ইয়াহিয়া খান মাতাল হলেও তার হিসেব খুবই পরিষ্কার। শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি কারাগারে পুরেছেন। থাকুক আরো কিছুদিন। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। যদি ইয়াহিয়া খানের কথা মানতে রাজি হন, ছেড়ে দেবেন। আর যদি বেঁকে বসেন দেশদ্রোহী হিসেবে ফাঁসিতে লটকে দেবেন। আওয়ামী লীগের যে অংশটা দেশের মধ্যে আছে, তার একটা অংশকে খুন করা হয়েছে, একটা অংশকে জেলে পোরা হয়েছে এবং আর একটা অংশকে একেবারে সরাসরি তাবেদারে পরিণত করা হয়েছে। সুতরাং দল হিসেবে পূর্বপাকিস্তানে আওয়ামী লীগের আর মাথা তুলে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। তাছাড়া আওয়ামী লীগের কাছে যে সমস্ত দল সত্তরের নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলো তাদের সবাইকে সাহস দিয়ে তিনি চাঙ্গা করে তুলেছেন। জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি সমস্ত দক্ষিণপন্থী দল পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে উঠে পড়ে লেগেছে। শিগগির আওয়ামী লীগের নির্বাচিত নেতারা ভারতে চলে যাওয়ার পর যে রাজনৈতিক শূণ্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা তারা পূরণ করতে পারবে। তাছাড়া পৃথিবীর মানুষকে দেখাবার জন্য পূর্বপাকিস্তানে একটা সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান তিনি করেছেন।
এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই পৃথিবীর মানুষের কাছে সাক্ষ্য দিয়েছে ইয়াহিয়া খান সাহেব দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করার স্বার্থে পূর্বপাকিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপ করে পাকিস্তানকে উদ্ধার করেছেন। সামরিক এক নায়ক হিসেবে কেউ তাঁকে দুষতে পারবে না। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই বললেন, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার স্বার্থে ইয়াহিয়া খান সামরিক বাহিনীকে মোতায়েন করেছেন। পূর্বপাকিস্তান থেকে সামরিক বাহিনী উঠিয়ে নিলে ভারত থেকে আগত দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে জনগণের জানমাল রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
ইয়াহিয়া খান গ্লাসের পর গ্লাস শ্যাম্পেন খালি করেন। আর ভাবছেন, তাঁর মতো সুদক্ষ জেনারেল এবং প্রতিভাবান নেতা পৃথিবীতে বেশি নেই। তার যোগ্যতার প্রমাণ, তিনি বোতলের পর বোতল নিঃশেষ করে ফেলতে পারেন। তাঁর সমস্ত জাগতিক বিষয়ে সংজ্ঞা লোপ হওয়ার পরেও একটা জিনিস মনের মধ্যে ধ্রুবতারার মতো জ্বলতে থাকে। ভারত যে সকল তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা পূর্বপাকিস্তানের দেশ প্রেমিকদের বাড়ি ঘরে গ্রেনেড ছুঁড়ছে, ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করছে, পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দিচ্ছে, তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য তিনি পূর্বপাকিস্তানের দেশপ্রেমিক যুবকদের নিয়ে রাজাকার, আলবদর এবং আল শামস বাহিনী গঠন করেছেন। তারা এখন পূর্বপাকিস্তানের সর্বত্র মাঠে নেমেছে এবং পাহারা দিচ্ছে। ভারত যতো ইচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা পাঠাতে থাকুক, জান নিয়ে কেউ ফেরত যেতে পারবে না।
হ্যাঁ, পৃথিবীর পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিওতে বিপুল পরিমাণ পূর্বপাকিস্তানীদের ভারতে পালিয়ে যাবার কথা বলছে। এক কোটির মতো মানুষ গেছে। সুতরাং এই ধরনের কিছু কথা তো উঠবেই। কিন্তু ভারতে কারা গিয়েছে। সেটা তো দেখতে হবে। ভারতে যারা চলে গেছে, তাদের তো শতকরা পঁচাশি ভাগ হিন্দু। হিন্দুদের ভারত ডেকে নিয়ে গেছে। কেনোনা এই হিন্দুদের ডেকে নিয়ে ভারত পাকিস্তানের অখণ্ডতা ধ্বংস করতে চায়। বাকি পনেরো ভাগ মুসলমান যারা ভারতে গিয়েছে, তাদের অধিকাংশই ভারতের অনুচর। আর কিছু সংখ্যক বিপথগামী। তথাপি পৃথিবীর মানুষ যদি বলে ইয়াহিয়া খান পূর্বপাকিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিক। ইয়াহিয়া খান বললেন, তারা ফিরে আসুক, যাদের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজের কোনো প্রমাণ নেই তিনি তাদের ক্ষমা করে দেবেন। কোনো ভয় নেই, শরণার্থীরা তাদের বাড়িঘরে ফিরে আসুক। ইয়াহিয়া খান সীমান্তের চৌকিগুলোর কাছাকাছি তাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অভ্যর্থনা কেন্দ্র খুলবেন। তিনি জানেন, হিন্দুরা ফিরবে না। আর মুসলমান যারা গিয়েছে যদি ফিরে আসে খান সাহেবের তো আরো সুবিধে। তিনি পৃথিবীর মানুষদের সামনে দেখাতে পারবেন পূর্বপাকিস্তানের হিন্দু এবং ভারত সরকার মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব ভাঙার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে। অন্যরা আসুক না আসুক কিছু যায় আসে না। কিন্তু হিন্দুরা যে ফিরে আসবে না এ ব্যাপারে ইয়াহিয়া খান সুনিশ্চিত। তিনি নতুন বোতলের সুরা গলধঃকরণ করতে করতে ভাবেন এক ঢিলে তিন পাখি মেরে ফেলেছি। আমি আশি লাখ হিন্দুকে ভারতের ওপর চাপিয়ে দিতে পেরেছি। তিনি ভাবেন আয়ুব খানের মাথায় এ বুদ্ধি আসেনি কেনো। পূর্বপাকিস্তানের হিন্দু না থাকলে আর কখনো বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দেবে না। ভারত সব সময়ে পাকিস্তানকে দুর্বল করতে চেয়েছে। তার বদলে ইয়াহিয়া ভারতের ঘাড়ে এমন এক জনসংখ্যার বোঝা চাপিয়ে দিতে যাচ্ছেন, সে অর্থনৈতিকভাবে আর কখনো মাথা সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। মাঝে মাঝে তিনি অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন। আর ভারত যদি যুদ্ধ করে সেখানেই তো আসল মজা। পাকিস্তানের বন্ধু আমেরিকা আছে, চীন আছে। তারা মদদ দিতে ছুটে আসবে। তবে ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার খুব দহরম মহরম চলছে। ভাবে গতিতে মনে হচ্ছে যদি যুদ্ধ লাগে রাশিয়া ভারতকে সমর্থন করবে। তা করুক। পূর্বপাকিস্তানের ব্যাপার নিয়ে দুনিয়ার বড়ো বড়ো দেশগুলো একটা বিশ্বব্যাপী তৃতীয় মহাযুদ্ধ স্বেচ্ছায় মাথায় তুলে নেবে ইয়াহিয়া খান সাহেব সে কথা বিশ্বাস করতে চান না। ভারত পাকিস্তানে একটি যুদ্ধ যদি লেগেই যায় বৃহৎ শক্তিগুলোর চাপে অল্পদিনের মধ্যেই থামিয়ে ফেলতে হবে। সে যুদ্ধে পাকিস্তান যদি বিশেষ সুবিধে করতে নাও পারে ইয়াহিয়া খান সাহেবের বিশেষ দুশ্চিন্তা নেই। তখন তিনি ভারতের সঙ্গে অস্ত্রবিরতি করবেন। মধ্যস্থতা করতে আমেরিকা ছুটে আসবে। তথাকথিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটির কোনো গুরুত্বই থাকবে না। বাংলাদেশ বলে কিছু আছে নাকি? গোটা ব্যাপারটাই ঘটছে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে। মাঝখান থেকে বাংলাদেশের প্রশ্ন উঠবে কেমন করে? ভারত পূর্বপাকিস্তান থেকে যে সকল হিন্দুকে দেশের অখণ্ডতা ধ্বংস করার জন্য তার ভূখণ্ডে ডেকে নিয়েছে পাকিস্তান কস্মিনকালেও তাদের আর ফেরত নেবে না। আর যে সকল মুসলমান চলে গিয়েছে, তারা যদি ফিরে আসতে চায় আসুক। ইয়াহিয়া খান সাহেব তাঁদের কথাটা ভেবে দেখবেন। তিনি গ্লোসে চুমুক দিচ্ছেন আর মাঝে মাঝে অট্টহাস্য করে উঠছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, হ্যাঁ সেই মেয়ে মানুষটি। আমাকে ল্যাং মারতে চায়? তার লড়াই করার খায়েশ হয়েছে? আচ্ছা ঠিক হ্যায়, নজদিগ মে এক জঙ আগ্যায়া। ময়দান মে মোলাকাত হোগা।