জুতো মচমচিয়ে ডঃ মাইতি কেবিনে প্রবেশ করলেন। আমাকে দেখতে পেয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আরে দানিয়েল সাহেব যে। আসুন আপনার হেন্ডসেক করি। আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম। করমর্দনের পালা সাঙ্গ হলে ডঃ মাইতি বললেন, এবার দানিয়েল সাহেব আপনাকে একটা কৈফিয়ত দিতে হবে। আমি বললাম, কিসের কৈফিয়ত ডঃ মাইতি। আপনার তো থাকার কথা নয়, হাসপাতালে ছ’টার পরে কাউকে থাকতে দেয়া হয় না। এখন আটটা বেজে তিরিশ মিনিট। মাইতিদা উনি চলে যেতে চেয়েছিলেন, আমি এক রকম জোর করেই রেখে দিয়েছি। জবাব দিলো তায়েবা। ভালো করোনি। এখানকার একটা ডিসিপ্লিন তো আছে। সেটা যদি জোর করে ভেঙ্গে ফেলো আমরা টলারেট করবো কেনো? তায়েবা ডঃ মাইতির কথায় কোনো জবাব না দিয়ে বললো, ঠিক আছে দানিয়েল ভাই, চলে যান। আমিও চলে আসার জন্য পা বাড়িয়েছিলাম। এমন সময় ডঃ মাইতি তায়েবার হাত ধরে হো হো করে হেসে উঠলেন। দিদি তোমার আচ্ছা রাগ তো। এটা যে হাসপাতাল, বাড়ি নয়। সে কথা তোমাকে কেমন করে বোঝাই । ঠিক আছে, সাহেব আর দশ মিনিট বসুন। বিছানার একপাশে বসলাম। এখনো তায়েবার রাগ কমেনি। দানিয়েল সাহেব আপনি কেমন আছেন? আমি বললাম, ভালো। সে রাতের পর আপনার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। মাঝে মধ্যে সময় হলে গরীবের দরোজায় একটু টোকা দেবেন। সে রাতের পর থেকে কেন জানিনে আমি ডঃ মাইতির মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কেমন ভয় ভয় করে। তায়েবা বললো, কালকে আসবেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। আমাকে হাসপাতাল থেকে চলে আসতে হলো।
০৯-১০. আগস্ট মাসের চৌদ্দ তারিখ
সেদিনটি ছিলো আগস্ট মাসের চৌদ্দ তারিখ। চারদিকে ভারতের স্বাধীনতা দিবস পালনের তোড়জোর চলছে। সকাল বেলা ঢাকা রেডিও ধরেছিলাম। গোটা বাংলাদেশে আজ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপিত হচ্ছে। ইয়াহিয়া খানের কণ্ঠস্বর শুনলাম। জঙ্গীলাট পাকিস্তানের দু’অংশের ঐক্য কেয়ামতের দিন পর্যন্ত অটুট থাকবে, এ ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদ প্রকাশ করে ঘোষণা করছেন, কোনো দুশমন পাকিস্তানের এক ইঞ্চি মাটি একজন পাকিস্তানী বেঁচে থাকতেও দখল করতে পারবে না। পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ শব্দটি উচ্চারণ করে ইয়াহিয়া খান তার উর্দু বক্তৃতা শেষ করলেন। পর পর ইংরেজি এবং বাংলায় তাঁর বক্তৃতা অনুবাদ করে শোনানো হলো। ইয়াহিয়া খানের বক্তৃতার পরে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের একজন অধ্যাপক পাকিস্তানকে সমর্থন করে এমন জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিলেন, শুনে আমার শিরার সমস্ত রক্ত চট করে মাথায় এসে জমা হলো। এই ভদ্রলোকটির কাছ থেকে আমরা দেশপ্রেমের প্রথম পাঠ গ্রহণ করেছিলাম। হয়তো অধ্যাপক শখ করে পাকিস্তানকে সমর্থন করার জন্য রেডিওতে বক্তৃতা দিতে আসেননি। সৈন্যরা বন্দুক দেখিয়ে বাড়ি থেকে টেনে বের করে রেডিওর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তবু আমার ভীষণ খারাপ লাগতে আরম্ভ করলো। আগস্ট মাসের এই সকালটি অত্যন্ত সুন্দর। শিশুসূর্যের প্রাণপূর্ণ উত্তাপে প্রাসাদ নগরী কোলকাতা যেনো ভেতর থেকে জেগে উঠেছিলো। মনটা অকারণে খুশিতে ছেয়ে গিয়েছিলো। রবীন্দ্রনাথের সে গানটির কলি মনের ভেতর আসা যাওয়া করছিলো। “আজি প্রভাত স্বপনে শরত তপনে, কি জানি পরান কিযে চায় গো, শেফালীর শাখে কি বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কি যে গায় গো”। ঢাকা রেডিও শুনে সব কিছু অশ্লীল মনে হতে লাগলো। বন্ধ করে দিলাম। এই কান্তিমান দিনের সমস্ত আলো, উত্তাপ প্রতিশ্রুতি আমার কাছে একেবারে অর্থহীন হয়ে দাঁড়ালো। আজ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। আগামীকাল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। আর আমরাও একটি স্বাধীনতা সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আকাশে বাতাসে সর্বত্র শাড়ির আঁচলের মতো স্বাধীনতা যেনো দুলে দুলে খেলা করছে। হায়রে স্বাধীনতা!
আমার মনে কৃষ্ণবর্ণ পুষ্পের মতো একটা বিশ্রী অনুভূতি জন্ম নিয়েছিলো, বিষয়টা আরো বেড়ে গেলো। ঘরের বন্ধুদের কারো কাছে এ অনুভূতি আমি প্রকাশ করতে পারিনে। এমন কি নরেশদাকেও না। কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না। কণ্ঠনালী দিয়ে একটার পর একটা তেতো ঢেকুর উঠে আসতে চাইছিলো। সকালে নাস্তা খাওয়া হয়নি। রুমে একটা তুমুল বিতর্ক চলছে। ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের ব্যাপারে সিরিয়ািস কোনো পদক্ষেপ নেবেন না। ইত্যাদি ইত্যাদি। শ্রীমতি গান্ধী যা ইচ্ছে করুন। আমি প্যান্ট শার্ট পরে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু গেটের কাছে এসে চিন্তা করলাম, কোথায় যাওয়া যায়। সত্যি সত্যি কোলকাতা শহরে যাওয়ার মতো জায়গা খুবই অল্প আছে। হঠাৎ করে মনে পড়ে গেলো এ্যান্টনী বাগান লেনে মজহারুল ইসলামের বাড়িতে গেলে মন্দ হয় না! সকালের নাস্তাটাও ওখানে খেয়ে নেয়া যাবে। আর ইসলামের কাজকর্মের একটু ফাঁক থাকলে তাকে নিয়ে অর্চনার ফ্রান্স থেকে আগত দাদার কাছে গিয়ে আলাপ করা যাবে।
আমি যখন এ্যান্টনী বাগান এসে পৌঁছলাম, ইসলামেরা সবেমাত্র নাস্তার টেবিলের চারপাশে এসে বসেছেন। এখনো কেউ খেতে আরম্ভ করেননি। আমাদের দেখে ইসলাম হাসতে হাসতে বললেন, আরে মশায় আপনার উৎপাতে দেখছি সকাল বেলাটাও নিরাপদে কাটানো যাবে না। বলেন কোন্ মহাপ্রয়োজনে এই সকাল বেলা বাড়িতে এসেছেন। আমি বললাম, কাজ না থাকলে কি আর আসি। আপনারা বাংলাদেশের মানুষেরা বেশ আছেন, গোটা কোলকাতা শহরে একেকজন ধর্মের ষাঁড়ের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একেক মহাপুরুষের সুকীর্তির কাহিনী শুনতে শুনতে কানে পঁচন ধরে গেছে। আপনারা তো ইন্দিরা সরকারের অতিথি হিসেবে দিব্যি আছেন। এদিকে ইন্দিরাজী আমাদের কোন্ হাল করেছেন, সেটার কি খোঁজখবর রাখেন? গতোকাল এই পাড়ায় আমাদের পার্টির যতো কর্মী ছিলো সবাইকে এ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে। আমি বাসায় ছিলাম না। তাই আপনার সঙ্গে দেখা হলো। মজহারুল ইসলাম সিপিআইএম-এর ডেডিকেটেড ওয়ার্কার। এখন পশ্চিমবঙ্গে সিদ্ধার্থ শংকরের কংগ্রেস সরকারের সমস্ত রোষ সিপিআইএম-এর বিরুদ্ধে। কেনোনা জ্যোতিবসু এবং প্রমোদ দাস গুপ্তের নেতৃত্বাধীন সিপিআইএম-ই হলো কংগ্রেসের পয়লা নম্বরের দুশমন। প্রতিদিন কর্মীদের দলে দলে গ্রেফতার করছে। কেউ নিজের বাড়িতে থাকতে পারছে না। মজবুত ঘাঁটিগুলো একে একে কংগ্রেসের হাতে গিয়ে পড়ছে। বাইরে থেকে ঠিক বোঝার উপায় নেই। এখনো কংগ্রেস সরকার একটি ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে।