আমি কিছু কাজ করতে চেয়েছিলাম। বেশি নয়, অন্ততঃ দিনে পাঁচটা টাকা জোটাবার জন্য আমি কিছু কাজ করতে চাই। তিন ঘণ্টা কুলিগিরি করেও যদি পাঁচটি টাকা পাই আমি করতে রাজি। ওই টাকাটি না পেলে আমার পক্ষে তায়েবার হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব হবে না। আর ইদানিং একটা সঙ্কোচবোধ আমাকে ভয়ানক আড়ষ্ট করে ফেলেছে। তায়েবার অসুখের কথা বলে চাইলে ওই টাকাটা হয়তো আমি কারো না কারো কাছ থেকে আদায় করতে পারি। আমার চেনাজানা মানুষের সংখ্যা নেহায়েত অল্প নয়। নানা সময়ে আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তাদের কাছে হাত পেতে চেয়ে নিতে কোনো রকমের কুণ্ঠা বোধ করিনি। তায়েবার অসুখের নাম করে কারো কাছে টাকা চাওয়া গেলেও আমার পক্ষে সম্ভবত নেয়া হবে না। দু’তিন দিন আগে অর্চনা হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে রেস্টুরেন্টে চা খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলো। ওখানেই সে আমার হাতে পাঁচশো টাকার একটি নোট দিয়ে বলেছিলো, দানিয়েল, টাকাটা রাখো। এ সময়টাতে তোমার বোধ হয় খুবই টানাটানি চলছে। আমি হাতে স্বর্গ পেয়ে গিয়েছিলাম। এই সময়ে পাঁচশো টাকা অনেক টাকা। তথাপি অর্চনার টাকাটি গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ধন্যবাদ দিয়ে বলেছিলাম, টাকাগুলো তোমার কাছে থাকুক, আমার যখন খুব প্রয়োজন পড়বে চেয়ে নেবো। অর্চনা বললো, তুমি বরাবর একগুয়ে। আর তাছাড়া…। তাছাড়া কি? তুমি আমাকে বন্ধু মনে করো না। আমি বললাম, অর্চনা আমি তোমাকে ঠিকই বন্ধু মনে করি, এই কোলকাতা শহরে তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই যার কাছে আমার মনের বোঝা হালকা করতে পারি। তুমি না থাকলে নিঃসন্দেহে আমার কষ্ট অনেকগুণে বেড়ে যেতো। আমার টাকার ভীষণ প্রয়োজন, তথাপি তোমার টাকাটি গ্রহণ করতে পারবো না। দয়া করে কিছু মনে করো না লক্ষ্মীটি। অর্চনা টাকা ব্যাগে রাখতে রাখতে বললো, বক্তৃতাটি কি একটু দীর্ঘ হয়ে গেলো না? আমি কোনো কথা না বলে গড়িয়াহাটার ট্রামে না ওঠা পর্যন্ত তাকে সঙ্গ দিলাম।
আমি যে কিছু কাজ করতে চাই একথা বন্ধুবান্ধব অনেককেই বলেছি। সেদিন সন্ধ্যেবেলা হাসপাতাল থেকে বৌ বাজারের হোস্টেলে ফেরার পর নরেশদা জানালেন। সৌগতবাবু একটা কাজের খবর দিয়ে গেছেন। শুনে আমিতো অবাক হয়ে গেলাম। সৌগত বন্দ্যোপাধ্যায় লোকটিকে আমি কখনো পছন্দ করিনি। তাই তাঁর সঙ্গে আন্তরিকভাবে আলাপ পর্যন্ত করা হয়নি। আজ তিনি আমার চূড়ান্ত বিপদের সময় এতো বড়ো একটা উপকার করলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজের সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া করার চেষ্টা করলাম। নরেশদা এক টুকরো কাগজ আমার হাতে তুলে দিলেন। দেখলাম, লেখা রয়েছে অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্পাদক সাপ্তাহিক নতুন খবর, ৯১ নম্বর মঠলেন, কোলকাতা-৯১। নরেশদাকে জিগ্গেস করলাম, নতুন খবর নামে কোলকাতায় একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা আছে তাতো জানতাম না। আমাকে কি ধরনের কাজ করতে হবে কিছু বলেছেন নাকি। তিনি জবাবে বললেন, না সেসব কিছু বলেননি। শুধু তোমাকে আগামীকাল সাড়ে ন’টার সময় তৈরি থাকতে বলেছেন, তিনি এসে তোমাকে নিয়ে যাবেন। সেদিনও বাংলাদেশের ছেলেরা কেউ হোস্টেলে ছিলো না। সকলে মিলে হাওড়াতে একটা অনুষ্ঠান করতে গেছে। ঘর ফাঁকা। আমার ঠিক কি হয়েছে খুলে বলতে পারবো না। যখন অধিক লোকজন থাকে একটুখানি নির্জনতার জন্য মন উতলা হয়ে ওঠে। আর যখন লোকজন থাকে না নির্জনতা বোঝার মতো বুকের ওপর চেপে বসে। নরেশদার ভেতর কি ঘটছে অনেকদিন জিগগেস করা হয়নি। অঞ্জলি কোলকাতা আসতে চায় কিনা। তার বাবা মা এখন রাজার মঠে বড়ো ভায়ের বাসায় কি অবস্থায় আছেন, ভদ্রতার খাতিরে হলেও এসকল সংবাদ জিগ্গেস করা প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু আমার কোনো কথা বলার প্রবৃত্তি হলো না। তিনি জিগগেস করলেন, এখন কি করবি? আমি বললাম, ঘুমোবো। কাল সৌগতবাবুর সঙ্গে যাবি? হ্যাঁ বলে মশারিটা নামিয়ে দিয়ে আমি শুয়ে পড়লাম।
পরের দিন ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে নটার সময় সৌগতবাবু এসে হাজির। বললেন, তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নিন। অনিমেষদা আবার সময়নিষ্ঠ মানুষ। তাঁকে কথা দিয়েছি ঠিক দশটার সময় আমরা আসবো। অধিক কথা না বাড়িয়ে জামা কাপড় পরে সৌগতবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে এলাম। বাসের জন্য বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হলো। আমরা যখন মঠলেনে এসে নামলাম দশটা প্রায় বাজে। প্রচণ্ড ভিড়ে ঘেমে একেবারে নেয়ে উঠেছি। নতুন খবরের অফিসে পৌঁছতে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নিলো না। মঠলেন বড়ো ঘিঞ্জি জায়গা, আমাদেরকে প্রায়ান্ধকার সিঁড়ি বেয়ে একটি সেকেলে লাল ইট বের হওয়া দালানের তিন তলায় উঠতে হলো। সিঁড়ির বাঁদিকে ছোটো একটি নেমপ্লেট লাগানো। দরোজা ভোলাই ছিলো। আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। অফিস কামরাটি খুব বড়ো নয়। একপাশে দেখলাম দু’জন কম্পোজিটর কম্পোজ করছে। টাইপের খাঁচার পাশ ঘেঁষে একটা চেকন লম্বা টেবিল পাতা। একজন অল্পবয়েসী মানুষ বসে বসে পুফ কাটছে। মাঝখানটিতে সম্পাদক অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের টেবিল। একটা ছোটো সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে ভদ্রলোক রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন। ভদ্রলোকের খুব ধারালো চেহারা। নাকটি তীক্ষ্ণ এবং বাঁকানো। গোঁফজোড়া ছুঁচোলো করে ছাটা। পরনে ধুতি এবং মটকার পাঞ্জাবি। ভদ্রলোকের চোখজোড়া ভীষণ উজ্জ্বল। বয়েস কতো হবে বলা মুশকিল। পঁয়তাল্লিশ হতে পারে, আবার পঞ্চাশও হতে পারে। কিছু মানুষ আছে যাদের চেহারা দেখে বয়েস আন্দাজ করা যায় না।