আমরা হাসপাতালে ফিরে এলাম। এসে দেখি সে মহানিম গাছটির গোড়ায় কেউ নেই। আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম, ওরা সব গেলো কোথায়। এই যে দানিয়েল সাহেব এইদিকে আসুন। লাল কংক্রিট বিছানো পথ বেয়ে উঃ মাইতি হাসপাতালের গেটের দিকে যাচ্ছেন। আমি পায়ে পায়ে তাঁর কাছে গেলাম। তিনি বললেন, চলুন, আপনাকে খুঁজছিলাম। আমি ডঃ মাইতির পেছন পেছন তাঁর কোয়াটারে গেলাম। তিনি ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর স্টেথিসকোপ রাখলেন। তারপর বললেন, দানিয়েল সাহেব বসুন, আজকে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলি। তিন চারদিন থেকে আপনার দেখা নেই। আমি তাঁর উল্টোদিকের সোফায় গিয়ে বসলাম। তিনি বললেন, দিন দেখি আপনার একটা চারমিনার। আপনার সঙ্গে দেখা হলেই আমার সিগারেটের নেশা চেপে যায়। আমি প্যাকেটটা বের করে দিলাম। তিনি একটা ধরিয়ে খকখক কাশলেন এবং গলগল করে ধোয়া ছাড়লেন। তারপর, বলুন আপনাদের যুদ্ধের সংবাদ। সহসা ডঃ মাইতির কথার কোনো জবাব দিতে পারলাম না। তাই ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি বললেন, আপনাদের যুদ্ধের সংবাদ আমার কাছ থেকে শুনুন। আপনারা খুব শিগগির দেশে চলে যাবেন এবং আপনাদের দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে। এখন বলুন, আপনার আনন্দ হচ্ছে কিনা। আমি বললাম, আমাদের দেশ স্বাধীন হবে এবং আমরা দেশে ফিরে যাবো। তিনি বললেন, এটাই তো আপনারা চেয়েছিলেন। আমার মনে হচ্ছিলো, ডঃ মাইতি অন্য কিছু একটা বলতে চান, যুদ্ধ সংক্রান্ত কথাগুলো ভনিতা মাত্র। আমার মনে হচ্ছিলো তিনি আমাকে অত্যন্ত কঠিন, অত্যন্ত দুঃখের কোনো কিছু হয়তো বলবেন। আমার বর্তমান যা মানসিক অবস্থা কেউ যদি বলে আগামীকাল সূর্য নিভে যাবে বোধ হয় কোনো ভাবান্তর ঘটবে না। আমি মনে মনে বিরক্তি অনুভব করছিলাম। ডঃ মাইতি আমাকে আসল কথাটি না বলে ধানাই পানাই করেন কেন। আমি জিগগেস করলাম, আপনি তায়েবার ব্যাপারে কিছু বলবেন? ইনটেনসিভ কেয়ারে সে কেমন আছে? ডঃ মাইতি টেবিল থেকে পেপার ওয়েটটি উঠিয়ে নিয়ে ঘুরাতে থাকলেন এবং প্রায় পাঁচ মিনিট তাই করে গেলেন। তারপর টেবিলের ওপর রেখে সরাসরি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিগগেস করলেন, কোনো মূল্যবান জিনিস পেতে হলে দাম দিতে হয়, একথা আপনি বিশ্বাস করেন? আমি বললাম, অবশ্যই বিশ্বাস করি। সুতরাং আপনাকেও দাম দিতে হবে, মনে মনে প্রস্তুত হোন। আমি বললাম, একটু বুঝিয়ে বলুন, আমি এমন কি মূল্যবান বস্তু পেতে যাচ্ছি, যার জন্য দাম দিতে আগেভাগে প্রস্তুত হতে হবে। ডঃ মাইতি বললেন, ওই যে বললাম, আপনারা স্বাধীনতা পেতে যাচ্ছেন। আমি জবাব দিলাম, আমরা কি দাম দেইনি? তিনি বললেন, আপনার দেশের মানুষ দাম দিয়েছে, আপনি এখনো কোনো দাম দেননি। শুধু কোলকাতা এসেছেন। আপনার কোনো পার্সোনাল কন্ট্রিবিউশনের কোটা শূণ্য। এইবার ঈশ্বর আপনাকে সে লজ্জা, সে অপমান থেকে উদ্ধার করতে যাচ্ছেন।
ডঃ মাইতির কথায় আমি চমকে উঠলাম। না না ডঃ মাইতি অমন করে বলবেন । আপনি অনুগ্রহ করে তায়েবা কেমন আছে সেটা বলুন। অতো উতলা হচ্ছেন কেন? আপনাকে তায়েবার কথা বলার জন্যই তো ডেকে এনেছি। একটু আগে ওয়ার্ডে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সেই ব্রিদিং ট্রাবলটা এখন অনেক কন্ট্রোলড কিন্তু এটা স্থায়ী হবে না। এ্যাট এ্যনি মোমেন্ট শি ক্যান গেট ব্যাক টু হার প্রিভিয়াস পজিশন। ইউ আর এ সিরিয়াস পার্সন এ্যৎ আই ওয়ান্ট টু টক টু ইউ সিরিয়াসলি । বাট উই প্রে টু লর্ড সো দ্যাট হি গ্রান্টস হার লংজিবিটি টিল দ্যা ফ্রিডম অব বাংলাদেশ ইজ এ্যাচিবড। ডঃ মাইতি উঠে দাঁড়ালেন। আপনাকে চা দিতে বলি। আমি কাপড় ছাড়ি। আমি বললাম, ডঃ মাইতি এখন চায়ের ঝামেলা করে লাভ নেই। আমি যাই। অলরাইট আসুন, কিন্তু তিনি সাবধান করে দিলেন, বাট ইউ শুড নট ভিজিট হার টু ফ্রিকোয়েন্টলি। আপনার সঙ্গে তার সম্পর্কটা খুব ইমোশনাল। শি নীডস কমপ্লিট রেস্ট এ্যণ্ড ফুল ট্রাঙ্কুয়িলিটি। সো টেক কেয়ার। এট দিজ স্টেজ ইউ আর এ লায়াবলিটি টু হার।
ডঃ মাইতির কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে, আসার সময় আমি এরই মধ্যে নিজে কতোটুকু বদলে যাচ্ছি সে কথা চিন্তা করে দেখলাম। তার মুখে তায়েবার মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেছে সে সংবাদটি শুনেছি। এতো বড়ো একটা দুসংবাদ শোনার পরও আমার মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না। আমি দিব্যি হাঁটাচলা করতে পারছি। ঠাণ্ডা মাথায় সব কিছু সামাল দিতে পারছি। আমার মানসিক ধৈর্য দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। এই যুদ্ধ তলায় তলায় আমাকে কতোটুকু বদলে দিয়েছে। সেই নিভৃত পথটুকু অতিক্রম করার সময় আমার চেতনায় ঘন্টা ধ্বনির মতো বাজতে থাকলো, তায়েবার মৃত্যদণ্ড তো ঘোষণা হয়ে গেছে। কিন্তু চূড়ান্ত ঘটনাটি কখন ঘটবে সেই তারিখটা জানায়নি। আমার মন বললো, ওয়েল ইট ক্যান হ্যাপেন এ্যট এ্যনি মোমেন্ট। নিশীথে পাওয়া মানুষের মতো আমি সেই নির্জন পারিবারিক রাস্তাটুকু অতিক্রম করে কখন বড়ো রাস্তায় এসে পড়েছি খেয়াল করতে পারিনি। আমার পেছনে হঠাৎ ঘটাং করে একখানা গাড়ি ব্রেক করলো। ট্যাক্সি থেকে শিখ ড্রাইভার নেমে এসে দু’টি সবল লোমশ হাতে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে বলতে গেলে একেবারে রাস্তার ওপর ছুঁড়ে দিলো। তারপর গালাগালি দিতে থাকলো, শালে লোক মরনেকা আওর কুয়ি মওকা নেহি মিলা। আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। বড়ো বড়ো চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সর্দারজি তার হাতের একটা প্রবল থাবা আমার কাঁধে বসিয়ে পুনরায় গাড়ি স্টার্ট করে চলে গেলো। গাড়িটি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর আমার চেতনা হলো, আমি এই গাড়ির তলায় চাপা পড়তে যাচ্ছিলাম। সর্দারজির কৃপায় এযাত্রা বেঁচে গেছি। সাক্ষাৎ মৃত্যুকে এড়িয়ে আসার পরও আমার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে পারলাম না।