রোববার দিনটিতে আমি সন্ধ্যের একটু আগেই হাসপাতালে গেলাম। গিয়ে দেখি জমজমাট ব্যাপার। ডোরা এসেছে, দোলা এসেছে। তায়েবার মাও এসেছেন। আর তায়েবা বালিশে হেলান দিয়ে বসে অর্চনার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। আজকে তায়েবাকে খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। চমৎকার একটা ধোয়া সাদা শাড়ি পরেছে। খোঁপায় বেলী ফুলের মালা জড়িয়েছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিলো গেন্ডারিয়ার বাড়িতে আনন্দঘন সময় কাটাচ্ছে। আমাকে প্রথম দেখতে পেলো অর্চনা। সে কলকল করে উঠলো, এই যে দানিয়েল, কাল থেকে টিকিটিরও দেখা নেই কেন। আমি হেসে বললাম, আটকে গিয়েছিলাম। তায়েবাদি হাসপাতালে, আর তুমি গা ঢাকা দিয়ে আছে। আমি জিগগেস করলাম, অর্চনা তুমি কালও এসেছিলে নাকি? অর্চনাদি কালও এসেছিলেন এবং অর্ধেকদিন আমার সঙ্গে কাটিয়ে গেছেন। আজকে আমার জন্য বেলী ফুলের মালা নিয়ে এসেছেন। খোঁপা থেকে মালাটা খুলে হাতে নিয়ে দেখালো। কি ভালো অর্চনাদি। তার সঙ্গে কথা বললে মনটা একেবারে হাল্কা হয়ে যায়। অর্চনা কৃত্রিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো, বাজে বকোনা তায়েবাদি, তোমার মতো এতো প্রাণখোলা মেয়ে এতোদিন হাসপাতালে পড়ে আছো এ খবর আমি আগে পাইনি কেন? দু’মহিলার এই পারস্পরিক প্রশস্তি বিনিময় শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হলো। তায়েবার মা আমার কাছে জানতে চাইলেন, বাবা দানিয়েল, কাল কি তোমার কোনো অসুখবিসুখ হয়েছিলো। তোমাকে খুব দুর্বল এবং বিমর্ষ দেখাচ্ছে। আমি মাথা নেড়ে বললাম, না আমি সুস্থই ছিলাম। তাহলে তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো। মা, তুমি যেনো একটা কি। মনে করতে চেষ্টা করো, তাঁকে কখন তুমি সুস্থ মানুষের মতো দেখেছিলে। সব সময় তো একই রকম দেখে আসছি। গোসল করবে না, জামাকাপড় পরিষ্কার রাখবে না, দাড়ি কাটবে না–আর এমন একটা মেক আপ করে থাকবেন, দেখলে মনে হবে রোগি অথবা সাতজন পাঁচজনে ধরে কিলিয়েছে। কথা বলা অবান্তর। এই নালিশটি তায়েবা আমার সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকেই করে আসছে। তায়েবার কথা শুনে ডোরা খিলখিল করে হেসে উঠলো। ডোরার এই হাসিটিও আমার পরিচিত। গেন্ডারিয়ার বাসায় তায়েবা অপরিচ্ছন্ন থাকার অনুযোগ করলেই ডোরা এমন করে হেসে উঠতো। আশ্চর্য ডোরা আজও তেমন করে নির্মলভাবে হাসতে পারে? নানা অঘটন ঘটে যাচ্ছে। তবু মনে হচ্ছে সকলে ঠিক আগের মতোই আছে। কিন্তু আমি একা বদলে যাচ্ছি কেন? বোধ করি মানুষের ভালো মন্দ সব কিছুর বিচারক সেজে বসি বলেই কি আমার এ দুরাবস্থা। মানুষের কৃতকর্মের বিচারক সেজে বসার আমার কি অধিকার? তায়েবার মা কথা বললেন, কি বাবা হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে গেলে কেন? ডোরা ফোড়ন কেটে বললো, একটুখানি গম্ভীর না দেখালে লোকে ইন্টেলেকচুয়াল বলবে কি করে? কথাটা তায়েবার, ডোরা ধার করে বললো। কোলকাতা এসে দেখেছি ডোরার মুখ খুলে গেছে। সে কায়দা করে কথা বলতে শিখে গেছে। এবার দোলা মুখ খুললো। বেচারিকে তোমরা খেপাচ্ছো কেন? আসলে দানিয়েল ভাই খুব সরল-সহজ ভালো মানুষ। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় নাক সিধে চলেন, ডানে বামে তাকান না। তার দোষ ঐ একটাই, তিনি রসিকতা বোঝেন না। আজকে হাসপাতালে এসে আমার একটা ভিন্নরকম ধারণা হলো। এতোদিন মনে করে এসেছি এরা তায়েবার এই ভয়ঙ্কর অসুখটিকে কোনো রকম গুরুত্ব না দিয়ে সবাই নিজের নিজের তালে আছে। আজকে মনে হলো, সবাই তায়েবাকে তার মারাত্মক অসুখটির কথা ভুলিয়ে রাখার জন্যই এমন হাসিখুশি এমন খোশগল্প করে। মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ ঘনিয়ে উঠলো। আমিই তো প্রথম থেকে তায়েবাকে তার একান্ত ব্যথার জায়গাটিতে আঘাত করে আসছি। হাবে ভাবে আচার আচরণে তায়েবাকে তার ভাই বোন আত্মীয় স্বজন থেকে আলাদা করে ফেলার একটা উগ্র আকাক্ষার প্রকাশ ক্রমাগত দেখিয়ে এসেছি। এটা কেমন করে ঘটলো? তায়েবার ওপর আমার কি দাবি? যদি বলি তায়েবাকে আমি প্রাণের গভীর থেকে ভালোবাসি। তাহলে ভালোবাসার এমন উদ্ভট দাবি কেমন করে হতে পারে যে আমি তাকে তার ডাল মূল থেকে আলাদা করতে চাইবো। আমি নিশ্চিত জানি সে মারা যাবেই। প্রতিদিন একটু একটু করে তার জীবনপ্রদীপের তেল শুকিয়ে আসছে। তথাপি আমার মনের অনুক্ত আকাক্ষা এই মৃত্যু পথযাত্রী তায়েবার সবটুকুকে আমি অধিকার করে ফেলবো। পারলে তার স্মৃতি থেকেও নিকটজনের নামনিশানা মুছে ফেলবো। নিজের মনেরে ভেতর জমাটবাঁধা একটা ঈর্ষার পিণ্ড যেনো দুলে উঠলো। এই প্রথম অনুভব করলাম, আমি একটা পশু, একটা দানব। যা পেতে চাই সব কিছু ভেঙ্গে চুরে ছত্রখান করে গুঁড়িয়ে পেতে চাই। অথচ মনে মনে একটা ভালো মানুষীর আত্মপ্রসাদ অনুভব করে দুনিয়ার তাবৎ মানুষকে আসামী বানিয়ে বিচারক সেজে বসে আছি। সেই সন্ধ্যেয় হাসপাতালে আমার মনের এই কুৎসিত দিকটির পরিচয় পেয়ে ক্রমশ নিজের মধ্যেই কুঁকড়ে যেতে থাকলাম। স্বাভাবিকভাবে কোনো কথাবার্তা বলতে পারছিলাম না।
হাসপাতালের শেষ ঘণ্টা বেজে উঠলো। অর্চনা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তায়েবাদি আজ আসি। শিগগির আবার আসবো। সে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, শোনো দানিয়েল, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। থাক্ ভালোই হলো, কথাটা মনে পড়লো। পারলে এরই মধ্যে একবার সময় করে আমাদের বাড়িতে আসবে, একটা জরুরী ব্যাপার আছে। জরুরী ব্যাপারের কথা শুনে আমি অর্চনার পিছু পিছু করিডোর পর্যন্ত এলাম। জানতে চাইলাম, আসলে ব্যাপারটা কি? অর্চনা বললো, জানো আমার এক দূর সম্পর্কীয় দাদা এসেছেন ফ্রান্স থেকে। তিনি এক সময়ে অনুশীলন দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারপর নেতাজী সুভাষ বোসের সঙ্গে আজাদ হিন্দুফৌজে যোগ দিয়েছিলেন। আমরা অনেকদিন তার কোনো সংবাদ পাইনি। অনেক বছর পরে জানতে পারলাম, তিনি ফ্রান্সে চলে গিয়েছেন এবং এক ফরাসী মহিলাকে বিয়ে করেছেন। আমরা তো তাঁর। কথা একদম ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি তো তাকে কোনোদিন চোখেও দেখিনি। হঠাৎ করে গত সপ্তাহে তিনি আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। বাড়ির লোকজন কলিযুগেও এমন আশ্চর্য কাণ্ড ঘটতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছে। তিনি সংবাদপত্রে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সংবাদ পাঠ করে আর টেলিভিশন রিপোর্ট দেখে সোজা কোলকাতা চলে এসেছেন। একেই বলে বিপ্লবী। তিনি এখন আমাদের বাড়িতেই আছেন। তুমি একদিন আসবে। তোমার সঙ্গে কথা বললে দাদা ভীষণ খুশি হবেন । অর্চনা চলে গেলো।