অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে দশ পনেরো মিনিটি আগে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যের (নামটা মনে আসছে না) উদ্বোধনী ভাষণটি শোনা হয়নি। আমরা যখন প্রবেশ করলাম রওশন আরা স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে কোলকাতার একজন গুণী শিল্পী একটি গান পরিবেশন করছিলেন। গানের কথাগুলো ভারী সুন্দর। ভদ্রলোক তন্ময় হয়ে গাইছিলেন।
শহীদ লক্ষ ভাই ভগিনী শহীদ রোশেনারা
তোমরা তো সব প্রাণের আগুন চোখের ধ্রুবতারা
রোশেনারা বোনটি আমার কোন্ গাঁয়ে যে ছিলো তোমার ঘর
সেথায় কি আজ বুটের তলে আকাশ বাতাস রৌদ্রজলে
ধু ধু করে পদ্মা নদীর চর।
শিল্পীর কণ্ঠে গানটি যেই শেষ হলো, এই বীরাঙ্গনা তরুণীর স্মৃতির প্রতি অপার সমবেদনায় উপস্থিত দর্শকদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। এই কল্পকন্যাটির প্রতি মমতায় আমার মনটাও মেদুর হয়ে উঠলো। গানের পর কোলকাতার সবচেয়ে খ্যাতিমান আবৃত্তিকার বিখ্যাত কবি এবং সমালোচক প্রমথনাথ বিশীর সুললিত ছন্দে লেখা একটি সুদীর্ঘ কবিতা আবৃতি করলেন। তারপরে একজন মাঝ বয়েসী মহিলা মঞ্চে এলেন। তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের কাছে রওশন আরা সম্পর্কিত এ পর্যন্ত যে সব সংবাদ তারা সংগ্রহ করতে পেরেছেন, তার একটা লিখিত বিবরণ পাঠ করলেন। রওশন আরার বাড়ি রাজশাহী জেলার নাটোর। তার বাবা পেশায় একজন পুলিশ অফিসার এবং সম্পর্কে সে ছিলো শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মীয়া। পড়াশোনা করতে ঢাকার ইডেন কলেজে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন পঁচিশে মার্চ তারিখে ঘুমন্ত ঢাকা নগরীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো, সে তখন নাটোরেই ছিলো। তারপর উত্তর বঙ্গে যখন প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়, রওশন আরা একক প্রচেষ্টায় একটি মহিলা ব্রিগেড গঠন করে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি কাজ করতে থাকে। এক রাতে ঘর্ঘর বিকট আওয়াজ শুনে রওশন আরার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে তার গুপ্ত আস্তানার মহিলা কর্মীদের জাগিয়ে তোলে। সর্বনাশ, বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা রাজশাহীর দিকে এগিয়ে আসছে। এখন যদি কোনো রকম বাধা না দেয়া যায়, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। প্রতিরোধ সংগ্রাম তছনছ হয়ে যাবে। পাকিস্তানী সৈন্যরা একজন মুক্তিসেনাকেও জীবিত থাকতে দেবে না। ট্যাঙ্কের গতি কিভাবে রোধ করা যায়। মহিলা ব্রিগেডের কর্মীরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। তারপর রওশন আরা এগিয়ে এসে সাথী মহিলাদের উদ্দেশ্যে বললো, পাকিস্তানী ট্যাঙ্কের গতি কি করে থামিয়ে দিতে হয়, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। মাথার ওড়নাটা খুলে নিয়ে ভালো করে বুকের সঙ্গে তিনটা মাইন শক্ত করে বেঁধে নিলো। সাথী মহিলারা অবাকদৃষ্টিতে রওশন আরার কার্যকলাপ দেখতে থাকে। কারো মুখে একটিও শব্দ নেই। প্রস্তুতি নেয়া শেষ হলে, তার প্রাণের বান্ধবি শিরিনকে জড়িয়ে ধরে বললো, শিরিন আমার মাকে বলিস। মুহূর্তের জন্য তার দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিলো। পরক্ষণেই সামনে গিয়ে এক মিনিট চুপ করে কি যেনো ভেবেছিলো। তারপর প্রাণপণ চিঙ্কারে জয়বাংলা ধ্বনি উচ্চারণ করে সারা শরীর ট্যাঙ্কের তলায় ছুঁড়ে দিয়েছিলো।
এটুকু পর্যন্ত পাঠ করার পর হলের মধ্যে আহা উঁহু আফশোস ধ্বনি শোনা যেতে থাকলো। কোনো কোনো মহিলা উচ্চৈস্বরে রোদন করে উঠলেন। শোকের মাতম থিতিয়ে আসতে কমসেকম পাঁচ মিনিট সময় লেগে গেলো। যিনি পাঠ করছিলেন, ধৈর্য ধরে সে সময়টুকু অপেক্ষা করলেন। ধীরে ধীরে হল শান্ত হয়ে এলে মহিলা জানালেন, সে রাত্রে রওশন আরা একটি ট্যাঙ্ক পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছিলো। ট্যাঙ্কে যে তিনজন পাকিস্তানী সৈন্য ছিলো প্রচণ্ড বিস্ফোরণে তাদের শরীর টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিলো। প্রতিবেদন পাঠিকা ভদ্রমহিলা একেবারে শেষ পর্যায়ে জানালেন, রওশন আরার ছিন্নবিছিন্ন শালোয়ার কামিজের রক্তরঞ্জিত অংশগুলো উদ্ধার করে মহিলা ব্রিগ্রেড তাদের পতাকা বানিয়েছে। বিদায় নেয়ার আগে মহিলা ডান হাতের মুঠি উর্ধে তুলে উচ্চারণ করলেন, জয়বাংলা। সমবেত শ্ৰোতৃমণ্ডলীর মধ্যে জয়বাংলা, জয়বাংলা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো।
তারপর এলেন আরেক মহিলা। তিনি এপর্যন্ত ভারতবর্ষের নারী সমাজ রওশন আরার আত্মদানে উদ্বুদ্ধ হয়ে কি কি কর্মসূচী গ্রহণ করেছে, তার একটা আনুষ্ঠানিক বিবরণ দাখিল করলেন। দিল্লীতে শ্রীমতি অরুণা আসফ আলির নেতৃত্বে একটি রওশন আরা ব্রিগেড গঠিত হয়েছে। তাঁরা পায়ে হেঁটে আগ্রা অবধি মার্চ করে গেছেন এবং বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা সগ্রহ করেছেন। পাটনায় রওশন আরা ব্রিগেডের কর্মীরা নিজের হাতে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আড়াই হাজার উলের সুয়েটার বুনে দিয়েছে। এইভাবে এলাহবাদ, বেনারস, জলন্ধর, অমৃতসর, মাদ্রাজ, দিল্লী রওশন আরা ব্রিগেডের কর্মীদের বিস্তারিত কর্মসূচীর বর্ণনা দিলেন। খোদ কোলকাতা শহরে রওশন আরার নামে একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বুঝলাম, রওশন আরা নামটি সমগ্র ভারতে, বিশেষ করে ভারতীয় নারী সমাজে উদ্দীপনার একটি শিখা হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠেছে। যে মেয়ে নিজের দেশের স্বাধীনতার জন্য স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বুকে মাইন বেঁধে ট্যাঙ্কের তলায় আত্মাহুতি দিয়ে দুনিয়ার নারী সমাজে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে, তার নামে কিছু করতে পারাটা নারী জন্মের এক বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার, একথা কে অস্বীকার করবে।