তায়েবার কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে পেছন ফিরে একবার হাসপাতাল কমপ্লেক্সটির দিকে তাকালাম। ছেঁড়া ছেঁড়া অন্ধকারে বিরাট বাড়িটাকে নিস্তব্ধতার প্রতিমূর্তির মতো দেখাচ্ছে। মৃত্যু এবং জীবনের সহাবস্থান বাড়িটার শরীরে এক পোচ অতিরিক্ত গাম্ভীর্য মাখিয়ে দিয়েছে মনে হলো। হাসপাতাল কম্পাউণ্ড থেকে বেরিয়ে এসপ্ল্যানেডের পথ ধরলাম। পনেরো নম্বর ট্রাম ধরে আমাকে বৌবাজারে নামতে হবে। উল্টোপাল্টা কতো রকমের চিন্তা মনের ভেতর ঢেউ তুলছিলো। তায়েবার অসুখটা কি খুব সিরিয়াস? তার মা কি দিনাজপুর থেকে কোলকাতা আসতে পেরেছে? ডোরা শেষ পর্যন্ত পিলে চমকানো এমন একটা দুর্ঘটনার সৃষ্টি করলো। এতো বড়ো একটা কাণ্ড ঘটাবার পরেও জাহিদ নামের মাঝ বয়েসী মানুষটি কি করে, কোন্ সাহসে হুলোবেড়ালের মতো গোঁফ জোড়া বাগিয়ে তায়েবাকে হাসপাতাল দর্শন দিতে আসে। আমি তো ভেবে পাইনে। ট্রাম দাঁড়াতে দেখে দৌড়ে চড়তে যাচ্ছি, এমন সময় পেছনে ঘাড়ের কাছে কার করস্পর্শ অনুভব করলাম। তাকিয়ে দেখি ডঃ মাইতি। তিনি বললেন, দানিয়েল সাহেব, একটা কথা বলতে এলাম। মাছ রান্না করার সময় একেবারে লবণ ছোঁয়াবেন না। আমি বললাম, আপনি ঠিকই ধরতে পেরেছেন গেণ্ডারিয়ার বাসাতেও তায়েবা কখনো লবণ খেতো না। তিনি জানতে চাইলেন, আপনি কতোদিন তায়েবাকে চেনেন। আমি বললাম, তা বছর চারেক তো হবেই। তিনি আমাকে জেরা করার ভঙ্গিতে বললেন, তার কী রোগ আপনি জানেন? বললাম, জানিনে, মাঝে মাঝে দেখতাম নিঃসার হয়ে পড়ে আছে। কিছুদিনের জন্য হাসপাতাল যেতো। আবার ভালো হয়ে চলে আসতো। শুধু এটুকু জানি সে লবণ খেতো না। আর চা টা ঠাণ্ডা করে খেতো। তিনি বললেন, এর বেশি আপনি কিছু জানেন না? বললাম, বারে জানবো কি করে। মহিলাদের রোগের কি কোনো সীমা সংখ্যা আছে? তাছাড়া তায়েবা আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি, আসলে তার অসুখটা কী? তিনি বললেন, উচিত কাজ করেছে, এসব আপনাকে পোষাবে না। আপনি অন্যরকমের মানুষ। আর শুনুন ভাত তরকারি আনার সময় লুকিয়ে আনবেন। ডঃ ভট্টাচার্য জানতে পেলে ওকে হাসপাতালে থাকতে দেবেন না। এটুকু কষ্ট করে মনে রাখবেন। তারপর নিজে নিজে বিড় বিড় করে বললেন, মেয়েটি তো ফুরিয়েই যাচ্ছে। যা খেতে চায় খেয়ে নিক। ডঃ মাইতি একটা চাপা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। আমার বুকটা ভয়ে আশঙ্কায় গুড় গুড় করে উঠলো। ডঃ মাইতি বললেন, আপনার ট্রাম, আমি চলি।
.
০২.
বৌ বাজারের স্টপেজে ট্রাম থামতেই লোডশেডিং শুরু হয়ে গেলো। সেই কোলকাতার বিখ্যাত লোডশেডিং। এটা এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে এখনো আমাদের ঠিক গা সওয়া হয়ে উঠেনি। অনেক কষ্টে হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ির গোড়ায় এসে দেখি দারোয়ান পাঁড়েজী কেরোসিনের কুপী জ্বালিয়ে কম্বলের ওপর দিব্যি হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। বিরাট উদরটা আস্ত একখানি ছোট্টো টিলার মতো নিশ্বাসের সাথে সাথে ওঠানামা করছে। নাক দিয়ে মেঘ ডাকার মতো শব্দ হচ্ছে। সকালবেলা বেরুবার সময় পাঁড়েজীকে টিকিতে একটা লাল জবা ফুল খুঁজে কপালে চন্দন মেখে সুর করে হিন্দিতে তুলসীদাসের রামায়ণ পড়তে দেখেছি। তাঁর যে এতোবড়ো একটা প্রকাণ্ড ভূঁড়ি আছে, তখন কল্পনাও করতে পারিনি। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে পাঁড়েজী ধড়মড় করে জেগে হাঁক দিলো, কৌন? আমি তার সামনে এসে দাঁড়ালে চোখ রগড়াতে রগড়াতে একটুখানি হেসে বললো, আমি তো ভাবলাম কৌন না কৌন আপনি তো জয়বাংলার বাবু আছেন, যাইয়ে।
দোতলায় পা দিতে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেলো। এ লক্ষ্যহীন, উদ্দেশ্যহীন জীবনে বচসা ঝগড়া এসব আমরা নিয়মিত করে যাচ্ছি। আমার শরীরটা আজ ক্লান্ত। মনটা ততোধিক। ভেবেছিলাম, কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকবো। কিছু সময় একা একা থাকা আমার বড়ো প্রয়োজন। বাইরে কোথাও পার্কে টার্কে বসে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসবো কিনা ভাবাগোণা করছি, এ সময়ে আলো জ্বলে উঠলো। সুতরাং ঘরের দিকে পা বাড়ালাম, মেঝের ওপর পাতা আমাদের ঢালাও বিছানার ওপর নরেশদা গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। তাঁর বিপরীত দিকে দু’জন অচেনা তরুণ, দু’জনেরই গায়ে মোটা কাপড়ের জামা। একজনের হাতা কনুই অবধি গুটানো। জামার রঙ বাদামী ধরনের, তবে ঠিক বাদামী নয়। বুঝলাম, এরা কোনো ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে এসে থাকবে। হাত গুটানো তরুণের গায়ের রঙ হয়তো এক সময়ে উজ্জ্বল ফর্সা ছিলো, এখন তামাটে হয়ে গেছে। আরেকজন একেবারে কুচকুচে কালো। নরেশদা বললেন, এসো দানিয়েলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। ফর্সা তরুণটির দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, এর নাম হচ্ছে আজহার, আমার ছাত্র। আর ও হচ্ছে তার বন্ধু হিরন্ময়। দু’জনেই জলাঙ্গী ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে এসেছে। আজ রাত সাড়ে বারোটার সময় ট্রেনিং নেয়ার জন্য অন্যান্যদের সঙ্গে দেরাদুন চলে যাচ্ছে। নরেশদা জিগগেস করলেন, আজহার, তোমরা কিছু খাবে? না স্যার, হোটেলে খেয়েই তো আপনার কাছে এলাম। নরেশদা বললেন, তারপর খবর টবর বলো। এখানে এসে কি দেখলে, আর কি শুনলে? আজহার বললো, দেখলাম স্যার ঘুরে ঘুরে প্রিন্সেপ স্ট্রীট, থিয়েটর রোডের সাহেবরা খেয়ে দেয়ে তোফা আরামে আছেন। অনেককে তো চেনাই যায় না। চেহারায় চেকনাই লেগেছে। আমাদের ক্যাম্পগুলোর অবস্থা যদি দেখতেন স্যার। কি বলবো, খোলা আকাশের নিচে হাজার হাজার তরুণ রাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজছে, রোদে পুড়ছে। কারো অসুখবিসুখ হলে কি করুণ অবস্থা দাঁড়ায় নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না স্যার। আমরা কোলকাতা এসেছি চারদিন হলো। এ সময়ের মধ্যে অনেক কিছু দেখে ফেলেছি। একেকজন লোক ভারত সরকারের অতিথি হিসেবে এখানে জামাই আদরে দিন কাটাচ্ছে। তাদের খাওয়া-দাওয়া ফুর্তি করা, কোনো কিছুর অভাব নেই। আরেক দল বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে সোনা লুট করে কোলকাতা এসে ডেরা পেতেছে। আবার অনেকে এসেছে বিহারীদের পুঁজিপাট্টা হাতিয়ে নিয়ে। আপনি এই কোলকাতা শহরের সবগুলো বার, নাইট ক্লাবে খোঁজ করে দেখুন। দেখতে পাবেন ঝাঁকে ঝাঁকে বাংলাদেশের মানুষ দু’হাতে পয়সা ওড়াচ্ছে। এদের সঙ্গে থিয়েটার রোডের কর্তাব্যক্তিদের কোনো যোগাযোগ নেই বলতে পারেন? কথায় কথায় আজহার ভীষণ রেগে উঠলো। আগে আমরা ফিরে আসি, দেখবেন এই সমস্ত হারামজাদাদের কি কঠিন শিক্ষাটা দেই। স্যার, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমি একটা সিগারেট খেতে পারি? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আমারই অফার করা উচিত ছিলো। কিন্তু মাস্টার ছিলাম তো সংস্কার কাটতে কাটতেও কাটে না। আজহার একটা সিগারেট ধরালো।