মাঝখানে পরিস্থিতি একেবারে থিতিয়ে গিয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশ নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। এভাবেই সব কিছু চলতে থাকবে। যেখানেই যাই, সর্বত্র থমথমে পরিবেশ, কি ঘটবে, কি ঘটতে যাচ্ছে কেউ কিছু বলতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে যতোই হতাশা বাড়ছে, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং দলাদলি ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ওর বিরুদ্ধে বলছে, অমুক অমুকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। কোলকাতার মানুষেরা আমাদের ওপর বিরক্ত হয়ে উঠছে। আর কতত। বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, পার্কে, মাঠে, ময়দানে সর্বত্র জয়বাংলার মানুষ দেখে দেখে তাদের চোখ পচে গেছে। আমরা আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে ভীষণ সংকুচিত হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছি। মানবিক মর্যাদা বোধটুকুও আস্তে আস্তে আমাদের লোপ পেতে বসেছে। লোহালক্কর ফেলে রাখলে যেমন মরচে ধরে, আমাদের মধ্যেও তেমনি স্তরে স্তরে হতাশা জমে ক্রমাগত অমানুষ হয়ে উঠছি। আমরা বৌ বাজারের হোস্টেলটিতে আট দশজন মানুষ থাকি। যখন এসেছিলাম সকলের মধ্যে প্রাণখোলা সম্পর্ক ছিলো। যতোই দিন যাচ্ছে আমরা আর স্বাভাবিক থাকতে পারছিনে। তুচ্ছ সিগারেট নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝগড়া বাধে। বালিশ, বিছানা, মশারি নিয়ে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। আমরাও দুতিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের এসব খুনসুটি দেখে হোস্টেলের ছাত্রেরা হাসে। প্রকাশ্যে খারাপ মন্তব্য করতেও কেউ ছাড়ে না। অথচ আমরা যখন অভুক্ত অবস্থায় মুখে সাত পাঁচ দিনের আকামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে এসেছিলাম, সকলে আমাদের বীরের সম্বর্ধনা দিয়েছিলো, বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো। আমাদের শরীরে ময়লা ছিলো, জামা কাপড়ের যা অবস্থা ছিলো বলার মতো নয়। কতো মানুষ যেচে আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে এসেছে, কতো বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছে। এখন কোলকাতার জল-হাওয়া লেগে আমাদের শরীরে লাবণ্য ফিরে এসেছে। অনেকেই ছিমছাম জামা কাপড় পরি। তথাপি কোলকাতা শহরের মানুষ আমাদের প্লেগের জীবাণুর মতো এড়িয়ে চলে। কোলকাতার জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, তার জন্য আমরা দায়ী। ট্রাম, বাস, ট্রেনে অস্বাভাবিক ভিড় বাড়ছে, সে জন্যও আমরা দায়ী। পার্ক মাঠ ময়দানের নির্জনতা বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে, সর্বত্র জয়বাংলার মানুষ গিস্ গিস্ করছে। কর্মহীন স্বপ্নহীন উদ্যমহীন অবস্থায় থাকতে থাকতে আমরা একে অন্যের ওপর ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। প্রতি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে একই লোকের চেহারা দেখে দেখে ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠেছি। একজনের মনের ময়লা অন্যজনের মনে লেগে লেগে স্রোতহীন বদ্ধকূয়োর পানির মতো আমাদের মনগুলোও দূষিত হয়ে পড়েছে। কোলকাতা শহর যেনো একটা উন্মুক্ত কারাগার। তার ভেতরে আমরা ছেড়ে দেয়া কয়েদির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমরা সকলে কোথায় যাবো, বিকেলে কোথায় কাটাবো, সব একটা ছকের মধ্যে পড়ে যেতে হয়। বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশের মানুষের কাছে যাবে না তো কোথায় যাবে? যে যেখানেই থাকিনে কেননা, সন্ধ্যেবেলা পানের দোকানের সম্মুখে, ছোটো ছোটো রেস্টুরেন্টের দোরগোড়ায় স্বাধীন বাংলা বেতারে এম. আর, আখতার মুকুলের চরমপত্র পাঠ শোনার জন্য দাঁড়িয়ে যাই। কোলকাতার মানুষ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা নবদ্বীপ হালদারের কমিক শুনে যে রকম মজা পায়, এম. আর. আখতার মুকুলের গলার আওয়াজ, বাঙ্গাল ভাষার রসিকতা, কথা বলার ভঙ্গি সব কিছু তেমনি উপভোগ করে। কিন্তু আমাদের কাছে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের এম, আর. আখতার মুকুলের চরমপত্রের আবেদন ভিন্ন রকম। বাংলাদেশের ব্যাপারে সকলের উদাসীনতা চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। তথাপি এম. আর. আখতার মুকুল যখন স্বাধীনবাংলা বেতারের অনুষ্ঠানে চরমপত্র পাঠ করেন তখন দোকানের সামনে আস্তে আস্তে লোক জমতে থাকে, তখন দোকানীর আওয়াজটা বাড়িয়ে না দিয়ে উপায় থাকে না। লোকজন এম. আর. আখতার মুকুলের কড়া রসিকতা চিবিয়ে চিবিয়ে উপভোগ করে। এম. আর. আখতার মুকুল ট্যাঙ্ক ধ্বংস করছেন, গানবোট ডোবাচ্ছেন, সৈন্যভর্তি ট্রেনসহ ব্রীজ উড়িয়ে দিচ্ছেন, সেনা ছাউনিতে ছাউনিতে ত্রাসের সঞ্চার করছেন। এ পর্যন্ত তিনি যতো পাকিস্তানী সৈন্য খুন করেছেন, যতো জখম করেছেন, যতো ট্যাঙ্ক অচল করেছেন, যতো কনভয় ধ্বংস করেছেন সব মিলিয়ে যোগ করলে যে সংখ্যাটা দাঁড়াবে, তাতে করে একজনও পাকিস্তানী সৈন্য বাংলার মাটিতে থাকার কথা নয়। তার পরদিন সন্ধ্যেবেলা আবার সৈন্য মারতে আসেন। আমরা অবাক হয়ে ভাবি এতো সৈন্য তিনি কোথায় পান। আমরা জানতাম, এম. আর. আখতার সাহেব যা বলছেন, তার দু শতাংশও যদি সত্য হতো, তাহলেও আমাদের যুদ্ধের পরিস্থিতি এরকম হওয়ার কথা নয়। সব মিথ্যে জেনেও আমরা পরের দিনের চরমপত্র পাঠ শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। আর কোথাও তো কেউ কিছু করতে পারছে না। অন্ততঃ একজন মানুষ আছেন, যিনি কল্পনায় পাকিস্তানী সৈন্য হত্যা করতে পারেন, ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দিতে পারেন, বাক্যের মন্ত্রশক্তিতে বাংলার সপক্ষে যুদ্ধ করার জন্য খরস্রোতা নদী, সুন্দর বনের বাঘ, বিষাক্ত সাপ, ঝক বাঁধা মশা, ভাটি অঞ্চলের প্যাক কাদা, পশুপক্ষি সবকিছুকে প্রতিরোধ সংগ্রামের ভূমিকায় শরিক করে নিতে পারেন। কার্যক্রম যতোই অপ্রতুল হোক না কেননা, এম. আর. আখতারের কণ্ঠ শুনে মনে একটা বিশ্বাস ঘনিয়ে উঠতো। আমাদের প্রকৃতি, আমাদের নদী, আমাদের বনাঞ্চল, আমাদের বাঘ, সাপ, আমাদের প্যাক কাদা পাকিস্তানী সৈন্য ধ্বংস করার অলৌকিক ক্ষমতা রাখে। কোথাও যখন কিছু ঘটছে না, কেউ কিছু করছে না। আমরা এম. আর. আখতার মুকুলের ওপর ভরসা ছাড়তাম না। আগামীকাল তিনি নতুন আক্রমণ এবং নতুন বিজয়ের কথা শোনাবেন। ডুবন্ত মানুষ তো প্রাণপণ শক্তিতে ভাসমান তৃণখণ্ডকে আঁকড়ে ধরে।