তায়েবার ক্যান্সারের জন্য সবাই দায়ী হবেন কেন? ক্যান্সার রোগ তো আরো অনেকের হয়। এই ওয়ার্ডের অধিকাংশই তো ক্যান্সার রোগী। তারা কাকে দায়ী করে? বড়ো জোর ভাগ্যকে? আমি যে তায়েবার পক্ষ অবলম্বন করে মনে মনে এতো লম্ফঝম্ফ করছি এ পর্যন্ত তায়েবার জন্য কি করতে পেরেছি? হ্যাঁ এ পর্যন্ত একটা কৃতিত্ব আমার আছে। তায়েবাকে সন্ধ্যেবেলা হাসপাতালে প্রতিদিন দেখতে যাওয়ার খরচটা আয় করার একটা ব্যবস্থা করতে পেরেছি। নিজের দীনতা, তুচ্ছতা এবং হীনমন্যতার পরিচয় পেয়ে একটা আত্মঘৃণা ঘুরে ঘুরে বার বার আমাকে দগ্ধ করতে থাকলো। সেদিন সকালবেলা আমি হাসপাতালে গেলাম। ডঃ মাইতি আমাকে একটা পাশের ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছিলেন। দিনটি খুবই সুন্দর। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে। হাওয়াতে সামান্য হিমেল পরশ। আকাশে চচনে রোদ উঠেছে। শিশুসকালের রোদে চারপাশের গাছপালা চিরদিন এমনই সবুজ থাকবে, সূর্য এমনি করে সুন্দর আলোকরাশি বর্ষণ করবে, এমনি করে মানুষজনের কলকাকলিতে রাজপথ মুখরিত হবে, রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া এমনি ধরনের আওয়াজ করে বাতাস কম্পিত করে তুলবে, শুধু থাকবে না তায়েবা, জীবনের চলমান স্রোত থেকে বাদ পড়ে যাবে শুধু একজন। আল্লার দুনিয়ার এই পরিপূর্ণতার মধ্যে তার প্রস্থানের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত থাকবে না। আমার এতো বড়ো ক্ষতি আমি পূরণ করবো কি করে।
তায়েবার কেবিনে যখন প্রবেশ করলাম, দেখে খুবই ভালো লাগলো। সে উঠে বসেছে। সকালবেলা বোধ হয় গোসল করে ফেলেছে। খয়েরি রঙ্গের একটা পাটভাঙ্গা শাড়ি পরেছে। তাকে খুবই প্রফুল্ল দেখাচ্ছে। মুখে মনে হয় ক্রীম মেখেছে, ঘাড়ে পাউডারের দানা ছড়িয়ে আছে। হাসপাতালে আমি কোনোদিন তায়েবাকে এরকম হাসিখুশি দেখেছি মনে পড়ে না। আমার মনের ভেতরে একটা সূক্ষ্ম আশার রেখা খেলে গেলো। তাহলে কি তায়েবার অসুখ সেরে যাবে!
আমাকে দেখামাত্রই তায়েবা কলকল করে উঠলো। এই যে দানিয়েল ভাই, এসে গেছেন। তার কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের দু’টো কলি গুনগুন করে উঠলো। এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার। আজি প্ৰাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার। পূর্বের দিনের মতো হাততালি দিয়ে উঠতে চেষ্টা করলো। জানেন দানিয়েল ভাই, এই সকালবেলায় আপনি প্রথম মানুষ নন। আপনার আগেও একজন এসেছিলেন, কে বলুন দেখি। আমি বললাম, কেমন করে বলবো কে এসেছিলো। সে ঠোঁট একটুখানি ফুলিয়ে বললো, এসেছিলো, অর্চনাদি। আমি বললাম, এতো সকালে অর্চনা কেমন করে এলো। তার কোনো পাশও ছিলো না। তায়েবা জবাব দিলো অর্চনাদি চাইলে কিনা করতে পারে। তার কত প্রভাব প্রতিপত্তি। এই হাসপাতালে ডঃ সেনগুপ্ত বলে এক ভদ্রলোক আছেন, তিনি অর্চনাদির কি ধরনের আত্মীয় হন। ডঃ সেনগুপ্তকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। আমি আপনাকে বলেছিলাম না অর্চনাদি খুউব ভালো, আর খুউব রুচিবান মহিলা। দেখুন এই শাড়িখানা আমাকে দিয়ে গেছে। খুব সুন্দর না, আমাকে মানিয়েছে? আমি জিগেস করলাম, এটা কি নতুন শাড়ি? সে কপট রাগের ভঙ্গি করে বললো। আপনি এখনো পর্যন্ত একটা মিষ্টি কুমোড়, নতুন শাড়ির সঙ্গে পুরোনো শাড়ির পার্থক্য পর্যন্ত ধরতে পারেন না। এমন রঙকানা মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। তারপর তায়েবা বললো, অর্চনাদি আমাকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে গোসল করিয়েছে। তারপর শাড়ি পরিয়েছে। আমার মুখে ক্রীম মাখিয়ে দিয়েছে। ভীষণ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে আমার অসুখবিসুখ কিছু নেই। অর্চনাদির শাড়িতে আমাকে মানিয়েছে। কই কিছু তো বললেন না। আমি বললাম, হ্যাঁ খুব মানিয়েছে। জানেন দানিয়েল ভাই, জীবনে আমি আপনার মতো বেরসিক মানুষ বেশি দেখিনি। আপনার কোনো ভদ্রতাজ্ঞান নেই। এমন মুখ গোমড়া স্বভাবের মানুষকে অর্চনাদির মতো এমন একজন রুচিবান মহিলা কি করে সহ্য করেন, আমি তো ভেবে পাইনে।
তায়েবা কথাটা যতো সহজভাবেই বলুক, শুনে আমার কেমন জানি লাগলো। হাজার হোক মানুষের মন তো। তার কথাটা গায়ে না মেখে আমি বললাম, অর্চনার আমাকে সহ্য করার কি আছে? তাকে আমি আগে থেকে চিনতাম, চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিলো। এইতো সম্পর্ক। এ অনেক মানুষই তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল, অর্চনাও তার একজন। আর তাছাড়া…। তাছাড়া আর কি। অর্চনা তোমাকে খুবই পছন্দ করে। একথা আমাকে বার বার বলেছে। তায়েবা বললো, অর্চনাদি আপনাকে খুব পছন্দ করে। আপনাকে পছন্দ করে বলেই আমাকে দেখতে আসে। আমার সঙ্গে অর্চনাদির তো সেরকম কোনো পরিচয় ছিলো না। আমি বললাম, মানুষ একসূত্রে না একসূত্রে একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়। তোমার সঙ্গে পূর্বে পরিচয় ছিলো না। এখন তোমার সঙ্গে পরিচয় হলো। অর্চনাদি কি সুন্দর আর কি লম্বা আর কতো লেখাপড়া জানে। আপনার নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগে। আমি বললাম, অর্চনা শুধু আমার বন্ধু, আর কিছু বলতে পারবো না। এবার তায়েবা কথাটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, আপনি দেখতে একটুও সুন্দর নন, তবু এতো ভালো মহিলাদের সঙ্গে এমন ঘনিষ্টতা হয় কি করে। আমি বুঝতে পারিনে, আমি বললাম, তোমার সঙ্গেও আমার একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে, এটাকে তুমি কি বলবে?
তায়েবা তার হাতটা আমার মুখে চাপা দিয়ে বললো, দানিয়েল ভাই, মনে আছে একবার আপনি সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাড়িতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছিলো। আপনি শুনেই কারফিউর মধ্যে চলে গিয়েছিলেন। সারারাত আমি ঘুমোতে পারিনি। পরের দিন সকালবেলা আপনাকে কতো জায়গায় খুঁজে শেষ পর্যন্ত ডঃ মফিজ চৌধুরীর বাড়ি গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম, মনে আছে? আমি বললাম, মনে থাকবে না কেন, ও সমস্ত ঘটনা কেউ কি ভুলতে পারে। আচ্ছা, সেদিন আপনি অমন করে চলে গিয়েছিলেন কেন? আমি মনে মনে খুবই চেয়েছিলাম, আপনি রাতটা আমাদের বাড়িতে থেকে যাবেন। কোনোদিন বলিনি, আজ বলছি, খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। আচ্ছা, সেদিন থেকে গেলেন না কেন? আমি বললাম, তুমি থাকতে বললে না কেন? আমি বললে আপনি থাকতেন। অবশ্যই থাকতাম! আপনাকে থাকতে বলতে হবে কেন, আপনি নিজেই থাকলেন না কেন? সব কথা কি বলতে হয়?