উৎপলা এখনো বাইরে থেকে ফেরেনি। কেবিনে আমরা দু’জন। এই ফাঁকে আমি জিগ্গেস করলাম, তায়েবা, তোমার শরীর কেমন? কেমন আছো? রোগের অবস্থা কি? তায়েবা মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে বললো, ওসব কথা থাকুক। আমার শরীর ভালো, আমি ভালো আছি। আমি বললাম, আগরতলা আসার সময় তোমাদের সঙ্গে শেষ দেখা। তোমরা তো আমার সঙ্গে এলে না, কোলকাতা এসে খবর পেলাম, তোমরাও আগরতলা এসে একটা ক্যাম্পে উঠেছে। কোলকাতায় নানাজনের কাছ থেকে নানাভাবে তোমার খবর পেয়েছি। একজন বললো, তোমাকে তিনদিন পার্ক সার্কাসের কাছে রাস্তা পার হতে দেখেছে। আরেকজন বললো, তুমি সকাল বিকেল তিনটি করে টিউশনি করছে। শেষ পর্যন্ত নির্মল একদিন এসে জানালো, তোমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। কোন্ হাসপাতাল, কি রোগ কিছুই জানাতে পারলো না। তোমার ঠিকানা যোগাড় করতে যেয়ে প্রায় একটা খুনখারাবী বাধিয়ে বসেছিলাম। তায়েবা বললো, সেসব কথা থাকুক। আপনার খবর বলুন, কোথায় আছেন, কখন এসেছেন? দু’বেলা চলছে কেমন করে বাড়ি ঘরের খবর পেয়েছেন? আপনার মা বোন এবং ভায়ের ছেলেরা কেমন আছে?
আমার তো বলবার মতো কোনো খবর নেই। তায়েবাকে জানাবো কি? কোলকাতা শহরে আমরা কচুরিপানার মতো ভেসে ভেসে দিন কাটাচ্ছি, বিশেষ করে মুসলমান ছেলেরা। আমাদের সঙ্গে মা বোন বা পরিবারের কেউ আসেনি। সে কারণে শরণার্থী শিবিরে আমাদের ঠাই হয়নি। আমরাও শিবিরের মানুষদের প্রাণান্তকর কষ্ট দেখে মানে মানে শহরের দিকে ছিটকে পড়েছি এবং কোলকাতা শহরে গুলতানি মেরে সময় যাপন করছি। একজন আরেক জনকে ল্যাং মারছি। বাংলাদেশের ফর্সা কাপড়চোপড় পরা অধিকাংশ মানুষের উদ্দেশ্যবিহীন বেকার জীবনযাপনের ক্লেদ কোলকাতার হাওয়া দুষিত করে তুলছে। আমরা সে হাওয়াতে শ্বাস টানছি। সীমান্তে একটা যুদ্ধ হচ্ছে। দেশের ভেতরেও একটা যুদ্ধ চলছে। অবস্থানগত কারণে আমরা সে ভয়ঙ্কর ব্যাপারটি ভুলে থাকতে চাই। কিন্তু পারি কই? যুদ্ধে চলে গেলে ভালো হতো। দেশের স্বাধীনতার জন্য কতোটুকু করতে পারতাম জানিনে। তবে বেঁচে থাকবার একটা উদ্দেশ্য চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করতে পারতাম। আমার যুদ্ধে যাওয়া হয়নি। যুদ্ধকে ভয় করি বলে নয়। আমাদের দেশের যে সকল মানুষের হাতে যুদ্ধের দায় দায়িত্ব, তারা আমাকে ট্রেনিং সেন্টারে পাঠাবার যথেষ্ট উপযুক্ত বিবেচনা করতে পারেননি। আমি তিন তিনবার চেষ্টা করেছি। প্রতিবারই মহাপুরুষদের দৃষ্টি আমার ওপর পড়েছে। অবশ্য আমাকে বুঝিয়েছেন, আপনি যুদ্ধে যাবেন কেন? আপনার মতো ক্রিয়েটিভ মানুষের ইউজফুল কতো কিছু করবার আছে। যান কোলকাতা যান। সেই থেকে কোলকাতায় আছি। হাঁটতে, বসতে, চলতে, ফিরতে মনে হয় আমি শূণ্যের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছি। এ সব কথা তায়েবাকে জানিয়ে লাভ কী? কোন্ বাস্তব পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে তাকে এই হাসপাতাল অবধি আসতে হয়েছে। সবটা না হলেও অনেকটা আমি জানি। তাকে খুশি করার জন্য বললাম, আমরা বাংলাদেশের বারো চৌদ্দজন ছেলে বৌবাজারের একটা হোস্টেলে খুব ভালোভাবে আছি। তুমি তো দাড়িঅলা নরেশদাকে চিনতে। এই হোস্টেলে তাঁর তিন ভাই আগে থেকে থাকতো। আমাদের অসুবিধে দেখে তারা দু’টো আস্ত রুম ছেড়ে দিয়েছে। রান্নাবান্না বাজার সব কিছু নিজেরাই করি। আমি এখানকার একটা সাপ্তাহিকে কলাম লিখছি। শীগগীর নরেশদা একটা কলেজে চাকরি পেতে যাচ্ছেন। এখানে বাংলাদেশের লক্ষ্মীছাড়া ছন্নছাড়াদের নিয়ে একটা সুন্দর সংসার গড়ে তুলেছি। আর শুনেছি বাড়িতে সবাই বেঁচেবর্তে আছে। তায়েবা আমার হাতে হাত রেখে বললো, দানিয়েল ভাই, আপনি একটা পথ করে নেবেন, এ কথা আমি নিশ্চিত জানতাম।
এরই মধ্যে জুতোর আওয়াজ পাওয়া গেলো। তায়েবা অবলীলায় বলে দিলো ওই যে মাইতিদা আসছেন। সত্যি সত্যি ডঃ মাইতি এসে কেবিনে প্রবেশ করলেন। তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, দানিয়েল সাহেব, আমি রসকষ হীন মানুষ। রোগী ঠেঙিয়ে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করি। শুনেছি আপনি একজন জিনিয়স, আপনার সাথে কি নিয়ে আলাপ করা যায় ভেবে স্থির করে একদিন জানাবো। আজ ভয়ানক ব্যস্ত; ক্ষমা করতে হবে। এখন আমি উঠবো।
তায়েবা বিছানা থেকে তড়াক করে নেমে ডঃ মাইতির ঝোলানো স্টেথেসকোপটা নিজের হাতে নিয়ে বললো, মাইতিদা আপনাকে দু’মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, দানিয়েল ভাই, কালও কি আপনি হাসপাতালে আসবেন? আমি মাথা নাড়লাম। তাহলে আমার জন্য অল্প ক’টা ভাত আর সামান্য ছোট মাছের তরকারি রান্না করে নিয়ে আসবেন। মরিচ দেবেন না, কেবল জিরে আর হলুদ। ছোট্ট মেয়েটির মতো আবদেরে গলায় বললো, মাইতিদা, আমাকে আগামীকাল ভাত খেতে না দিলে আপনাদের কথামতো আমি ইনজেকশন দেবো না, ক্যাপসুল খাবো না, হেন টেস্ট তেন টেস্ট কিছুই করতে দেবো না। ডঃ মাইতির হাত ধরে বললো, আপনি হ্যাঁ বলুন মাইতিদা। ডঃ মাইতি বেশ শান্ত কণ্ঠে বললেন, বেশতো দানিয়েল সাহেব, কালকে ভাত মাছ রান্না করে নিয়ে আসুন। কিন্তু আমি ভাবছি, পুরুষ মানুষের হাতের রান্না তোমার মুখে রুচবে কিনা? তায়েবা বললো, রুচবে, খুব রুচবে। দানিয়েল ভাই ট্যাংরা মাছ পান কিনা দেখবেন। ডঃ মাইতি ঘড়ি দেখে বললেন, এবার আমি উঠবো। দানিয়েল সাহেব, আপনিও কেটে পড়ুন। এমনিতে অনেক কনসেসন দেয়া হয়েছে।