মজহার সুযোগ পেলেই আমাদের খোঁচা দিতে ছাড়েন না। তাঁর অভিযোগটির মর্মবস্তু অনেকটা এরকম, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কৌশলে ফঁপিয়ে ফুলিয়ে বাংলাদেশ ইস্যুটি অস্বাভাবিক বড়ো করে জনমত সেদিকে আকর্ষণ করে রাখতে চাইছেন। আর সে সুযোগটি পুরোপুরি নিয়ে বিরোধী দলের অস্তিত্ব একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য অবিরাম হামলা করে চলেছেন। তিনি এবং তাঁর মতো অনেকেই মনে করেন আমরা এখানে এসে শ্রীমতী গান্ধীর হাতে একটি মারাত্মক অস্ত্র তুলে দিয়েছি। তথাপি সিপিআইএম-এর লোকদের আমাদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি আছে। নকশাল ছেলেরা তো সরাসরি মনে করে আমরা জনগণের বিপ্লবের জানী দুশমন। আর ভারতীয় গোঁড়া মুসলমানেরা বাংলাদেশের মানুষদের হিন্দুদের খেলার পুতুল ছাড়া কিছু মনে করেন না। সে যাক, আমি মজহারকে বললাম, আপনাকে মশায় আমার সঙ্গে যেতে হবে।
মজহার প্রথমে যেতে চাননি। একাজ সেকাজের অছিলা করে পিছলে যেতে চেষ্টা করছিলো। আমি যখন চাপাচাপি করতে থাকলাম, শেষ পর্যন্ত রাজী না হয়ে উপায় ছিলো না। নাস্তা করার পর দু’জনে বেরিয়ে পড়লাম। আমি ভাবলাম গরিয়াহাটা অবধি বাসে যাবো। কিন্তু মজহার রাজী হলেন না। তিনি বললেন, মশায় এখন ট্রামে যাওয়া চলবে না। গতোরাতে পাড়া থেকে আমাদের পার্টির সমস্ত ওয়ার্কারকে তুলে নিয়ে গেছে। আপনার সাধ হয়েছে আমায় কিছু পয়সা খরচ করাবেন। তা আর কি করা যাবে। অপেক্ষা করুন ট্যাক্সি আসুক।
ট্যাক্সি এলে দু’জনে উঠে বসলাম। ডানদিকে বেরিয়ে শিয়ালদার মোড়ে এসে জানজটের মধ্যে আটকে গেলো ট্যাক্সি। মজহার বললেন, আপনি মশায় মানুষটাই অপয়া… দিন একখান চারমিনার। আর তো কিছু করার উপায় নেই! বসে বসে ধোয়া ছাড়ি। আমি সিগারেট বের করে দিলাম। তিনি দেয়ালে সাঁটা পোষ্টারের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, দেখুন, ইন্দিরা গান্ধীকে কেমন চিতা বাঘিনীর মতো দেখাচ্ছে না? আমার কিন্তু তেমন মনে হলো না। ইন্দিরা গান্ধীকে ইন্দিরা গান্ধীর মতোই মনে হচ্ছিলো। বোধ হয় চিতা বাঘিনীর ছাপটি মজহারের মনে আছে। তাঁকে তুষ্ট করার জন্য বললাম তা দেখাচ্ছে বটে, আপনাদের পোষ্টার? হ্যাঁ, ছবিটা কে এঁকেছে জানেন? ছবিটা হলো গিয়ে দেব্রত দাশ গুপ্তের। বদিক থেকে তাকিয়ে দেখুন একেবারে অবিকল চিতা বাঘিনী। তাকিয়ে দেখার পর আমারও কেমন চিতা বাঘিনী মনে হলো। এই সময়ে জানজট হালকা হয়ে এলো।
গোলপার্কে এসে ট্যাক্সি থেকে নামলাম দু’জনে। দরজায় বেল টিপতেই অর্চনা নিজে এসে দোর খুলে দিলো। অর্চনা স্নান করেছে, পিঠের ওপর আধভেজা চুলের বোঝ ছড়িয়ে আছে। তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। চশমা না পরলে তাকে সত্যি সত্যি সুন্দর দেখা যায়। মজহারকে সামনে ঠেলে দিয়ে বললাম, তোমার প্যারিস ফেরত দাদার সঙ্গে পরিচয় করে দেবার জন্য এক বন্ধুকে ধরে নিয়ে এসেছি। মাথা নীচু করে আদাব জানিয়ে জিগগেস করলো, আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন? মজহার বললেন, না, আমার বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলায়। তবে দু’পুরুষ ধরে কোলকাতা স্থায়ীভাবে বসবাস করছি এবং কলেজ স্ট্রীট মার্কেটে একখানা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চালাই।
আপনারা বসুন আমি চা নিয়ে আসি। প্রমোদদা ততোক্ষণে এসে পড়বেন। আমি জানতে চাইলাম তিনি কি এখন বাড়িতে নেই? অর্চনা বললেন, খুব সকাল বেলা উঠে তিনি একাকি বেরিয়ে পড়েন। ঘুরে ঘুরে পুরোনো আড্ডার জায়গাগুলো দেখেন। রোদটা তেঁতে উঠলেই চলে আসেন বাসায়। আসার সময় প্রায় হয়ে এলো। চায়ে মুখ দিয়েছি, এমন সময় বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থামার শব্দ শোনা গেলো। অর্চনা উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলতে খুলতে বললো, এই বুঝি দাদা এলেন।
লম্বা চাওড়া ফর্সা চেহারার এক ভদ্রলোক ঘরে প্রবেশ করলেন। দেখতে ঠিক বাঙালি মনে হয় না। এখন বেলা অধিক হয়নি। তবু ভদ্রলোকের শরীর ঘেমে এক রকম ভিজে গেছে। অর্চনা তাড়াতাড়ি একটা তোয়ালে এনে দিলো এবং ফ্যানটা অন করে স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে জিগ্গেস করলো, দাদা আপনার প্রাতকালীন তীর্থদর্শন আর কতোদিন চলবে? সারা জীবন দেখলেও মনে হচ্ছে শেষ হবে না। ভদ্রলোকের অনভ্যস্থ জিহ্বায় বাংলা ভাষাটা ঠিকমতো আসতে চায় না। হঠাৎ করে বয়স্ক মানুষের মুখে শিশুর মতো বাংলা ভাষা শুনলে কানটা আচমকা খুব খুশি হয়ে ওঠে। তিনি বললেন, বিদেশে এ কোলকাতা শহরের অনেক অপবাদ শুনেছি। কোলকাতা নোংরা, ঘিঞ্জি আর দুর্গন্ধময় এসব আর কি। ঘুরে ঘুরে দেখতে কিন্তু আমার বেশ লাগে।
শেয়ালদার মোড়ে নোংরা জঞ্জাল আর আবর্জনার স্তূপ দেখে অর্চনা আমার কি মনে হলো জানিস? যেনো আবার নতুন করে জন্মাচ্ছি। কি জানি দাদা আপনি দার্শনিক মানুষ। আপনার দেখার ধরনটাই আলাদা। আমরা কিন্তু নোংরা আবর্জনাকে আবর্জনাই দেখি। প্রমোদবাবু হেসে উঠলেন হো হো করে। এসবের সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক তোকে আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। আহ্ কতদিন পরে আবার কোলকাতা দেখছি। নিজের মাটি, নিজের মানুষ কি জিনিস যদি বুঝতে চাস তো একটানা কয়েক বছর দেশের বাইরে কাটিয়ে আয়, তারপর বুঝতে পারবি। এ মাটি মানুষ ছেড়ে বিদেশে আপনি তো একটানা দু’যুগেরও অধিক সময় কাটিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, মাঝে মাঝে আমি নিজেও অবাক হয়ে ভাবি এতোটা সময় কি করে কাটিয়ে দিলাম। কোনো সন্ধ্যেবেলা অথবা রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ভাবতাম, আর, ঢের হয়েছে। এবার সব ছেড়ে ছুঁড়ে দেশে ফিরে গিয়ে ছোটো নাগপুরের ওদিকে একটা কুটির তৈরি করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবো। কিন্তু আর হলো কৈ? দেশে আসতে চাইলেও আসতে দিচ্ছে কে? আমি ফ্রেঞ্চ সিটিজেন হয়ে গেছি। তাছাড়া তোমার বৌদি আছে, ছেলেমেয়েরা আছে। তারা সকলে ওদেশটার জীবনধারায় অভ্যস্থ। সব কটাকে এখানে নিয়ে এলে ডাঙ্গার মাছের মতো অবস্থা হবে। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মানুষের সব সাধ কি পূর্ণ হয়? তবু ভাগ্য ভালো বলতে হবে। বাংলাদেশের ফ্রিডম ওয়ারটা শুরু হলো। আর নিজেকে আটকে রাখা গেলো না। ছুটে চলে এলাম। অর্চনা বললো, অন্তত একটা সাধ তো আপনার মিটলো। পুরনো দিনের কারো সঙ্গে দেখা হলো? প্রমোদ বাবু বললেন, দেখো, তোকে আসল খবরটাই বলা হয়নি। আমার সঙ্গে গেলো পরশুদিন অনুকূলদার দেখা হয়েছে। তিনি পূর্বের মতো শক্ত সমর্থ আছেন। শুধু মাথার চুলটাতেই একটু পাক ধরেছে। এ ধরনের চিরতরুণ মানুষকে দেখলে ঈর্ষা হয়। এখনো তিনি সমাজের কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা মোল আঠারো বছর বয়সে যেভাবে তার কাছে ঝাঁক বেঁধে যেতাম, তেমনি এখনো তার ঘরে ষোল আঠারো বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। দেখলে বিস্ময়ে অবাক হয়ে যেতে হয়। জানিস অর্চনা, অনুকূলদা পুরোনো বিপ্লবীদের জড়ো করে বেঙ্গল ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স পার্টি গড়েছেন। তাঁর দলের ছেলেরা কোলকাতা শহরের সব জায়গায় বড়ো বড়ো করে লিখেছে, দু’বাংলার চেক পোস্ট উড়িয়ে দাও-দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। অনুকূলদাদের বিএনভিপি ফান্ডে তিনশো ডলার ডোনেট করলাম।