ভারত পাকিস্তানে সাজো সাজো রব চলছে। বাংলাদেশ ভারতের নৌকোয় পা রেখেছে। সুতরাং ভারত যা করে বাংলাদেশকে অম্লানবদনে মেনে নিতে হবে। তারপরেও ভারতের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার জন্য, বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত একটি যুদ্ধ। ঘাড়ে তুলে নিচ্ছে। ভারতের স্বার্থ থাকে থাকুক। কিন্তু আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই এবং মাতৃভূমিকে স্বাধীন দেখতে চাই। তারপরেও একটা প্রশ্ন যখন মন কুঁড়ে জেগে উঠে, নিজের কাছেই নিজে বেসামাল হয়ে পড়ি। বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উনিশশো আটচল্লিশ থেকেই সগ্রাম করে আসছে। আসন্ন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধটিই কি বাঙালি জাতির বিগত বাইশ বছরের রক্তাক্ত সংগ্রামের একমাত্র ফলাফল। এই যুদ্ধে হয়তো ভারত জয়লাভ করবে এবং ভারতের সহযোগিতায় আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হবো। আমাদের জাতীয় সংগ্রামের এই পরিণতি। এটাই কি আমরা চেয়েছিলাম? কি জানি, ইতিহাস কোন্ দিকে মোড় নিচ্ছে। আমাদের বাবারা পাকিস্তান তৈরি করেছিলেন, আর আমরা পাকিস্তান ভাঙছি। এই যুদ্ধ সংঘাত রক্তপাতের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় ইতিহাস কোন্ ভবিষ্যতের পানে পাড়ি দিচ্ছে? কে জানে!
১৩-১৪. হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম
মাঝখানে তিনদিন হাসপাতালে যেতে পারিনি। ভেতর বাইরের চাপে এক রকম হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। চারদিনের দিন হাসপাতালে যেয়ে যা শুনলাম তাতে আমি তো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। এই তিনদিনে তায়েবার অসুখ বাড়াবাড়ি রকমের বেড়ে গিয়েছিলো। পরশুদিন তাকে ইনটেনসিভ কেয়ারে নিয়ে যেতে হয়েছে। ডাক্তারেরা কাউকে দেখা করতে দিচ্ছে না। হাসপাতালের সামনে সেই মহানিম গাছের চারপাশের বাঁধানো গোলাকার চক্রটিতে সবাই বসে আছে। জাহিদুল, ডোরা, দোলা, হেনা ভাই আরো দুচারজন আত্মীয়স্বজন। দূরে একাকী মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন তায়েবার মা। এই বর্ষীয়সী মহিলাকে এইভাবে ভিড় থেকে দূরে একেবারে একাকী বজ্রাহত তরুর মতো বসে থাকতে দেখে আমার বুকটা আশংকায় ধুকপুক করে উঠলো। আমি পায়ে পায়ে তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মহিলা আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন। তাঁর চোখের কোণায় অক্ষরেখা। আঁচলে মুছে নিয়ে বললেন, এই তিনদিনে তুমি একবারও হাসপাতালে আসোনি। তোমার কি জ্বরজারি কিছু একটা হয়েছিলো? আমি না বলতে যেয়েও পারলাম না। আমার অসুখ বিসুখ হয়নি। অথচ আমি আসিনি, জানলে মহিলা ব্যথিত হবেন। তাই বললাম, আমার জ্বর হয়েছিলো। মহিলা কিছু বললেন না। আমি তার পায়ের কাছে ঘাসের ওপর বসলাম।
একটু একটু শীত করছিলো। হাসপাতালের লোকজন কমে আসতে শুরু করেছে। সন্ধ্যেবেলা আলো জ্বলে উঠেছে। আমরা বাইরে বসে আছি, কি করবো জানিনে। সমস্ত পরিবেশটাই কেমন ভূতুরে হয়ে দাঁড়িয়েছে। তায়েবাকে ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা হয়েছে। সকলেই জেনে গেছে তার আর বেশি সময় নেই। আমি দু’হাতে মাথা ঢেকে তায়েবার এই পরিণতির জন্য কে দায়ী চিন্তা করতে চেষ্টা করলাম। তায়েবার এই অকাল মৃত্যুর জন্য আমি জাহিদুলকে মনে মনে দায়ী করলাম। পরক্ষণে ভাবলাম, জাহিদুল দায়ী হতে যাবেন কেন? জাহিদুলের দোষ কি? জাহিদুল ডোরাকে বিয়ে করেছেন বলে তায়েবাকে মরতে হবে এটা কেমন করে হয়। তাহলে ভোরাই কি দায়ী? বিচার করে দেখলাম, ডোরারই বা কসুর কি? সে তো কাউকে না কাউকে বিয়ে করতোই। জাহিদুলকে বিয়ে করে অন্যায়টা কি করেছে। তার ফলে তায়েবা মরতে যাবে কেন? হেনা বিয়ে করে অন্যায়টা কি করেছে। তার ফলে তায়েবা মরতে যাবে কেনো? হেনা ভাই তায়েবার খোঁজ খবর না নিয়ে নিজে একটা বিয়ে করেছেন বলেই কি তায়েবা মরতে বসেছে? হেনা ভাই বিয়েটা না করলে বেঁচে থাকতো তার নিশ্চয়তা কি? তাহলে তায়েবার মা-ই তার মৃত্যুর কারণ? খুব খুঁটিয়ে চিন্তা করার পর একটা জিনিস আবিষ্কার করলাম, মহিলা তায়েবার ঘাড়ে অত্যধিক দায়িত্বের বোঝা চাপিয়েছিলেন, তাই বলে কি তায়েবাকে মরতে হবে? তাহলে দায়ী কে? তায়েবা কোলকাতা এসেছিলো, তাই কি তাকে মরতে হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু না হলে তাকে কোলকাতা আসতে হতো না। এই স্বাধীনতা সংগ্রামই কি তায়েবার মৃত্যু ঘটাতে যাচ্ছে। আমি স্বাধীনতা সংগ্রামকেও বা কেমন করে দায়ী করি। তাহলে তায়েবার মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? তায়েবার মৃত্যু জন্য কেউ না কেউ একজন তো দায়ী হবে। কাউকে দায়ী না করে আমার মন শান্তি পাচ্ছিলো না। তখনই মনে পড়ে গেলো তায়েবা নিজের মুখে। বলেছে, সে আমাকে ভালোবাসে, তাহলে কি আমিই কি তায়েবার মৃত্যুর জন্য দায়ী?
হাসপাতালের সামনের রাস্তায় হঠাৎ আওয়াজ শুনে সচকিত হয়ে তাকালাম। চারজন মানুষ একখানি খাঁটিয়ায় করে একটা সাদা চাঁদরে ঢাকা মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সকলে একসঙ্গে হরিবোল বলে চিৎকার করছে। এই দৃশ্যটা দেখে আমার মধ্যে একটা দার্শনিক নির্লিপ্ততা জন্ম নিলো। মানুষের জন্ম মৃত্যুর রহস্যটা আমার চোখে পরিষ্কার হয়ে ধরা দিলো। মৃত্যু সর্বব্যাপী ওঁত পেতে রয়েছে। কেউ কারো জন্য দায়ী নয়। আমি পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিলাম, হেনা ভাই এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। তারপর ডাকলেন, দানিয়েল এদিকে এসো। তিনি আমাকে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে গিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসালেন। বললেন, চা খাও। কাপে যেই চুমুক দিয়েছি, হেনা ভাই বললেন, দেখি তোমার একটা চারমিনার দাও। সিগারেটটা ধরিয়ে বললেন, শোনো দানিয়েল আজ তোমাকে একটা কথা বলবো। আমি বললাম, বলুন। তিনি বললেন, শোনো তিনদিন তুমি হাসপাতালে আসোনি। এই তিনদিন তায়েবার কি কষ্ট হয়েছে সে আমি বলতে পারবো না। গত পরশুদিন রাতে সে তিনবার জ্ঞান হারিয়েছিলো। প্রতিবারই জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পরে তোমার কথা জিগগেস করেছে। তুমি বোধ হয় এরই মধ্যে জেনে গেছো আমার বোনটি বাঁচবে না। তোমাকে যে কথাটি আমি বলার জন্য ডেকেছি, তিনি একটুখানি ইতস্তত করলেন। হাতের পোড়া সিগারেটটি ফেলে দিয়ে আমার কাছ থেকে আরেকটি সিগারেট চেয়ে নিয়ে ধরালেন। তারপর আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে কোনো গোপন কথা বলছেন এমন ভঙ্গিতে ফিস ফিস করে বললেন, আমার বোনটি তোমাকে খুবই ভালোবাসে। আমার কাঁধে হাত রাখলেন, ভাবতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। সে আর বাঁচবে না। তাঁর চোখের কোণে অশ্রু চিক চিক করে উঠলো। আমি কোনো কথাই বলতে পারলাম না।