তারপর তায়েবা আমার হাত ধরে বললো, দানিয়েল ভাই, আপনাকে একটা কথা বলবো, রাখবেন? আমি বললাম, বলো। আগে বলুন, রাখবেন। আচ্ছা রাখবো, এখন কথাটি বলো। আপনি আমাকে এখান থেকে কোথাও নিয়ে চলুন। চলুন, আমরা কোথাও পালিয়ে যাই। তার কথাটি শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। তায়েবা পাগলামি করছে নাতো। আমি তাকে কোথায় নিয়ে যাবো। আর সে হাসপাতাল থেকে যাবেই বা কেমন করে। জবাব না দিয়ে আমি চুপ করে রইলাম। সে আমার গায়ে ঠেলা দিয়ে বললো, কি চুপ করে রইলেন যে। আমি বললাম, হাসপাতাল থেকে তোমাকে যেতে দেবে? আমি যদি যেতে চাই হাসপাতাল আমাকে ধরে রাখবে কেমন করে? সে ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো, আপনি আমাকে চেনেন না? চেনবোনা কেনো। তায়েবাকে আমি বিলক্ষণ চিনি। সে যখন কোনো কিছু করবে ঠিক করে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। যেদিন আসাদ মারা যায় সে রিকশা করে হাসপাতাল থেকে আসছিলো। হঠাৎ করে মিছিল দেখে বেরিয়ে পড়ে, একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করেছিলো। আমরা কেউ বাধা দিয়ে রাখতে পারিনি। আমি মনে মনে ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম। আজকেও যদি সে এরকম একটা কিছু করে বসে। আমি তো জানি তাকে আটকে রাখবো এমন ক্ষমতা আমার নেই। আপাততঃ তাকে একটু শান্ত করার জন্য বললাম, আগে একটু বসো, আলাপ করি কোথায় যেতে চাও। একটা ব্যবস্থা না হয় করা যাবে। সে জেদ ধরে রইলো, না আমি ওভাবে পড়ে থাকবো না। আপনি আমাকে নিয়ে চলুন। আমি বললাম, কোথায় নিয়ে যাবো আগে বলল, তারপর না হয় যাওয়া যাবে। সে জবাব দিলো, আমাকে বলতে হবে কেন, আপনার যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যান। আমি যদি তোমাকে এ অবস্থায় এখান থেকে নিয়ে যাই, তোমার বোন, মা, ভাই এবং পার্টির লোকেরা আমায় কি আস্ত রাখবে? কোনো একটা কারণে তোমার অসুখটা হঠাৎ করে বেড়ে যায়, সকলের কাছে আমি কি জবাব দেবো? আমার মা, ভাই, বোন, পার্টির লোক কি মনে করবে? আমি দেখবো, আপনি নিয়ে যাবেন কিনা বলুন? তুমি জানো, এখানে আমার নিজেরথ থাকার জায়গা নেই। তোমাকে আমি কোথায় নিয়ে যেতে পারি। সে বললো, অন্ততঃ আপনি কোথাও আমাকে নিয়ে বেড়িয়ে আসুন। এই হাসপাতালে থাকতে থাকতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। আপনি আমাকে নিয়ে চলুন। এখন কেউ নেই, এই সময়ে বেরিয়ে পড়াই উত্তম। আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি একটু ডঃ মাইতির সঙ্গে পরামর্শ করে আসি। তুমি একটুখানি অপেক্ষা করো। ডঃ মাইতির কাছে যাবেন কেন? আপনি যখন অর্চনাদিকে নিয়ে বেড়াতে যান, তখন কি ডঃ মাইতির পারমিশন চান? আমি বললাম, অর্চনাকে নিয়ে কখন আবার বেড়াতে গেলাম। এ উদ্ভট সংবাদ কার কাছে শুনলে? তায়েবা চোখের রাঙ্গা পুতুলি দুটো দেখিয়ে বললো, ফের মিথ্যে কথা বলছেন, অর্চনাদি আমাকে নিজেই বলেছেন, অর্চনাদিকে নিয়ে আপনি বেলেঘাটা না কোথায় গিয়েছিলেন? আমি হেসে ফেললাম, ওহ সেই কথা বলো। বেলেঘাটাতে তার এক নকশাল বন্ধুর বাড়িতে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলো। অৰ্চনা আমাকে বাসা চেনাতে নিয়ে গিয়েছিলো। তায়েবা বললো, থাক্ আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না। আপনাকেও আমার চেনা হয়ে গেছে। তায়েবাকে আমি কোনোদিন সাধারণ মেয়েমানুষের সঙ্গে এক করে দেখিনি। আমি মনে করতাম, সে মেয়েলি ঈর্ষা, বিদ্বেষ এসবের অনেক উর্ধ্বে। আজকে তার অন্য একটা পরিচয় পেলাম। দীর্ঘদিন ধরে আমি মনের মধ্যে একটা সংশয় লালন করে আসছিলাম। তায়েবার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক সেটার ভিত্ কি? আমি তার অসুখকে উপলক্ষ করে তার পরিবার এবং পার্টির লোকদের বিরুদ্ধে মনে মনে অসংখ্য অভিযোগের যে খসড়া এঁকেছি তার একটা বাস্তব ভিত্তি পেয়ে গেলাম। আমার নালিশ করার অধিকার আছে, হ্যাঁ আছে, একশোবার আছে। আমার চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছিলো। হঠাৎ সে অতি কষ্টে বলে বসলো, দানিয়েল ভাই, আমাকে বিছানায় শুইয়ে দেন। আমার কেমন জানি লাগছে। আমি তাড়াতাড়ি বিছানায় শুইয়ে দিলাম। তার মুখে কোনো কথা নেই। গর গর আওয়াজ বেরিয়ে
আসছে।
.
১২.
সেপ্টেম্বর মাস প্রায় শেষ হয়ে আসছে। আমরা যারা কোলকাতা শহরের ভাসমান প্রাণী, দৈনন্দিন খাদ্য সংগ্রহের প্রয়োজনে এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আড্ডা জমাচ্ছি, নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করছি, ঘরেরও না, ঘাটেরও না; সেই চূড়ান্ত সত্যটা ভুলে থাকার জন্য অষ্টপ্রহর এটা ওটায় ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করছি। কিন্তু সেই দিকচিহ্নহীন সময় প্রবাহ আমাদের সবাইকে ঠেলে একটা কঠিন জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিলো। এতোদিন আমরা জানতাম সীমান্তে একটা যুদ্ধ চলছে। ঠিক যুদ্ধটা কোথায় হচ্ছে, কারা করছে, সে বিষয়ে আমাদের একেবারে যে ধারণা ছিলো না সে কথা সত্যি নয়। মাঝে মধ্যে আমরা সীমান্ত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে গিয়েছি। সেখানে যুদ্ধের প্রস্তুতি যেটুকু চলছে নিজেদের চোখে দেখার সুযোগ হয়েছে। ক্যাম্পগুলোতে ট্রেনিং চলছে ঠিকই, কিন্তু এই ট্রেনিং থেকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে নিরস্তিত্ব করে দিতে পারে এ রকম একটা মুক্তিযুদ্ধ জন্ম নিতে পারে সে কথা প্রাণের ভেতর বিশ্বাস করতে পারিনি। আমাদের কোথাও কিছু নেই, সবকিছুই শূণ্যের ওপর ঝুলছে। সবটাতেই ভারতের করুণার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ক্যাম্পে হাজার হাজার তরুণের মৃত্যুর সরল প্রস্তুতি অফুরন্ত মনোবল, আসন্ন সংগ্রামে সেটাই জাতিগতভাবে আমাদের সত্যিকার বিনিয়োগ। আমাদের ট্রেনিংরত মুক্তিযোদ্ধাদের জয়বাংলা রণধ্বনি আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে যখনই ফেটে পড়েছে আমাদের শিরার রক্ত চলকে উঠেছে। সেই প্রেরণাদীপ্ত পরিবেশে যতোক্ষণ থেকেছি, সমস্ত জাগতিক হিসেব নিকেশ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে আমরা বিশ্বাস করেছি আমরা জয়ী হবো। জয়ী হবো এই বিশ্বাসটুকুও যদি না রাখতে পারি, তাহলে আমাদের অস্তিত্বের মূল্য কি? এই কোলকাতা শহরে আমরা কি করতে এসেছি। সমস্ত সন্দেহ, সমস্ত সংশয়কে সবলে তাড়িয়ে দিয়ে মনের মধ্যে একটা আশাবাদের শিখা প্রাণপণ প্রয়াসে উজ্জ্বল করে জ্বালিয়ে রাখতে আমরা ব্যস্ত ছিলাম। আমরা জয়ী হবো, আমাদের জয়লাভ করতে হবে। এই আশাটুকু না রাখতে পারলে মানুষের শরীর ধরে হেঁটে বেড়ানোর কোনো মানে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু একটা হিসেবী মনও তো ছিলো। সেটা মাঝে মাঝে ভয়ানকভাবে বেঁকে বসতো। ক্যাম্পের বাস্তব অবস্থা দেখে মনটা দমে যেতো। পর্যাপ্ত খাবার নেই, গোলাবারুদ নেই। প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রের তালিকা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠালে, ক্যাম্পে সে অস্ত্র এসে পৌঁছতে অনেক সময় সপ্তাহ, পক্ষ, এমনকি মাস গড়িয়ে যেতো। কোনো সময় আদৌ পৌঁছাতো না। নির্দেশনার প্রশ্নে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশী নেতৃত্বের মতবিরোধ লেগেই রয়েছে। থিয়েটর রোডের অস্থায়ী সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কাছে বার বার নালিশ করেও সদুত্তর পাওয়া যেতো না। প্রায় সবগুলো ক্যাম্পে একটা যাচ্ছেতাই অবস্থা। তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখার জন্য অনেক সময় ক্যাম্প কমাণ্ডারেরা গামছায় কিছু গ্রেনেড বেঁধে দিয়ে বলতো, যাও চোরাগোপ্তাভাবে পাকিস্তানী সৈন্যের ওপর আক্রমণ করো, রাজাকারদের খতম করো, তারপর ফিরে এসো। এভাবে শুধুমাত্র কিছু গ্রেনেডসহ তরুণ ছেলেদের দেশের ভেতরে পাঠানো যে প্রকারান্তরে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়া এ কথা ক্যাম্প কমাণ্ডারেরাও বিশ্বাস করতেন। কিন্তু উপায় কি? অতোগুলো জোয়ান ছেলে ক্যাম্পে বসে থাকলে এক সময়ে নিষ্ক্রিয়তা এসে ভর করবে। তখন তাদের মধ্যে কোনো রকমের গতি সৃষ্টি করা দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে। তাই যে কোনো রকমের এ্যাকশনের মধ্যে অন্ততঃ একাংশকে ব্যস্ত না রাখতে পারলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।