ক্যাম্পে গেলেই সকলে থিয়েটর রোডের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গালাগাল করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গণপ্রতিনিধিদের সংযোগ সমন্বয় খুবই ক্ষীণ। তারা যে ক্যাম্প পরিদর্শন করতে যান না তাও ঠিক নয়। মাঝে মাঝে সরকারের তরফ থেকে কেউ না কেউ যান। সব সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন না একজন তাদের সঙ্গে থাকেন। বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিরা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশতে পারে না। ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময় পারেন না। তাঁদের অবচেতন মনে সব সময় একটা ভীতি কাজ করে। যদি বেঁফাস কিছু মনে করেন। গণপ্রতিনিধিদের এই আঁটোসাঁটো দায়সারা মনোভাব মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাদের বেশিরভাগই আশা করে তারা যেভাবে প্রাণ দেয়ার জন্য এক পায়ের ওপর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের যারা নেতা তাদের মধ্যে সেরকম খাঁটি জঙ্গী মনোভাব দেখতে পাবে। তার বদলে যখন নাদুশনুদুশ নেতারা স্নো-পাউডার চর্চিত মুখমণ্ডল এবং স্নিগ্ধ তেলঢালা শরীর নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পেছন পেছন হাজির হয়ে জনসভায় বক্তৃতার ঢঙ্গে হাত উঠিয়ে শেখ মুজিবের কণ্ঠস্বর নকল করে বলতে থাকেন, ভাইসব, তোমরা বাংলা মায়ের দামাল ছেলে। তোমরাই বাংলা জননীকে মুক্ত করবে। সেই দামাল ছেলেরা তখন তাঁদের অপেক্ষাকৃত নিচু স্বরে শালা বানচোত বলে গালাগাল করে। মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং সেক্টরগুলোর কমান্ডারদের মধ্যে সব সময় ঝগড়া বিবাদ লেগেই আছে। সর্বাধিনায়ক বুড়ো জেনারেল ওসমানী সত্যিকার যুদ্ধের চাইতে মিলিটারি আদব কায়দার প্রতি অত্যধিক যত্নশীল। যুদ্ধের কাজের অগ্রগতির চাইতে তার হুকুম পালিত হলো কিনা প্রায় সময়ে সেটাই তাঁর মনোযোগর বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। সর্বাধিনায়ক এবং সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে মতবিরোধ কোনো কোনো সময়ে এমন পর্যায়ে দাঁড়ায় যে ওসমানী সাহেব তার দীর্ঘ গোঁফে তা দেয়া ছাড়া অন্য কিছু করার আছে সে কথা চিন্তা করতে পারেন না। যে যার মতো করে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছেন, কারো পরিকল্পনার সঙ্গে কারো পরিকল্পনা মিলছে না। প্রায় সময়েই অচলাবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। ভারতীয়রা বাংলাদেশ কমান্ডের সঙ্গে কোনো রকমের যোগাযোগ না করেই বাংলাদেশী যুবকদের আলাদাভাবে ট্রেনিং দিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে থিয়েটর রোডে তাজুদ্দিন সাহেবের কাছে সংবাদ পাঠিয়েও কোনো সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
থিয়েটর রোডের অস্থায়ী সরকারের কার্যালয়ে তাজুদ্দিন সাহেব যে খুব সুখে আছেন, সে কথাও ঠিক নয়। আওয়ামী লীগ দলটির মধ্যে কোন্দলের অন্ত নেই। তাজুদ্দিন সাহেব অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় আওয়ামী লীগের উচ্চাভিলাষী নেতাদের অনেকেই তার ওপর বিরক্ত। তিনি যে গোটা পরিস্থিতিটা সামাল দিতে পারবেন, তার ওপর এই আস্থা স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধীরও নেই। ভারত সরকার তাজুদ্দিন বিরোধীদেরও হাতে রাখার চেষ্টা করছে। তাজুদ্দিন সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়েছে। নিজের স্বাধীনভাবে কোনো কিছু করার ক্ষমতা বিশেষ নেই। সব সময় ভারত যা বলছে, সায় দিতে হচ্ছে, যা চাপিয়ে দিচ্ছে তাই মেনে নিতে হচ্ছে। ভারতের মাটিতে প্রকাশ্যে তাজুদ্দিনের বিপক্ষে কেউ কিছু বলতে সাহস না করলেও আওয়ামী লীগের একাংশ আমেরিকার মাধ্যমে গোপনে ইয়াহিয়া খানের সামরিক প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ চালাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। তাদের যুক্তি একটাই, ভারত কখনো বাংলাদেশের হয়ে যুদ্ধ করবে না, সুতরাং ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সঙ্গে আপোষ মীমাংসায় আসাই হবে সবচেয়ে ভালো কাজ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কি করতে যাচ্ছেন কেউ জানে না। ভারতীয় জনমত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অনুকূলে এবং বেশিরভাগ ভারতীয় জনগণ চায় শ্রীমতী গান্ধী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে অনতিবিলম্বে স্বীকৃতি প্রদান করুন। কিন্তু যুদ্ধ করতে বললে তো যুদ্ধ করা যায় না। শ্রীমতী অত্যন্ত সন্তর্পনে অগ্রসর হচ্ছেন। বিশ্বজনমত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরতায় শিউরে উঠেছে একথা সত্যি, কিন্তু শুধুমাত্র বিশ্বজনগণের সহানুভূতির ওপর নির্ভর করে শ্ৰীমতী গান্ধী একটা যুদ্ধ কাঁধে নিতে পারেন না। পাকিস্তানের পক্ষে আমেরিকা আছে, আছে চীন। এই দুটো শক্তিশালী দেশ বারবার নালিশ করে আসছে ভারত পাকিস্তানকে ভেঙে দু’টুকরো করার জন্য পূর্বপাকিস্তানের জনগণের একাংশকে তার ভূখণ্ডের মধ্যে ডেকে নিয়ে অনর্থক ওই গণ্ডগোলটা পাকিয়ে তুলেছে। মুসলিম দেশসমূহের অধিকাংশও পাকিস্তানের অবস্থানকে সমর্থন করে। ভারতীয় জনগণের একটা বিরাট অংশ মনে করে চিরশত্রু পাকিস্তানকে চিরদিনের মতো দুর্বল করার এই একটা মোক্ষম সুযোগ। সুতরাং শ্রীমতী গান্ধীর অনতিবিলম্বে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়া উচিত। আকাঙ্ক্ষা পূরণের বাসনা থেকে তো আর যুদ্ধ বাধানো যায় না। সত্যি বটে, পূর্বপাকিস্তানের সাত কোটি মানুষ পাকিস্তানকে ধ্বংস করার কাজে ভারতকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করবে। যদি একটা যুদ্ধ সত্যি সত্যি লাগে, পাকিস্তানের মিত্র চীন কিংবা আমেরিকা যদি পকিস্তানের সমর্থনে এগিয়ে আসে, তাহলে একটা বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা এড়ানো অসম্ভব। ভারতবর্ষ কি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য একটা বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি আপন কাঁধে নিতে পারে, বোধ করি শ্রীমতী গান্ধী চাইছিলেন যুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশের সংকটের একটা শান্তিপূর্ণ সমধান হোক।