হঠাৎ করে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের মধ্যে একটা গতির সঞ্চার হলো। কথাটা বোধ হয় সঠিক বললাম না। ভারত পাকিস্তান সম্পর্কের একটা নতুন মোড় নিলো। ভারতের দূত ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া ইত্যাদি দেশে ছুটাছুটি করতে আরম্ভ করলো। পাকিস্তানও বসে নেই। ইয়াহিয়ার প্রতিনিধি ইউরোপীয় দেশগুলোতে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে এবং পাকিস্তানের অবস্থান সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ নয়াদিল্লীতে ঘন ঘন যাওয়া আসা করছেন। বৈঠক করছেন। পত্রপত্রিকায় সে সকল সংবাদ ছাপা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বোধ করি মনস্থির করে ফেলেছেন, তাকে একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে। তার কথাবার্তা, বিবৃতি ভাষণের মধ্যে একটা উদ্দেশ্য পরিষ্কার ফুটে উঠছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের বেগও তীব্র হয়ে উঠেছে। কোলকাতার পত্রপত্রিকাগুলো খবর দিতে আরম্ভ করেছে, মুক্তিযোদ্ধারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে। পাউরুটির ভেতর ছুরির মতো পাকিস্তানী সৈন্যের বেষ্টনী ভেদ করে তারা দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে। পাকিস্তান রেডিও একথা স্বীকার করে নিয়েছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ানরা ছদ্মবেশে পূর্বপাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করে নাশকতামূলক কাজকর্ম করে পালিয়ে যাচ্ছে। বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকাও বলতে আরম্ভ করেছে, মুক্তিযোদ্ধারা সত্যি সত্যি দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে এখানে সেখানে অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে। আইয়ুব খানের সময়ের গভর্ণর আবদুল মোনায়েম খানকে মুক্তিযোদ্ধারা বাড়িতে ঢুকে গ্রেনেড ছুঁড়ে হত্যা করেছে। ভেড়ামারা, কুষ্টিয়া, রংপুর, টাঙ্গাইল, খুলনা, বরিশাল এসকল অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম তীব্রতরো হয়ে উঠেছে। টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণের মুখে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী পিছু হটে এসেছে। বিবিসি-র সংবাদদাতা আরো খবর দিয়েছে পাকিস্তানী সৈন্য ভর্তি লরীগুলো দিনে রাতে সীমান্ত অভিমুখে ছুটছে। সৈন্যরা সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় বাঙ্কার নির্মাণ করছে এবং ট্র্যান্স কাটছে।
এরই মধ্যে একদিন শ্রীমতী গান্ধী সোভিয়েত রাশিয়া সফরে গেলেন। ভারত এবং রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা অনেক বেড়ে গেছে সেটা আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিলো। রাশিয়ার কথাবার্তার মধ্যেও ভিন্ন একটা সুর লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো। বাংলাদেশের ব্যাপারে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন এবং প্রেসিডেন্ট পদগর্নি সব সময়ে ইয়াহিয়া খানকে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার অনুরোধ করে আসছিলেন। কিন্তু শ্ৰীমতী গান্ধীর রাশিয়া সফরের পর থেকে রাশিয়ান নেতাদের বক্তব্যের ধরণও বেশ পাল্টে গেলো। ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে একটা বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে। দুই দেশের যে যুক্ত ইস্তেহার প্রকাশিত হয়েছে তাতে প্রথমবারের মতো পূর্বপাকিস্তানের বদলে পূর্ববাংলা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
রাশিয়া থেকে শ্রীমতী গান্ধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলেন। যুক্তরাষ্ট্রে নিক্সনের সঙ্গে দেখা করলেন, বিশেষ সুবিধে করতে পেরেছেন বলে মনে হলো না। নিক্সন প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো রকম ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে শ্রীমতী গান্ধী মার্কিন জনমতকে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করলেন। নানা জায়গায় বক্তৃতা দিলেন। পত্রপত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিলেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এসে তিনি পশ্চিম জার্মানি সফর করলেন। তারপর ফ্রান্স এবং সবশেষে ইংল্যাণ্ড। রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব চুক্তির পরও শ্রীমতী পশ্চিম ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন কেন বুদ্ধিমান মানুষের কাছে তার কারণ অস্পষ্ট রইলো না। ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি করে পশ্চিমা দেশগুলোর স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কিছু করতে যাচ্ছেন না সে আশ্বাসটা ওসকল দেশের সরকার এবং জনগণের সামনে তুলে ধরাই ছিলো তার উদ্দেশ্য।
পাকিস্তানও বসে নেই। ইয়াহিয়া খান চীন মার্কিন সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে দূতিয়ালী করছেন। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে হেনরী কিসিঞ্জার গোপনে উড়ে বেইজিং-এ পৌঁছেছেন। সেখানে চৌ এন লাই এবং মাও সেতুংয়ের সঙ্গে চীন-মার্কিন সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের বিষয়টি পাকাপাকি করে ফেলেছেন। ইয়াহিয়া খান ধরে নিয়েছেন চীন মার্কিন সম্পর্কোন্নয়নে ইয়াহিয়া খান যেহেতু মধ্যস্থের ভূমিকা পালন করেছেন, তাই পাকিস্তানের বিপদের দিনে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং পররাষ্ট্র সচিব হেনরী কিসিঞ্জার বরাবর পাকিস্তানী অবস্থানের পক্ষেই কথা বলে আসছিলেন। আর চীন তো খোলাখুলি ভারতকে আক্রমণকারী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে অনেকদিন থেকেই ধমক দিয়ে আসছে। তবে একটা মজার ব্যাপার চীনা ড্রাগন শুধু লম্ফ ঝম্ফ করে, গর্জন করে, কিন্তু সরাসরি কামড় দিতে ছুটে আসে না।
ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী খান ভূট্টো সাহেবের নেতৃত্বে চীনে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছেন। চীনা নেতারা ভোজসভায় অনেক ভালো ভালো কথা বলেছেন। খোদ চৌ এন লাই আশ্বাস দিয়েছেন পাকিস্তান যদি ভারত কর্তৃক আক্রান্ত হয় চীন পাশে এসে দাঁড়াবে। ভূট্টো সাহেব দেশে ফিরে এসে সাংবাদিকদের বলেছেন তাঁর চীন সফর শতকরা একশো ভাগ ফলপ্রসু হয়েছে।