পূর্বপাকিস্তান থেকে প্রায় এক কোটির বেশি মানুষ ভারতে চলে এসেছে। তার মধ্যে প্রায় আশি লক্ষ হিন্দু। যদি তাড়াতাড়ি কিছু একটা সমাধান খুঁজে বের করা না হয়, যে সকল মুসলমান ভারতে এসেছে তাদের অনেকেরই মনোবল ভেঙ্গে যাবে। অন্যদিকে ইয়াহিয়া খান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে শরণার্থীদের ডাকছে তোমরা ফিরে এসো। কোনো ভয় নেই। একটা সময় আসতে পারে মুসলমানদের একটা বিরাট অংশ দেশে ফেরত চলে যেতে চাইবে। তখন ভারত অনেক নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যাবে। যা কিছু করার তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে। যদি ভারত একটা যুদ্ধ মাথায় নেয় চীন আমেরিকা যে পাকিস্তানের সপক্ষে ছুটে আসবে না সে ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি। একটা পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানের বন্ধুদের চাপে যদি যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করতে হয়, ভারতের লোকসান হবে অনেক বেশি। তখন পাকিস্তান এই আশি লক্ষের মতো হিন্দুকে ফেরত নিতে চাইবে না। আশি লক্ষ বাড়তি মানুষের চাপ সহ্য করতে গিয়ে ভারতের দম বেরিয়ে যাবে। শ্রীমতি গান্ধী একটা বিরাট মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছেন, যদিও তার আচার আচরণে সে কথা বোঝার উপায় নেই। পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু করে বৃহত্তর শক্তির চাপে যদি মাঝপথে থামিয়ে দিতে বাধ্য হতে হয়, সবদিক দিয়ে ভারতের ক্ষতি সবচাইতে বেশি। তখন এক পাকিস্তানের বদলে দুই পাকিস্তানের সৃষ্টি হবে। পূর্বপাকিস্তানে একজনও হিন্দু অধিবাসী থাকবে না। ভারতের হাজার সমস্যা। তার ওপর যদি ওই আশি লক্ষ মানুষের বোঝা তার ওপর চাপে, ওই বাড়তি জনসংখ্যার চাপে ভারত থেতলে যাবে।
ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের লোকদের সঙ্গে যদি একটি সমঝোতায় এসে শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করতেন, শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতেন, মানে সমস্ত শরণার্থীদের ফেরত নিতেন, তাহলে সবদিক দিয়ে সেটাই হতো উত্তম। শ্ৰীমতী গান্ধীর জানার বাকি নেই, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে একটা আপোষ মীমাংসায় এলেও পাকিস্তান একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। পঁচিশে মার্চের রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে নিষ্ঠুর নরমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছে, যে রক্তস্রোত বইয়েছে, যেভাবে অগ্নিসংযোগ এবং নরহত্যার আয়োজন করেছে, তাতে করে দু’অংশের জনগণের মধ্যে আস্থা এবং বিশ্বাসের শেষ সম্ভাবনাটুকু চিরতরে ধ্বংস হয়ে গেছে। পূর্ব এবং পশ্চিমপাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ একটি রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে আসন্ন সংকট হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারে, কিন্তু শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান কখনো ভারতের ভয়ের কারণে হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। ভারত একটি দুর্বল পাকিস্তান চায়। বিনা যুদ্ধে যদি সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়, যুদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা তিনি খুঁজে পান না। তারপরেও শ্রীমতী গান্ধীর মনে একটি প্রবল আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। আশি লক্ষ হিন্দু পাকিস্তানী সৈন্যের বর্বর আক্রমণের মুখে সব খুইয়ে প্রাণমাত্র সম্বল করে ভারতে পালিয়ে এসেছে, তারা নিরাপদে বসবাস করার নিশ্চিত নিরাপত্তা না পেলে কি পূর্বপাকিস্তানে ফেরত যেতে চাইবে? যে কোনো রাজনৈতিক সমাধান তাদের নিরাপদে দেশে ফেরার পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা কি দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে তারা ভারতের মাটি থেকে কোনোক্রমেই দেশে ফিরতে চাইবে না। ভারত জোর করে তো হিন্দুদের ঠেলে দেশে পাঠাতে পারবে না। শ্রীমতি গান্ধী চোখ বুজলেই দেখতে পান একটি যুদ্ধ তার ঘাড়ে এসে পড়েছে। এই যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার যতো বিপদ সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিপদ তার চাইতে অনেক কম। তিনি অনুভব করছিলেন, বল এখন ইয়াহিয়া খানের কোর্টে। ইয়াহিয়া খানের মাথায় যদি সুবুদ্ধির উদয় হয়, তাহলে হয়তো যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। তাছাড়া আর কোনো বিকল্প তো তিনি দেখেন না।
ইসলামাবাদে বসে ইয়াহিয়া খান হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিতে দিতে সম্পূর্ণ ভিন্নরকম চিন্তা করছিলেন। কার্যকারণ সবকিছু মিলিয়ে পরিচ্ছন্নভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা তার নেই। কেনোনা তিনি সব সময় মদের নেশায় বিভোর থাকেন। সুন্দরী নারী এবং নর্তকি গায়িকা ছাড়া আর কারো কাছে স্বচ্ছন্দ হওয়ার ক্ষমতা তিনি ক্রমাগত হারিয়ে ফেলছেন। যেটুকু চিন্তা করার ক্ষমতা এখনো অবশিষ্ট আছে, তাই দিয়ে মনে করেন তিনি একটা মরদের মতো কাজ করে ফেলেছেন। এ পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান যে কাজটি করতে পারেননি তিনি একাই সে কাজটি করে ফেলতে পেরেছেন। পূর্বপাকিস্তানের সমস্যার এমন সরল সমাধানের কথা পূর্ববর্তী কোনো রাষ্ট্রপ্রধান চিন্তা পর্যন্ত করতে পারেননি। যেহেতু পূর্বপাকিস্তানে এক কোটিরও বেশি হিন্দু বসবাস করে, সেটাই পূর্বপাকিস্তানের আসল সমস্যা। এই হিন্দুদের প্ররোচনাতেই বিচ্ছিন্নতাবাদ সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পেরেছে। অস্ত্রের মুখে তাদেরকে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করে ভারতে ঠেলে দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদের মূল তিনি চিরদিনের মতো উৎপাটন করে ফেলেছেন। হিন্দুরা যখন নেই, আস্তে আস্তে পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামী পরিবেশ ফিরে আসবে। তিনি মনে করেন আরো একটি গ্রন্থিল এবং জটিল সমস্যার সমাধান তিনি প্রায় করে এনেছেন। পূর্বপাকিস্তানের মানুষ সব সময় আন্দোলন করে, কারণ সেখানে অনেক মানুষ। এক চিলতে একটু মাটি। সেখানে বসবাস করে কোটি কোটি মানুষ, পিঁপড়ের মতো পিলপিল করছে মানুষের সারি। প্রায় এক কোটি মানুষকে তিনি অস্ত্রের মুখে সরিয়ে দিতে পেরেছেন। এই এক কোটি মানুষের বাড়িঘর, জমিজমা, ব্যবসাবাণিজ্য সব অন্যদের দখলে চলে যাবে। তাদের গায়ে গতরে একটু হাওয়া লাগবে। তারা হাত পা ছড়িয়ে বসতে পারবে। এই বাড়তি জমি বাড়ি ঘর পাওয়ার পর তাদের অসন্তোষ অনেক কমে আসবে। পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের প্রতি তার মায়া হয়। তিনি মিছামিছি উনিশশো পঁয়ষট্টি সালে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। হাতের কাছে এমন সহজ সমাধান থাকা সত্ত্বেও আয়ুব খান সাহেব কেননা যে পূর্বপাকিস্তানকে বাগে আনতে পারলেন না, তিনি বুঝতে পারেন না। মদের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে ভাবেন, কি বোকাই না ছিলেন আয়ুব খান। অথচ কতো সহজে সব সঙ্কটের সমাধান প্রায় করে এনেছেন।