হঠাৎ প্রমোদবাবু আমার চোখে চোখ রেখে জিগগেস করলেন, আচ্ছা এখনো কি ঢাকা শহরে পঙ্খিরাজ গাড়ি আছে? কথা শুনে আমার হাসি পাওয়ার দশা। বললাম, এখন কি আর পঙ্খিরাজের যুগ আছে? আমার কথায় তিনি বোধ করি খানিকটে আহত হলেন। সে কি আপনারা এমন সুন্দর জিনিসটি উঠিয়ে দিলেন? জবাবে বললাম, কেউ উঠিয়ে দেয়নি, কালের প্রভাবে আপনা আপনিই উঠে গেছে। তারপর আমার কাছে জানতে চাইলেন, আপনাদের মুক্তিসংগ্রামের সংবাদ বলুন। ফ্রেঞ্চ টেলিভিশনে প্রায় প্রতিদিনই খবর থাকতো। মনে করেছিলাম, বাংলাদেশে একটি বড়ো ঘটনা ঘটছে? অনেকদিন থেকেই দেশে আসবো আসবো ভাবছিলাম, তবে ইনারশিয়া কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। টিভিতে বাংলাদেশের সংবাদ শুনে শুনে নিজের মধ্যে এমন একটা হ্যাচকা টান অনুভব করছিলাম আর স্থির থাকতে পারলাম না, চলে এলাম।
এরই মধ্যে চা-বিস্কুট এসে গেছে। ভদ্রলোক একটা বিস্কুটের কোণায় কামড় দিয়ে এক চুমুক চা পান করলেন। সেই সময়ে তাঁর দৃষ্টি মজহারুল ইসলাম সাহেবের ওপর পড়লো। লজ্জা পেয়ে বললেন, আরে আপনার সঙ্গে তো কথাই বলা হয়নি। আপনিও কি বাংলাদেশের। ইসলাম বললেন, না আমার বাড়ি মুর্শিদাবাদ। তবে আমরা দু’পুরুষ ধরে কোলকাতায় বসবাস করছি। আপনি কি করেন? ইসলাম বললেন, আমি এখানে কলেজ স্ট্রীটে একখানা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চালাই। আপনার নাম? ইসলাম বললেন, মজহারুল ইসলাম। আপনি মুসলমান? ইসলাম জোর দিয়ে বললেন, হ্যাঁ মুসলমান। প্রমোদবাবু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। অর্চনা বুদ্ধিমতী মহিলা। কথার খেই ধরে জিগগেস করলো, আপনার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নামটি কিন্তু এখনো জানা হয়নি। ইসলাম বললেন, নব জাগৃতি’। কেমন চলছে আপনার ব্যবসা? অর্চনার কৌতূহল মেটাবার জন্য বললেন, বর্তমানে ব্যবসার অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। আমরা তো মার্কসিস্ট বইপত্র ছেপে থাকি। শ্রীমতী গান্ধীর সরকার বর্তমানে মার্কসিস্ট সবকিছুর ওপর অত্যন্ত খাপ্পা হয়ে আছেন। কোনো কোনো সপ্তাহে দোকান খোলাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমার তো আবার ডবল রিক্স। নামে মুসলমান, তার ওপর মার্কসীয় বইপত্রের প্রকাশক। অর্চনা সোজা হয়ে বসেছিলো। একটুখানি ঝুঁকে পড়ে চায়ের পেয়ালাটা তুলে নিলো। তার চোখেমুখে সহানুভূতি মিশ্রিত লজ্জার ছায়া ঘনিয়ে এসেছে। আপনি মুসলিম বলে ব্যবসাপত্র করতে অসুবিধে হয় কি? ইসলাম বললেন, সব সময়ে নয়, মাঝে মাঝে বেশ বিপদে পড়তে হয়। এই দেখুন না, আমার দোকানটা ছিলো পুরবী সিনেমার কাছে। গেলো রায়টের সময় গোটা দোকানটাই জ্বালিয়ে দেয়া হয়, একটি পৃষ্ঠাও বাঁচাতে পারিনি। শুনে সহসা অর্চনার মুখে কোনো কথা যোগালো না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, এটা ভারী লজ্জা এবং দুঃখের। ভারতের নেতৃবৃন্দ যারা প্রকাশ্য জনসভায় বড়ো বড়ো কথা বলেন, তাঁদের গলায় দড়ি দিয়ে মরা উচিত। ইসলাম বললেন, আমাদের দেশে খারাপ লোকের সংখ্যা নেহায়েতই মুষ্টিমেয়। তারা ক্ষমতাসীনদের সহায়তাতেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। গড়পড়তা সাধারণ মানুষ খুবই ভালো। এই ভালো মানুষেরা আছে বলেই এখনো পর্যন্ত টিকে আছি। আমি ধরে নিয়েছি, ওটা একটা এ্যাকসিডেন্ট। তাই আমার কোনো রকম নালিশ বা অনুযোগ নেই।
প্রমোদবাবু হাতের পেয়ালাটা নামিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। তারপর বললেন, অর্চনা, বোধ করি তোর কথা সত্যি। এরই মধ্যে এতোসব পরিবর্তন হয়ে গেছে আমি তার বিন্দুবিসর্গও জানিনে। আমার মন সে সাতচল্লিশ আটচল্লিশে থিতু হয়ে আছে। এখানে এসে দেখতে পাচ্ছি প্রচণ্ড রকমের ওলোট পালোট হয়ে গেছে। এই উপমহাদেশটি কোন্ দিকে যাচ্ছে? একবার দেশ ভাগ হয়ে হিন্দুস্থান পাকিস্তান হলো। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ যদি সফল হয় পাকিস্তান আরার খণ্ড হবে। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবতে চেষ্টা করি, সব মিলিয়ে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে। গোটা ভারত উপমহাদেশে বাংলার স্থান কোথায়? বৃটিশ তাড়ানোর সংগ্রামে বাংলা দিয়েছে সব চাইতে বেশি, পেয়েছে সব চাইতে কম। বাঙালির ভাগ্য কি হবে বলতে পারেন? আমি চুপ করে রইলাম। অর্চনা বললো, দাদা, আমার ক্ষমতা থাকলে রাজনৈতিক কুষ্ঠি তৈরি করতাম। আপাতত যখন সে ক্ষমতা নেই, সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়াই উস্কৃষ্ট কর্ম মনে করি। অতো ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন কি? যা ঘটবার তাতো ঘটবেই। তিনি অর্চনার কথা কানে না নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিগগেস করলেন, আপনাদের শেখ মুজিবুর রহমানটি কেমন মানুষ আমার জানতে খুব ইচ্ছে হয়। মুক্তিযুদ্ধ যদি জয়যুক্ত হয় ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জানেন এটা বিরাট ব্যাপার। বাংলার ইতিহাসে আমি যতোদূর জানি, এই ভূখণ্ডে বিক্ষোভ বিদ্রোহের অন্ত নেই। কিন্তু বাঙালি আপন প্রতিভা বলে নিজেদের মেরুদণ্ডের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা রাষ্ট্রযন্ত্র সৃষ্টি করেছে, তেমন কোনো প্রমাণ নেই। বাংলাদেশ যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারে তাহলে একটা অভিনব ব্যাপার হবে। কোলকাতায় খোঁজখবর নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে যেটুকু জেনেছি, তা থেকে স্থির কোনো ধারণা গঠন করা সম্ভব নয়। আমাকে কেউ কেউ বলেছেন মুজিব একজন গোঁড়া সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের সময় সোহরাওয়ার্দীর চ্যালা ছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তিনি মহাত্মাজীর মন্ত্রশিষ্য। অহিংস অসহযোগনীতি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এই বিরাট গণসংগ্রাম রচনা করেছেন। দু’চারজন কমিউনিস্ট বন্ধুর কাছে জিগগেস করে যা জেনেছি তাতে সংশয়টা আরো বেড়ে গেলো। মুজিব নাকি ঘোরতরো কমিউনিস্ট বিরোধী। মুজিব লোকটা কেমন, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন কি সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারেননি। আমার কাছে সবটা ধোঁয়া ধোয়া ছায়া ছায়া মনে হয়। কিন্তু একটা বিষয় দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। মানুষটার ভেতর নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে। নইলে তাঁর ডাকে এতোগুলো মানুষ বেরিয়ে এলো কেমন করে। আমি টিভিতে মুজিবের অনেকগুলো জনসভার ছবি দেখেছি। দেখার সময় শরীরের পশম সোজা হয়ে গিয়েছিলো। এ রকম মারমুখি মানুষের ঢল আমি কোথাও দেখেছি মনে পড়ে না। মনে মনে কল্পনা করতাম অনুশীলন, যুগান্তর এ সকল বিপ্লবী পার্টির প্রভাবে এই গণসংগ্রাম জন্ম নিয়েছে। এখন বুঝতে পারছি, আমার মধ্যে যথেষ্ট ইনফর্মেশন গ্যাপ ছিলো। ফ্রান্সে আমার এক ইন্ডিয়ান বন্ধু আছে। তাঁর ছোটো ভাই ওয়েস্ট বেঙ্গল কংগ্রেসের এক হোমড়াচোমড়া ব্যক্তি। বেলেঘাটার দিকে বাড়ি। গত পরশুদিন তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন জিন্নাহর দ্বি-জাতিতত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে এবং পাকিস্তান আর টিকে থাকতে পারছে না। আমি তাঁর সরল বিশ্বাসের কোনো প্রতিবাদ করিনি। রকম সকম দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যে সামান্য অধিকার আমার আছে, তা দিয়েই বলতে পারি ভারতবর্ষের ব্যাপারে এক জাতিতত্ত্ব এবং দ্বি-জাতিতত্ত্ব কোনোটাই খাটে না। আসলে ভারতবর্ষ বহু জাতি এবং বহু ভাষার একটি মহাদেশ। উনিশশো সাতচল্লিশে ধর্মের প্রশ্নটি মুখ্য হয়ে অন্য সব প্রশ্ন ধামাচাপা দিয়েছিলো। আরো একটা কথা, নানা অনগ্রসর পশ্চাৎপদ জাতি এবং অঞ্চলের জনগণ তাদের প্রকৃত দাবি তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছিলো বলেই আপাত সমাধান হিসেবে ভারত পাকিস্তান রাষ্ট্র দু’টির জন্ম হয়েছিলো। পরিস্থিতি যে রকম দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তান ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশ একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নিতে যাচ্ছে। একথা যদি বলি আশা করি অন্যায় হবে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। তারপরে ভারতকে একই সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। আঞ্চলিক, জাতিগত, ধর্ম এবং ভাষাগত বিচ্ছিন্নতার দায় মেটাতে গিয়ে ভারতবর্ষের কর্তাব্যক্তিদের হিমসিম খেতে হবে। এমনকি ভারতের ঐক্যও বিপন্ন হতে পারে।