মনে মনে আমি ভীষণ অস্বস্থি বোধ করছিলাম। এই কোলকাতা শহরে ক্ষুধা তৃষ্ণার অধীন আমি একজন বিপন্ন ব্যক্তি মাত্র। আপন অন্তর্গত বেদনার ভারে সর্বক্ষণ কুঁজো হয়ে আছি, আপন হৃদয়ের উত্তাপে সর্বক্ষণ জ্বলছি। কোথাও পালিয়ে গিয়ে দুঃখগুলো নাড়াচাড়া করবো সে রকম কোনো ঠায় নেই। কেউ আমাকে নিছক আমি হিসেবে দেখতে রাজী নয়। যেখানেই যাই ভারত পাকিস্তান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এসব এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। এ এমন জটাজাল, ছাড়াতে চাইলেও ছাড়াতে পারিনে। হাম কমলি কো ছোড়নে মাংতা, মগর কমলি হামকো নেহি ছোড়। আমি যেখানেই যাই বাংলাদেশের যুদ্ধের কথা ওঠে। বাংলাদেশের কথা উঠলেই চীন, রাশিয়া, বৃটেন, আমেরিকার কথা আপনিই এসে পড়ে। বাংলাদেশের এক কোটির মতো মানুষ ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে ভারতে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, তার জন্য যেনো আমি দায়ী। চীনা অস্ত্রে পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশের জনগণকে হত্যা করছে, সেজন্যও আমি ছাড়া দায়ী কে? বিশ্ববিবেক বাংলাদেশের এই দুঃখের দিনে কোনো রকমের সাড়া দিচ্ছে না, তার জন্যও আমাকে ছাড়া কাকে দায়ী করবো? আমি হলাম গিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সমস্যা সঙ্কটের অঙ্কুর। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার যদি জন্ম না হতো।
তায়েবা হাসপাতালে পড়ে আছে। তার সাংঘাতিক ক্যান্সার, ডাক্তার বলছে সে বাঁচবে না। এই বেদনার ভার আমি কি করে হালকা করি। যতোই চেষ্টা করি না কেনো আমার ভেতরের সঙ্গে বাইরের কিছুতেই মেলাতে পারিনে। পৃথিবী চলছে তার আপন নিয়মে। মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে রক্ত আসতে চায়। কি করবো স্থির করতে পারিনে। ঘটনা স্রোত আমার সমগ্র অস্তিত্বকে এমন একটা গহ্বরের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছে, সারাজীবন চেষ্টা করলেও বোধ করি বেরিয়ে আসতে পারবো না। সময় তার জটাজাল প্রসারিত করে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে।
এরই মধ্যে সুনীলদা বাজার সেরে এসে আলোচনায় যোগ দিয়েছেন। মজহার, সুনীলদা, অর্চনা, প্রমোদবাবু উনারা কথা বলে যাচ্ছিলেন। আমার কিছু বলতে প্রবৃত্তি হচ্ছিলো না। ইচ্ছে হচ্ছিলো উঠে একদৌড়ে কোথাও পালিয়ে যাই। কিন্তু যাবো কোথায়? প্রায় অর্ধেক কোলকাতা শহর ঘুরে একটুখানি সান্ত্বনার প্রত্যাশায় তো এ বাড়িতে এলাম। অর্চনার আজকের রকম সকম দেখে মনে মনে ভীষণ ব্যথিত হলাম। আমি জানি তায়েবা মারা যাচ্ছে। কারো করার কিছু নেই। আমারও না, অর্চনারও না। তবু অর্চনা যখন আগ্রহী হয়ে তায়েবার অসুখের কথা জিগগেস করে, আমাকে মিথ্যে আশ্বাসে আশ্বস্থ করে, আমি মনে মনে শান্তি পাই। আমি শান্তি পেলে কি তায়েবা বাঁচবে? না বাঁচবে না। সে মারা যাবে, তাকে মারা যেতেই হবে। মারা যাবার জন্যই সে অতি কষ্টে সীমান্ত অতিক্রম করে কোলকাতা শহরে এসেছে। আসলে সংকট আমার ভেতরে। তায়েবাকে উপলক্ষ করে একটা আবরণ তৈরি করে নিজের কাছ থেকে নিজে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। সুনীলদা এক পর্যায়ে সমস্ত আলোচনাটা তাঁর সেই সুবিখ্যাত শান্তির থিয়োরর দিকে টেনে নিলেন। জানেন প্রমোদদা, ভেতরের ট্যানশনই হলো দুনিয়ার সমস্ত অশান্তির উৎস। যুদ্ধ, বিভীষিকা, মানুষে মানুষে সংঘাত এসব হলো ভেতরের ট্যানশনের বাহ্যিক প্রকাশ মাত্র। এগুলো থেকে মুক্তি না পেলে পৃথিবীর অসুখ কখনো সারবে না, আর মানুষও কোনোদিন শান্তি পাবে না। ক্ষণিক ঘটনার দিকে না তাকিয়ে সমস্যার মূলটাই আমাদের দেখা উচিত।
প্রমোদবাবু ফস করে জিগগেস করে বসলেন, কি রকম। এই যে ধরুন মানুষের রিপুগুলো আছে না তারাই তো মানুষকে সংঘাতের শান্তিনাশা পথে টেনে নিয়ে যায়। সুতরাং মানুষের প্রথম লক্ষ হওয়া উচিত এই সব রিপু থেকে মুক্ত হওয়া। প্রমোদবাবু বললেন, তার কোনো পথ আছে কি? আছে, আছে প্রমোদ দা। তা হলে তো মানুষ থাকবে না, সব দেবতা হয়ে যাবে। প্রমোদদা মানুষ তো আসলে দেবতাই, জ্ঞানদৃষ্টি দিয়ে জগতকে বার করতে পারে না বলেই সে পশু হয়ে যায়। প্রমোদবাবু বললেন, সুনীল তোমার কথাগুলো অত্যন্ত চমৎকার। আমি অনেক বছর ইউরোপে থেকেছি। সুতরাং আস্থা স্থাপন করতে পারবো না। অর্চনা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো, দাদা তুমি প্রমোদদার সঙ্গে চুটিয়ে শান্তি চর্চা করতে থাকো। রান্না হওয়ার দেরী আছে। আমি দানিয়েলকে নিয়ে গেলাম। বেচারী কষ্ট পাচ্ছে। তারপর ইসলামের দিকে তাকিয়ে বললেন, দয়া করে আপনি কিছু মনে করবেন না, আমি একটু দানিয়েলকে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছি।
অৰ্চনা আমাকে ভেতরের ঘরে বসিয়ে ফ্যানটা ছেড়ে দিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, দানিয়েল, তোমার খবর বলো। কোনো দুঃসংবাদ নেই তো। কেমন আছেন তায়েবাদি? আমি বললাম, যেমন দেখেছিলে সে রকমই আছে। তা তোমার মুখ চোখ অমন শুকনো কেনো? এই সময়ে তোমাকে তো শক্ত হতে হবে। আমি বললাম, শক্তই তো আছি যতোটুকু থাকা যায়। অর্চনা ভু কুঁচকে বললো, তোমার চোখ মুখ কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। বললাম, আমার পক্ষে কোথাও স্থির থাকা সম্ভব হচ্ছে না। চারদিক থেকে এমন একটা চাপ এসে আমার ওপর পড়ছে আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিনে। অর্চনা আমার কাঁধে হাত দিয়ে কণ্ঠস্বরটা খুবই নামিয়ে অনেকটা ফিসফিস করে জিগগেস করলো, দানিয়েল, তুমি তায়েবাদিকে খুবই ভালোবাসো, তাই না? তার কথার জবাব দিতে গিয়ে আমার মুখে কথা আটকে গেলো। সহসা কোনো কিছু বলতে পারলাম না। অর্চনা আমার মানসিক অবস্থাটা আঁচ করে বললো, দানিয়েল, তুমি বরং আরেক কাপ চা খাও এবং একটু শান্ত হয়ে বসো। আমি একটু ভেতর থেকে আসি। বড়ো জোর দশ মিনিট। তার বেশি নয়।