গোটা দিনের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে একদম ভুলেই ছিলাম। নরেশদার কথায় সমস্ত দিনের ঘটনারাজি একটার পর একটা বায়োস্কোপের ছবির মতো প্রাণবান হয়ে উঠলো। আমি বললাম, সকাল দশটার দিকে তো গেলাম লেনিন সরণিতে। তিনি জানতে চাইলেন, লেনিন সরণিতে কেনো? বললাম, জাহিদুলের কাছে তায়েবার ঠিকানা চাইতে। জাহিদুল তোমাকে তায়েবার ঠিকানা দিলেন? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন। দিতে কি চায়, শেষ পর্যন্ত দিতে বাধ্য করা হলো। কি করে? তিনি জানতে চাইলেন। জবাবে বললাম, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে দেখি একেবারে সিঁড়ির গোড়ার রুমটিতে জাহিদুল মটকার পাঞ্জাবি পরে বসে আছেন। হারমোনিয়াম, তবলা ইত্যাদি ফরাশের একপাশে। রিহার্সেল জাতীয় কিছু একটা হয়ে গেছে অথবা হবে। জাহিদুলের সঙ্গে আরো চার পাঁচজন মানুষ। একজন বাংলাদেশের। বাকিরা কোলকাতার। আপনি তো জানেন, মওকা পেলেই জাহিদুল ন্যাকা ন্যাকা ভাষায় চমৎকার গল্প জমাতে পারে। সেরকম কিছু একটা বোধ হয় করছিলো। সেখানে আরো তিনজন মহিলার মধ্যে ডোরাকেও দেখলাম। আমাকে দেখেই দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে আরম্ভ করেছে। তার মুখের শিশুর মতো অম্লান সরলতা তেমনি আছে। কোনো দুশ্চিন্তার রেখা, কোনো ভাবান্তর নেই। গেন্ডারিয়ার বাসায় যেমন সেজেগুজে থাকতো অবিকল তেমনি। যেনো সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, কোথাও কিছু ঘটেনি। জানেন তো ডোরাটা বরাবরই বোকা এবং পরনির্ভরশীল। নিশ্চয়ই এই সময়ের মধ্যে সে জাহিদুলের মধ্যে একটা নির্ভর করার মতো ক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছে। জাহিদুল সে সুযোগটার সদ্ব্যবহার করে মেয়েটিকে একেবারে নিকে করে ফেলেছে। জাহিদুলের বিরুদ্ধে আমার অনেক নালিশ আছে, তবু তার সৎ সাহসের তারিফ করি। বিয়ে না করে অন্যভাবেও মেয়েটিকে সে ব্যবহার করতে পারতো। জানেন তো জাহিদুলের আসল বউয়ের সংবাদ? শশীভূষণ তার মেয়েটির ট্যুইশনি করতো না, জাহিদুলকে একটা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে শশীকে বগলদাবা করে শান্তিনিকেতন চলে গেছে। এক্কেবারে ক্ষুরের মতো ধারালো মহিলা। যেদিকে যায়, ফাঁক করে যায়। তুমি কোন্ শশীর কথা বলছো? আমাদের জগন্নাথ হলের ছোট্টোমতো সুন্দর ছেলেটি নয়তো! সে তো অত্যন্ত সুশীল ছেলে। সে কেনো যাবে রাশেদা খাতুনের সঙ্গে? খাতুনেরও তো প্রচুর সুনাম শুনেছি, তিনিও বা এ রকম বাজে কাজ করতে যাবেন কেনো? এসব ব্যাপারে নরেশদার মাথাটা আস্তে আস্তে কাজ করে। তাই বিরক্ত না হয়েই বললাম, যুদ্ধ স্রোতে ভেসে যায় ধনমান জীবন যৌবন। আমি আর আপনি করলে যা অপকর্ম হয়, মহাপুরুষেরা করলেই সে সব লীলা হয়ে দাঁড়ায়। নরেশদা বললেন, ওসব কথা রাখো, তোমার খবর বলো। আমি বললাম, রাশেদা খাতুন যখন শশীকে ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর পুরে তীর্থযাত্রা করলো, ওদিকে জাহিদুল ভেবে দেখলো, সে কিছু একটা করে যদি না বসে, তাহলে লোকে তাকে মরদ বলবে না। তাই কোনোও কালবিলম্ব না করে ডোরাকে নিকে করে বসলো। তাতে তার কোনো বেগই পেতে হয়নি। সে ওদেরই তো অভিভাবক ছিলো। সুতরাং ‘আপনা উদ্যান ফল, তাতে কিবা বলাবল’ স্বামী স্ত্রীর দ্বৈত সংগ্রামে ডোরাকে বলি হতে হয়েছে। আঘাতটা সবচেয়ে বেশি লেগেছে তায়েবার। সে ছোটো বোনটাকে প্রাণের চাইতে ভালোবাসাতো আর জাহিদুলকে বাবারও অধিক শ্রদ্ধা করতো। তায়েবার সমস্ত বিশ্বাস, সমস্ত মানসিক আশ্রয় ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে। আমার তো মনে হয় ওটাই তার অসুখ গুরুতর হয়ে ওঠার মূল কারণ। নরেশদা কিছুক্ষণের জন্য মুখের ভেতর পুরে দেয়া গ্রাসটা চিবুতে পারলেন না। দু’মিনিটের মতো ঝিম মেরে বসে রইলেন। তারপর বললেন, তোমার ঠিকানা সংগ্রহের বৃত্তান্তটা বলো।
আমি শুরু করলাম। জাহিদুল আমাকে দেখার পর ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। জানেন, নরেশদা ওঁকে এখন বেশ স্লীম দেখায়। ভূড়িটাও কোথায় যেনো আত্মগোপন করেছে। গোঁফজোড়া এমন কায়দা করে ছেটেছেন, কাছে থেকে না দেখলে পাকনা অংশ চোখেই পড়ে না। নরেশদা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি আবার আজেবাজে কথা বলছো। কি ঘটেছে সেটাই বলো। সুতরাং আরম্ভ করলাম। প্রথমে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। মুখ খুলতেই পারিনি। কি জানি কেউ যদি কিছু মনে করে। শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে বললাম, আপনি কি একটু বাইরে আসবেন? জাহিদুল উঠে এলে আমি তাকে সিঁড়ির গোড়ায় ডেকে নিয়ে বললাম, আপনার কাছ থেকে আমি তায়েবার ঠিকানাটি সংগ্রহ করতে এসেছি। জাহিদুল অত্যন্ত উন্মা এবং ঝঝের সঙ্গে বললেন, আমি কি পকেটে পকেটে তায়েবার ঠিকানা বয়ে বেড়াই নাকি? আমি তার চোখে চোখ রেখে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে জানালাম। আপনার কাছে আমি তায়েবার ঠিকানা নিতে এসেছি এবং আপনি জানেন তার ঠিকানা। ভালোয় ভালোয় যদি না দেন চিৎকার করবো, চেঁচামেচি করবো। একেবারে বিফল হলে অন্যকিছু করবো। আমি প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে লম্বা চ্যাপ্টা জিনিসটির অস্তিত্ব তাকে বুঝিয়ে দিলাম। ধমকের সুরে আমাকে বললো, এক মিনিট দাঁড়াও। আমি তো ভয়ে অস্থির এই বুঝি পুলিশের কাছে টেলিফোন করে বলবেন, পাকিস্তানী গুপ্তচর পকেটে ছুরি নিয়ে বাংলাদেশের একজন সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধাকে খুন করতে এসেছে। কিন্তু সে ওসব কিছুই করলেন না, সিঁড়ি থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট কুড়িয়ে ভেতরের কাগজটা বের করে নিলেন এবং সেটা দেয়ালে ঠেকিয়ে তায়েবার হাসপাতালের নাম, ওয়ার্ড এবং বেড নম্বর লিখে আমাকে দিলেন। আমার কেমন অনুভূতি হয়েছিলো? দেশ থেকে আসার পর এই প্রথম একটা কাজের মতো কাজ করলাম। করুণার ওপর বাঁচতে বাঁচতে নিজের অস্তিত্বের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।