সৌগত বন্দ্যোপাধ্যায় নমস্কার করে বললেন, এই যে অনিমেষদা, দেখলেন তো কাঁটায় কাঁটায় দশটায় এসে হাজির হয়েছি। অনিমেষবাবু তাঁর রিভলভিং চেয়ারে একটুখানি নড়ে চড়ে বসলেন। টেবিল থেকে পেপার ওয়েটটা তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করলেন। তারপর বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে বললেন, বসো বসো সৌগত, একটা কাজের মতো কাজ করে বসে আছো দেখছি। জীবনে তোমাকে এই প্রথম সময় রক্ষা করতে দেখলাম। তারপর তোমার পকেট বিপ্লবী দলের সংবাদ কি। এই বুঝি তোমার নতুন কমরেড।
সৌগত অনিমেষবাবুর অন্যসব কথার জবাব না দিয়ে বললেন, আপনি একজন অনুবাদক চেয়েছিলেন। আমার ধারণা ইনি ভালো অনুবাদ করতে পারবেন। ভদ্রলোক বাংলাদেশ থেকে এসে ভীষণ অসুবিধেয় পড়ে গেছেন। তার এক নিকট আত্মীয়ার ভীষণ অসুখ। আপনি যদি কিছু সাহায্য করতে পারেন। এবার তিনি আপাদমস্তক আমাকে একবার ভালো করে দেখে নিলেন। তারপর জানতে চাইলেন, আপনি বংলাদেশ থেকে এসেছেন? আমি মাথা নাড়লাম। ভদ্রলোক বললেন, বাংলাদেশ মানেই তো অসুবিধে। ওই মুসলমানের দেশে এতোদিন পড়েছিলেন, আগে চলে আসেননি কেনো? ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি একরকম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আমার চোখমুখ লাল হয়ে গেলো। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। কি বলতে হবে খুঁজে না পেয়ে সৌগতবাবুর দিকে তাকালাম। দেখি তিনিও মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। তিনি আমার চাইতে কম অবাক হননি।
সৌগতবাবু আমতা আমতা করে বলতে চেষ্টা করলেন, আপনি অনুবাদ করার লোক চেয়েছিলেন, আমার ধারণা ইনি ভালো অনুবাদ করবেন, আপনি টেস্ট করে দেখতে পারেন। আরে রাখো তোমার টেস্ট, আগে কথাবার্তা বলতে দাও। তারপর অনিমেষবাবু আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, কি মশায়, চুপ করে আছেন, আগে চলে আসেননি কেন? আমি মৃদুকণ্ঠে বললাম, আগে চলে আসবো কেমন করে? তিনি ফের জিগগেস করলেন, এখন কি করে চলে আসতে পারলেন? আমি বললাম, পাকিস্তানী মিলিটারি আক্রমণ করে বসলো, তাই বাধ্য হয়ে…। আমার মুখের কথা শেষ হওয়ার আগে ভদ্রলোক কণ্ঠস্বর চড়িয়ে বললেন, মুসলমানদের লাথি আঁটা এতোদিন খুব মধুর লেগেছিলো তাই না, এখন মুসলমানে মুসলমানে লাঠালাঠি লেগেছে, আপনারা সকলে একসঙ্গে হুড়মুড় করে আমাদের ওপর চড়ে বসেছেন। অগত্যা আমাকে। বলতে হলো আমিও মুসলমান। তাঁর মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। হলেনই বা মুসলমান। তাতে এমন কি এসে গেলো। আমি মশায় সাফ কথার মানুষ। হিন্দু মুসলমানের ভিত্তিতে যখন দেশ ভাগ হয়েছে, হিন্দুদের সে দেশ থেকে অনেক আগেই চলে আসা উচিত ছিলো। দেড় কোটিরও বেশি হিন্দু পূর্বপাকিস্তানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার জন্য দশ কোটি মুসলমানকে আমাদের সহ্য করতে হচ্ছে। দেশ ভাগের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুরা ভারতবর্ষে চলে এলে আমরা মুসলমানদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করতাম। সব সমস্যার সাফ সাফ সমাধান হয়ে যেতো। ওই হিন্দুরা পূর্বপাকিস্তানে থেকে যাওয়ার জন্যই ভারতকে মুসলমানে মুসলমানে মারামারি কাটাকাটিতে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। ভারতের কি আর কোনো সমস্যা নেই? সে কথাও থাকুক। ভারতবর্ষ হিন্দুদের দেশ বলেই না হয় হিন্দুরা ভারতবর্ষে এসেছে। কিন্তু আপনারা কোন্ মুখে দলে দলে চলে এলেন? আমি অনিমেষ বাবুর কথায় রাগ করতে পারলাম না। আমার লেগেছে একথা সত্যি। তারপরেও মনে মনে ভদ্রলোকের প্রশংসা না করে পারলাম না। তার মধ্যে আর যাই হোক কপটতার বালাই নেই।
আমি মনে করলাম, আর বসে থেকে লাভ কি? অন্ততঃ একটা নতুন অভিজ্ঞতা তো হলো। আমি স্যাণ্ডেলে পা গলিয়ে বললাম, তাহলে আমি আসি। সৌগতবাবুকে আমার সঙ্গে আসতে বলবো কিনা ভাবনায় পড়ে গেলাম। অনিমেষবাবু বললেন, আপনার খারাপ লেগেছে বুঝতে পারি। কিন্তু আমি মশায় যা ভাবি বলে ফেলি। আমার ভেতর ঢাক ঢাক গুড় গুড় কিছু পাবেন না। বসুন, চা খান। চলে যাবেন কেন, আপনি তো কিছু কাজ চেয়েছিলেন। আমার তো একজন অনুবাদক প্রয়োজন। তারপর তিনি কম্পোজিটরদের একজনকে ডেকে বললেন, ভূপতি যাও নিচে থেকে, চা এবং সিঙ্গারা নিয়ে এসো। উঠি উঠি করেও উঠতে পারলাম না। সৌগতবাবু বললেন, অনিমেষদা, চা আনতে তো কিছু সময় লাগবে, ততোক্ষণে আপনি দানিয়েল সাহেবকে টেস্ট করে দেখেন, অনুবাদে হাত আছে কিনা। অনিমেষবাবু ধমক দিয়ে বললেন, সৌগত নড়াচড়া করবে না। ঠিক হয়ে বসো। আমি তোমাদের শখের কমিউনিস্টদের মতো হিপোক্র্যাট নই। আমার অনুবাদের মানুষ দরকার, উনি যদি ভালোভাবে করতে পারেন, অবশ্যই কাজ দেবো। সহজ কথাটা সহজভাবে বলি বলে মনে করো না, আমার কোনো ভদ্রতাজ্ঞান নেই।
এবার অনিমেষবাবু অপেক্ষাকৃত সহজ ভঙ্গিতে আমার সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। তিনি জানতে চাইলেন আমার বাড়ি কোথায়। আমি বললাম, চট্টগ্রাম। তিনি বললেন, আমাদের বাড়িও একসময় ওদিকে ছিলো। পঞ্চাশের রায়টের পর সবকিছু বেচেকিনে চলে এসেছি। আমি তাঁর বাড়ি চট্টগ্রাম কোথায় জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, না চট্টগ্রাম নয়, তবে সীমান্তের অপর পাড়েই তাঁদের বাড়ি। যশোর জেলার নড়াইল মহকুমায়। এরই মধ্যে চা এলো, সিঙ্গারা এলো। আমার দিকে প্লেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, খান। চা খাওয়া শেষ হলে একটা সিগারেট খাওয়া যাবে কিনা অনুমতি চাইলাম। তিনি বললেন, ফিল ফ্রি। সংবাদপত্রের অফিসে আবার কেউ সিগারেট খাওয়ার অনুমতি চায় নাকি। তারপর তিনি আমাকে ইংরেজি টাইপ করা একটি প্রবন্ধ দিয়ে বললেন, একটা পৃষ্ঠা অনুবাদ করে দেখান, দেখি আপনার হাত কেমন। আমি একটু সরে বসে অনুবাদ করতে লেগে গেলাম। প্রবন্ধটির শিরোনাম হলো আর্যদের আদি নিবাস। স্বামীজী বিরূপাক্ষ হলেন লেখক। তিনি প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন, ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা আর্যদের বহিরাগত প্রমাণ করে যে সকল বইপুস্তক লিখেছেন, সেগুলো একেবারেই প্রমাণসিদ্ধ নয়। আর্যদের আদি নিবাস হলো ভারতবর্ষে। এই ভারতবর্ষ থেকেই আর্যরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমার একটা পৃষ্ঠা অনুবাদ করতে আধ ঘণ্টার মতো সময় লাগলো। তারপর আমি অনুবাদ করা অংশটি নিয়ে অনিমেষবাবুর টেবিলে রাখলাম। তিনি চশমা খুলে পড়ে দেখলেন। বললেন, আপনি তো মোটামুটি ভালোই অনুবাদ করেন। শুধু একটি শব্দ আমি পাল্টাচ্ছি। যেখানে সিন্ধুনদের পানি বলেছেন,আমি পানি কেটে জল শব্দটি বসাচ্ছি। আমি বললাম, জল পানিতে আমার কিছু আসবে যাবে না।