সৌগতবাবু বললেন, দেখি অনিমেষদা। তারপর মূলপ্রবন্ধ এবং অনূদিত অংশ টেনে নিয়ে দেখতে লাগলেন। অনুবাদের অংশটি পড়া শেষ করে বললেন, তাহলে এখন থেকে আপনি আর্যদের আদি নিবাস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এই ধরনের প্রবন্ধের পাঠক এখনো পশ্চিমবঙ্গে আছে নাকি। আপনার কাগজ কেউ পড়ে? সৌগত, তুমি একটা আস্ত আহামক। শখের কমিউনিস্টগিরি করে বেড়াও বলে দেখতে পাওনি। দশ বছর থেকেই প্রতি সপ্তাহে আট হাজার কাগজ ছেপে আসছি। বাজারে দেয়ার প্রয়োজন হয় না, গ্রাহকদের বাড়িতে আমি কাগজ পাঠিয়ে দেই। তারা আমাকে ডাকে চাঁদা পাঠান। তোমার ভুলে যাওয়া উচিত নয়, তোমার মতো পশ্চিম বাংলায় সকলে বিটকেলে জাতখোয়ানো বামুন নয়। কিছু খাঁটি এবং সৎ ব্রাহ্মণ এখনো আছেন। সৎ হিন্দুও অনেক আছেন। তারা অনেকদিন থেকেই আমার কাগজ নিয়মিত পাঠ করে আসছেন। তুমি যদি দেখতে চাও আমি গ্রাহক লিস্ট দেখাতে পারি। অনিমেষবাবুর খোঁচা খেয়ে সৌগত একটু নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, বুঝলাম, সৎ হিন্দুরা আপনার কাগজ পড়েন। কিন্তু আপনি কাগজে কি লিখেন? কেননা আমি হিন্দুদের কথা লিখি। হিন্দুদের মহান ঐতিহ্যের কথা লিখি। স্বার্থের কথা লিখি। হিন্দুরা যে মহান জাতি সে কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেই। অনিমেষবাবুর কথার মধ্যে কোনো জড়তা নেই। যে কেউ তাঁর কথা শুনলে বুঝতে পারবেন, তার মন এবং মুখের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। অনিমেষবাবু বললেন, সৌগত, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তোমার বাংলাদেশের কমরেডের সঙ্গে কথাবার্তাটা আগে ফয়সালা করে নেই। প্রতি হাজার শব্দে আমি পঁচিশ টাকা করে দিয়ে থাকি। আমাদের যিনি অনুবাদ করতেন, তিন চার মাস যাবত অসুস্থ। বাঁচবেন কিনা সন্দেহ। তোমার বন্ধু যদি রাজি থাকেন, তাঁকে কাজটা দিতে আমি প্রস্তুত। সৌগত বাবু বললেন, কিন্তু দাদা আমার একটা খটকা থেকে গেলো। আপনার কাগজ হিন্দুদের কাগজ। একজন মুসলিম যদি অনুবাদ করে আর সে লেখা যদি আপনি ছাপেন, তাতে কোনো দোষ হবে না? অনিমেষবাবু স্পষ্টভাবে বললেন, না কোনো দোষ হবে না। কেন দোষ হবে? যদি হিন্দু সংস্কৃতি, হিন্দু সভ্যতা সম্বন্ধে তোমার কোনো ধারণা থাকতো, তুমিও বুঝতে পারতে এতে দোষের কিছু নেই। আমি একজন সৎ এবং নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ হিসেবে অনুভব করি সঠিক বিষয়টি চিন্তা করা ছাড়া আমার আর কোনো কর্তব্য নেই। যুগে যুগে ব্রাহ্মণেরা তাই করে এসেছে। ক্ষত্রিয়েরা যুদ্ধ করেছে, বৈশ্যরা ব্যবসা করেছে, শূদ্ররা পরিশ্রম করেছে। আর ব্রাহ্মণ সব সময়ে বিধান দিয়েছে। কেউ না কেউ ব্রাহ্মণের কাজ করে দিয়েছে। একজন গুণবান পণ্ডিত ব্রাহ্মণের লেখা একজন মুসলমান দিয়ে অনুবাদ করালে এবং সে লেখা হিন্দুদের পড়তে দিলে এতে দোষের কিছু থাকতে পারে বলে আমি মনে করিনে। সৌগতবাবু এবং অনিমেষবাবুর বিতর্কটি শুনে আমি তো দিশেহারা। ভাবনায় পড়ে গেলাম। কাজটা নেবো কিনা। আমার যে অবস্থা রাস্তায় কুলিগিরি হলেও আপত্তি ছিলো না। আমার দৈনিক মাত্র পাঁচ ছয়টি টাকার প্রয়োজন। কুলিগিরিতে শারীরিক পরিশ্রম লাগে কিন্তু মানসিক নির্যাতন নেই। এই কাজটি গ্রহণ করলে তার চাইতে ঢের কম শ্রমে আরো বেশি আমি পেতে পারি। আমার অন্তরাত্মা বলছে, এই কাজের ভেতরে এমন কিছু আছে, গ্রহণ করলে আমি নিজের কাছে নিজে ছোটো হয়ে যাবো। কিন্তু তায়েবার কথা মনে হওয়ায় বুকটা হু হু করে উঠলো। কথা দিলাম, অনুবাদের কাজটা আমি করবো।
১১-১২. অনিমেষবাবুর অনুবাদের কাজ
অনিমেষবাবুর অনুবাদের কাজটা গ্রহণ করার পর থেকে আমার মানসিকতার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আমার সেই উড়ু উড়ু ভাবটা অনেক পরিমাণে কমেছে। আসলে এতোদিন আমার ভেতরে যে হা হুতাশ চলছিলো এবং যা আমি তায়েবার প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রকাশ মনে করে আসছিলাম, তা সর্বাংশে সঠিক নয়। আমার নিজের প্রতি নিজের যে কর্তব্যবোধ তা পালন করার অক্ষমতা থেকেই আমার ভাবাবেগ জন্ম নিচ্ছিলো। তায়েবার চারপাশে যারা জড়ো হয়, যারা তাকে সকাল বিকেল দেখতে আসে আমি মনে করতাম, কেউ তায়েবার মঙ্গল চায় না। তারা আসে মজা দেখার জন্য, কষ্ট বাড়াবার জন্য অথবা জাহিদুল এবং ডোরার মতো নিজেদের কৃতকর্মের অপরাধবোধ লাঘব করার জন্য। আমি মনে করতাম, গোটা কোলকাতা শহরে আমিই হলাম একমাত্র ব্যক্তি যে তায়েবার মঙ্গল চায়। আর সকলেই তায়েবার শত্রু।
দৈনিক দশ টাকা আয় করার জন্য তিন সাড়ে তিন ঘণ্টার কঠোর খাটুনি খাটতে গিয়ে আমার চোখ খুলে গেলো। আমি আবিষ্কার করলাম তায়েবার চিকিৎসার যাবতীয় অষুধপত্তর সবটা হাসপাতাল দেয় না, বাইরে থেকে সংগ্রহ করতে হয়। তার পেছনে অন্ততঃ তিন থেকে সাড়ে তিনশো টাকা ব্যয় করতে হয় প্রতিদিন। এই টাকাটা কে সংগ্রহ করে, কার কাছ থেকে সংগ্রহ করে, কে অষুধ কেনে, কে পথ্য সরবরাহ করে কিছুরই সংবাদ জানিনে। অথচ আমি মনে করি আমি তায়েবাকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসার দাবিতে না করতে পারবো হেননা দুঃসাধ্য কর্ম আমার নেই। তায়েবার দেখাশোনার সব দায়িত্বটা যদি আমার ওপর পড়তো, আমি কি করতাম। আমি মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম। তার পার্টির মানুষদের আমি অপরাধী সাব্যস্ত করে বসে আছি। কিন্তু তারা তো টাকাটা ম্যানেজ করছে। জাহিদুলকে আমি ক্রিমিন্যাল ধরে নিয়েছি। আমার বিবেচনায় ডোরা একটি নষ্টা মেয়ে। দু’তিনদিন আগে জানতে পেরেছি, জাহিদুল এখানে সেখানে ডোরাকে নিয়ে যে অনুষ্ঠান করায়, তাতে যে টাকাটা আসে, তার সবটা তায়েবার পেছনে খরচ করে। এমনকি দিল্লীতে গান গেয়ে যে টাকাটা ডোরা পেয়েছিলো, ও দিয়ে আমেরিকা থেকে কি একটা দুষ্প্রাপ্য ইনজেকশন আনিয়েছে। ডোরা জাহিদুলকে বিয়ে করেছে। তাতে এমন অন্যায়টা কি হয়েছে? এরকম অনেক তো ঘটে। হেনা ভাই একটা বিধবা মেয়েকে এ সময়ে বিয়ে করে অপরাধ কি করেছে? মহিলা এবং হেনা ভাই পরস্পরকে পছন্দ করেই তো বিয়ে করেছে। আমি এক ধারে সকলকে অপরাধী মনে করি কেন। পৃথিবীর সকলে ঘোরতরো পাপে লিপ্ত, আর আমি একা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির এ কেমন করে হয়।