মাসখানেক বাদে আমি যখন কোলকাতায় এলাম অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, এই কোলকাতা শহরের বিকচের কল্পকন্যাটির নব জন্ম ঘটে গেছে। আকাশবাণীর দেবদুলাল বাবুর কল্যাণে রওশন আরার পরিচিতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। রওশন আরার আত্মীয়স্বজনরা রেডিওতে সাজানো সাক্ষাতকার দিতে আরম্ভ করেছেন।
তারপর থেকে ভারতের পত্র পত্রিকাসমূহ রওশন আরাকে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। আনন্দ বাজার যদি হেডলাইন করে, যুগান্তর ছাপাচ্ছে জীবনবৃত্তান্ত। অমৃত বাজার উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করছে। মিতভাষী বলে স্টেটসম্যানের সুনাম আছে।
এই সম্ভ্রান্ত সংবাদপত্রটি সম্পাদকীয় কলামে রওশন আরার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন। করেছিলো। পত্র পত্রিকার প্রচার একটু থিতিয়ে এলেই রওশন আরাকে নিয়ে কবিমশায়রা কবিতা লিখতে এলেন। শিল্পীরা গান গাইতে থাকলেন। নাট্যদল নাটক করতে এগিয়ে এলেন। প্রথম প্রথম ওসব দেখে আমার ভীষণ মজা লাগতো। যুদ্ধের প্রথম বলিইতো সত্য। কিন্তু আমি বা বিকচ ইচ্ছে করলেই রওশন আরাকে আবার নিরস্তিত্ব করতে পারিনে। আমরা যদি হলপ করেও বলি, না ঘটনাটি সত্য নয় রওশন আরা বলতে কেউ নেই। সবটাই আমাদের কল্পনা। লোকজন আমাদের পাকিস্তানী স্পাই আখ্যা দিয়ে ফাঁসিতে ঝোলাবার জন্য ছুটে আসবে। এই সময়ের মধ্যে রওশন আরার ভীষণ বাড়বাড়ন্ত অবস্থা। সিপিআই যদি করে রওশন আরা দিবস, কংগ্রেস পালন করছে রওশন আরা রজনী। আমাদের কি ক্ষমতা রওশন আরার অস্তিত্ব ধ্বংস করি।
আজকে ওই রওশন আরার ওপর অনুষ্ঠানটি দেখার পর আমার মনে একটা চোট লাগলো। তায়েবা ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলনের সময় আসাদ হত্যার দিনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পত্রপত্রিকায় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিলো। সবগুলো কাগজে পুরো পৃষ্ঠা ছবি ছাপা হয়েছিলো। আজ সে কোলকাতার পিজি হাসপাতালে নিঃশব্দে মৃত্যুর প্রহর গুণছে, আর অলীক রওশন আরার ভাবমূর্তি ভারতীয় জনমনের অক্ষয় আসন দখল করে আছে। হায়রে তায়েবা তোমার জন্য অশ্রু। হায়রে বাংলাদেশ তোমার জন্য বেদনা। কেনো এরকম ভাবলাম বলতে পারবো না। হয়তো ভাবলাম, এ কারণে যে যার অস্তিত্ব কস্মিনকালেও ছিলো না, সেই রওশন আরার ভাবমূর্তি আকাশপ্রমাণ উঁচু হয়ে উঠেছে। আর তায়েবা এক সময়ে যে বাংলাদেশে সংগ্রামের উষ্ণ নিশ্বাস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলো, আজ কোলকাতার হাসপাতালে সকলের অগোচরে মারা যাচ্ছে।
.
১৪.
তায়েবার কথা প্রায় শেষ। একটি নারী দিনে দিনে নীরবে নিভৃতে কোলকাতার পিজি হাসপাতালে একটি কেবিনে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। আমরা জানতাম সে মারা যাবেই। মারা যাবার জন্যই সে কোলকাতা এসেছে। যুদ্ধ দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে। আমি ধরে নিয়েছিলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী, আর তায়েবাকে এখানে রেখে যেতে হবে। তায়েবা অত্যন্ত শান্তভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিলো। স্বাভাবিক মানুষ যেমন করে জীবনের কর্তব্যগুলো পালন করার জন্য নিতান্ত সহজভাবে সংকল্প গ্রহণ করে, সেও তেমন আসন্ন মৃত্যুর কাছে মন প্রাণ সবকিছু সমর্পন করে প্রতীক্ষা করছিলো।
তায়েবার প্রাক মৃত্যুকালীন আনুষ্ঠানিকতা অর্থাৎ একজন ক্যান্সার রোগীকে শেষ মুহূর্তে যে ধরনের চিকিৎসা করা হয়, ডাক্তারেরা করে যাচ্ছিলেন। তাঁরা তায়েবাকে একজন সাধারণ রোগীর চাইতে অধিক ভালোবাসতেন। তাই সকলে মিলে চেষ্টা করছিলেন, তার কষ্টটা যেনো কম হয়। কিন্তু ডাক্তারেরা হাজার চেষ্টা করেও তায়েবার কষ্ট কমাতে পারেনি। মৃত্যুর তিনদিন আগেই তাকে শুনতে হয়েছে, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের চাচার বাড়িতেই তার মা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে আছেন। উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই। যে বাড়ির মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে যৌবন ছিনে প্রাণপণ প্রয়াসে পালিয়ে গিয়েছিলেন, আজ প্রায় দুযুগেরও বেশি পরে সেই একই বাড়িতে তিনি একখণ্ড জড় পদার্থের মতো পড়ে আছেন।
ডিসেম্বরের চার তারিখ ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ওই দিন সন্ধ্যে থেকে সকাল পর্যন্ত গোটা কোলকাতা শহরে বিমান হামলার ভয়ে কোনো আলো জ্বলেনি। সেই ব্ল্যাক আউটের রাতে তায়েবার কাছে কোনো ডাক্তার আসতে পারেনি। কোনো আত্মীয়স্বজন পাশে ছিলো না। ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের কারণে যে অন্ধকার কোলকাতা শহরে ছড়িয়ে পড়েছিলো, সেই অন্ধকারের মধ্যে তায়েবা আত্মবিসর্জন করলো।