আমি রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে থাকলাম, এখন আমার কি করা উচিত। এই অবস্থায় আমি কি করবো, কোথায় যেতে পারি। সমস্ত ভাবনা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো। সমস্ত চেতনায় ঘন্টারোলে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো। আজ তায়েবার মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেছে। কিন্তু কখন কার্যকর হবে তারিখটি আমি জানিনে। একজন মহিলা এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন। আধো আধো অন্ধকারে ঠিক চিনতে পারলাম না কে হতে পারে। গলার আওয়াজ শুনে বুঝলাম অর্চনা। তাকে কোনো জবাব দেবার আগে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, অর্চনা এখানে কেনো? সে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো এবং বললো, দানিয়েল, তোমার হয়েছে কি? একটু আগে তুমি গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে। আর তায়েবাদির এখানেও তুমি তিনদিন আসোনি। তোমাকে এমন উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে কেনো? আমি স্বগতোক্তির মতো করে বললাম, অর্চনা, তায়েবার মৃত্যুদণ্ড হয়ে যাচ্ছে, আমরা কোনদিন কার্যকর হবে তারিখটি জানিনে। কি সব অলক্ষুণে কথা বলছো? তোমার মাথার কোনো ঠিক নেই। আমি বললাম, জানো অর্চনা, আমাকে ডঃ মাইতি বাড়িতে ডেকে নিয়ে সব বলেছেন। কি বলেছেন? বলেছেন কোনো আশা নেই। এখন শুধু খাঁচা ছেড়ে পাখির উড়াল দেয়া বাকি। অর্চনা বললো, দানিয়েল, এই সময়ে তোমার মাথা ঠাণ্ডা রাখা খুবই প্রয়োজন। তায়েবাদির মা খুবই ভেঙ্গে পড়েছেন। আমার তো ভয় হচ্ছে মহিলা কেমন জানি হয়ে গেছেন। যেখানে বসেন বসে থাকেন, ওঠার কথা ভুলে যান। কারো সঙ্গে বিশেষ কথা বলেন না। এই তিনদিন জল ছাড়া কিছুই মুখে দেননি। আমি জিগ্গেস করলাম, এসব তুমি জানলে কেমন করে? দানিয়েল, তুমি বোকার মতো কথা বলছে। এই তিনদিন আমি দু’বেলা তায়েবাদিকে দেখতে এসেছি। যখন বাড়াবাড়িটা শুরু হলো সকলে তো ভয়েই অস্থির। ভাগ্যিস মনীষদা কোলকাতায় ছিলেন। পিজি-র ডিরেক্টর। তিনি দাদার বন্ধু এবং এক সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। তাকে ধরে কোনো রকমে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নিয়ে যাবার সুযোগটা পাওয়া গিয়েছিলো। আপাততঃ তায়েবাদি বিপদমুক্ত। কিন্তু এটা স্থায়ী কিছু না। লুকোছাপা করে তো লাভ নেই। ক্যান্সারের রোগীর শেষ পরিণতি তোমারও তো অজানা থাকার কথা নয়। আরেকটা দরকারি কথা বলি মনে রাখবে। সবাইকে বলতে শুনলাম, তোমাকে দেখলে তায়েবাদি ভয়ঙ্কর আপসেট হয়ে পড়েন। সুতরাং তুমি হুট করে কেবিনে ঢুকে পড়ার আগে একটু খোঁজ খবর নিয়ো।
অর্চনার কথা শুনে হাজার দুঃখের মধ্যেও আমার কৌতুকবোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। আমি যে ভাবতে চেষ্টা করেছিলাম, তায়েবার এই মৃত্যুর জন্য আমি একাই দায়ী। সকলে এই কথাটি বুঝে গিয়ে আমাকে সঠিক শনাক্ত করে ফেলেছে। আমি হো হো করে হেসে উঠতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। অর্চনা বললো, তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? আমি বললাম, পাগল হয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। আর রাখো তোমার যত্তোসব…। আমি বললাম, অর্চনা এটা একটা চমৎকার নাটক, আমরা সকলে মিলে ঘটিয়ে তুলেছি। এখন শেষ অঙ্কে কি ঘটে দেখার জন্য উৎকণ্ঠিত আগ্রহে সকলে প্রতীক্ষা করছি। কিন্তু আমি তোমাকে একটা সহজ কথা জিগগেস করবো। জবাব দেবে? বলো তোমার সহজ কথাটা, যদি জানা থাকে জবাব দেবো। আমি বললাম, আমি দেখতে পাচ্ছি এই নাটকে তুমিও একটা চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা কি করে সম্ভব হলো আমাকে বুঝিয়ে বলবে? দানিয়েল, আসলে তুমি একটা সিনিক। সব ব্যাপারে ঠাট্টা করার স্বভাবটি তোমার মজ্জাগত। ঠিক বলেছো অর্চনা, ওই সিনিসিজমটা এখনো আমার মধ্যে আছে বলেই হাঁটাচলা করতে পারছি। কিন্তু সেটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়। তখন অর্চনা বললো, তুমি সত্যি একটা অদ্ভুত মানুষ। তবু তোমার একটা গভীর অন্তর্দৃষ্টি আছে, সেকথা আমি অস্বীকার করবো না। তোমার আর তায়েবাদির সম্পর্কের একটি ইন্টারেস্টিং দিক আছে। সেটাই আমাকে ভীষণ কৌতূহলী করে তুলেছিলো গোড়ার দিকে। তুমি যখন কোনো কিছু গম্ভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকো, কখন জানো না নিজেই সে জিনিসটির অংশ হয়ে গেছে। এই ব্যাপারটা অল্প বিস্তর আমার ক্ষেত্রেও ঘটে যাচ্ছে। এমনিতে আমি রোগী টোগী দেখতে পারিনে। কিন্তু তায়েবাদির মধ্যে আমি অন্যরকম একটা কিছু দেখেছিলাম, যা সচরাচর দেখা যায় না। সেটাই আমাকে টেনেছিলো। তুমি যাই। বলো দানিয়েল, তায়েবাদি একটা অসাধারণ মেয়ে। এমন আশ্চর্য হৃদয়ের মহিলা জীবনে আর একটিও দেখিনি। তায়েবাদিকে দেখলে ভালোবাসতে হয়, শ্রদ্ধা করতে হয়। আমি বললাম, অর্চনা সেসব কথা থাকুক। আমি এসব আর সহ্য করতে পারছিনে, তুমি আমাকে কোথাও নিয়ে যাবে? সে এক মুহূর্ত কি চিন্তা করলো। তারপর ঘড়ি দেখলো। তুমি একথা বলে খুবই ভালো করেছে। আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম। আজকে মহানগর নারী সংঘ রবীন্দ্রসদনে তোমাদের ঢাকার বীরাঙ্গনা শহীদ রওশন আরার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রওশনআরা রজনী উদযাপন করছে। আমার মেজদি মহানগর নারী সংঘের একজন নেত্রী। তিনি আমাকে দু’খানা টিকেট দিয়েছিলেন। সেগুলো ব্যাগের মধ্যেই পড়ে আছে। এখন মাত্র সাড়ে আটটা বাজে। অনুষ্ঠান নিশ্চয়ই সাড়ে দশটা পর্যন্ত চলবে। চলো ওইতো রবীন্দ্রসদন। বড়োজোর পাঁচ মিনিট। আমি ক্লান্ত ছিলাম, কথা বলার প্রবৃত্তি হলো না। অর্চনার পেছন পেছন রবীন্দ্রসদনে এসে হাজির হলাম।