তারপর যখন ঘোষিকা জানালেন, এখন কোলকাতার একটি নামকরা নাট্য প্রতিষ্ঠান রওশন আরার আত্মদানের ঘটনাটি অবলম্বনে রচিত একটি একাঙ্কিকা পরিবেশন করবে। আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে গেলো। আমি পাশে বসা অর্চনাকে কানে কানে জানালাম, আমাকে এবার যেতে হবে। অর্চনা বললো, চলে যাবে? আমি বললাম, ভীষণ খারাপ লাগছে। সে বললো, যাও, আমি মেজদির সঙ্গে যাবো।
যখন রবীন্দ্রসদন থেকে বেরিয়ে এলাম, প্রায় দশটা বেজে গেছে। ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও একা একা হাঁটতে থাকলাম। সমগ্র ভারতে রওশন আরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রাম থেকে এই রকম রওশন আরার মতো বীর কন্যা যদি সত্যি সত্যি জন্ম নিতো, তাহলে আমাদের সংগ্রামের অবস্থা কি দাঁড়াতো মনে মনে কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম। আমার বন্ধু আগরতলার অধ্যাপক বিজন চৌধুরীর ছোটো ভাই বিকচ চৌধুরীর তেজোদ্দীপ্ত চেহারাটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। বিকচের প্রকাণ্ড কল্পনা করার ক্ষমতা সঠিক খাতে প্রবাহিত হলেও উপযুক্ত ক্ষেত্র পেলে কি অঘটনই না ঘটিয়ে তুলতে পারতো। আগরতলা এম বি. বি কলেজের গ্রাজুয়েট বিকচ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ভৌমিক চৌধুরীর জেন্টস পকেট রুমালের মতো দৈনিক পত্রিকাটিতে উর্বরা কল্পনা শক্তি প্রসুত নতুন নতুন কল্পকাহিনীর জন্ম দিয়ে যাচ্ছে এখনো।
আমার এখনো সে সন্ধ্যাটির কথা মনে আছে। সারাদিন খুব বিষ্টি ছিলো। বিকচ প্রতিদিন সীমান্তে যেয়ে এটা সেটা সংবাদ এনে পেছনের চারটি কলাম ভরাট করতো। বিকচের মতো মানুষেরও মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের জন্য আগরতলা সীমান্তে যেতে হতো। এটা একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কারণ বিকচ নিউজপ্রিন্টের প্যাড নিয়ে বসলেই গানবোট ডুবতো, কনভয়ের পর কনভয় সৈন্য ধ্বংস হয়ে যেতো; ট্রেন লাইন উড়ে যেতো। তথাপি বিকচ সাইকেলটাতে প্যাডেল ঘুরিয়ে সীমান্ত অবধি যেতো। কারণ প্রতিদিন যেতে যেতে ওটা তার একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছিলো। বিকচ তার ছোট্টো পত্রিকার পাতায় এতো সৈন্য মেরেছে, এতো ট্যাঙ্ক ছারখার করেছে, এতে কর্ণেল, ব্রিগেডিয়ার বন্দী করেছে, আগরতলার মানুষ তার মারণ ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে পাকিস্তানী সৈন্যদের যম টাইটেল দিয়েছে। এপ্রিলের শেষের বিষ্টিমুখর দিনটিতে, আধভেজা অবস্থায় অফিসে এসে দেয়ালে সাইকেলটি ঠেকিয়েই ঘোষণা দিয়ে বললো, এ বিষ্টিতে কোথাও যেতে টেতে পারবো না। ধ্যাননেত্রে আগে একটু দেখে নেই। বাংলাদেশে আবার নতুন কি ঘটলো। হাতের সিগারেটটি আমাকে দিয়ে বললো, ততোক্ষণে তুমি এটা টানতে থাকো। আমি একটু চোখ বুঝে দেখি সত্যি সত্যি কয়েক মিনিট চোখ বুজে রইলো। চোখ খুলে আমাকে জিগ্গেস করলো, সিগারেট কি সত্যি সত্যি শেষ করে ফেলেছে। আমি বললাম, তুমি সবটা পুড়িয়েই আমাকে দিয়েছিলে, একটান দিতেই সব শেষ। যাও দিপুকে দিয়ে মনার দোকান থেকে আমার নাম করে পাঁচটা চারমিনার আনতে বলো। সিগারেট এলে একটাতে অগ্নি সংযোগ করে লম্বা লম্বা কটা টান মেরে নিউজপ্রিন্টের প্যাডে পুরো খবরটা সে রচনা করেছিলো। বয়ান এ রকম : ফুলজান নামের এক যুবতী বুকে মাইন বেঁধে পাকিস্তানী সৈন্যের একটা আস্ত ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে দেখিয়ে বললো, দেখতে খবরটা কেমন হয়েছে। আমি বললাম, দ্যা আইডিয়া ইজ এ্যাণ্ড। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এরকম একটা বীরকন্যা জন্মাতে পারলে খুব ভালো হয়। বিকচ আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলেছিলো, আমরা যদি না লিখি তাহলে জন্মাবে কেমন করে। আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে। সে বাঁ চোখটা টিপে একটু হেসেছিলো। আমি বললাম, এ ক্ষেত্রে একটা সেকেণ্ড থট দিতে হবে।
যে কোনো সংবাদ কি, কেনো, কোথায়, কখন, কিভাবে এই এতোগুলো কেনোর জবাব দিতে না পারলে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। তোমার গল্প সেই শর্তগুলো পূরণ করেনি। ধরো নাম নির্বাচনের বিষয়টি, তুমি বলেছো ফুলজান। এই নামটি একেবারেই চলতে পারে না। বাঙালি মুসলমানের নাম সম্পর্কে তোমার ধারণা নেই। তাই ফুলজান শব্দটি তোমার কলমের মুখে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে ফুলজান যাদের নাম, তারা বড়োজোর হাঁড়ি পাতিল ঘষে, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ট্যাঙ্কের তলায় আত্মাহুতি দিতে পারে না। সুতরাং একটা যুৎসই নাম দাও, যাতে শুনলে মানুষের মনে একটা সম্ভ্রমের ভাব জাগবে। রওশন আরা নামটি মন্দ কি। বঙ্কিম এই নামটি বেছে নিয়েছিলেন। নামের তো একটি মাহাত্ম আছেই। রওশান আরা নাম যে মেয়ের, সে যেমন হৃদয়াবেগের আহবানে সাড়া দিয়ে জয়সিংদের ভালোবাসতে পারে; তেমনি দেশ জননীর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ট্যাঙ্কের তলায় আত্মাহুতিও দিতে পারে। নামটা মনে ধরেছিলো বিকচের। তারপর গল্পের নিয়মেই বাকি ব্যাপারগুলো বেরিয়ে এসেছিলো। তার বাড়ি নাটোর। তার বাবা পুলিশ অফিসার। সে ইডেনে পড়তো এবং শেখ মুজিবের আত্মীয়া ইত্যাদি। বিকচ যদি রওশন আরার বাবার মর্যাদা পায়, আমাকে কাকা টাকা কিছু একটা বলতেই হবে। সংবাদটি সামনের পাতায় বক্স করে ছাপা হয়েছিলো। আগরতলার মানুষ এটাকেও আরেকটা বিকীয় উদ্ভাবন ধরে নিয়েছিলেন। কেউ হ্যাঁচ্ছোটিও করেননি।