এই ফাঁকে হিরন্ময় মুখ খুললো। স্যার, আমি একটা গল্প শুনেছি। তবে গল্পটা খুব ভালো নয়। যদি বেয়াদবি না ধরেন বলতে পারি। বেয়াদবি ধরার কি আছে, বলে যাও। এই যুদ্ধ মান অপমান, ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায় সবকিছু বানের তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যে সকল মানুষকে দেশে থাকতে শ্রদ্ধা করতাম, কোলকাতায় তাদের অনেকের আচরণ দেখে সরল বাংলায় যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়- তাই হতে হচ্ছে। এখনো তোমরা স্যার ডাকছো, তার বদলে শালা বললেও অবাক হবার কিছু ছিলো না। অতএব বিনা সঙ্কোচে বলে যেতে পারো তোমার গল্প। ঠিক গল্প নয় স্যার। এখানকার একটা মন্ত্রী নাকি সোনাগাছিতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। চেনেন তো স্যার, সোনাগাছি কি জন্য বিখ্যাত। নরেশদা দাড়িতে আঙুল চালাতে চালাতে বললেন, এই নিরীহ মাস্টার অন্য কিছু বলতে না পারলেও সোনাগাছি কি জন্য বিখ্যাত সে কথা অবশ্যই বলতে পারে। কেননা না কোলকাতা আসার অনেক আগেই তাকে প্রেমেন্দ্র মিত্তিরের অনেকগুলো ছোটো গল্প পাঠ করতে হয়েছিলো। এবার তোমার গল্পটা শুরু করতে পারো। হিরন্ময়ও একটা সিগারেট জ্বালালো। তারপর একমুখ ধোয়া ছেড়ে বললো, পুলিশ অফিসারের জেরার মুখে ভদ্রলোককে কবুল করতে হলো, তিনি ভারতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের একজন মন্ত্রী। পুলিশ অফিসার তখন বললেন, তাহলে স্যারের গুডনেমটা বলতে হয়। মন্ত্রী বাহাদুর নিজের নাম প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ টেলিফোন করে দেখে যে বক্তব্য সঠিক। পুলিশ অফিসারটি দাঁতে জিব কেটে বললেন, স্যার, কেননা মিছিমিছি সোনাগাছির মতো খারাপ জায়গায় গিয়ে না হক ঝুট ঝামেলার মধ্যে পড়বেন। আর ভারত সরকারের আতিথেয়তার নিন্দে করবেন। আগে ভাগে আমাদের স্মরণ করলেই পারতেন, আমরা আপনাকে ভিআইপি-র উপযুক্ত জায়গায় পাঠিয়ে দিতাম।
নরেশদা বললেন, চারদিকে কতো কিছু ঘটছে নিজের চোখেই তো দেখতে পাচ্ছি। তবে এ কথাও মিথ্যে নয় যে এসব একেবারে অস্বাভাবিক নয়। আমরা তো সবাই প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এসেছি। নিজের প্রাণ ছাড়া আর কিছু যেখানে বাঁচাবার নেই, সেখানে এ ধরনের বিকৃতিগুলো আসবে, আসতে বাধ্য। চিন্তা করে দেখো জানুয়ারি থেকে পঁচিশে মার্চের আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের দিনগুলোর কথা। আর মানুষদের কথা চিন্তা করো। প্রাণপাতালের তাপে জেগে ওঠা সেই মানুষগুলো। একেকটা ব্যক্তি যেনো একেকটা ঝরোণা। আর আজ দেখো সেই মানুষদের অবস্থা। এই তোমার আসার একটু আগেই আমি বনগাঁ থেকে ফিরলাম। বাংলাদেশের মানুষ কি অবস্থার মধ্যে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করছে, নিজের চোখেই তো দেখে এলাম। ওপরের দিকে কিছু মানুষ কি করছে না করছে, সেটা এখন আমার কাছে কোনো ব্যাপারই নয়। শরণার্থী শিবিরগুলোতে কি অবর্ণনীয় কষ্ট এই বিজুলীর আলো জ্বলা কোলকাতা শহরে বসে কল্পনাও করতে পারবে না। প্রতিটি ক্যাম্পে প্রতিদিন বেশিরভাগ মারা যাচ্ছে শিশু এবং বৃদ্ধ। সকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। বনগাঁ থেকে শেয়ালদা প্রতিটি স্টেশনে তুমি দেখতে পাবে বাংলাদেশের মানুষ। খোলা প্লাটফর্মের তলায় কি চমৎকার সংসারই না পেতেছে তারা। পুরুষেরা সব বসে আছে নির্বিকার। তাদের চোখের দৃষ্টি মরে গেছে। চিন্তা করবার, ভাবনা করবার, স্বপ্ন দেখবার কিছু নেই। সকলেরই একমাত্র চিন্তা আজকের দিনটি কেমন করে কাটে। তাও কি সকলের কাটে। মরণ যখন কাউকে করুণা করে পরিবারের লোক ছাড়া অন্য কারো মনে রেখাপাত পর্যন্ত করে না। মৃতদেহ প্লাটফর্মের পাশে পড়ে থাকে, অথচ দেখতে পাবে পাশের পরিবারটি এলুমিনিয়ামের থালায় মরিচ দিয়ে বাসী ভাত খাচ্ছে। এমন অনুভূতিহীন মানুষের কথা আগে তুমি কল্পনা করতে পেরেছো? মেয়েগুলোকে দেখো। সকলের পরনে একেকখানি তেনা। চুলে জট বেঁধেছে। পুষ্টির অভাবে সারা শরীর কাঠি হয়ে গেছে। এদের মধ্যে এমনও অনেক আছে, জীবনে রেলগাড়ি দেখেছে কীনা সন্দেহ। এখন সাধ মিটিয়ে রেলগাড়ি চলাচলের পথের ধারে তাদের অচল জীবন কাটাচ্ছে। এ অবস্থা কেননা হলো? সবাই বলছে একটা সংগ্রাম চলছে। আমিও মেনে নেই। হ্যাঁ সংগ্রাম চলছে। কিন্তু আমার কথা হলো সংগ্রাম চলছে অথচ আমি বসে আছি। আমি তো দেশকে কম ভালবাসিনি। দেশের জন্য মরতে আমি ভয় পাইনে। কিন্তু লড়াই করে মরে যাওয়ার সুযোগটা নেই কেন? গলদটা কোথায় জানো আজহার, এই মানুষগুলো লড়াইর ময়দানে থাকলে সকলেরই করবার মতো কিছু না কিছু কাজ পাওয়া যেতো। দেশ যুদ্ধ করছে, কিন্তু যুদ্ধের ময়দান না দেখেই এদের দেশত্যাগ করতে হয়েছে। অচল জীবন্ত মানুষ এখানে এসে জড়পদার্থে পরিণত হচ্ছে। সেখানেই দুঃখ। নেতা এবং দল এসব মানুষের মনে স্বাধীনতার আকাক্ষার সৃষ্টি করলো। কিন্তু তাদের সংগ্রামের ক্ষেত্র রচনা করতে ব্যর্থ হলো। নেতা গেলো পাকিস্তানের কারাগারে। আর আমরা পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণের মুখে দেশ ছেড়ে চলে এলাম। সেখানেই আফসোস। নানা হতাশা এবং বেদনার মধ্যেও স্বীকার করি একটা যুদ্ধ হচ্ছে। একদিন না একদিন আমাদের মাটি থেকে পাকিস্তানী সৈন্যদের চলে যেতেই হবে। কিন্তু আমার তো বাবা এ তক্তপোষের ওপর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পিঠে বাত ধরে গেলো। নরেশদা এক নাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বলে থামলেন। কিছু মনে করো না বাবা, মাস্টার মানুষ। একবার বলতে আরম্ভ করলে আর থামতে পারিনে।