শোভা মেয়েটি চা দিয়ে গেলো। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মনে হলো বাইরের গরম ভেতরের গরমকে অনেকখানি কাবু করে ফেলেছে। আমার ভাবাবেগ অনেকখানি প্রশমিত হয়ে এসেছে। আমি সমস্ত বিষয় অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা মাথায় বিচার করতে পারছি। বাইরের ঘরের টুকরো টুকরো আলাপ কানে আসছে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, হিন্দু, মুসলমান, চীন, রাশিয়া, আমেরিকা, বাঙালি, অবাঙালি, শেখ মুজিব, ভাসানী, ইন্দিরা গান্ধী, নকশাল, কংগ্রেস, সিপিএম এসকল বিষয় আলোচনায় বার বার ঘুরে ঘুরে আসছে। আমি যেখানেই যাই সেখানেই মাটি খুঁড়ে একটি বিতর্ক জেগে ওঠে। আমার জন্মই যেনো একটা মস্ত বড়ো বিতর্কের বিষয়। আমি যদি জন্ম না নিতাম, এতোগুলো মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতে আসতো না, তায়েবার অসুখ হতো না, যে সকল সংকটু সমস্যা পৃথিবীর স্বাভাবিক জীবন প্রবাহের গতিরোধ করে দাঁড়িয়েছে, তার কিছুই ঘটতো না। দুনিয়াতে যেখানে যা কিছু ঘটছে তার জন্য যেনো আমিই দায়ী। আমাকে নিন্দা করতে হয়, পক্ষ নিতে হয়। মনে হচ্ছে আমি দুনিয়া জোড়া প্রসারিত একটা শক্ত মাকড়সার জালের মধ্যে পড়ে গেছি। হাজার চেষ্টা করেও তার নাগপাশ ছিন্ন করতে পারবো না।
অর্চনা ভেতরের ঘর থেকে এসে জিগগেস করলো, চা খেয়েছো? আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলাম। সে আমার দিকে কবার চোরা চোখে তাকালো এবং তারপর বললো, তায়েবাদির অসুখটা বেশ জটিল। খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন এমন তো মনে হয় না। তুমি কি মনে করো? জবাব দিলাম, তায়েবা আর অসুখ। থেকে কোনোদিনই সুস্থ হয়ে উঠবে না এবং এটাই তার শেষ অসুখ। সে আমি বিলক্ষণ জানি, তায়েবা জানে এবং তার মা বোন আত্মীয়স্বজন সকলেই জানে। কোন দিনটিতে সে মারা যাবে সে সংবাদটি আমরা কেউ জানিনে। সেটাই হয়েছে চূড়ান্ত সমস্যার বিষয়। অর্চনা আমার চোখে চোখ রেখে বললো। দানিয়েল, তুমি সময় বিশেষে ভয়ানক নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারো। আমি বললাম, তুমি এর মধ্যে নিষ্ঠুরতার কি পেলে? যে কথাটি সকলে জানে শুধু সঙ্কোচবশে প্রকাশ করছে না, সে কথাটিই আমি বলেছি। আচ্ছা দানিয়েল, তোমাকে একটা কথা জিগ্গেস করবো। আমি বললাম, হ্যাঁ করো। ধরো যদি তায়েবাদির কিছু একটা ঘটে যায় তুমি কি খুব কষ্ট পাবে? একথা কেননা জানতে চাইছো। তোমার আর তায়েবাদির সম্পর্কটা ভারী অদ্ভুত। আমার কি মনে হয় জানো, হঠাৎ করে তায়েবাদি যদি এ অসুখটাতে না পড়তেন, তোমরা যে একে অন্যকে ভালোবাসো, সেটা এমন করে অনুভব করতে পারতে না। অর্চনার কথা শুনে সহসা আমার মুখে কোনো কথা জোগালো না। আমি চুপ করে বসে ভাবতে লাগলাম। তায়েবার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কি ধরণের। সেকি আমাকে ভালোবাসে? আমিও কি তাকে ভালোবাসি? তার সঙ্গে আমার পরিচয় চার বছরেরও অধিক। কখনো এমন করে আমাদের দুজনের সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে হয়নি। আজকে অর্চনার কথা শোনার পর আমাকে নিজের ভেতর ডুবে যেতে হলো। তায়েবার সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে আমাদের মধ্যে যা যা ঘটেছে একে একে মনের মধ্যে খেলে যেতে থাকলো। খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠতে থাকলো। আমি স্পষ্টই অনুভব করলাম, সব সময়ই আমার মন তায়েবার দিকে বলগাহারা অশ্বের মতো ছুটে গিয়েছে, কিন্তু যখনই কাছাকাছি গিয়েছি, থমকে দাঁড়াতে হয়েছে, হৃদয় মন রক্তাক্ত করে ফিরে আসতে হয়েছে। তার সমস্ত অস্তিত্ব তার পার্টির ভেতর প্রোথিত। বারবার মনে হয়েছে সে যেনো সপ্তরথী পরিবেষ্টিত একটা মানবদুর্গের মধ্যে স্বেচ্ছাবন্দী এক নারী। এই দুর্গ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার কথা সে যেমন চিন্তা করতে পারে না। আমিও তার ভেতর প্রবেশ করবো কখনো মেনে নিতে পারিনি। আমরা পরস্পরের প্রতি যতদূর আকর্ষণ অনুভব করেছি, ঠিক সমান পরিমাণ বিকর্ষণ আমাদেরকে আলাদা করে রেখেছে। তারপরও তায়েবা যখন ডেকেছে ছুটে গেছি, হৃদপিণ্ডটা ছিঁড়ে নিয়ে তার পায়ে অঞ্জলি দেবো ভেবেছি। কিন্তু পরক্ষণেই এমন কিছু ঘটেছে, আমাকে ক্ষুব্ধ ব্যথিত হয়ে বুকের ভেতর একটা জখম নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে অর্চনা জিগগেস করলো, দানিয়েল কি ভাবছো? আমি বললাম, আর ভাবাভাবির কি আছে, যা ঘটবার ঘটে যাবে। শোনো দানিয়েল, একটা কথা তোমাকে বলি। তায়েবাদির হাসপাতালে তোমার আরো বেশি সময় থাকা উচিত। তুমি থাকলে উনি খুবই হাসিখুশি থাকেন। আমি বললাম, তার কাছাকাছি থাকতে পারলে ভালো লাগে। কিন্তু তার পার্টির মানুষেরা আমার দিকে এমন চোখে তাকায়, আমি খুবই বিব্রত বোধ করি। উনারা চোখেমুখে এমন একটা ভঙ্গি করেন যেনো আমি তায়েবাকে দেখতে এসে মস্ত একটা অপরাধ করে ফেলেছি। আর তার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে দেখা হলেই একটা না একটা খোটাখুটি লেগে যায়। শেষে তায়েবার ওপর সব কিছুর চাপটা গিয়ে পড়ে। তার রোগের যন্ত্রণাটা বেড়ে যায়। এটা এমন একটা জটিল এবং বিদ্ঘুটে ব্যাপার তোমাকে সবটা খুলে বোঝাতে পারবো না। অর্চনা বললো, কিছু কিছু বুঝতে পারি। তবু একটা কথা বলবো, তুমি ভয়ানক একরোখা এবং জেদী, নিজের দিকটা ছাড়া আর কিছু দেখো না। বিশেষ বিশেষ সময়ে মানুষকে নমনীয় হতে হয়। আমি বললাম, তুমি আমাকে আমি যা নই তা হতে বলছো, সে তো সম্ভব নয়। দূর দানিয়েল, আমি কি বলতে চাইছি তুমি কিছুই বুঝতে পারোনি। যাক্, এখন তুমি কি করতে চাও, সেটা বলো। আমি তোমার কাছে একটা বিশেষ অনুরোধ করবো বলে এসেছি। অর্চনা বললো, বলে ফেলো। তায়েবা তোমার খুব তারিফ করেছে। তার কথা শুনে মনে হয়েছে, সে মনের ভেতর থেকে তোমাকে খুবই পছন্দ করে। যে সমস্ত মানুষজন ওখানে আসে তার বেশিরভাগই তাকে একভাবে না একভাবে জখম না করে ছাড়ে না। অথচ সে কাউকে কিছু বলতে পারে না। সমস্ত পরিস্থিতিটাই এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোথাও থেকে একটি সান্ত্বনার বাক্য শোনার সুযোগ নেই। তার যারা একেবারে কাছের মানুষ, তাদের দেখলে সে মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে উঠে। তুমি যদি এক আধটু সময় করে হাসপাতালে যাও, এটা ওটা বলে তার মনটা একটু হালকা রাখতে চেষ্টা করো, ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই কৃতজ্ঞ থাকবো।