অর্চনা বললো, দানিয়েল, তোমার বলার প্রয়োজন ছিলো না। আমি তো এমনিতেই তায়েবাদিকে দেখতে প্রতিদিন যাচ্ছি। তাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। একেবারে খড়খড়ে মহিলা। কোথাও কোনো স্যাঁতস্যাঁতে নেই। কিন্তু তুমি যে বললে আমি এটা ওটা বলে তার মনটা হালকা করতে পারবো, এটা বোধ করি সত্যি নয়। আমি জিগেস করলাম, তুমি একথা বললে কেন? অর্চনা বললো, আজ দুপুরে আমাদের এখানে খেয়ে যাও। আমি বললাম, না অর্চনা, তা হয় না। আমাকে বাংলাদেশের ছেলেদের সঙ্গেই খেতে হবে। আর তাছাড়া ইসলাম সাহেবের কাছে প্রমোদবাবু তাঁর কৈশোর-যৌবনের স্মৃতিচারণ করছেন। এই ফ্রান্স প্রত্যাগত ভদ্রলোকটিকে আমার মনে ধরেছে। ভদ্রলোকের সঙ্গে হয়তো কোনো ব্যাপারে আমার মতের মিল হবে না। কিন্তু তাঁর চরিত্রের একটি দিক আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। প্রমোদবাবু এখনো মনে করেন, জাতি হিসেবে বাঙালির একটি স্বাধীন অবস্থান সৃষ্টি হবে। এটা সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি বড়ো ঘটনা। যদিও নানা পরস্পর বিরোধী মতামতের দ্বন্দ্ব দেখে তাঁর মনে নানা রকম সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আমি বললাম, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুবই খুশি হলাম। আরেকদিন সময় করে এসে গল্প করে যাবো। প্রমোদবাবু বললেন, কাল আমি আপনাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প দেখতে সীমান্ত এলাকায় যাবো। হয়তো দু’চারদিন থেকে যেতে হবে। আমি বাড়িতে আছি কিনা খবর নিয়ে আসবেন। আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করার ইচ্ছে। আমি বললাম, আপনি একা একা সীমান্ত এলাকায় যাবেন কোনো অসুবিধে হবে না। তিনি জবাবে বললেন, ত্রিগুনা সেন হলেন তার এক বন্ধুর মামা। ত্রিগুনাবাবু তাঁকে বিএসএফ-এর এক কর্ণেলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন। কর্ণেল সাহেবই তাঁকে নিয়ে যাবেন।
অর্চনাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে চড়ার পর মজহারুল ইসলাম সাহেব বললেন, মশায় আপনাদের নিয়ে আর পারা গেলো না। একবার ইসলামের ধুয়ো তুলে দেশ ভাগ করলেন। আবার এখন বাঙালিত্বের ধুয়ো তুলে কি সমস্ত বিষাক্ত মতামত এখানে ওখানে ছড়াচ্ছেন। দুনিয়াতে পাগলের সংখ্যা তো অল্প নয়, বস্তাপচা বাঙালি জাতীয়তার কথায় বিশ্বাস করে এমন মানুষও দেখি পাওয়া যায় ভূড়ি ভূড়ি। আমি বললাম, পাওয়া যাবেনা কেন? মশায় দেখছি আপনারা আমাদের অনেক জ্বালাবেন। আমি বললাম, আল্লাহ, আমাদের জ্বালাবার ক্ষমতাটুকুই শুধু দিয়েছেন। তিনি একটা চারমিনার ধরিয়ে বললেন, রাখেন আপনার আল্লাহ, আজকের গোটা দিনটিই নষ্ট হলো।
.
১০.
দেখতে দেখতে সেপ্টেম্বর মাস চলে এসেছে। হাসপাতালে যাওয়া আমার নিত্যিদিনের অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেছে। অন্য কোনো কাজকর্ম না থাকলে দিনে দু’বারও যাই। রোজই দেখতে পাচ্ছি তায়েবার প্রাণশক্তি আস্তে আস্তে থিতিয়ে আসছে। এখন সে নিজের শক্তিতে বিছানা থেকে উঠতে পারে না, তাকে তুলে বসাতে হয়। ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যেতে হয়। কোলকাতায় আমাদের জীবনধারণ কঠিন হয়ে উঠেছে। তায়েবার মা, দু’বোন, বড়ো ভাই সকলেই কোলকাতায় আছেন। তার পার্টির কর্মীরাও নিয়মিত আসে, দেখাশোনা করে। কিন্তু তায়েবা শুয়ে থাকে। বড়ো বড়ো চোখ পাকিয়ে সব কিছু দেখে। খুব কমই কথা বলে। আগে যে তায়েবাকে দেখেছে, এ অবস্থায় দেখলে মনে হবে এই মধ্যে আগের তায়েবার কিছুই অবশিষ্ট নেই। সে যখন শুয়ে থাকে, দেখলে আমার মরা নদীর মতো মনে হয়। গতি নেই, স্পন্দন নেই। আমার বুকটা ধক করে উঠে। কি যে বেদনার স্রোত বয়ে যায় সে আমি ভাষায় বর্ণনা করতে পারবো না। এখনো জাহিদুল আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। ডোরা দেখলে অপ্রস্তুত বোধ করে। এমন একটা জিজ্ঞাসাচিহ্ন ফুটিয়ে তোলে, তার অর্থ দাঁড়ায় তুমি এখানে কেন?
কারো কোনো মন্তব্য আমি আর গায়ে মাখিনে। আমার সঙ্গে কেউ কথা বলুক, না বলুক আমার কিছু যায় আসে না। আমি যখন তার কেবিনে ঢুকি, দেখামাত্রই তায়েবার ঠোঁটে একটা ক্লান্ত সুন্দর হাসির রেখা জেগে উঠে। তার এই হাসিটাই আমাকে সবকিছু অগ্রাহ্য করতে শিখিয়েছে। আমার ইচ্ছে করে তার হাত পায়ে হাত বুলিয়ে দিই। মাথার উড়ো উড়ো রুক্ষ চুলগুলো ঠিক করে রাখি। খসে পড়া সাপের খোলসের মতো এলোমেলো শাড়িটা গুছিয়ে ঠিক করে পরিয়ে দেই। কিছুই করতে পারিনে আমি। সব সময় ঘরভর্তি মানুষ তাকে পাহারা দিয়ে রাখে। আমাকে মনের বেদনা মনের ভেতর চেপে রাখতে হয়।
আমাদের বেঁচে থাকাটাই একটা সগ্রাম। পরের বেলার ভাত কিভাবে জোটাবো সে জন্য অনেক ফন্দিফিকির করতে হয়। ভাগ্যগুণে একটা থাকার জায়গা পেয়েছি। সেখানে যারা থাকে সকলের অবস্থাই আমার মতো। যেখান থেকে যে পয়সা সংগ্রহ করে আনি, ও দিয়ে সকলে মিলে ভাত খাওয়া সম্ভব হয় না। প্রায় সময় আমাদের মাদ্রাজি দোকানে দোসা খেয়ে কাটাতে হয়। তার ওপর আমার আবার সিগারেট খাওয়ার নেশা। রোজ তায়েবার পেছনে কম করে পাঁচটি টাকা সংগ্রহ করতে কি পরিমাণ বেগ পেতে হয় বলে বোঝানো সম্ভব নয়। এখানে সেখানে লেখালেখি করে অল্পস্বল্প অর্থ আমি আয় করেছি। তার পরিমাণ খুবই সামান্য। বাংলাদেশের নানা চেনাজানা মানুষ কিছু টাকা পয়সা দিয়েছে। অস্বীকার করবো না, প্রিন্সেপ স্ট্রীটে অস্থায়ী সরকারের অফিস থেকেও নানা সময়ে কিছু টাকা আমাকে দেয়া হয়েছে। কোলকাতার মানুষেরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কিছু টাকা আমার হাতে তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষক সহায়ক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ চক্রবর্তী অল্পস্বল্প কাজ করিয়ে নিয়ে সে তুলনায় অনেক বেশি টাকা আমাকে দিয়েছেন। কিন্তু টাকার এমন ধর্ম, পকেটে পড়ার সাথে সাথে উধাও হয়ে যায়। যেদিকেই তাকাই প্রয়োজন গিলে খাওয়ার জন্য হাঁ করে ছুটে আসে।