প্রমোদবাবুর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে অর্চনা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো, দাদা আপনি এতোদিন বাদে দেশে এসে আবার বিএনভিপি-র পাল্লায় পড়েছেন? ছি, কি কেলেঙ্কারীর কথা। কেনো, বিএনভিপি কি দোষটা করলো? ওরা ভাঙা বাংলাকে আবার জোড়া লাগাতে বলছে। একি চাট্টিখানি কথা। জানো, এই বাংলা বিভাগ সহ্য করতে না পেরে উনিশশো সাতচল্লিশে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। অর্চনা বললো, আপনি যেনো একটা কি দাদা। এই বিএনভিপি-র মতো প্রতিক্রিয়াশীল দল গোটা পশ্চিমবাংলায় আর একটিও নেই। আপনি চেনেন না বটে। ওদের আমরা হাড়ে হাড়ে চিনি। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার এমন চমৎকার ডিপো আর একটাও খুঁজে পাবেন না। আপনি গিয়ে তাদের খপ্পরে পড়লেন? একদিক দিয়ে হিসেব করলে আপনি বিশেষ ভুল করেননি। মানুষের বাচ্চা বয়সে চোট লাগলে বুড়ো বয়সে সেটা আবার চাড়া দিয়ে ওঠে? আপনার কৈশোর এবং যৌবনকাল কেটেছে অনুশীলন দলের বিপ্লবীদের সংস্পর্শে। মাঝখানে পঁচিশ তিরিশ বছরের মতো বিদেশে কাটিয়েছেন। কিন্তু আপনার মন ওই জায়গাটিতেই এখনো আটকে রয়েছে। মাঝখানের দু’দুটি যুগ অতিবাহিত হয়ে গেছে। সমাজের কতো পরিবর্তন ঘটে গেছে, রাজনীতির ধরনধারণ কতো পাল্টে গেছে। আপনার অগ্নি যুগের বিপ্লবীদের স্মৃতি এখন অতীত যুগের দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু নয়। অর্চনা অধিক কথা না বাড়িয়ে বললো, যাকগে, আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য আমার এক বাংলাদেশের বন্ধুকে ডেকে এনেছি। ওর নাম দানিয়েল। আপনাকে ঢাকার সমস্ত খবরাখবর বলতে পারবে। প্রমোদবাবু নমস্কারের ভঙ্গিতে জোড়হাত করলেন। তারপর জিগ্গেস করলেন, আপনি ঢাকায় থাকেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, উয়ারি চেনেন? বললাম, ঢাকায় থাকি উয়ারি চেনবো না কেন? আচ্ছা আপনি জানেন উয়ারিতে একটা র্যাঙ্কিন স্ট্রীট আছে। আমাকে বলতে হলো, হ্যাঁ, উয়ারিতে একটা র্যাঙ্কিন স্ট্রীট আছে। ওই র্যাঙ্কিন স্ট্রীটের ৩২ নম্বরের বাড়িতে ছোটোবেলায় আমি থেকেছি। জিগেস করলাম, ওটা কি আপনাদের বাড়ি ছিলো? জবাবে প্রমোদবাবু বললেন, ঠিক আমাদের বাড়ি নয়। আমি জন্মেছি গ্রামে। ঢাকা শহর থেকে বেশি দূরে নয়। বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পাড়ে শুভাড্যায়। র্যাঙ্কিন স্ট্রীটের বাড়িটি ছিলো আমার দাদামশায় রায় বাহাদুর নলিনাক্ষ চৌধুরীর। তিনি ছিলেন জমিদার। অসাধারণ প্রতাপশালী মানুষ। আপনি কি কখনো রায় বাহাদুর নলিনাক্ষ চৌধুরীর নাম শুনেছেন? আমাকে বলতেই হলো, এরকম কোনো নাম শুনেছি বলে মনে পড়ে না। তিনি একটুখানি নিরাশ হলেন মনে হলো। তারপর জানতে চাইলেন, আচ্ছা র্যাঙ্কিন স্ট্রীটের ৩২ নম্বর বাড়িটি আপনি দেখেছেন? আমি বললাম, র্যাঙ্কিন স্ট্রীটটি চিনি বটে, কিন্তু কোন্ বাড়িটির কথা বলছেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনে। প্রয়োদ বাবু বললেন, বাড়িটি দোতলা। সামনে একটা লোহার গেট। গেটের কাছে একটি বেল গাছ। বাড়ির পেছন দিকে একসার নারকেল গাছ। এবার চিনতে পারলেন? এতো বিশদ করে বলার পরও বাড়িটি আমার চেনার বাইরে থেকে গেলো। ভদ্রতার খাতিরে বলতে হলো, আমি থাকি র্যাঙ্কিন স্ট্রীট থেকে অনেক দূরে। সে কারণে বাড়িটির সঙ্গে পরিচয় ঘটে উঠতে পারেনি। ভদ্রলোক একটু দমে গেলেন। পকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে তিনি ফের জানতে চাইলেন। আপনি কি ফরাশগঞ্জের সত্যানন্দ সিংহের নাম শুনেছেন, এক সময়ে যিনি ঢাকার অনুশীলন সমিতির সর্বেসর্বা ছিলেন। এবারেও আমাকে অজ্ঞতা প্রকাশ করতে হলো।
প্রমোদবাবু সিগারেটের ছাই ঝেড়ে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বললেন, এটা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার, আপনি ঢাকায় থাকেন অথচ সত্যানন্দ সিংহের নাম শোনেননি। আমাদের সময়ে সত্যানন্দ সিংহকে সকলে এক ডাকে চিনতো। বৃটিশ সরকার তার মাথার ওপর দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। আপনারা মুক্তিযুদ্ধ করছেন, অথচ অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের নাম পর্যন্ত জানেন না, এটা কেমন করে হয়। আমি মনে মনে রেগে গেলাম। কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করলাম না। বললাম, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের নাম জানার কোনো সম্পর্ক আছে কি? তিনি বললেন, বারে, সম্পর্ক থাকবে না কেনো? সব ব্যাপারে একটা ধারাবাহিকতা থাকা তো প্রয়োজন।
উত্তরে আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না। অর্চনা এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করলো। সে প্রমোদবাবুকে জিগ্গেস করলো, আচ্ছা দাদা বলুন দেখি, আপনি দেশ ছেড়েছেন কতোদিন। প্রমোদবাবু মাথা চুলকে বললেন, তা হবে সাতাশ আটাশ বছর। অর্চনা ফের জানতে চাইলে অগ্নিযুগের যেসকল বিপ্লবীকে চিনতেন দেশ ছাড়ার সময়ে সকলের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিলো? প্রমোদবাবু বললেন, তা ছিলো না- কে কোথায় ছিটকে পড়েছিলেন তার কি কোনো ঠিক ঠিকানা আছে? কেবল অনুকূলদার সঙ্গে সম্পর্কটা ছিলো। আপনি প্রায় তিরিশ বছর পূর্বে যোগাযোগ রাখতে পারেননি। এই বেচারি যদি আপনার চেনাজানা মানুষদের চিনতে না পারে তাহলে কি খুব অন্যায় হবে? মধ্যিখানে কতো কিছু ঘটে গেলো। দেশ বিভক্ত হলো। জন্ম নিলো হিন্দুস্থান, পাকিস্তান। আবার সেই পাকিস্তানও এখন ভেঙ্গে যেতে লেগেছে। আপনার দশা হয়েছে রিপভ্যান উইঙ্কলের মতো। আপনি যে ঢাকার কথা বলছেন, সে হলো আপনার স্মৃতি এবং স্বপ্নের ঢাকা শহর। এখনকার ঢাকা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। শুনেছি রাস্তাগুলো প্রশস্ত চওড়া। লেখাপড়া শিক্ষা সংস্কৃতিতে ঢাকা এখন অনেক এগিয়ে গেছে। কোনো কোনো দিক দিয়ে কোলকাতাকেও ছাড়িয়ে গেছে।