আমরা যখন নিচে নামলাম, তখন রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। কোলকাতা শহরের যন্ত্রযানের চলাচল একেবারে কমে এসেছে। তথাপি একথা বলা যাবে না কোলকাতা শহর বিশ্রাম নিচ্ছে। নোঙরা ঘেয়ো রাস্তা মান্ধাতার আমলের পাতা ট্রামলাইন, উন্মুক্ত ফুটপাতে শুয়ে থাকা মানুষজনের গাদাগাদি ঠেসাঠেসি ভিড় দেখলে একথা মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে এই নগরী বিশ্রাম কাকে বলে জানে না, শুধু যন্ত্রণায় কঁকায়। আচমকা ছুটে চলা নৈশ ট্যাক্সিগুলোর আওয়াজ শুনলে একথাই মনে হয়। ডানদিকের উঁচু বিল্ডিংটার ফাঁকে একখানি চাঁদ দেখা যাচ্ছে। রাস্তার গর্তের জমা পানিতে চাঁদের ছায়া পড়েছে। আহা তাহলে কোলকাতা শহরেও চাঁদ ওঠে। নরেশদা পানের দোকান থেকে পান এবং সিগারেট কিনলেন। পকেটে পয়সা থাকলে দুনিয়ার ভালো জিনিস যতো আছে কিনতে তার জুড়ি নেই। আমার হাতে একটা তবক দেয়া পানের খিলি তুলে দিয়ে বললেন, নাও খাও। কাল আবার পয়সা নাও থাকতে পারে। তারপর আবৃত্তি করলেন, নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও।
হোস্টেলের গেটে এসে দেখলাম, দারোয়ান গেটের তালায় চাবি লাগাচ্ছে। সেই আগের দারোয়ানটিই। বললো, বাবুজী আওর একটু হোলে গেট বন্ধ হোয়ে যেতো। তখন তো খুব অসুবিধে হোয়ে যেতো। আমরা তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ওপরে এলাম। আজ হোস্টেল একেবারে ফাঁকা। আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের যে ছেলেরা থাকে, সবাই বারাসত রিফিউজি ক্যাম্পে নাটক করতে গেছে। নরেশদার ভাই দু’জনও বাংলাদেশের ছেলেদের সঙ্গে গেছে। অঢেল জায়গা, ইচ্ছে করলে আমরা দুজন দু’রুমে কাটাতে পারি। অন্যদিন যে প্রাইভেসির অভাবে অন্তরে অন্তরে গুমরাতে থাকি আজ সেই প্রাইভেসিটাই বড়ো রকমের একটা বোঝা হয়ে দাঁড়ালো। আমরা দু’জন পরস্পরকে এতো ভালোভাবে চিনি যে হা করলে একে অপরের আলজিভ পর্যন্ত দেখে ফেলি।
নরেশদা বিছানার ওপর সটান শুয়ে পড়ে পুরোনো কথার খেই ধরে জিগেস করলেন, তায়েবাকে কোন্ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে? জবাব দিলাম, পিজিতে। তা ভালোই মনে হলো সকলের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করছে। আগের মতোই আছে, জেদী, বেপরোয়া। কিন্তু ডাক্তার যা বললেন, তাতে মনে হলো অসুখটা খুব একটা সাংঘাতিক। আমার কেমন জানি ভয় হচ্ছে। নরেশদা জিগগেশ করলেন, ডাক্তার কী রোগ বললেন। উল্টো ডাক্তার আমাকে জিগগেস করলেন, কী রোগ। আমরা কেমন করে বলবো। তায়েবা কখনো তার রোগের কথা আমাকে বলেছে নাকি! এটা তার প্রাইভেট ব্যাপার। নরেশদা বললেন, আমি তো কোনো কারণ খুঁজে পাইনে কেনো তোমার কাছে তায়েবার রোগের বিষয়ে জানতে চাইবেন। আমি বললাম, রহস্য টহস্য কিছু নেই। তাহলে গোটা ব্যাপারটা আপনাকে খুলেই বলি।
তায়েবা বলেছে, আগামীকাল যদি হাসপাতালে যাই তার জন্য কিছু ভাত এবং ছোটো মাছ মরিচ না দিয়ে শুধু জিরে আর হলুদ দিয়ে যেনো রান্না করে নিয়ে যাই। তাকে নাকি এক মাস থেকে ভাতই খেতে দেয়া হয়নি। আমি ভাত বেঁধে নিয়ে গেলে সেটা সে খাবে। এ ব্যাপারে ডঃ মাইতির কাছে আবদার ধরেছিলো। ডঃ মাইতি এক শর্তে রাজি হয়েছেন। ডঃ ভট্টাচার্যি যেনো জানতে না পারেন। তিনি জানতে পারলে তায়েবাকে নাকি হাসপাতালে থাকতে দেবেন না। তিনি ট্রাম স্টপেজের গোড়ায় এসে এ কথা আমাকে জানিয়েছেন। আরো বলেছেন, রান্না করার সময় কিছুতেই যেনো লবণ না দেই। পরে অবশ্য তাঁকে আপন মনে বিড়বিড় করতে শুনেছি, মেয়েটা তো শেষই হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং যা খেতে চায় খেয়ে নিক না । এই শেষের কথাটি শুনে আমার ভয় ধরে গেছে। তায়েবার যদি ভয়ানক কিছু ঘটে, সে যদি আর না বাঁচে।
নরেশদা সিগারেট ধরিয়ে আরেকটা ধমক দিলেন। কি সব আবোল তাবোল বকছো। বাঁচবে না কেনো, চুপ করো। মরণ কি খেলা নাকি! পাকিস্তানী সৈন্যদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে এতদূর যখন আসতে পেরেছে, দেখবে নিশ্চয়ই ভালো হয়ে উঠবে। হয়তো একটু সময় নেবে এই ভাত মাছ রান্নার ব্যাপারটি নিয়ে কিছু ভেবেছো কী?। না এখনো ভেবে ঠিক করতে পারিনি। আপনি বনগাঁ থেকে ফেরার পর আমি এলাম। সারাক্ষণ হাসপাতালেই তো কাটিয়ে এলাম। সত্যিই রান্না করাটাও দেখছি একটা অসম্ভব ব্যাপার। আচ্ছা নরেশদা একটা কাজ করলে হয় না। আমার বান্ধবী অর্চনা আছে না। গোলপার্কের কাছে যার বাসা। সে বাসায় তো আপনিও গিয়েছেন। তাকে গিয়ে সমস্ত বিষয় বুঝিয়ে বলবো, ভাবছি কাল সকালে তার বাসায় যাবো। অবশ্যই অর্চনা কোনো একটা উপায় বের করবে। নরেশদা বললেন, তিনি তো সকালবেলা কলেজে যান। দেখা করবে কেমন করে। আর কলেজে থেকে যদি সোজা বান্ধবীর বাসা বা অন্য কোথাও চলে যান, তখন কি করবে? একেবারে ফাঁকার উপর লাফ দেয়া যায় নাকি? আমার বোপোদয় হলো। সত্যিই তো এরকম ঘটতে পারে। আমি মাথা চুলকে বললাম, আরো একটি ভালো আইডিয়া এসেছে। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে কাকাবাবু মুজফফর আহমদের কাছে যাবো। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করেন। তাঁর কাছে সব খুলে টুলে বললে একটা উপায় অবশ্যই বের করে দেবেন। তোমার মাথায় যতো সব উদ্ভট জিনিস জট পাকিয়ে রয়েছে। নিজে বাথরুম পর্যন্ত যেতে পারেন না তার কাছে যাবে ভাত আর ছোটো মাছের আবদার করতে। তোমার বয়েস বাড়ছে না কমছে। আমি তো কোনো পথ দেখছিনে। কি করবো আপনি না হয় বলুন।