হিরন্ময় জানতে চাইলো, স্যার, বনগাঁ কেনো গিয়েছিলেন? নরেশদা জবাবে বললেন, আমার বুড়ো মা এবং বাবা কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনসহ আজকে বনগাঁ শরণার্থী শিবিরে পৌঁছানোর কথা। বনগাঁর আশেপাশে যে কটা শরণার্থী শিবির আছে, সবগুলোতেই তালাশ করলাম। পরিচিত আত্মীয়-স্বজন অনেকের সঙ্গেই দেখা হলো। কিন্তু মা বাবাকে পাওয়া গেলো না। হয়তো এসে পড়বেন দু’চারদিনের মধ্যে। নইলে…, নরেশদা চুপ করে গেলেন। কথাটার অশুভ ইঙ্গিত সকলকেই স্পর্শ করলো। আমি অত্যন্ত দুঃখিত স্যার। হাতের আধ পোড়া সিগারেটটি ছুঁড়ে ফেলে দিলো আজহার। স্যার, আপনার এই মানসিক অবস্থায় বিরক্ত করার জন্য অত্যন্ত লজ্জিত এবং দুঃখিত। আসলে প্রথমেই আপনার মা বাবা আত্মীয়-স্বজনের সংবাদ নেয়াই উচিত ছিলো। আমাদের মুসলমান ছেলেদের বেশিরভাগই একা একা এসেছি কীনা, তাই পরিবারের কথাটা মনে থাকে না। সেজন্য এমনটি ঘটেছে। আশা করছি, অবশ্যই তারা দু’চারদিনের মধ্যে এসে পড়বেন। আপনি চিন্তাভাবনা করবেন না স্যার। আমি দেরাদুনে পৌঁছেই আপনাকে চিঠি দেবো। আপনি অবশ্যই জানাবেন, তারা পৌঁছুলেন কিনা। আজহার ঘড়ি দেখে প্রায় এক রকম লাফিয়ে উঠলো। স্যার, এবার আমাদের উঠতে হয়। মেজর হরদয়াল সিংয়ের কাছে হাওড়া স্টেশনে হাজিরা দিতে হবে। তার আগে অনেকগুলো ফর্মালিটি পালন করতে হবে। কাঁটায় কাঁটায় রাত বারোটায় রিপোর্ট করতে হবে। আজহার এবং হিরন্ময় উঠে দাঁড়ালো। তাদের পিছু পিছু আমি এবং নরেশদা বিদায় জানাতে নিচ তলার গেট পর্যন্ত এলাম। আজহার নত হয়ে নরেশদার পা ছুঁয়ে সালাম করলো। তারপর বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদে ফেললো। নরেশদা মমতা মেশানো কণ্ঠে বললো, ছি বাবা, কাঁদতে নেই। আজহার কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললো, আমার দু’ভাই পাকিস্তানের মারীতে আটকা পড়ে আছে। এক বোন এবং ভগ্নিপতি লাহোরে। এতোদিন মনেই পড়েনি। আপনার মা বাবার কথা শুনে তাদের কথা মনে পড়লো। রাস্তার ফুটপাত ধরে দু’জন হন হন করে চলে গেলো। আমরা দুজন কিছুক্ষণ সেদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমাদের সকলেরই একেকটা করুণকাহিনী রয়েছে।
নরেশদা জানতে চাইলেন। দানিয়েল তুমি খেয়েছো? আমি মাথা নাড়লাম। চল ওপরে যেয়ে কাজ নেই, একেবারে খেয়েই আসি। বললাম, চলুন তিনি জিগগেস করলেন, কোথায় যাবে? আমার অতো বেশি খাওয়ার ইচ্ছে নেই, যেখানেই হোক চলুন। নরেশদা বললেন, এতো দুঃখ, এতো মৃত্যু, এসবের যেনো শেষ নেই। যাই হোক, চলো আজ মাছ ভাত খাই। আজ আমার একটুখানি নেশা করতে ইচ্ছে করছে। নরেশদা এমনিতে হাসিখুশি ভোজনবিলাসী মানুষ। কিন্তু পয়সার অভাবে তাঁকেও আমাদের সঙ্গে দু’বেলা মাদ্রাজী দোকানে দোসা খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। বাঙালি দোকানে সামান্য পরিমাণ মাছ, ডাল এবং ভাত খেতে কম করে হলেও ছয় টাকা লেগে যায়; সেখানে মাদ্রাজী দোকানে দেড় দু’টাকায় চমৎকার আহারপর্ব সমাধা করা যায়।
ভীমনাগের মিষ্টির দোকানের সামনে দিয়ে আমি রাস্তা পার হলাম। স্যার আশুতোষ মুখার্জীর ছবিটিতে কড়া আলো পড়েছে। স্যার আশুতোষ ভীমনাগের মিষ্টি খেতে পছন্দ করতেন, বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রচার করার জন্য ভীমনাগ স্যার আশুতোষের পোর্ট্রেটটা ঝুলিয়েছে। কিন্তু পোর্ট্রেটটি দেখে এরকম ধারণা হওয়াও একান্ত স্বাভাবিক যে ভীমনাগের মিষ্টির গুণেই স্যার আশুতোষ এতো বৃহদায়তন ভূঁড়ির অধিকারী হতে পেরেছেন। অতএব, যাঁরা ভূঁড়ির আয়তন বড়ো করতে চান, পত্রপাঠ ভীমনাগের দোকানে চলে আসুন।
আমরা দু’জন সামান্য একটু ডাইনে হেঁটে বঙ্গলক্ষ্মী হোটেলে ঢুকলাম। খদ্দেরের পরিমাণ যথেষ্ট নয়। একটা টেবিলের দু’পাশে বসলাম। নরেশদা বললেন, চলো আজ মাংস খাওয়া যাক। আমি জিগগেস করলাম, পয়সা আছে? তিনি টেবিলের ওপর টোকা দিয়ে বললেন, হ্যাঁ আজ কিছু পয়সা পাওয়া গেছে। এটাতো আশ্চর্য ব্যাপার। রাস্তায় কুড়িয়ে পেলেন নাকি? রাস্তায় কি আর টাকা পয়সা কুড়িয়ে পাওয়া যায়? মাদারীপুরের এক ভদ্রলোক আমার কাছ থেকে শ’তিনেক টাকা ধার নিয়েছিলেন। আজকে বনগাঁ স্টেশনের কাছে তাঁর সঙ্গে দেখা। অবশ্য তিনি জীপে চড়ে রিফিউজি ক্যাম্পে দর্শন দিতে এসেছিলেন। তাঁর হাতে অনেক টাকা, অনেক প্রতাপ। মাদারীপুর ব্যাংকের লুট করা টাকাও নাকি তাঁর হাত দিয়ে বিলিবণ্টন হয়েছে। ভাবলাম, এই সময়ে পাওনা টাকাটা দাবি না করাই হবে বোকামো। আমি জীপের সামনে দাঁড়াতেই তিনি ঝট করে জীপ থেকে নেমে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কতো কি জিগগেস করলেন। কিন্তু আমি আমার উদ্দেশ্যটা ভুলে যাইনি। আমাদের দিনকাল খারাপ যাচ্ছে শুনে পকেট থেকে একটি পাঁচশো টাকার নোটের তোড়া অন্য কেউ দেখতে না পায় মতো বের করে, সেখান থেকে একখানি নোট আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি তো বিপদেই পড়ে গেলাম। খুচরো কোথায় পাই! তাই বললাম, আপনি বরং তিনশোই দিন। আমার তো খুচরো করার কোনো উপায় নেই। তিনি বললেন, রাখুন প্রফেসর বাবু, আপনার খুচরো সে পরে দেখা যাবে। জীপে স্টার্ট দিয়ে দলবলসহ বারাসত রিফিউজি ক্যাম্প ভিজিট করতে চলে গেলেন। বেয়ারা এলে তিনি পাঁঠার মাংস, ভাত, ডাল দিতে বললেন।
খেতে খেতে জিগগেস করলাম, মা বাবার কোনো খোঁজ পেলেন? খবর তো পাচ্ছি রোজ পথে আছেন, পথে আছেন কিন্তু কোন্ পথ সেটাতো ভেবে স্থির করতে পারছিনে। আজই তো এসে যাওয়ার কথা ছিলো। গোটা দিন অপেক্ষা করলাম, কিন্তু অপেক্ষাই সার। হঠাৎ করে নরেশদার হিক্কা উঠলো। প্রাণপণ সংযমে হিক্কার বেগ দমন করে আবার খেতে লেগে গেলেন। আমি ফের জানতে চাইলাম, কল্যাণীরও কোনো খবর পাওয়া গেলো না। হ্যাঁ, তার একটা খবর আছে বটে। তবে সত্যি মিথ্যে বলতে পারবো না। সে নাকি কিভাবে পশ্চিম দিনাজপুরে তার এক আত্মীয়বাড়ি এসে উঠেছে। ঠিকানা পেয়েছেন? নরেশদা জবাবে বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, তবে দু’য়েকদিনের মধ্যে নিজে গিয়ে দেখে আসুন, অথবা ক্ষীতিশকে পাঠিয়ে দিন। নরেশদা আমাকে ধমক মারলেন। আরে রাখো তোমার পশ্চিম দিনাজপুর। যাওয়া আসার খরচ কতো জানো? এই কল্যাণীর সঙ্গে নরেশদার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। তারিখটা ছিলো একুশে এপ্রিল। এরই মধ্যে পঁচিশে মার্চের রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা ক্র্যাক ডাউন করে বসলো। খরচ যতোই হোক ম্যানেজ করা যাবে। আপনি ঘুরে আসুন। সে কথা এখন রাখো। তোমার খবর বলো। সকাল থেকে কোথায় কোথায় গেলে এবং কি করলে?