে না? অনিমেষবাবু স্পষ্টভাবে বললেন, না কোনো দোষ হবে না। কেন দোষ হবে? যদি হিন্দু সংস্কৃতি, হিন্দু সভ্যতা সম্বন্ধে তোমার কোনো ধারণা থাকতো, তুমিও বুঝতে পারতে এতে দোষের কিছু নেই। আমি একজন সৎ এবং নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ হিসেবে অনুভব করি সঠিক বিষয়টি চিন্তা করা ছাড়া আমার আর কোনো কর্তব্য নেই। যুগে যুগে ব্রাহ্মণেরা তাই করে এসেছে। ক্ষত্রিয়েরা যুদ্ধ করেছে, বৈশ্যরা ব্যবসা করেছে, শূদ্ররা পরিশ্রম করেছে। আর ব্রাহ্মণ সব সময়ে বিধান দিয়েছে। কেউ না কেউ ব্রাহ্মণের কাজ করে দিয়েছে। একজন গুণবান পণ্ডিত ব্রাহ্মণের লেখা একজন মুসলমান দিয়ে অনুবাদ করালে এবং সে লেখা হিন্দুদের পড়তে দিলে এতে দোষের কিছু থাকতে পারে বলে আমি মনে করিনে। সৌগতবাবু এবং অনিমেষবাবুর বিতর্কটি শুনে আমি তো দিশেহারা। ভাবনায় পড়ে গেলাম। কাজটা নেবো কিনা। আমার যে অবস্থা রাস্তায় কুলিগিরি হলেও আপত্তি ছিলো না। আমার দৈনিক মাত্র পাঁচ ছয়টি টাকার প্রয়োজন। কুলিগিরিতে শারীরিক পরিশ্রম লাগে কিন্তু মানসিক নির্যাতন নেই। এই কাজটি গ্রহণ করলে তার চাইতে ঢের কম শ্রমে আরো বেশি আমি পেতে পারি। আমার অন্তরাত্মা বলছে, এই কাজের ভেতরে এমন কিছু আছে, গ্রহণ করলে আমি নিজের কাছে নিজে ছোটো হয়ে যাবো। কিন্তু তায়েবার কথা মনে হওয়ায় বুকটা হু হু করে উঠলো। কথা দিলাম, অনুবাদের কাজটা আমি করবো।

 ১১-১২. অনিমেষবাবুর অনুবাদের কাজ

অনিমেষবাবুর অনুবাদের কাজটা গ্রহণ করার পর থেকে আমার মানসিকতার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আমার সেই উড়ু উড়ু ভাবটা অনেক পরিমাণে কমেছে। আসলে এতোদিন আমার ভেতরে যে হা হুতাশ চলছিলো এবং যা আমি তায়েবার প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রকাশ মনে করে আসছিলাম, তা সর্বাংশে সঠিক নয়। আমার নিজের প্রতি নিজের যে কর্তব্যবোধ তা পালন করার অক্ষমতা থেকেই আমার ভাবাবেগ জন্ম নিচ্ছিলো। তায়েবার চারপাশে যারা জড়ো হয়, যারা তাকে সকাল বিকেল দেখতে আসে আমি মনে করতাম, কেউ তায়েবার মঙ্গল চায় না। তারা আসে মজা দেখার জন্য, কষ্ট বাড়াবার জন্য অথবা জাহিদুল এবং ডোরার মতো নিজেদের কৃতকর্মের অপরাধবোধ লাঘব করার জন্য। আমি মনে করতাম, গোটা কোলকাতা শহরে আমিই হলাম একমাত্র ব্যক্তি যে তায়েবার মঙ্গল চায়। আর সকলেই তায়েবার শত্রু।

দৈনিক দশ টাকা আয় করার জন্য তিন সাড়ে তিন ঘণ্টার কঠোর খাটুনি খাটতে গিয়ে আমার চোখ খুলে গেলো। আমি আবিষ্কার করলাম তায়েবার চিকিৎসার যাবতীয় অষুধপত্তর সবটা হাসপাতাল দেয় না, বাইরে থেকে সংগ্রহ করতে হয়। তার পেছনে অন্ততঃ তিন থেকে সাড়ে তিনশো টাকা ব্যয় করতে হয় প্রতিদিন। এই টাকাটা কে সংগ্রহ করে, কার কাছ থেকে সংগ্রহ করে, কে অষুধ কেনে, কে পথ্য সরবরাহ করে কিছুরই সংবাদ জানিনে। অথচ আমি মনে করি আমি তায়েবাকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসার দাবিতে না করতে পারবো হেননা দুঃসাধ্য কর্ম আমার নেই। তায়েবার দেখাশোনার সব দায়িত্বটা যদি আমার ওপর পড়তো, আমি কি করতাম। আমি মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম। তার পার্টির মানুষদের আমি অপরাধী সাব্যস্ত করে বসে আছি। কিন্তু তারা তো টাকাটা ম্যানেজ করছে। জাহিদুলকে আমি ক্রিমিন্যাল ধরে নিয়েছি। আমার বিবেচনায় ডোরা একটি নষ্টা মেয়ে। দু’তিনদিন আগে জানতে পেরেছি, জাহিদুল এখানে সেখানে ডোরাকে নিয়ে যে অনুষ্ঠান করায়, তাতে যে টাকাটা আসে, তার সবটা তায়েবার পেছনে খরচ করে। এমনকি দিল্লীতে গান গেয়ে যে টাকাটা ডোরা পেয়েছিলো, ও দিয়ে আমেরিকা থেকে কি একটা দুষ্প্রাপ্য ইনজেকশন আনিয়েছে। ডোরা জাহিদুলকে বিয়ে করেছে। তাতে এমন অন্যায়টা কি হয়েছে? এরকম অনেক তো ঘটে। হেনা ভাই একটা বিধবা মেয়েকে এ সময়ে বিয়ে করে অপরাধ কি করেছে? মহিলা এবং হেনা ভাই পরস্পরকে পছন্দ করেই তো বিয়ে করেছে। আমি এক ধারে সকলকে অপরাধী মনে করি কেন। পৃথিবীর সকলে ঘোরতরো পাপে লিপ্ত, আর আমি একা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির এ কেমন করে হয়।

তায়েবার ক্যান্সারের জন্য সবাই দায়ী হবেন কেন? ক্যান্সার রোগ তো আরো অনেকের হয়। এই ওয়ার্ডের অধিকাংশই তো ক্যান্সার রোগী। তারা কাকে দায়ী করে? বড়ো জোর ভাগ্যকে? আমি যে তায়েবার পক্ষ অবলম্বন করে মনে মনে এতো লম্ফঝম্ফ করছি এ পর্যন্ত তায়েবার জন্য কি করতে পেরেছি? হ্যাঁ এ পর্যন্ত একটা কৃতিত্ব আমার আছে। তায়েবাকে সন্ধ্যেবেলা হাসপাতালে প্রতিদিন দেখতে যাওয়ার খরচটা আয় করার একটা ব্যবস্থা করতে পেরেছি। নিজের দীনতা, তুচ্ছতা এবং হীনমন্যতার পরিচয় পেয়ে একটা আত্মঘৃণা ঘুরে ঘুরে বার বার আমাকে দগ্ধ করতে থাকলো। সেদিন সকালবেলা আমি হাসপাতালে গেলাম। ডঃ মাইতি আমাকে একটা পাশের ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছিলেন। দিনটি খুবই সুন্দর। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে। হাওয়াতে সামান্য হিমেল পরশ। আকাশে চচনে রোদ উঠেছে। শিশুসকালের রোদে চারপাশের গাছপালা চিরদিন এমনই সবুজ থাকবে, সূর্য এমনি করে সুন্দর আলোকরাশি বর্ষণ করবে, এমনি করে মানুষজনের কলকাকলিতে রাজপথ মুখরিত হবে, রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া এমনি ধরনের আওয়াজ করে বাতাস কম্পিত করে তুলবে, শুধু থাকবে না তায়েবা, জীবনের চলমান স্রোত থেকে বাদ পড়ে যাবে শুধু একজন। আল্লার দুনিয়ার এই পরিপূর্ণতার মধ্যে তার প্রস্থানের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত থাকবে না। আমার এতো বড়ো ক্ষতি আমি পূরণ করবো কি করে।

তায়েবার কেবিনে যখন প্রবেশ করলাম, দেখে খুবই ভালো লাগলো। সে উঠে বসেছে। সকালবেলা বোধ হয় গোসল করে ফেলেছে। খয়েরি রঙ্গের একটা পাটভাঙ্গা শাড়ি পরেছে। তাকে খুবই প্রফুল্ল দেখাচ্ছে। মুখে মনে হয় ক্রীম মেখেছে, ঘাড়ে পাউডারের দানা ছড়িয়ে আছে। হাসপাতালে আমি কোনোদিন তায়েবাকে এরকম হাসিখুশি দেখেছি মনে পড়ে না। আমার মনের ভেতরে একটা সূক্ষ্ম আশার রেখা খেলে গেলো। তাহলে কি তায়েবার অসুখ সেরে যাবে!

আমাকে দেখামাত্রই তায়েবা কলকল করে উঠলো। এই যে দানিয়েল ভাই, এসে গেছেন। তার কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের দু’টো কলি গুনগুন করে উঠলো। এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার। আজি প্ৰাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার। পূর্বের দিনের মতো হাততালি দিয়ে উঠতে চেষ্টা করলো। জানেন দানিয়েল ভাই, এই সকালবেলায় আপনি প্রথম মানুষ নন। আপনার আগেও একজন এসেছিলেন, কে বলুন দেখি। আমি বললাম, কেমন করে বলবো কে এসেছিলো। সে ঠোঁট একটুখানি ফুলিয়ে বললো, এসেছিলো, অর্চনাদি। আমি বললাম, এতো সকালে অর্চনা কেমন করে এলো। তার কোনো পাশও ছিলো না। তায়েবা জবাব দিলো অর্চনাদি চাইলে কিনা করতে পারে। তার কত প্রভাব প্রতিপত্তি। এই হাসপাতালে ডঃ সেনগুপ্ত বলে এক ভদ্রলোক আছেন, তিনি অর্চনাদির কি ধরনের আত্মীয় হন। ডঃ সেনগুপ্তকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। আমি আপনাকে বলেছিলাম না অর্চনাদি খুউব ভালো, আর খুউব রুচিবান মহিলা। দেখুন এই শাড়িখানা আমাকে দিয়ে গেছে। খুব সুন্দর না, আমাকে মানিয়েছে? আমি জিগেস করলাম, এটা কি নতুন শাড়ি? সে কপট রাগের ভঙ্গি করে বললো। আপনি এখনো পর্যন্ত একটা মিষ্টি কুমোড়, নতুন শাড়ির সঙ্গে পুরোনো শাড়ির পার্থক্য পর্যন্ত ধরতে পারেন না। এমন রঙকানা মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। তারপর তায়েবা বললো, অর্চনাদি আমাকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে গোসল করিয়েছে। তারপর শাড়ি পরিয়েছে। আমার মুখে ক্রীম মাখিয়ে দিয়েছে। ভীষণ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে আমার অসুখবিসুখ কিছু নেই। অর্চনাদির শাড়িতে আমাকে মানিয়েছে। কই কিছু তো বললেন না। আমি বললাম, হ্যাঁ খুব মানিয়েছে। জানেন দানিয়েল ভাই, জীবনে আমি আপনার মতো বেরসিক মানুষ বেশি দেখিনি। আপনার কোনো ভদ্রতাজ্ঞান নেই। এমন মুখ গোমড়া স্বভাবের মানুষকে অর্চনাদির মতো এমন একজন রুচিবান মহিলা কি করে সহ্য করেন, আমি তো ভেবে পাইনে।

তায়েবা কথাটা যতো সহজভাবেই বলুক, শুনে আমার কেমন জানি লাগলো। হাজার হোক মানুষের মন তো। তার কথাটা গায়ে না মেখে আমি বললাম, অর্চনার আমাকে সহ্য করার কি আছে? তাকে আমি আগে থেকে চিনতাম, চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিলো। এইতো সম্পর্ক। এ অনেক মানুষই তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল, অর্চনাও তার একজন। আর তাছাড়া…। তাছাড়া আর কি। অর্চনা তোমাকে খুবই পছন্দ করে। একথা আমাকে বার বার বলেছে। তায়েবা বললো, অর্চনাদি আপনাকে খুব পছন্দ করে। আপনাকে পছন্দ করে বলেই আমাকে দেখতে আসে। আমার সঙ্গে অর্চনাদির তো সেরকম কোনো পরিচয় ছিলো না। আমি বললাম, মানুষ একসূত্রে না একসূত্রে একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়। তোমার সঙ্গে পূর্বে পরিচয় ছিলো না। এখন তোমার সঙ্গে পরিচয় হলো। অর্চনাদি কি সুন্দর আর কি লম্বা আর কতো লেখাপড়া জানে। আপনার নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগে। আমি বললাম, অর্চনা শুধু আমার বন্ধু, আর কিছু বলতে পারবো না। এবার তায়েবা কথাটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, আপনি দেখতে একটুও সুন্দর নন, তবু এতো ভালো মহিলাদের সঙ্গে এমন ঘনিষ্টতা হয় কি করে। আমি বুঝতে পারিনে, আমি বললাম, তোমার সঙ্গেও আমার একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে, এটাকে তুমি কি বলবে?

তায়েবা তার হাতটা আমার মুখে চাপা দিয়ে বললো, দানিয়েল ভাই, মনে আছে একবার আপনি সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাড়িতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছিলো। আপনি শুনেই কারফিউর মধ্যে চলে গিয়েছিলেন। সারারাত আমি ঘুমোতে পারিনি। পরের দিন সকালবেলা আপনাকে কতো জায়গায় খুঁজে শেষ পর্যন্ত ডঃ মফিজ চৌধুরীর বাড়ি গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম, মনে আছে? আমি বললাম, মনে থাকবে না কেন, ও সমস্ত ঘটনা কেউ কি ভুলতে পারে। আচ্ছা, সেদিন আপনি অমন করে চলে গিয়েছিলেন কেন? আমি মনে মনে খুবই চেয়েছিলাম, আপনি রাতটা আমাদের বাড়িতে থেকে যাবেন। কোনোদিন বলিনি, আজ বলছি, খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। আচ্ছা, সেদিন থেকে গেলেন না কেন? আমি বললাম, তুমি থাকতে বললে না কেন? আমি বললে আপনি থাকতেন। অবশ্যই থাকতাম! আপনাকে থাকতে বলতে হবে কেন, আপনি নিজেই থাকলেন না কেন? সব কথা কি বলতে হয়?

তারপর তায়েবা আমার হাত ধরে বললো, দানিয়েল ভাই, আপনাকে একটা কথা বলবো, রাখবেন? আমি বললাম, বলো। আগে বলুন, রাখবেন। আচ্ছা রাখবো, এখন কথাটি বলো। আপনি আমাকে এখান থেকে কোথাও নিয়ে চলুন। চলুন, আমরা কোথাও পালিয়ে যাই। তার কথাটি শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। তায়েবা পাগলামি করছে নাতো। আমি তাকে কোথায় নিয়ে যাবো। আর সে হাসপাতাল থেকে যাবেই বা কেমন করে। জবাব না দিয়ে আমি চুপ করে রইলাম। সে আমার গায়ে ঠেলা দিয়ে বললো, কি চুপ করে রইলেন যে। আমি বললাম, হাসপাতাল থেকে তোমাকে যেতে দেবে? আমি যদি যেতে চাই হাসপাতাল আমাকে ধরে রাখবে কেমন করে? সে ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো, আপনি আমাকে চেনেন না? চেনবোনা কেনো। তায়েবাকে আমি বিলক্ষণ চিনি। সে যখন কোনো কিছু করবে ঠিক করে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। যেদিন আসাদ মারা যায় সে রিকশা করে হাসপাতাল থেকে আসছিলো। হঠাৎ করে মিছিল দেখে বেরিয়ে পড়ে, একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করেছিলো। আমরা কেউ বাধা দিয়ে রাখতে পারিনি। আমি মনে মনে ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম। আজকেও যদি সে এরকম একটা কিছু করে বসে। আমি তো জানি তাকে আটকে রাখবো এমন ক্ষমতা আমার নেই। আপাততঃ তাকে একটু শান্ত করার জন্য বললাম, আগে একটু বসো, আলাপ করি কোথায় যেতে চাও। একটা ব্যবস্থা না হয় করা যাবে। সে জেদ ধরে রইলো, না আমি ওভাবে পড়ে থাকবো না। আপনি আমাকে নিয়ে চলুন। আমি বললাম, কোথায় নিয়ে যাবো আগে বলল, তারপর না হয় যাওয়া যাবে। সে জবাব দিলো, আমাকে বলতে হবে কেন, আপনার যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যান। আমি যদি তোমাকে এ অবস্থায় এখান থেকে নিয়ে যাই, তোমার বোন, মা, ভাই এবং পার্টির লোকেরা আমায় কি আস্ত রাখবে? কোনো একটা কারণে তোমার অসুখটা হঠাৎ করে বেড়ে যায়, সকলের কাছে আমি কি জবাব দেবো? আমার মা, ভাই, বোন, পার্টির লোক কি মনে করবে? আমি দেখবো, আপনি নিয়ে যাবেন কিনা বলুন? তুমি জানো, এখানে আমার নিজেরথ থাকার জায়গা নেই। তোমাকে আমি কোথায় নিয়ে যেতে পারি। সে বললো, অন্ততঃ আপনি কোথাও আমাকে নিয়ে বেড়িয়ে আসুন। এই হাসপাতালে থাকতে থাকতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। আপনি আমাকে নিয়ে চলুন। এখন কেউ নেই, এই সময়ে বেরিয়ে পড়াই উত্তম। আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি একটু ডঃ মাইতির সঙ্গে পরামর্শ করে আসি। তুমি একটুখানি অপেক্ষা করো। ডঃ মাইতির কাছে যাবেন কেন? আপনি যখন অর্চনাদিকে নিয়ে বেড়াতে যান, তখন কি ডঃ মাইতির পারমিশন চান? আমি বললাম, অর্চনাকে নিয়ে কখন আবার বেড়াতে গেলাম। এ উদ্ভট সংবাদ কার কাছে শুনলে? তায়েবা চোখের রাঙ্গা পুতুলি দুটো দেখিয়ে বললো, ফের মিথ্যে কথা বলছেন, অর্চনাদি আমাকে নিজেই বলেছেন, অর্চনাদিকে নিয়ে আপনি বেলেঘাটা না কোথায় গিয়েছিলেন? আমি হেসে ফেললাম, ওহ সেই কথা বলো। বেলেঘাটাতে তার এক নকশাল বন্ধুর বাড়িতে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলো। অৰ্চনা আমাকে বাসা চেনাতে নিয়ে গিয়েছিলো। তায়েবা বললো, থাক্‌ আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না। আপনাকেও আমার চেনা হয়ে গেছে। তায়েবাকে আমি কোনোদিন সাধারণ মেয়েমানুষের সঙ্গে এক করে দেখিনি। আমি মনে করতাম, সে মেয়েলি ঈর্ষা, বিদ্বেষ এসবের অনেক উর্ধ্বে। আজকে তার অন্য একটা পরিচয় পেলাম। দীর্ঘদিন ধরে আমি মনের মধ্যে একটা সংশয় লালন করে আসছিলাম। তায়েবার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক সেটার ভিত্ কি? আমি তার অসুখকে উপলক্ষ করে তার পরিবার এবং পার্টির লোকদের বিরুদ্ধে মনে মনে অসংখ্য অভিযোগের যে খসড়া এঁকেছি তার একটা বাস্তব ভিত্তি পেয়ে গেলাম। আমার নালিশ করার অধিকার আছে, হ্যাঁ আছে, একশোবার আছে। আমার চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছিলো। হঠাৎ সে অতি কষ্টে বলে বসলো, দানিয়েল ভাই, আমাকে বিছানায় শুইয়ে দেন। আমার কেমন জানি লাগছে। আমি তাড়াতাড়ি বিছানায় শুইয়ে দিলাম। তার মুখে কোনো কথা নেই। গর গর আওয়াজ বেরিয়ে

আসছে।

.

১২.

সেপ্টেম্বর মাস প্রায় শেষ হয়ে আসছে। আমরা যারা কোলকাতা শহরের ভাসমান প্রাণী, দৈনন্দিন খাদ্য সংগ্রহের প্রয়োজনে এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আড্ডা জমাচ্ছি, নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করছি, ঘরেরও না, ঘাটেরও না; সেই চূড়ান্ত সত্যটা ভুলে থাকার জন্য অষ্টপ্রহর এটা ওটায় ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করছি। কিন্তু সেই দিকচিহ্নহীন সময় প্রবাহ আমাদের সবাইকে ঠেলে একটা কঠিন জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিলো। এতোদিন আমরা জানতাম সীমান্তে একটা যুদ্ধ চলছে। ঠিক যুদ্ধটা কোথায় হচ্ছে, কারা করছে, সে বিষয়ে আমাদের একেবারে যে ধারণা ছিলো না সে কথা সত্যি নয়। মাঝে মধ্যে আমরা সীমান্ত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে গিয়েছি। সেখানে যুদ্ধের প্রস্তুতি যেটুকু চলছে নিজেদের চোখে দেখার সুযোগ হয়েছে। ক্যাম্পগুলোতে ট্রেনিং চলছে ঠিকই, কিন্তু এই ট্রেনিং থেকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে নিরস্তিত্ব করে দিতে পারে এ রকম একটা মুক্তিযুদ্ধ জন্ম নিতে পারে সে কথা প্রাণের ভেতর বিশ্বাস করতে পারিনি। আমাদের কোথাও কিছু নেই, সবকিছুই শূণ্যের ওপর ঝুলছে। সবটাতেই ভারতের করুণার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ক্যাম্পে হাজার হাজার তরুণের মৃত্যুর সরল প্রস্তুতি অফুরন্ত মনোবল, আসন্ন সংগ্রামে সেটাই জাতিগতভাবে আমাদের সত্যিকার বিনিয়োগ। আমাদের ট্রেনিংরত মুক্তিযোদ্ধাদের জয়বাংলা রণধ্বনি আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে যখনই ফেটে পড়েছে আমাদের শিরার রক্ত চলকে উঠেছে। সেই প্রেরণাদীপ্ত পরিবেশে যতোক্ষণ থেকেছি, সমস্ত জাগতিক হিসেব নিকেশ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে আমরা বিশ্বাস করেছি আমরা জয়ী হবো। জয়ী হবো এই বিশ্বাসটুকুও যদি না রাখতে পারি, তাহলে আমাদের অস্তিত্বের মূল্য কি? এই কোলকাতা শহরে আমরা কি করতে এসেছি। সমস্ত সন্দেহ, সমস্ত সংশয়কে সবলে তাড়িয়ে দিয়ে মনের মধ্যে একটা আশাবাদের শিখা প্রাণপণ প্রয়াসে উজ্জ্বল করে জ্বালিয়ে রাখতে আমরা ব্যস্ত ছিলাম। আমরা জয়ী হবো, আমাদের জয়লাভ করতে হবে। এই আশাটুকু না রাখতে পারলে মানুষের শরীর ধরে হেঁটে বেড়ানোর কোনো মানে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু একটা হিসেবী মনও তো ছিলো। সেটা মাঝে মাঝে ভয়ানকভাবে বেঁকে বসতো। ক্যাম্পের বাস্তব অবস্থা দেখে মনটা দমে যেতো। পর্যাপ্ত খাবার নেই, গোলাবারুদ নেই। প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রের তালিকা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠালে, ক্যাম্পে সে অস্ত্র এসে পৌঁছতে অনেক সময় সপ্তাহ, পক্ষ, এমনকি মাস গড়িয়ে যেতো। কোনো সময় আদৌ পৌঁছাতো না। নির্দেশনার প্রশ্নে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশী নেতৃত্বের মতবিরোধ লেগেই রয়েছে। থিয়েটর রোডের অস্থায়ী সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কাছে বার বার নালিশ করেও সদুত্তর পাওয়া যেতো না। প্রায় সবগুলো ক্যাম্পে একটা যাচ্ছেতাই অবস্থা। তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখার জন্য অনেক সময় ক্যাম্প কমাণ্ডারেরা গামছায় কিছু গ্রেনেড বেঁধে দিয়ে বলতো, যাও চোরাগোপ্তাভাবে পাকিস্তানী সৈন্যের ওপর আক্রমণ করো, রাজাকারদের খতম করো, তারপর ফিরে এসো। এভাবে শুধুমাত্র কিছু গ্রেনেডসহ তরুণ ছেলেদের দেশের ভেতরে পাঠানো যে প্রকারান্তরে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়া এ কথা ক্যাম্প কমাণ্ডারেরাও বিশ্বাস করতেন। কিন্তু উপায় কি? অতোগুলো জোয়ান ছেলে ক্যাম্পে বসে থাকলে এক সময়ে নিষ্ক্রিয়তা এসে ভর করবে। তখন তাদের মধ্যে কোনো রকমের গতি সৃষ্টি করা দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে। তাই যে কোনো রকমের এ্যাকশনের মধ্যে অন্ততঃ একাংশকে ব্যস্ত না রাখতে পারলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

ক্যাম্পে গেলেই সকলে থিয়েটর রোডের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গালাগাল করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গণপ্রতিনিধিদের সংযোগ সমন্বয় খুবই ক্ষীণ। তারা যে ক্যাম্প পরিদর্শন করতে যান না তাও ঠিক নয়। মাঝে মাঝে সরকারের তরফ থেকে কেউ না কেউ যান। সব সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন না একজন তাদের সঙ্গে থাকেন। বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিরা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশতে পারে না। ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময় পারেন না। তাঁদের অবচেতন মনে সব সময় একটা ভীতি কাজ করে। যদি বেঁফাস কিছু মনে করেন। গণপ্রতিনিধিদের এই আঁটোসাঁটো দায়সারা মনোভাব মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাদের বেশিরভাগই আশা করে তারা যেভাবে প্রাণ দেয়ার জন্য এক পায়ের ওপর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের যারা নেতা তাদের মধ্যে সেরকম খাঁটি জঙ্গী মনোভাব দেখতে পাবে। তার বদলে যখন নাদুশনুদুশ নেতারা স্নো-পাউডার চর্চিত মুখমণ্ডল এবং স্নিগ্ধ তেলঢালা শরীর নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পেছন পেছন হাজির হয়ে জনসভায় বক্তৃতার ঢঙ্গে হাত উঠিয়ে শেখ মুজিবের কণ্ঠস্বর নকল করে বলতে থাকেন, ভাইসব, তোমরা বাংলা মায়ের দামাল ছেলে। তোমরাই বাংলা জননীকে মুক্ত করবে। সেই দামাল ছেলেরা তখন তাঁদের অপেক্ষাকৃত নিচু স্বরে শালা বানচোত বলে গালাগাল করে। মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং সেক্টরগুলোর কমান্ডারদের মধ্যে সব সময় ঝগড়া বিবাদ লেগেই আছে। সর্বাধিনায়ক বুড়ো জেনারেল ওসমানী সত্যিকার যুদ্ধের চাইতে মিলিটারি আদব কায়দার প্রতি অত্যধিক যত্নশীল। যুদ্ধের কাজের অগ্রগতির চাইতে তার হুকুম পালিত হলো কিনা প্রায় সময়ে সেটাই তাঁর মনোযোগর বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। সর্বাধিনায়ক এবং সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে মতবিরোধ কোনো কোনো সময়ে এমন পর্যায়ে দাঁড়ায় যে ওসমানী সাহেব তার দীর্ঘ গোঁফে তা দেয়া ছাড়া অন্য কিছু করার আছে সে কথা চিন্তা করতে পারেন না। যে যার মতো করে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছেন, কারো পরিকল্পনার সঙ্গে কারো পরিকল্পনা মিলছে না। প্রায় সময়েই অচলাবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। ভারতীয়রা বাংলাদেশ কমান্ডের সঙ্গে কোনো রকমের যোগাযোগ না করেই বাংলাদেশী যুবকদের আলাদাভাবে ট্রেনিং দিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে থিয়েটর রোডে তাজুদ্দিন সাহেবের কাছে সংবাদ পাঠিয়েও কোনো সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।

থিয়েটর রোডের অস্থায়ী সরকারের কার্যালয়ে তাজুদ্দিন সাহেব যে খুব সুখে আছেন, সে কথাও ঠিক নয়। আওয়ামী লীগ দলটির মধ্যে কোন্দলের অন্ত নেই। তাজুদ্দিন সাহেব অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় আওয়ামী লীগের উচ্চাভিলাষী নেতাদের অনেকেই তার ওপর বিরক্ত। তিনি যে গোটা পরিস্থিতিটা সামাল দিতে পারবেন, তার ওপর এই আস্থা স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধীরও নেই। ভারত সরকার তাজুদ্দিন বিরোধীদেরও হাতে রাখার চেষ্টা করছে। তাজুদ্দিন সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়েছে। নিজের স্বাধীনভাবে কোনো কিছু করার ক্ষমতা বিশেষ নেই। সব সময় ভারত যা বলছে, সায় দিতে হচ্ছে, যা চাপিয়ে দিচ্ছে তাই মেনে নিতে হচ্ছে। ভারতের মাটিতে প্রকাশ্যে তাজুদ্দিনের বিপক্ষে কেউ কিছু বলতে সাহস না করলেও আওয়ামী লীগের একাংশ আমেরিকার মাধ্যমে গোপনে ইয়াহিয়া খানের সামরিক প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ চালাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। তাদের যুক্তি একটাই, ভারত কখনো বাংলাদেশের হয়ে যুদ্ধ করবে না, সুতরাং ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সঙ্গে আপোষ মীমাংসায় আসাই হবে সবচেয়ে ভালো কাজ।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কি করতে যাচ্ছেন কেউ জানে না। ভারতীয় জনমত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অনুকূলে এবং বেশিরভাগ ভারতীয় জনগণ চায় শ্রীমতী গান্ধী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে অনতিবিলম্বে স্বীকৃতি প্রদান করুন। কিন্তু যুদ্ধ করতে বললে তো যুদ্ধ করা যায় না। শ্রীমতী অত্যন্ত সন্তর্পনে অগ্রসর হচ্ছেন। বিশ্বজনমত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরতায় শিউরে উঠেছে একথা সত্যি, কিন্তু শুধুমাত্র বিশ্বজনগণের সহানুভূতির ওপর নির্ভর করে শ্ৰীমতী গান্ধী একটা যুদ্ধ কাঁধে নিতে পারেন না। পাকিস্তানের পক্ষে আমেরিকা আছে, আছে চীন। এই দুটো শক্তিশালী দেশ বারবার নালিশ করে আসছে ভারত পাকিস্তানকে ভেঙে দু’টুকরো করার জন্য পূর্বপাকিস্তানের জনগণের একাংশকে তার ভূখণ্ডের মধ্যে ডেকে নিয়ে অনর্থক ওই গণ্ডগোলটা পাকিয়ে তুলেছে। মুসলিম দেশসমূহের অধিকাংশও পাকিস্তানের অবস্থানকে সমর্থন করে। ভারতীয় জনগণের একটা বিরাট অংশ মনে করে চিরশত্রু পাকিস্তানকে চিরদিনের মতো দুর্বল করার এই একটা মোক্ষম সুযোগ। সুতরাং শ্রীমতী গান্ধীর অনতিবিলম্বে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়া উচিত। আকাঙ্ক্ষা পূরণের বাসনা থেকে তো আর যুদ্ধ বাধানো যায় না। সত্যি বটে, পূর্বপাকিস্তানের সাত কোটি মানুষ পাকিস্তানকে ধ্বংস করার কাজে ভারতকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করবে। যদি একটা যুদ্ধ সত্যি সত্যি লাগে, পাকিস্তানের মিত্র চীন কিংবা আমেরিকা যদি পকিস্তানের সমর্থনে এগিয়ে আসে, তাহলে একটা বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা এড়ানো অসম্ভব। ভারতবর্ষ কি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য একটা বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি আপন কাঁধে নিতে পারে, বোধ করি শ্রীমতী গান্ধী চাইছিলেন যুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশের সংকটের একটা শান্তিপূর্ণ সমধান হোক।

পূর্বপাকিস্তান থেকে প্রায় এক কোটির বেশি মানুষ ভারতে চলে এসেছে। তার মধ্যে প্রায় আশি লক্ষ হিন্দু। যদি তাড়াতাড়ি কিছু একটা সমাধান খুঁজে বের করা না হয়, যে সকল মুসলমান ভারতে এসেছে তাদের অনেকেরই মনোবল ভেঙ্গে যাবে। অন্যদিকে ইয়াহিয়া খান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে শরণার্থীদের ডাকছে তোমরা ফিরে এসো। কোনো ভয় নেই। একটা সময় আসতে পারে মুসলমানদের একটা বিরাট অংশ দেশে ফেরত চলে যেতে চাইবে। তখন ভারত অনেক নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যাবে। যা কিছু করার তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে। যদি ভারত একটা যুদ্ধ মাথায় নেয় চীন আমেরিকা যে পাকিস্তানের সপক্ষে ছুটে আসবে না সে ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি। একটা পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানের বন্ধুদের চাপে যদি যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করতে হয়, ভারতের লোকসান হবে অনেক বেশি। তখন পাকিস্তান এই আশি লক্ষের মতো হিন্দুকে ফেরত নিতে চাইবে না। আশি লক্ষ বাড়তি মানুষের চাপ সহ্য করতে গিয়ে ভারতের দম বেরিয়ে যাবে। শ্রীমতি গান্ধী একটা বিরাট মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছেন, যদিও তার আচার আচরণে সে কথা বোঝার উপায় নেই। পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু করে বৃহত্তর শক্তির চাপে যদি মাঝপথে থামিয়ে দিতে বাধ্য হতে হয়, সবদিক দিয়ে ভারতের ক্ষতি সবচাইতে বেশি। তখন এক পাকিস্তানের বদলে দুই পাকিস্তানের সৃষ্টি হবে। পূর্বপাকিস্তানে একজনও হিন্দু অধিবাসী থাকবে না। ভারতের হাজার সমস্যা। তার ওপর যদি ওই আশি লক্ষ মানুষের বোঝা তার ওপর চাপে, ওই বাড়তি জনসংখ্যার চাপে ভারত থেতলে যাবে।

ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের লোকদের সঙ্গে যদি একটি সমঝোতায় এসে শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করতেন, শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতেন, মানে সমস্ত শরণার্থীদের ফেরত নিতেন, তাহলে সবদিক দিয়ে সেটাই হতো উত্তম। শ্ৰীমতী গান্ধীর জানার বাকি নেই, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে একটা আপোষ মীমাংসায় এলেও পাকিস্তান একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। পঁচিশে মার্চের রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে নিষ্ঠুর নরমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছে, যে রক্তস্রোত বইয়েছে, যেভাবে অগ্নিসংযোগ এবং নরহত্যার আয়োজন করেছে, তাতে করে দু’অংশের জনগণের মধ্যে আস্থা এবং বিশ্বাসের শেষ সম্ভাবনাটুকু চিরতরে ধ্বংস হয়ে গেছে। পূর্ব এবং পশ্চিমপাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ একটি রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে আসন্ন সংকট হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারে, কিন্তু শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান কখনো ভারতের ভয়ের কারণে হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। ভারত একটি দুর্বল পাকিস্তান চায়। বিনা যুদ্ধে যদি সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়, যুদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা তিনি খুঁজে পান না। তারপরেও শ্রীমতী গান্ধীর মনে একটি প্রবল আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। আশি লক্ষ হিন্দু পাকিস্তানী সৈন্যের বর্বর আক্রমণের মুখে সব খুইয়ে প্রাণমাত্র সম্বল করে ভারতে পালিয়ে এসেছে, তারা নিরাপদে বসবাস করার নিশ্চিত নিরাপত্তা না পেলে কি পূর্বপাকিস্তানে ফেরত যেতে চাইবে? যে কোনো রাজনৈতিক সমাধান তাদের নিরাপদে দেশে ফেরার পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা কি দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে তারা ভারতের মাটি থেকে কোনোক্রমেই দেশে ফিরতে চাইবে না। ভারত জোর করে তো হিন্দুদের ঠেলে দেশে পাঠাতে পারবে না। শ্রীমতি গান্ধী চোখ বুজলেই দেখতে পান একটি যুদ্ধ তার ঘাড়ে এসে পড়েছে। এই যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার যতো বিপদ সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিপদ তার চাইতে অনেক কম। তিনি অনুভব করছিলেন, বল এখন ইয়াহিয়া খানের কোর্টে। ইয়াহিয়া খানের মাথায় যদি সুবুদ্ধির উদয় হয়, তাহলে হয়তো যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। তাছাড়া আর কোনো বিকল্প তো তিনি দেখেন না।

ইসলামাবাদে বসে ইয়াহিয়া খান হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিতে দিতে সম্পূর্ণ ভিন্নরকম চিন্তা করছিলেন। কার্যকারণ সবকিছু মিলিয়ে পরিচ্ছন্নভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা তার নেই। কেনোনা তিনি সব সময় মদের নেশায় বিভোর থাকেন। সুন্দরী নারী এবং নর্তকি গায়িকা ছাড়া আর কারো কাছে স্বচ্ছন্দ হওয়ার ক্ষমতা তিনি ক্রমাগত হারিয়ে ফেলছেন। যেটুকু চিন্তা করার ক্ষমতা এখনো অবশিষ্ট আছে, তাই দিয়ে মনে করেন তিনি একটা মরদের মতো কাজ করে ফেলেছেন। এ পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান যে কাজটি করতে পারেননি তিনি একাই সে কাজটি করে ফেলতে পেরেছেন। পূর্বপাকিস্তানের সমস্যার এমন সরল সমাধানের কথা পূর্ববর্তী কোনো রাষ্ট্রপ্রধান চিন্তা পর্যন্ত করতে পারেননি। যেহেতু পূর্বপাকিস্তানে এক কোটিরও বেশি হিন্দু বসবাস করে, সেটাই পূর্বপাকিস্তানের আসল সমস্যা। এই হিন্দুদের প্ররোচনাতেই বিচ্ছিন্নতাবাদ সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পেরেছে। অস্ত্রের মুখে তাদেরকে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করে ভারতে ঠেলে দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদের মূল তিনি চিরদিনের মতো উৎপাটন করে ফেলেছেন। হিন্দুরা যখন নেই, আস্তে আস্তে পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামী পরিবেশ ফিরে আসবে। তিনি মনে করেন আরো একটি গ্রন্থিল এবং জটিল সমস্যার সমাধান তিনি প্রায় করে এনেছেন। পূর্বপাকিস্তানের মানুষ সব সময় আন্দোলন করে, কারণ সেখানে অনেক মানুষ। এক চিলতে একটু মাটি। সেখানে বসবাস করে কোটি কোটি মানুষ, পিঁপড়ের মতো পিলপিল করছে মানুষের সারি। প্রায় এক কোটি মানুষকে তিনি অস্ত্রের মুখে সরিয়ে দিতে পেরেছেন। এই এক কোটি মানুষের বাড়িঘর, জমিজমা, ব্যবসাবাণিজ্য সব অন্যদের দখলে চলে যাবে। তাদের গায়ে গতরে একটু হাওয়া লাগবে। তারা হাত পা ছড়িয়ে বসতে পারবে। এই বাড়তি জমি বাড়ি ঘর পাওয়ার পর তাদের অসন্তোষ অনেক কমে আসবে। পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের প্রতি তার মায়া হয়। তিনি মিছামিছি উনিশশো পঁয়ষট্টি সালে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। হাতের কাছে এমন সহজ সমাধান থাকা সত্ত্বেও আয়ুব খান সাহেব কেননা যে পূর্বপাকিস্তানকে বাগে আনতে পারলেন না, তিনি বুঝতে পারেন না। মদের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে ভাবেন, কি বোকাই না ছিলেন আয়ুব খান। অথচ কতো সহজে সব সঙ্কটের সমাধান প্রায় করে এনেছেন।

ইয়াহিয়া খান মাতাল হলেও তার হিসেব খুবই পরিষ্কার। শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি কারাগারে পুরেছেন। থাকুক আরো কিছুদিন। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। যদি ইয়াহিয়া খানের কথা মানতে রাজি হন, ছেড়ে দেবেন। আর যদি বেঁকে বসেন দেশদ্রোহী হিসেবে ফাঁসিতে লটকে দেবেন। আওয়ামী লীগের যে অংশটা দেশের মধ্যে আছে, তার একটা অংশকে খুন করা হয়েছে, একটা অংশকে জেলে পোরা হয়েছে এবং আর একটা অংশকে একেবারে সরাসরি তাবেদারে পরিণত করা হয়েছে। সুতরাং দল হিসেবে পূর্বপাকিস্তানে আওয়ামী লীগের আর মাথা তুলে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। তাছাড়া আওয়ামী লীগের কাছে যে সমস্ত দল সত্তরের নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলো তাদের সবাইকে সাহস দিয়ে তিনি চাঙ্গা করে তুলেছেন। জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি সমস্ত দক্ষিণপন্থী দল পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে উঠে পড়ে লেগেছে। শিগগির আওয়ামী লীগের নির্বাচিত নেতারা ভারতে চলে যাওয়ার পর যে রাজনৈতিক শূণ্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা তারা পূরণ করতে পারবে। তাছাড়া পৃথিবীর মানুষকে দেখাবার জন্য পূর্বপাকিস্তানে একটা সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান তিনি করেছেন।

এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই পৃথিবীর মানুষের কাছে সাক্ষ্য দিয়েছে ইয়াহিয়া খান সাহেব দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করার স্বার্থে পূর্বপাকিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপ করে পাকিস্তানকে উদ্ধার করেছেন। সামরিক এক নায়ক হিসেবে কেউ তাঁকে দুষতে পারবে না। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই বললেন, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার স্বার্থে ইয়াহিয়া খান সামরিক বাহিনীকে মোতায়েন করেছেন। পূর্বপাকিস্তান থেকে সামরিক বাহিনী উঠিয়ে নিলে ভারত থেকে আগত দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে জনগণের জানমাল রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

ইয়াহিয়া খান গ্লাসের পর গ্লাস শ্যাম্পেন খালি করেন। আর ভাবছেন, তাঁর মতো সুদক্ষ জেনারেল এবং প্রতিভাবান নেতা পৃথিবীতে বেশি নেই। তার যোগ্যতার প্রমাণ, তিনি বোতলের পর বোতল নিঃশেষ করে ফেলতে পারেন। তাঁর সমস্ত জাগতিক বিষয়ে সংজ্ঞা লোপ হওয়ার পরেও একটা জিনিস মনের মধ্যে ধ্রুবতারার মতো জ্বলতে থাকে। ভারত যে সকল তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা পূর্বপাকিস্তানের দেশ প্রেমিকদের বাড়ি ঘরে গ্রেনেড ছুঁড়ছে, ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করছে, পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দিচ্ছে, তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য তিনি পূর্বপাকিস্তানের দেশপ্রেমিক যুবকদের নিয়ে রাজাকার, আলবদর এবং আল শামস বাহিনী গঠন করেছেন। তারা এখন পূর্বপাকিস্তানের সর্বত্র মাঠে নেমেছে এবং পাহারা দিচ্ছে। ভারত যতো ইচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা পাঠাতে থাকুক, জান নিয়ে কেউ ফেরত যেতে পারবে না।

হ্যাঁ, পৃথিবীর পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিওতে বিপুল পরিমাণ পূর্বপাকিস্তানীদের ভারতে পালিয়ে যাবার কথা বলছে। এক কোটির মতো মানুষ গেছে। সুতরাং এই ধরনের কিছু কথা তো উঠবেই। কিন্তু ভারতে কারা গিয়েছে। সেটা তো দেখতে হবে। ভারতে যারা চলে গেছে, তাদের তো শতকরা পঁচাশি ভাগ হিন্দু। হিন্দুদের ভারত ডেকে নিয়ে গেছে। কেনোনা এই হিন্দুদের ডেকে নিয়ে ভারত পাকিস্তানের অখণ্ডতা ধ্বংস করতে চায়। বাকি পনেরো ভাগ মুসলমান যারা ভারতে গিয়েছে, তাদের অধিকাংশই ভারতের অনুচর। আর কিছু সংখ্যক বিপথগামী। তথাপি পৃথিবীর মানুষ যদি বলে ইয়াহিয়া খান পূর্বপাকিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিক। ইয়াহিয়া খান বললেন, তারা ফিরে আসুক, যাদের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজের কোনো প্রমাণ নেই তিনি তাদের ক্ষমা করে দেবেন। কোনো ভয় নেই, শরণার্থীরা তাদের বাড়িঘরে ফিরে আসুক। ইয়াহিয়া খান সীমান্তের চৌকিগুলোর কাছাকাছি তাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অভ্যর্থনা কেন্দ্র খুলবেন। তিনি জানেন, হিন্দুরা ফিরবে না। আর মুসলমান যারা গিয়েছে যদি ফিরে আসে খান সাহেবের তো আরো সুবিধে। তিনি পৃথিবীর মানুষদের সামনে দেখাতে পারবেন পূর্বপাকিস্তানের হিন্দু এবং ভারত সরকার মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব ভাঙার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে। অন্যরা আসুক না আসুক কিছু যায় আসে না। কিন্তু হিন্দুরা যে ফিরে আসবে না এ ব্যাপারে ইয়াহিয়া খান সুনিশ্চিত। তিনি নতুন বোতলের সুরা গলধঃকরণ করতে করতে ভাবেন এক ঢিলে তিন পাখি মেরে ফেলেছি। আমি আশি লাখ হিন্দুকে ভারতের ওপর চাপিয়ে দিতে পেরেছি। তিনি ভাবেন আয়ুব খানের মাথায় এ বুদ্ধি আসেনি কেনো। পূর্বপাকিস্তানের হিন্দু না থাকলে আর কখনো বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দেবে না। ভারত সব সময়ে পাকিস্তানকে দুর্বল করতে চেয়েছে। তার বদলে ইয়াহিয়া ভারতের ঘাড়ে এমন এক জনসংখ্যার বোঝা চাপিয়ে দিতে যাচ্ছেন, সে অর্থনৈতিকভাবে আর কখনো মাথা সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। মাঝে মাঝে তিনি অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন। আর ভারত যদি যুদ্ধ করে সেখানেই তো আসল মজা। পাকিস্তানের বন্ধু আমেরিকা আছে, চীন আছে। তারা মদদ দিতে ছুটে আসবে। তবে ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার খুব দহরম মহরম চলছে। ভাবে গতিতে মনে হচ্ছে যদি যুদ্ধ লাগে রাশিয়া ভারতকে সমর্থন করবে। তা করুক। পূর্বপাকিস্তানের ব্যাপার নিয়ে দুনিয়ার বড়ো বড়ো দেশগুলো একটা বিশ্বব্যাপী তৃতীয় মহাযুদ্ধ স্বেচ্ছায় মাথায় তুলে নেবে ইয়াহিয়া খান সাহেব সে কথা বিশ্বাস করতে চান না। ভারত পাকিস্তানে একটি যুদ্ধ যদি লেগেই যায় বৃহৎ শক্তিগুলোর চাপে অল্পদিনের মধ্যেই থামিয়ে ফেলতে হবে। সে যুদ্ধে পাকিস্তান যদি বিশেষ সুবিধে করতে নাও পারে ইয়াহিয়া খান সাহেবের বিশেষ দুশ্চিন্তা নেই। তখন তিনি ভারতের সঙ্গে অস্ত্রবিরতি করবেন। মধ্যস্থতা করতে আমেরিকা ছুটে আসবে। তথাকথিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটির কোনো গুরুত্বই থাকবে না। বাংলাদেশ বলে কিছু আছে নাকি? গোটা ব্যাপারটাই ঘটছে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে। মাঝখান থেকে বাংলাদেশের প্রশ্ন উঠবে কেমন করে? ভারত পূর্বপাকিস্তান থেকে যে সকল হিন্দুকে দেশের অখণ্ডতা ধ্বংস করার জন্য তার ভূখণ্ডে ডেকে নিয়েছে পাকিস্তান কস্মিনকালেও তাদের আর ফেরত নেবে না। আর যে সকল মুসলমান চলে গিয়েছে, তারা যদি ফিরে আসতে চায় আসুক। ইয়াহিয়া খান সাহেব তাঁদের কথাটা ভেবে দেখবেন। তিনি গ্লোসে চুমুক দিচ্ছেন আর মাঝে মাঝে অট্টহাস্য করে উঠছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, হ্যাঁ সেই মেয়ে মানুষটি। আমাকে ল্যাং মারতে চায়? তার লড়াই করার খায়েশ হয়েছে? আচ্ছা ঠিক হ্যায়, নজদিগ মে এক জঙ আগ্যায়া। ময়দান মে মোলাকাত হোগা।

মাঝখানে পরিস্থিতি একেবারে থিতিয়ে গিয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশ নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। এভাবেই সব কিছু চলতে থাকবে। যেখানেই যাই, সর্বত্র থমথমে পরিবেশ, কি ঘটবে, কি ঘটতে যাচ্ছে কেউ কিছু বলতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে যতোই হতাশা বাড়ছে, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং দলাদলি ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ওর বিরুদ্ধে বলছে, অমুক অমুকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। কোলকাতার মানুষেরা আমাদের ওপর বিরক্ত হয়ে উঠছে। আর কতত। বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, পার্কে, মাঠে, ময়দানে সর্বত্র জয়বাংলার মানুষ দেখে দেখে তাদের চোখ পচে গেছে। আমরা আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে ভীষণ সংকুচিত হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছি। মানবিক মর্যাদা বোধটুকুও আস্তে আস্তে আমাদের লোপ পেতে বসেছে। লোহালক্কর ফেলে রাখলে যেমন মরচে ধরে, আমাদের মধ্যেও তেমনি স্তরে স্তরে হতাশা জমে ক্রমাগত অমানুষ হয়ে উঠছি। আমরা বৌ বাজারের হোস্টেলটিতে আট দশজন মানুষ থাকি। যখন এসেছিলাম সকলের মধ্যে প্রাণখোলা সম্পর্ক ছিলো। যতোই দিন যাচ্ছে আমরা আর স্বাভাবিক থাকতে পারছিনে। তুচ্ছ সিগারেট নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝগড়া বাধে। বালিশ, বিছানা, মশারি নিয়ে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। আমরাও দুতিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের এসব খুনসুটি দেখে হোস্টেলের ছাত্রেরা হাসে। প্রকাশ্যে খারাপ মন্তব্য করতেও কেউ ছাড়ে না। অথচ আমরা যখন অভুক্ত অবস্থায় মুখে সাত পাঁচ দিনের আকামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে এসেছিলাম, সকলে আমাদের বীরের সম্বর্ধনা দিয়েছিলো, বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো। আমাদের শরীরে ময়লা ছিলো, জামা কাপড়ের যা অবস্থা ছিলো বলার মতো নয়। কতো মানুষ যেচে আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে এসেছে, কতো বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছে। এখন কোলকাতার জল-হাওয়া লেগে আমাদের শরীরে লাবণ্য ফিরে এসেছে। অনেকেই ছিমছাম জামা কাপড় পরি। তথাপি কোলকাতা শহরের মানুষ আমাদের প্লেগের জীবাণুর মতো এড়িয়ে চলে। কোলকাতার জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, তার জন্য আমরা দায়ী। ট্রাম, বাস, ট্রেনে অস্বাভাবিক ভিড় বাড়ছে, সে জন্যও আমরা দায়ী। পার্ক মাঠ ময়দানের নির্জনতা বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে, সর্বত্র জয়বাংলার মানুষ গিস্ গিস্ করছে। কর্মহীন স্বপ্নহীন উদ্যমহীন অবস্থায় থাকতে থাকতে আমরা একে অন্যের ওপর ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। প্রতি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে একই লোকের চেহারা দেখে দেখে ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠেছি। একজনের মনের ময়লা অন্যজনের মনে লেগে লেগে স্রোতহীন বদ্ধকূয়োর পানির মতো আমাদের মনগুলোও দূষিত হয়ে পড়েছে। কোলকাতা শহর যেনো একটা উন্মুক্ত কারাগার। তার ভেতরে আমরা ছেড়ে দেয়া কয়েদির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমরা সকলে কোথায় যাবো, বিকেলে কোথায় কাটাবো, সব একটা ছকের মধ্যে পড়ে যেতে হয়। বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশের মানুষের কাছে যাবে না তো কোথায় যাবে? যে যেখানেই থাকিনে কেননা, সন্ধ্যেবেলা পানের দোকানের সম্মুখে, ছোটো ছোটো রেস্টুরেন্টের দোরগোড়ায় স্বাধীন বাংলা বেতারে এম. আর, আখতার মুকুলের চরমপত্র পাঠ শোনার জন্য দাঁড়িয়ে যাই। কোলকাতার মানুষ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা নবদ্বীপ হালদারের কমিক শুনে যে রকম মজা পায়, এম. আর. আখতার মুকুলের গলার আওয়াজ, বাঙ্গাল ভাষার রসিকতা, কথা বলার ভঙ্গি সব কিছু তেমনি উপভোগ করে। কিন্তু আমাদের কাছে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের এম, আর. আখতার মুকুলের চরমপত্রের আবেদন ভিন্ন রকম। বাংলাদেশের ব্যাপারে সকলের উদাসীনতা চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। তথাপি এম. আর. আখতার মুকুল যখন স্বাধীনবাংলা বেতারের অনুষ্ঠানে চরমপত্র পাঠ করেন তখন দোকানের সামনে আস্তে আস্তে লোক জমতে থাকে, তখন দোকানীর আওয়াজটা বাড়িয়ে না দিয়ে উপায় থাকে না। লোকজন এম. আর. আখতার মুকুলের কড়া রসিকতা চিবিয়ে চিবিয়ে উপভোগ করে। এম. আর. আখতার মুকুল ট্যাঙ্ক ধ্বংস করছেন, গানবোট ডোবাচ্ছেন, সৈন্যভর্তি ট্রেনসহ ব্রীজ উড়িয়ে দিচ্ছেন, সেনা ছাউনিতে ছাউনিতে ত্রাসের সঞ্চার করছেন। এ পর্যন্ত তিনি যতো পাকিস্তানী সৈন্য খুন করেছেন, যতো জখম করেছেন, যতো ট্যাঙ্ক অচল করেছেন, যতো কনভয় ধ্বংস করেছেন সব মিলিয়ে যোগ করলে যে সংখ্যাটা দাঁড়াবে, তাতে করে একজনও পাকিস্তানী সৈন্য বাংলার মাটিতে থাকার কথা নয়। তার পরদিন সন্ধ্যেবেলা আবার সৈন্য মারতে আসেন। আমরা অবাক হয়ে ভাবি এতো সৈন্য তিনি কোথায় পান। আমরা জানতাম, এম. আর. আখতার সাহেব যা বলছেন, তার দু শতাংশও যদি সত্য হতো, তাহলেও আমাদের যুদ্ধের পরিস্থিতি এরকম হওয়ার কথা নয়। সব মিথ্যে জেনেও আমরা পরের দিনের চরমপত্র পাঠ শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। আর কোথাও তো কেউ কিছু করতে পারছে না। অন্ততঃ একজন মানুষ আছেন, যিনি কল্পনায় পাকিস্তানী সৈন্য হত্যা করতে পারেন, ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দিতে পারেন, বাক্যের মন্ত্রশক্তিতে বাংলার সপক্ষে যুদ্ধ করার জন্য খরস্রোতা নদী, সুন্দর বনের বাঘ, বিষাক্ত সাপ, ঝক বাঁধা মশা, ভাটি অঞ্চলের প্যাক কাদা, পশুপক্ষি সবকিছুকে প্রতিরোধ সংগ্রামের ভূমিকায় শরিক করে নিতে পারেন। কার্যক্রম যতোই অপ্রতুল হোক না কেননা, এম. আর. আখতারের কণ্ঠ শুনে মনে একটা বিশ্বাস ঘনিয়ে উঠতো। আমাদের প্রকৃতি, আমাদের নদী, আমাদের বনাঞ্চল, আমাদের বাঘ, সাপ, আমাদের প্যাক কাদা পাকিস্তানী সৈন্য ধ্বংস করার অলৌকিক ক্ষমতা রাখে। কোথাও যখন কিছু ঘটছে না, কেউ কিছু করছে না। আমরা এম. আর. আখতার মুকুলের ওপর ভরসা ছাড়তাম না। আগামীকাল তিনি নতুন আক্রমণ এবং নতুন বিজয়ের কথা শোনাবেন। ডুবন্ত মানুষ তো প্রাণপণ শক্তিতে ভাসমান তৃণখণ্ডকে আঁকড়ে ধরে।

হঠাৎ করে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের মধ্যে একটা গতির সঞ্চার হলো। কথাটা বোধ হয় সঠিক বললাম না। ভারত পাকিস্তান সম্পর্কের একটা নতুন মোড় নিলো। ভারতের দূত ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া ইত্যাদি দেশে ছুটাছুটি করতে আরম্ভ করলো। পাকিস্তানও বসে নেই। ইয়াহিয়ার প্রতিনিধি ইউরোপীয় দেশগুলোতে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে এবং পাকিস্তানের অবস্থান সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ নয়াদিল্লীতে ঘন ঘন যাওয়া আসা করছেন। বৈঠক করছেন। পত্রপত্রিকায় সে সকল সংবাদ ছাপা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বোধ করি মনস্থির করে ফেলেছেন, তাকে একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে। তার কথাবার্তা, বিবৃতি ভাষণের মধ্যে একটা উদ্দেশ্য পরিষ্কার ফুটে উঠছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের বেগও তীব্র হয়ে উঠেছে। কোলকাতার পত্রপত্রিকাগুলো খবর দিতে আরম্ভ করেছে, মুক্তিযোদ্ধারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে। পাউরুটির ভেতর ছুরির মতো পাকিস্তানী সৈন্যের বেষ্টনী ভেদ করে তারা দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে। পাকিস্তান রেডিও একথা স্বীকার করে নিয়েছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ানরা ছদ্মবেশে পূর্বপাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করে নাশকতামূলক কাজকর্ম করে পালিয়ে যাচ্ছে। বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকাও বলতে আরম্ভ করেছে, মুক্তিযোদ্ধারা সত্যি সত্যি দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে এখানে সেখানে অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে। আইয়ুব খানের সময়ের গভর্ণর আবদুল মোনায়েম খানকে মুক্তিযোদ্ধারা বাড়িতে ঢুকে গ্রেনেড ছুঁড়ে হত্যা করেছে। ভেড়ামারা, কুষ্টিয়া, রংপুর, টাঙ্গাইল, খুলনা, বরিশাল এসকল অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম তীব্রতরো হয়ে উঠেছে। টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণের মুখে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী পিছু হটে এসেছে। বিবিসি-র সংবাদদাতা আরো খবর দিয়েছে পাকিস্তানী সৈন্য ভর্তি লরীগুলো দিনে রাতে সীমান্ত অভিমুখে ছুটছে। সৈন্যরা সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় বাঙ্কার নির্মাণ করছে এবং ট্র্যান্স কাটছে।

এরই মধ্যে একদিন শ্রীমতী গান্ধী সোভিয়েত রাশিয়া সফরে গেলেন। ভারত এবং রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা অনেক বেড়ে গেছে সেটা আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিলো। রাশিয়ার কথাবার্তার মধ্যেও ভিন্ন একটা সুর লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো। বাংলাদেশের ব্যাপারে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন এবং প্রেসিডেন্ট পদগর্নি সব সময়ে ইয়াহিয়া খানকে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার অনুরোধ করে আসছিলেন। কিন্তু শ্ৰীমতী গান্ধীর রাশিয়া সফরের পর থেকে রাশিয়ান নেতাদের বক্তব্যের ধরণও বেশ পাল্টে গেলো। ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে একটা বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে। দুই দেশের যে যুক্ত ইস্তেহার প্রকাশিত হয়েছে তাতে প্রথমবারের মতো পূর্বপাকিস্তানের বদলে পূর্ববাংলা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

রাশিয়া থেকে শ্রীমতী গান্ধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলেন। যুক্তরাষ্ট্রে নিক্সনের সঙ্গে দেখা করলেন, বিশেষ সুবিধে করতে পেরেছেন বলে মনে হলো না। নিক্সন প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো রকম ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে শ্রীমতী গান্ধী মার্কিন জনমতকে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করলেন। নানা জায়গায় বক্তৃতা দিলেন। পত্রপত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিলেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এসে তিনি পশ্চিম জার্মানি সফর করলেন। তারপর ফ্রান্স এবং সবশেষে ইংল্যাণ্ড। রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব চুক্তির পরও শ্রীমতী পশ্চিম ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন কেন বুদ্ধিমান মানুষের কাছে তার কারণ অস্পষ্ট রইলো না। ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি করে পশ্চিমা দেশগুলোর স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কিছু করতে যাচ্ছেন না সে আশ্বাসটা ওসকল দেশের সরকার এবং জনগণের সামনে তুলে ধরাই ছিলো তার উদ্দেশ্য।

পাকিস্তানও বসে নেই। ইয়াহিয়া খান চীন মার্কিন সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে দূতিয়ালী করছেন। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে হেনরী কিসিঞ্জার গোপনে উড়ে বেইজিং-এ পৌঁছেছেন। সেখানে চৌ এন লাই এবং মাও সেতুংয়ের সঙ্গে চীন-মার্কিন সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের বিষয়টি পাকাপাকি করে ফেলেছেন। ইয়াহিয়া খান ধরে নিয়েছেন চীন মার্কিন সম্পর্কোন্নয়নে ইয়াহিয়া খান যেহেতু মধ্যস্থের ভূমিকা পালন করেছেন, তাই পাকিস্তানের বিপদের দিনে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং পররাষ্ট্র সচিব হেনরী কিসিঞ্জার বরাবর পাকিস্তানী অবস্থানের পক্ষেই কথা বলে আসছিলেন। আর চীন তো খোলাখুলি ভারতকে আক্রমণকারী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে অনেকদিন থেকেই ধমক দিয়ে আসছে। তবে একটা মজার ব্যাপার চীনা ড্রাগন শুধু লম্ফ ঝম্ফ করে, গর্জন করে, কিন্তু সরাসরি কামড় দিতে ছুটে আসে না।

ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী খান ভূট্টো সাহেবের নেতৃত্বে চীনে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছেন। চীনা নেতারা ভোজসভায় অনেক ভালো ভালো কথা বলেছেন। খোদ চৌ এন লাই আশ্বাস দিয়েছেন পাকিস্তান যদি ভারত কর্তৃক আক্রান্ত হয় চীন পাশে এসে দাঁড়াবে। ভূট্টো সাহেব দেশে ফিরে এসে সাংবাদিকদের বলেছেন তাঁর চীন সফর শতকরা একশো ভাগ ফলপ্রসু হয়েছে।

ভারত পাকিস্তানে সাজো সাজো রব চলছে। বাংলাদেশ ভারতের নৌকোয় পা রেখেছে। সুতরাং ভারত যা করে বাংলাদেশকে অম্লানবদনে মেনে নিতে হবে। তারপরেও ভারতের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার জন্য, বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত একটি যুদ্ধ। ঘাড়ে তুলে নিচ্ছে। ভারতের স্বার্থ থাকে থাকুক। কিন্তু আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই এবং মাতৃভূমিকে স্বাধীন দেখতে চাই। তারপরেও একটা প্রশ্ন যখন মন কুঁড়ে জেগে উঠে, নিজের কাছেই নিজে বেসামাল হয়ে পড়ি। বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উনিশশো আটচল্লিশ থেকেই সগ্রাম করে আসছে। আসন্ন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধটিই কি বাঙালি জাতির বিগত বাইশ বছরের রক্তাক্ত সংগ্রামের একমাত্র ফলাফল। এই যুদ্ধে হয়তো ভারত জয়লাভ করবে এবং ভারতের সহযোগিতায় আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হবো। আমাদের জাতীয় সংগ্রামের এই পরিণতি। এটাই কি আমরা চেয়েছিলাম? কি জানি, ইতিহাস কোন্ দিকে মোড় নিচ্ছে। আমাদের বাবারা পাকিস্তান তৈরি করেছিলেন, আর আমরা পাকিস্তান ভাঙছি। এই যুদ্ধ সংঘাত রক্তপাতের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় ইতিহাস কোন্ ভবিষ্যতের পানে পাড়ি দিচ্ছে? কে জানে!

১৩-১৪. হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম

মাঝখানে তিনদিন হাসপাতালে যেতে পারিনি। ভেতর বাইরের চাপে এক রকম হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। চারদিনের দিন হাসপাতালে যেয়ে যা শুনলাম তাতে আমি তো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। এই তিনদিনে তায়েবার অসুখ বাড়াবাড়ি রকমের বেড়ে গিয়েছিলো। পরশুদিন তাকে ইনটেনসিভ কেয়ারে নিয়ে যেতে হয়েছে। ডাক্তারেরা কাউকে দেখা করতে দিচ্ছে না। হাসপাতালের সামনে সেই মহানিম গাছের চারপাশের বাঁধানো গোলাকার চক্রটিতে সবাই বসে আছে। জাহিদুল, ডোরা, দোলা, হেনা ভাই আরো দুচারজন আত্মীয়স্বজন। দূরে একাকী মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন তায়েবার মা। এই বর্ষীয়সী মহিলাকে এইভাবে ভিড় থেকে দূরে একেবারে একাকী বজ্রাহত তরুর মতো বসে থাকতে দেখে আমার বুকটা আশংকায় ধুকপুক করে উঠলো। আমি পায়ে পায়ে তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মহিলা আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন। তাঁর চোখের কোণায় অক্ষরেখা। আঁচলে মুছে নিয়ে বললেন, এই তিনদিনে তুমি একবারও হাসপাতালে আসোনি। তোমার কি জ্বরজারি কিছু একটা হয়েছিলো? আমি না বলতে যেয়েও পারলাম না। আমার অসুখ বিসুখ হয়নি। অথচ আমি আসিনি, জানলে মহিলা ব্যথিত হবেন। তাই বললাম, আমার জ্বর হয়েছিলো। মহিলা কিছু বললেন না। আমি তার পায়ের কাছে ঘাসের ওপর বসলাম।

একটু একটু শীত করছিলো। হাসপাতালের লোকজন কমে আসতে শুরু করেছে। সন্ধ্যেবেলা আলো জ্বলে উঠেছে। আমরা বাইরে বসে আছি, কি করবো জানিনে। সমস্ত পরিবেশটাই কেমন ভূতুরে হয়ে দাঁড়িয়েছে। তায়েবাকে ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা হয়েছে। সকলেই জেনে গেছে তার আর বেশি সময় নেই। আমি দু’হাতে মাথা ঢেকে তায়েবার এই পরিণতির জন্য কে দায়ী চিন্তা করতে চেষ্টা করলাম। তায়েবার এই অকাল মৃত্যুর জন্য আমি জাহিদুলকে মনে মনে দায়ী করলাম। পরক্ষণে ভাবলাম, জাহিদুল দায়ী হতে যাবেন কেন? জাহিদুলের দোষ কি? জাহিদুল ডোরাকে বিয়ে করেছেন বলে তায়েবাকে মরতে হবে এটা কেমন করে হয়। তাহলে ভোরাই কি দায়ী? বিচার করে দেখলাম, ডোরারই বা কসুর কি? সে তো কাউকে না কাউকে বিয়ে করতোই। জাহিদুলকে বিয়ে করে অন্যায়টা কি করেছে। তার ফলে তায়েবা মরতে যাবে কেন? হেনা বিয়ে করে অন্যায়টা কি করেছে। তার ফলে তায়েবা মরতে যাবে কেনো? হেনা ভাই তায়েবার খোঁজ খবর না নিয়ে নিজে একটা বিয়ে করেছেন বলেই কি তায়েবা মরতে বসেছে? হেনা ভাই বিয়েটা না করলে বেঁচে থাকতো তার নিশ্চয়তা কি? তাহলে তায়েবার মা-ই তার মৃত্যুর কারণ? খুব খুঁটিয়ে চিন্তা করার পর একটা জিনিস আবিষ্কার করলাম, মহিলা তায়েবার ঘাড়ে অত্যধিক দায়িত্বের বোঝা চাপিয়েছিলেন, তাই বলে কি তায়েবাকে মরতে হবে? তাহলে দায়ী কে? তায়েবা কোলকাতা এসেছিলো, তাই কি তাকে মরতে হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু না হলে তাকে কোলকাতা আসতে হতো না। এই স্বাধীনতা সংগ্রামই কি তায়েবার মৃত্যু ঘটাতে যাচ্ছে। আমি স্বাধীনতা সংগ্রামকেও বা কেমন করে দায়ী করি। তাহলে তায়েবার মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? তায়েবার মৃত্যু জন্য কেউ না কেউ একজন তো দায়ী হবে। কাউকে দায়ী না করে আমার মন শান্তি পাচ্ছিলো না। তখনই মনে পড়ে গেলো তায়েবা নিজের মুখে। বলেছে, সে আমাকে ভালোবাসে, তাহলে কি আমিই কি তায়েবার মৃত্যুর জন্য দায়ী?

হাসপাতালের সামনের রাস্তায় হঠাৎ আওয়াজ শুনে সচকিত হয়ে তাকালাম। চারজন মানুষ একখানি খাঁটিয়ায় করে একটা সাদা চাঁদরে ঢাকা মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সকলে একসঙ্গে হরিবোল বলে চিৎকার করছে। এই দৃশ্যটা দেখে আমার মধ্যে একটা দার্শনিক নির্লিপ্ততা জন্ম নিলো। মানুষের জন্ম মৃত্যুর রহস্যটা আমার চোখে পরিষ্কার হয়ে ধরা দিলো। মৃত্যু সর্বব্যাপী ওঁত পেতে রয়েছে। কেউ কারো জন্য দায়ী নয়। আমি পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিলাম, হেনা ভাই এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। তারপর ডাকলেন, দানিয়েল এদিকে এসো। তিনি আমাকে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে গিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসালেন। বললেন, চা খাও। কাপে যেই চুমুক দিয়েছি, হেনা ভাই বললেন, দেখি তোমার একটা চারমিনার দাও। সিগারেটটা ধরিয়ে বললেন, শোনো দানিয়েল আজ তোমাকে একটা কথা বলবো। আমি বললাম, বলুন। তিনি বললেন, শোনো তিনদিন তুমি হাসপাতালে আসোনি। এই তিনদিন তায়েবার কি কষ্ট হয়েছে সে আমি বলতে পারবো না। গত পরশুদিন রাতে সে তিনবার জ্ঞান হারিয়েছিলো। প্রতিবারই জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পরে তোমার কথা জিগগেস করেছে। তুমি বোধ হয় এরই মধ্যে জেনে গেছো আমার বোনটি বাঁচবে না। তোমাকে যে কথাটি আমি বলার জন্য ডেকেছি, তিনি একটুখানি ইতস্তত করলেন। হাতের পোড়া সিগারেটটি ফেলে দিয়ে আমার কাছ থেকে আরেকটি সিগারেট চেয়ে নিয়ে ধরালেন। তারপর আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে কোনো গোপন কথা বলছেন এমন ভঙ্গিতে ফিস ফিস করে বললেন, আমার বোনটি তোমাকে খুবই ভালোবাসে। আমার কাঁধে হাত রাখলেন, ভাবতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। সে আর বাঁচবে না। তাঁর চোখের কোণে অশ্রু চিক চিক করে উঠলো। আমি কোনো কথাই বলতে পারলাম না।

আমরা হাসপাতালে ফিরে এলাম। এসে দেখি সে মহানিম গাছটির গোড়ায় কেউ নেই। আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম, ওরা সব গেলো কোথায়। এই যে দানিয়েল সাহেব এইদিকে আসুন। লাল কংক্রিট বিছানো পথ বেয়ে উঃ মাইতি হাসপাতালের গেটের দিকে যাচ্ছেন। আমি পায়ে পায়ে তাঁর কাছে গেলাম। তিনি বললেন, চলুন, আপনাকে খুঁজছিলাম। আমি ডঃ মাইতির পেছন পেছন তাঁর কোয়াটারে গেলাম। তিনি ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর স্টেথিসকোপ রাখলেন। তারপর বললেন, দানিয়েল সাহেব বসুন, আজকে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলি। তিন চারদিন থেকে আপনার দেখা নেই। আমি তাঁর উল্টোদিকের সোফায় গিয়ে বসলাম। তিনি বললেন, দিন দেখি আপনার একটা চারমিনার। আপনার সঙ্গে দেখা হলেই আমার সিগারেটের নেশা চেপে যায়। আমি প্যাকেটটা বের করে দিলাম। তিনি একটা ধরিয়ে খকখক কাশলেন এবং গলগল করে ধোয়া ছাড়লেন। তারপর, বলুন আপনাদের যুদ্ধের সংবাদ। সহসা ডঃ মাইতির কথার কোনো জবাব দিতে পারলাম না। তাই ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি বললেন, আপনাদের যুদ্ধের সংবাদ আমার কাছ থেকে শুনুন। আপনারা খুব শিগগির দেশে চলে যাবেন এবং আপনাদের দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে। এখন বলুন, আপনার আনন্দ হচ্ছে কিনা। আমি বললাম, আমাদের দেশ স্বাধীন হবে এবং আমরা দেশে ফিরে যাবো। তিনি বললেন, এটাই তো আপনারা চেয়েছিলেন। আমার মনে হচ্ছিলো, ডঃ মাইতি অন্য কিছু একটা বলতে চান, যুদ্ধ সংক্রান্ত কথাগুলো ভনিতা মাত্র। আমার মনে হচ্ছিলো তিনি আমাকে অত্যন্ত কঠিন, অত্যন্ত দুঃখের কোনো কিছু হয়তো বলবেন। আমার বর্তমান যা মানসিক অবস্থা কেউ যদি বলে আগামীকাল সূর্য নিভে যাবে বোধ হয় কোনো ভাবান্তর ঘটবে না। আমি মনে মনে বিরক্তি অনুভব করছিলাম। ডঃ মাইতি আমাকে আসল কথাটি না বলে ধানাই পানাই করেন কেন। আমি জিগগেস করলাম, আপনি তায়েবার ব্যাপারে কিছু বলবেন? ইনটেনসিভ কেয়ারে সে কেমন আছে? ডঃ মাইতি টেবিল থেকে পেপার ওয়েটটি উঠিয়ে নিয়ে ঘুরাতে থাকলেন এবং প্রায় পাঁচ মিনিট তাই করে গেলেন। তারপর টেবিলের ওপর রেখে সরাসরি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিগগেস করলেন, কোনো মূল্যবান জিনিস পেতে হলে দাম দিতে হয়, একথা আপনি বিশ্বাস করেন? আমি বললাম, অবশ্যই বিশ্বাস করি। সুতরাং আপনাকেও দাম দিতে হবে, মনে মনে প্রস্তুত হোন। আমি বললাম, একটু বুঝিয়ে বলুন, আমি এমন কি মূল্যবান বস্তু পেতে যাচ্ছি, যার জন্য দাম দিতে আগেভাগে প্রস্তুত হতে হবে। ডঃ মাইতি বললেন, ওই যে বললাম, আপনারা স্বাধীনতা পেতে যাচ্ছেন। আমি জবাব দিলাম, আমরা কি দাম দেইনি? তিনি বললেন, আপনার দেশের মানুষ দাম দিয়েছে, আপনি এখনো কোনো দাম দেননি। শুধু কোলকাতা এসেছেন। আপনার কোনো পার্সোনাল কন্ট্রিবিউশনের কোটা শূণ্য। এইবার ঈশ্বর আপনাকে সে লজ্জা, সে অপমান থেকে উদ্ধার করতে যাচ্ছেন।

ডঃ মাইতির কথায় আমি চমকে উঠলাম। না না ডঃ মাইতি অমন করে বলবেন । আপনি অনুগ্রহ করে তায়েবা কেমন আছে সেটা বলুন। অতো উতলা হচ্ছেন কেন? আপনাকে তায়েবার কথা বলার জন্যই তো ডেকে এনেছি। একটু আগে ওয়ার্ডে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সেই ব্রিদিং ট্রাবলটা এখন অনেক কন্ট্রোলড কিন্তু এটা স্থায়ী হবে না। এ্যাট এ্যনি মোমেন্ট শি ক্যান গেট ব্যাক টু হার প্রিভিয়াস পজিশন। ইউ আর এ সিরিয়াস পার্সন এ্যৎ আই ওয়ান্ট টু টক টু ইউ সিরিয়াসলি । বাট উই প্রে টু লর্ড সো দ্যাট হি গ্রান্টস হার লংজিবিটি টিল দ্যা ফ্রিডম অব বাংলাদেশ ইজ এ্যাচিবড। ডঃ মাইতি উঠে দাঁড়ালেন। আপনাকে চা দিতে বলি। আমি কাপড় ছাড়ি। আমি বললাম, ডঃ মাইতি এখন চায়ের ঝামেলা করে লাভ নেই। আমি যাই। অলরাইট আসুন, কিন্তু তিনি সাবধান করে দিলেন, বাট ইউ শুড নট ভিজিট হার টু ফ্রিকোয়েন্টলি। আপনার সঙ্গে তার সম্পর্কটা খুব ইমোশনাল। শি নীডস কমপ্লিট রেস্ট এ্যণ্ড ফুল ট্রাঙ্কুয়িলিটি। সো টেক কেয়ার। এট দিজ স্টেজ ইউ আর এ লায়াবলিটি টু হার।

ডঃ মাইতির কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে, আসার সময় আমি এরই মধ্যে নিজে কতোটুকু বদলে যাচ্ছি সে কথা চিন্তা করে দেখলাম। তার মুখে তায়েবার মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেছে সে সংবাদটি শুনেছি। এতো বড়ো একটা দুসংবাদ শোনার পরও আমার মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না। আমি দিব্যি হাঁটাচলা করতে পারছি। ঠাণ্ডা মাথায় সব কিছু সামাল দিতে পারছি। আমার মানসিক ধৈর্য দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। এই যুদ্ধ তলায় তলায় আমাকে কতোটুকু বদলে দিয়েছে। সেই নিভৃত পথটুকু অতিক্রম করার সময় আমার চেতনায় ঘন্টা ধ্বনির মতো বাজতে থাকলো, তায়েবার মৃত্যদণ্ড তো ঘোষণা হয়ে গেছে। কিন্তু চূড়ান্ত ঘটনাটি কখন ঘটবে সেই তারিখটা জানায়নি। আমার মন বললো, ওয়েল ইট ক্যান হ্যাপেন এ্যট এ্যনি মোমেন্ট। নিশীথে পাওয়া মানুষের মতো আমি সেই নির্জন পারিবারিক রাস্তাটুকু অতিক্রম করে কখন বড়ো রাস্তায় এসে পড়েছি খেয়াল করতে পারিনি। আমার পেছনে হঠাৎ ঘটাং করে একখানা গাড়ি ব্রেক করলো। ট্যাক্সি থেকে শিখ ড্রাইভার নেমে এসে দু’টি সবল লোমশ হাতে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে বলতে গেলে একেবারে রাস্তার ওপর ছুঁড়ে দিলো। তারপর গালাগালি দিতে থাকলো, শালে লোক মরনেকা আওর কুয়ি মওকা নেহি মিলা। আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। বড়ো বড়ো চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সর্দারজি তার হাতের একটা প্রবল থাবা আমার কাঁধে বসিয়ে পুনরায় গাড়ি স্টার্ট করে চলে গেলো। গাড়িটি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর আমার চেতনা হলো, আমি এই গাড়ির তলায় চাপা পড়তে যাচ্ছিলাম। সর্দারজির কৃপায় এযাত্রা বেঁচে গেছি। সাক্ষাৎ মৃত্যুকে এড়িয়ে আসার পরও আমার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে পারলাম না।

আমি রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে থাকলাম, এখন আমার কি করা উচিত। এই অবস্থায় আমি কি করবো, কোথায় যেতে পারি। সমস্ত ভাবনা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো। সমস্ত চেতনায় ঘন্টারোলে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো। আজ তায়েবার মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেছে। কিন্তু কখন কার্যকর হবে তারিখটি আমি জানিনে। একজন মহিলা এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন। আধো আধো অন্ধকারে ঠিক চিনতে পারলাম না কে হতে পারে। গলার আওয়াজ শুনে বুঝলাম অর্চনা। তাকে কোনো জবাব দেবার আগে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, অর্চনা এখানে কেনো? সে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো এবং বললো, দানিয়েল, তোমার হয়েছে কি? একটু আগে তুমি গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে। আর তায়েবাদির এখানেও তুমি তিনদিন আসোনি। তোমাকে এমন উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে কেনো? আমি স্বগতোক্তির মতো করে বললাম, অর্চনা, তায়েবার মৃত্যুদণ্ড হয়ে যাচ্ছে, আমরা কোনদিন কার্যকর হবে তারিখটি জানিনে। কি সব অলক্ষুণে কথা বলছো? তোমার মাথার কোনো ঠিক নেই। আমি বললাম, জানো অর্চনা, আমাকে ডঃ মাইতি বাড়িতে ডেকে নিয়ে সব বলেছেন। কি বলেছেন? বলেছেন কোনো আশা নেই। এখন শুধু খাঁচা ছেড়ে পাখির উড়াল দেয়া বাকি। অর্চনা বললো, দানিয়েল, এই সময়ে তোমার মাথা ঠাণ্ডা রাখা খুবই প্রয়োজন। তায়েবাদির মা খুবই ভেঙ্গে পড়েছেন। আমার তো ভয় হচ্ছে মহিলা কেমন জানি হয়ে গেছেন। যেখানে বসেন বসে থাকেন, ওঠার কথা ভুলে যান। কারো সঙ্গে বিশেষ কথা বলেন না। এই তিনদিন জল ছাড়া কিছুই মুখে দেননি। আমি জিগ্‌গেস করলাম, এসব তুমি জানলে কেমন করে? দানিয়েল, তুমি বোকার মতো কথা বলছে। এই তিনদিন আমি দু’বেলা তায়েবাদিকে দেখতে এসেছি। যখন বাড়াবাড়িটা শুরু হলো সকলে তো ভয়েই অস্থির। ভাগ্যিস মনীষদা কোলকাতায় ছিলেন। পিজি-র ডিরেক্টর। তিনি দাদার বন্ধু এবং এক সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। তাকে ধরে কোনো রকমে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নিয়ে যাবার সুযোগটা পাওয়া গিয়েছিলো। আপাততঃ তায়েবাদি বিপদমুক্ত। কিন্তু এটা স্থায়ী কিছু না। লুকোছাপা করে তো লাভ নেই। ক্যান্সারের রোগীর শেষ পরিণতি তোমারও তো অজানা থাকার কথা নয়। আরেকটা দরকারি কথা বলি মনে রাখবে। সবাইকে বলতে শুনলাম, তোমাকে দেখলে তায়েবাদি ভয়ঙ্কর আপসেট হয়ে পড়েন। সুতরাং তুমি হুট করে কেবিনে ঢুকে পড়ার আগে একটু খোঁজ খবর নিয়ো।

অর্চনার কথা শুনে হাজার দুঃখের মধ্যেও আমার কৌতুকবোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। আমি যে ভাবতে চেষ্টা করেছিলাম, তায়েবার এই মৃত্যুর জন্য আমি একাই দায়ী। সকলে এই কথাটি বুঝে গিয়ে আমাকে সঠিক শনাক্ত করে ফেলেছে। আমি হো হো করে হেসে উঠতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। অর্চনা বললো, তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? আমি বললাম, পাগল হয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। আর রাখো তোমার যত্তোসব…। আমি বললাম, অর্চনা এটা একটা চমৎকার নাটক, আমরা সকলে মিলে ঘটিয়ে তুলেছি। এখন শেষ অঙ্কে কি ঘটে দেখার জন্য উৎকণ্ঠিত আগ্রহে সকলে প্রতীক্ষা করছি। কিন্তু আমি তোমাকে একটা সহজ কথা জিগগেস করবো। জবাব দেবে? বলো তোমার সহজ কথাটা, যদি জানা থাকে জবাব দেবো। আমি বললাম, আমি দেখতে পাচ্ছি এই নাটকে তুমিও একটা চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা কি করে সম্ভব হলো আমাকে বুঝিয়ে বলবে? দানিয়েল, আসলে তুমি একটা সিনিক। সব ব্যাপারে ঠাট্টা করার স্বভাবটি তোমার মজ্জাগত। ঠিক বলেছো অর্চনা, ওই সিনিসিজমটা এখনো আমার মধ্যে আছে বলেই হাঁটাচলা করতে পারছি। কিন্তু সেটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়। তখন অর্চনা বললো, তুমি সত্যি একটা অদ্ভুত মানুষ। তবু তোমার একটা গভীর অন্তর্দৃষ্টি আছে, সেকথা আমি অস্বীকার করবো না। তোমার আর তায়েবাদির সম্পর্কের একটি ইন্টারেস্টিং দিক আছে। সেটাই আমাকে ভীষণ কৌতূহলী করে তুলেছিলো গোড়ার দিকে। তুমি যখন কোনো কিছু গম্ভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকো, কখন জানো না নিজেই সে জিনিসটির অংশ হয়ে গেছে। এই ব্যাপারটা অল্প বিস্তর আমার ক্ষেত্রেও ঘটে যাচ্ছে। এমনিতে আমি রোগী টোগী দেখতে পারিনে। কিন্তু তায়েবাদির মধ্যে আমি অন্যরকম একটা কিছু দেখেছিলাম, যা সচরাচর দেখা যায় না। সেটাই আমাকে টেনেছিলো। তুমি যাই। বলো দানিয়েল, তায়েবাদি একটা অসাধারণ মেয়ে। এমন আশ্চর্য হৃদয়ের মহিলা জীবনে আর একটিও দেখিনি। তায়েবাদিকে দেখলে ভালোবাসতে হয়, শ্রদ্ধা করতে হয়। আমি বললাম, অর্চনা সেসব কথা থাকুক। আমি এসব আর সহ্য করতে পারছিনে, তুমি আমাকে কোথাও নিয়ে যাবে? সে এক মুহূর্ত কি চিন্তা করলো। তারপর ঘড়ি দেখলো। তুমি একথা বলে খুবই ভালো করেছে। আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম। আজকে মহানগর নারী সংঘ রবীন্দ্রসদনে তোমাদের ঢাকার বীরাঙ্গনা শহীদ রওশন আরার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রওশনআরা রজনী উদযাপন করছে। আমার মেজদি মহানগর নারী সংঘের একজন নেত্রী। তিনি আমাকে দু’খানা টিকেট দিয়েছিলেন। সেগুলো ব্যাগের মধ্যেই পড়ে আছে। এখন মাত্র সাড়ে আটটা বাজে। অনুষ্ঠান নিশ্চয়ই সাড়ে দশটা পর্যন্ত চলবে। চলো ওইতো রবীন্দ্রসদন। বড়োজোর পাঁচ মিনিট। আমি ক্লান্ত ছিলাম, কথা বলার প্রবৃত্তি হলো না। অর্চনার পেছন পেছন রবীন্দ্রসদনে এসে হাজির হলাম।

অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে দশ পনেরো মিনিটি আগে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যের (নামটা মনে আসছে না) উদ্বোধনী ভাষণটি শোনা হয়নি। আমরা যখন প্রবেশ করলাম রওশন আরা স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে কোলকাতার একজন গুণী শিল্পী একটি গান পরিবেশন করছিলেন। গানের কথাগুলো ভারী সুন্দর। ভদ্রলোক তন্ময় হয়ে গাইছিলেন।

শহীদ লক্ষ ভাই ভগিনী শহীদ রোশেনারা
তোমরা তো সব প্রাণের আগুন চোখের ধ্রুবতারা
রোশেনারা বোনটি আমার কোন্ গাঁয়ে যে ছিলো তোমার ঘর
সেথায় কি আজ বুটের তলে আকাশ বাতাস রৌদ্রজলে
ধু ধু করে পদ্মা নদীর চর।

শিল্পীর কণ্ঠে গানটি যেই শেষ হলো, এই বীরাঙ্গনা তরুণীর স্মৃতির প্রতি অপার সমবেদনায় উপস্থিত দর্শকদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। এই কল্পকন্যাটির প্রতি মমতায় আমার মনটাও মেদুর হয়ে উঠলো। গানের পর কোলকাতার সবচেয়ে খ্যাতিমান আবৃত্তিকার বিখ্যাত কবি এবং সমালোচক প্রমথনাথ বিশীর সুললিত ছন্দে লেখা একটি সুদীর্ঘ কবিতা আবৃতি করলেন। তারপরে একজন মাঝ বয়েসী মহিলা মঞ্চে এলেন। তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের কাছে রওশন আরা সম্পর্কিত এ পর্যন্ত যে সব সংবাদ তারা সংগ্রহ করতে পেরেছেন, তার একটা লিখিত বিবরণ পাঠ করলেন। রওশন আরার বাড়ি রাজশাহী জেলার নাটোর। তার বাবা পেশায় একজন পুলিশ অফিসার এবং সম্পর্কে সে ছিলো শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মীয়া। পড়াশোনা করতে ঢাকার ইডেন কলেজে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন পঁচিশে মার্চ তারিখে ঘুমন্ত ঢাকা নগরীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো, সে তখন নাটোরেই ছিলো। তারপর উত্তর বঙ্গে যখন প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়, রওশন আরা একক প্রচেষ্টায় একটি মহিলা ব্রিগেড গঠন করে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি কাজ করতে থাকে। এক রাতে ঘর্ঘর বিকট আওয়াজ শুনে রওশন আরার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে তার গুপ্ত আস্তানার মহিলা কর্মীদের জাগিয়ে তোলে। সর্বনাশ, বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা রাজশাহীর দিকে এগিয়ে আসছে। এখন যদি কোনো রকম বাধা না দেয়া যায়, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। প্রতিরোধ সংগ্রাম তছনছ হয়ে যাবে। পাকিস্তানী সৈন্যরা একজন মুক্তিসেনাকেও জীবিত থাকতে দেবে না। ট্যাঙ্কের গতি কিভাবে রোধ করা যায়। মহিলা ব্রিগেডের কর্মীরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। তারপর রওশন আরা এগিয়ে এসে সাথী মহিলাদের উদ্দেশ্যে বললো, পাকিস্তানী ট্যাঙ্কের গতি কি করে থামিয়ে দিতে হয়, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। মাথার ওড়নাটা খুলে নিয়ে ভালো করে বুকের সঙ্গে তিনটা মাইন শক্ত করে বেঁধে নিলো। সাথী মহিলারা অবাকদৃষ্টিতে রওশন আরার কার্যকলাপ দেখতে থাকে। কারো মুখে একটিও শব্দ নেই। প্রস্তুতি নেয়া শেষ হলে, তার প্রাণের বান্ধবি শিরিনকে জড়িয়ে ধরে বললো, শিরিন আমার মাকে বলিস। মুহূর্তের জন্য তার দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিলো। পরক্ষণেই সামনে গিয়ে এক মিনিট চুপ করে কি যেনো ভেবেছিলো। তারপর প্রাণপণ চিঙ্কারে জয়বাংলা ধ্বনি উচ্চারণ করে সারা শরীর ট্যাঙ্কের তলায় ছুঁড়ে দিয়েছিলো।

এটুকু পর্যন্ত পাঠ করার পর হলের মধ্যে আহা উঁহু আফশোস ধ্বনি শোনা যেতে থাকলো। কোনো কোনো মহিলা উচ্চৈস্বরে রোদন করে উঠলেন। শোকের মাতম থিতিয়ে আসতে কমসেকম পাঁচ মিনিট সময় লেগে গেলো। যিনি পাঠ করছিলেন, ধৈর্য ধরে সে সময়টুকু অপেক্ষা করলেন। ধীরে ধীরে হল শান্ত হয়ে এলে মহিলা জানালেন, সে রাত্রে রওশন আরা একটি ট্যাঙ্ক পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছিলো। ট্যাঙ্কে যে তিনজন পাকিস্তানী সৈন্য ছিলো প্রচণ্ড বিস্ফোরণে তাদের শরীর টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিলো। প্রতিবেদন পাঠিকা ভদ্রমহিলা একেবারে শেষ পর্যায়ে জানালেন, রওশন আরার ছিন্নবিছিন্ন শালোয়ার কামিজের রক্তরঞ্জিত অংশগুলো উদ্ধার করে মহিলা ব্রিগ্রেড তাদের পতাকা বানিয়েছে। বিদায় নেয়ার আগে মহিলা ডান হাতের মুঠি উর্ধে তুলে উচ্চারণ করলেন, জয়বাংলা। সমবেত শ্ৰোতৃমণ্ডলীর মধ্যে জয়বাংলা, জয়বাংলা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো।

তারপর এলেন আরেক মহিলা। তিনি এপর্যন্ত ভারতবর্ষের নারী সমাজ রওশন আরার আত্মদানে উদ্বুদ্ধ হয়ে কি কি কর্মসূচী গ্রহণ করেছে, তার একটা আনুষ্ঠানিক বিবরণ দাখিল করলেন। দিল্লীতে শ্রীমতি অরুণা আসফ আলির নেতৃত্বে একটি রওশন আরা ব্রিগেড গঠিত হয়েছে। তাঁরা পায়ে হেঁটে আগ্রা অবধি মার্চ করে গেছেন এবং বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা সগ্রহ করেছেন। পাটনায় রওশন আরা ব্রিগেডের কর্মীরা নিজের হাতে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আড়াই হাজার উলের সুয়েটার বুনে দিয়েছে। এইভাবে এলাহবাদ, বেনারস, জলন্ধর, অমৃতসর, মাদ্রাজ, দিল্লী রওশন আরা ব্রিগেডের কর্মীদের বিস্তারিত কর্মসূচীর বর্ণনা দিলেন। খোদ কোলকাতা শহরে রওশন আরার নামে একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বুঝলাম, রওশন আরা নামটি সমগ্র ভারতে, বিশেষ করে ভারতীয় নারী সমাজে উদ্দীপনার একটি শিখা হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠেছে। যে মেয়ে নিজের দেশের স্বাধীনতার জন্য স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বুকে মাইন বেঁধে ট্যাঙ্কের তলায় আত্মাহুতি দিয়ে দুনিয়ার নারী সমাজে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে, তার নামে কিছু করতে পারাটা নারী জন্মের এক বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার, একথা কে অস্বীকার করবে।

তারপর যখন ঘোষিকা জানালেন, এখন কোলকাতার একটি নামকরা নাট্য প্রতিষ্ঠান রওশন আরার আত্মদানের ঘটনাটি অবলম্বনে রচিত একটি একাঙ্কিকা পরিবেশন করবে। আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে গেলো। আমি পাশে বসা অর্চনাকে কানে কানে জানালাম, আমাকে এবার যেতে হবে। অর্চনা বললো, চলে যাবে? আমি বললাম, ভীষণ খারাপ লাগছে। সে বললো, যাও, আমি মেজদির সঙ্গে যাবো।

যখন রবীন্দ্রসদন থেকে বেরিয়ে এলাম, প্রায় দশটা বেজে গেছে। ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও একা একা হাঁটতে থাকলাম। সমগ্র ভারতে রওশন আরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রাম থেকে এই রকম রওশন আরার মতো বীর কন্যা যদি সত্যি সত্যি জন্ম নিতো, তাহলে আমাদের সংগ্রামের অবস্থা কি দাঁড়াতো মনে মনে কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম। আমার বন্ধু আগরতলার অধ্যাপক বিজন চৌধুরীর ছোটো ভাই বিকচ চৌধুরীর তেজোদ্দীপ্ত চেহারাটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। বিকচের প্রকাণ্ড কল্পনা করার ক্ষমতা সঠিক খাতে প্রবাহিত হলেও উপযুক্ত ক্ষেত্র পেলে কি অঘটনই না ঘটিয়ে তুলতে পারতো। আগরতলা এম বি. বি কলেজের গ্রাজুয়েট বিকচ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ভৌমিক চৌধুরীর জেন্টস পকেট রুমালের মতো দৈনিক পত্রিকাটিতে উর্বরা কল্পনা শক্তি প্রসুত নতুন নতুন কল্পকাহিনীর জন্ম দিয়ে যাচ্ছে এখনো।

আমার এখনো সে সন্ধ্যাটির কথা মনে আছে। সারাদিন খুব বিষ্টি ছিলো। বিকচ প্রতিদিন সীমান্তে যেয়ে এটা সেটা সংবাদ এনে পেছনের চারটি কলাম ভরাট করতো। বিকচের মতো মানুষেরও মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের জন্য আগরতলা সীমান্তে যেতে হতো। এটা একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কারণ বিকচ নিউজপ্রিন্টের প্যাড নিয়ে বসলেই গানবোট ডুবতো, কনভয়ের পর কনভয় সৈন্য ধ্বংস হয়ে যেতো; ট্রেন লাইন উড়ে যেতো। তথাপি বিকচ সাইকেলটাতে প্যাডেল ঘুরিয়ে সীমান্ত অবধি যেতো। কারণ প্রতিদিন যেতে যেতে ওটা তার একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছিলো। বিকচ তার ছোট্টো পত্রিকার পাতায় এতো সৈন্য মেরেছে, এতো ট্যাঙ্ক ছারখার করেছে, এতে কর্ণেল, ব্রিগেডিয়ার বন্দী করেছে, আগরতলার মানুষ তার মারণ ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে পাকিস্তানী সৈন্যদের যম টাইটেল দিয়েছে। এপ্রিলের শেষের বিষ্টিমুখর দিনটিতে, আধভেজা অবস্থায় অফিসে এসে দেয়ালে সাইকেলটি ঠেকিয়েই ঘোষণা দিয়ে বললো, এ বিষ্টিতে কোথাও যেতে টেতে পারবো না। ধ্যাননেত্রে আগে একটু দেখে নেই। বাংলাদেশে আবার নতুন কি ঘটলো। হাতের সিগারেটটি আমাকে দিয়ে বললো, ততোক্ষণে তুমি এটা টানতে থাকো। আমি একটু চোখ বুঝে দেখি সত্যি সত্যি কয়েক মিনিট চোখ বুজে রইলো। চোখ খুলে আমাকে জিগ্‌গেস করলো, সিগারেট কি সত্যি সত্যি শেষ করে ফেলেছে। আমি বললাম, তুমি সবটা পুড়িয়েই আমাকে দিয়েছিলে, একটান দিতেই সব শেষ। যাও দিপুকে দিয়ে মনার দোকান থেকে আমার নাম করে পাঁচটা চারমিনার আনতে বলো। সিগারেট এলে একটাতে অগ্নি সংযোগ করে লম্বা লম্বা কটা টান মেরে নিউজপ্রিন্টের প্যাডে পুরো খবরটা সে রচনা করেছিলো। বয়ান এ রকম : ফুলজান নামের এক যুবতী বুকে মাইন বেঁধে পাকিস্তানী সৈন্যের একটা আস্ত ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে দেখিয়ে বললো, দেখতে খবরটা কেমন হয়েছে। আমি বললাম, দ্যা আইডিয়া ইজ এ্যাণ্ড। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এরকম একটা বীরকন্যা জন্মাতে পারলে খুব ভালো হয়। বিকচ আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলেছিলো, আমরা যদি না লিখি তাহলে জন্মাবে কেমন করে। আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে। সে বাঁ চোখটা টিপে একটু হেসেছিলো। আমি বললাম, এ ক্ষেত্রে একটা সেকেণ্ড থট দিতে হবে।

যে কোনো সংবাদ কি, কেনো, কোথায়, কখন, কিভাবে এই এতোগুলো কেনোর জবাব দিতে না পারলে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। তোমার গল্প সেই শর্তগুলো পূরণ করেনি। ধরো নাম নির্বাচনের বিষয়টি, তুমি বলেছো ফুলজান। এই নামটি একেবারেই চলতে পারে না। বাঙালি মুসলমানের নাম সম্পর্কে তোমার ধারণা নেই। তাই ফুলজান শব্দটি তোমার কলমের মুখে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে ফুলজান যাদের নাম, তারা বড়োজোর হাঁড়ি পাতিল ঘষে, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ট্যাঙ্কের তলায় আত্মাহুতি দিতে পারে না। সুতরাং একটা যুৎসই নাম দাও, যাতে শুনলে মানুষের মনে একটা সম্ভ্রমের ভাব জাগবে। রওশন আরা নামটি মন্দ কি। বঙ্কিম এই নামটি বেছে নিয়েছিলেন। নামের তো একটি মাহাত্ম আছেই। রওশান আরা নাম যে মেয়ের, সে যেমন হৃদয়াবেগের আহবানে সাড়া দিয়ে জয়সিংদের ভালোবাসতে পারে; তেমনি দেশ জননীর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ট্যাঙ্কের তলায় আত্মাহুতিও দিতে পারে। নামটা মনে ধরেছিলো বিকচের। তারপর গল্পের নিয়মেই বাকি ব্যাপারগুলো বেরিয়ে এসেছিলো। তার বাড়ি নাটোর। তার বাবা পুলিশ অফিসার। সে ইডেনে পড়তো এবং শেখ মুজিবের আত্মীয়া ইত্যাদি। বিকচ যদি রওশন আরার বাবার মর্যাদা পায়, আমাকে কাকা টাকা কিছু একটা বলতেই হবে। সংবাদটি সামনের পাতায় বক্স করে ছাপা হয়েছিলো। আগরতলার মানুষ এটাকেও আরেকটা বিকীয় উদ্ভাবন ধরে নিয়েছিলেন। কেউ হ্যাঁচ্ছোটিও করেননি।

মাসখানেক বাদে আমি যখন কোলকাতায় এলাম অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, এই কোলকাতা শহরের বিকচের কল্পকন্যাটির নব জন্ম ঘটে গেছে। আকাশবাণীর দেবদুলাল বাবুর কল্যাণে রওশন আরার পরিচিতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। রওশন আরার আত্মীয়স্বজনরা রেডিওতে সাজানো সাক্ষাতকার দিতে আরম্ভ করেছেন।

তারপর থেকে ভারতের পত্র পত্রিকাসমূহ রওশন আরাকে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। আনন্দ বাজার যদি হেডলাইন করে, যুগান্তর ছাপাচ্ছে জীবনবৃত্তান্ত। অমৃত বাজার উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করছে। মিতভাষী বলে স্টেটসম্যানের সুনাম আছে।

এই সম্ভ্রান্ত সংবাদপত্রটি সম্পাদকীয় কলামে রওশন আরার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন। করেছিলো। পত্র পত্রিকার প্রচার একটু থিতিয়ে এলেই রওশন আরাকে নিয়ে কবিমশায়রা কবিতা লিখতে এলেন। শিল্পীরা গান গাইতে থাকলেন। নাট্যদল নাটক করতে এগিয়ে এলেন। প্রথম প্রথম ওসব দেখে আমার ভীষণ মজা লাগতো। যুদ্ধের প্রথম বলিইতো সত্য। কিন্তু আমি বা বিকচ ইচ্ছে করলেই রওশন আরাকে আবার নিরস্তিত্ব করতে পারিনে। আমরা যদি হলপ করেও বলি, না ঘটনাটি সত্য নয় রওশন আরা বলতে কেউ নেই। সবটাই আমাদের কল্পনা। লোকজন আমাদের পাকিস্তানী স্পাই আখ্যা দিয়ে ফাঁসিতে ঝোলাবার জন্য ছুটে আসবে। এই সময়ের মধ্যে রওশন আরার ভীষণ বাড়বাড়ন্ত অবস্থা। সিপিআই যদি করে রওশন আরা দিবস, কংগ্রেস পালন করছে রওশন আরা রজনী। আমাদের কি ক্ষমতা রওশন আরার অস্তিত্ব ধ্বংস করি।

আজকে ওই রওশন আরার ওপর অনুষ্ঠানটি দেখার পর আমার মনে একটা চোট লাগলো। তায়েবা ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলনের সময় আসাদ হত্যার দিনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পত্রপত্রিকায় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিলো। সবগুলো কাগজে পুরো পৃষ্ঠা ছবি ছাপা হয়েছিলো। আজ সে কোলকাতার পিজি হাসপাতালে নিঃশব্দে মৃত্যুর প্রহর গুণছে, আর অলীক রওশন আরার ভাবমূর্তি ভারতীয় জনমনের অক্ষয় আসন দখল করে আছে। হায়রে তায়েবা তোমার জন্য অশ্রু। হায়রে বাংলাদেশ তোমার জন্য বেদনা। কেনো এরকম ভাবলাম বলতে পারবো না। হয়তো ভাবলাম, এ কারণে যে যার অস্তিত্ব কস্মিনকালেও ছিলো না, সেই রওশন আরার ভাবমূর্তি আকাশপ্রমাণ উঁচু হয়ে উঠেছে। আর তায়েবা এক সময়ে যে বাংলাদেশে সংগ্রামের উষ্ণ নিশ্বাস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলো, আজ কোলকাতার হাসপাতালে সকলের অগোচরে মারা যাচ্ছে।

.

১৪.

তায়েবার কথা প্রায় শেষ। একটি নারী দিনে দিনে নীরবে নিভৃতে কোলকাতার পিজি হাসপাতালে একটি কেবিনে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। আমরা জানতাম সে মারা যাবেই। মারা যাবার জন্যই সে কোলকাতা এসেছে। যুদ্ধ দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে। আমি ধরে নিয়েছিলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী, আর তায়েবাকে এখানে রেখে যেতে হবে। তায়েবা অত্যন্ত শান্তভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিলো। স্বাভাবিক মানুষ যেমন করে জীবনের কর্তব্যগুলো পালন করার জন্য নিতান্ত সহজভাবে সংকল্প গ্রহণ করে, সেও তেমন আসন্ন মৃত্যুর কাছে মন প্রাণ সবকিছু সমর্পন করে প্রতীক্ষা করছিলো।

তায়েবার প্রাক মৃত্যুকালীন আনুষ্ঠানিকতা অর্থাৎ একজন ক্যান্সার রোগীকে শেষ মুহূর্তে যে ধরনের চিকিৎসা করা হয়, ডাক্তারেরা করে যাচ্ছিলেন। তাঁরা তায়েবাকে একজন সাধারণ রোগীর চাইতে অধিক ভালোবাসতেন। তাই সকলে মিলে চেষ্টা করছিলেন, তার কষ্টটা যেনো কম হয়। কিন্তু ডাক্তারেরা হাজার চেষ্টা করেও তায়েবার কষ্ট কমাতে পারেনি। মৃত্যুর তিনদিন আগেই তাকে শুনতে হয়েছে, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের চাচার বাড়িতেই তার মা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে আছেন। উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই। যে বাড়ির মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে যৌবন ছিনে প্রাণপণ প্রয়াসে পালিয়ে গিয়েছিলেন, আজ প্রায় দুযুগেরও বেশি পরে সেই একই বাড়িতে তিনি একখণ্ড জড় পদার্থের মতো পড়ে আছেন।

ডিসেম্বরের চার তারিখ ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ওই দিন সন্ধ্যে থেকে সকাল পর্যন্ত গোটা কোলকাতা শহরে বিমান হামলার ভয়ে কোনো আলো জ্বলেনি। সেই ব্ল্যাক আউটের রাতে তায়েবার কাছে কোনো ডাক্তার আসতে পারেনি। কোনো আত্মীয়স্বজন পাশে ছিলো না। ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের কারণে যে অন্ধকার কোলকাতা শহরে ছড়িয়ে পড়েছিলো, সেই অন্ধকারের মধ্যে তায়েবা আত্মবিসর্জন করলো।

Exit mobile version