এই সময়ে হাসপাতালের শেষ ঘণ্টা বেজে উঠলো। না চাইতেই একটা সুযোগ আমার হাত এসে গেলো। আমতা আমতা করে বললাম, জায়গাটি তো চেনা হলো, আরেকদিন না হয় আসা যাবে। আজ চলি। যতোই মৃদুভাবে বলি না কেন, আমার কথাগুলোতে রাগ ছিলো, ঝাঁঝ ছিলো। এটুকু না বুঝতে পারার মতো বোকা নিশ্চয়ই তায়েবা নয়। সে শশব্যস্তে বললো, সেকি কতোদিন পরে এলেন, এখুনি চলে যাবেন?। বসুন দু’চারটা কথাবার্তা বলি। আমি বললাম, শেষ ঘণ্টা বেজে গেছে, এখন যাওয়াই উত্তম। তায়েবা শাড়ির আঁচল আঙুলে জড়াতে জড়াতে বললো, সেজন্য আপনাকে চিন্তা করতে হবে না, আমি মাইতিদাকে বলে সব ম্যানেজ করে নেবো। আমি স্পষ্টতই অনুভব করলাম, আমার বুকের ভেতরে ঈর্ষার একটা কুটিল রেখা। জানতে চাইলাম, মাইতিদাটি কে? জবাবে বললো, মাইতিদা হচ্ছে ডঃ মাইতি। অসম্ভব ভালো মানুষ। কিন্তু বাইরে ভদ্রলোক ভীষণ কড়া। একটু পরেই আসবেন, আলাপ করলেই বুঝতে পারবেন কি সুন্দর মন। তার কথায় আমি স্প্রীংয়ের মতো লাফিয়ে উঠলাম। দোহাই তায়েবা উদ্ধার করো। দিদিমণিদের সামনে তুমি আগে একটা সার্কাস দেখিয়ে ফেলেছে। আরো একটা সার্কাস তুমি তোমার মাইতিদার সামনে দেখাবে বলে যদি মনস্থ করে থাকো। আমি তাতে রাজী হতে পারবো না। তারচে বরং আমি চলি। সুন্দর মনের মানুষদের নিয়ে তুমি থাকো। তোমার সুন্দর মনের মানুষদের গুণপনা এই সময়ে গোটা কোলকাতা জেনে ফেলেছে।
তায়েবা হঠাৎ সাপের মতো ফোঁস করে উঠলো। আপনি আমার অসুখের সংবাদ নিতে এসেছেন, নাকি যে সব কথা শুনতে শুনতে আমার কান পঁচে গেছে, সেগুলো পাঁচ কাহন করে বলতে এসেছেন। চলে যান, আপনি এখুনি চলে যান। একখানা লাউড স্পীকার ভাড়া করে আমার লোকদের কথা কোলকাতা শহরে ঘটা করে প্রচার করুন। ভাড়ার টাকা আমি দেবো। এই আচমকা বিস্ফোরণে আমি দমে গেলাম। টুলটা নেড়ে বিছানার কাছে এসে বসতে বসতে বললাম, তুমি এই মহিলাদের সামনে আমাকে এমনভাবে অপমানটা করলে কেন? কই অপমান করলাম, কোথায় অপমান করলাম? মনটা আপনার অত্যন্ত সংকীর্ণ। এই যে বললে প্রতি বছরে আমি ফার্স্ট হয়ে আসছি। বারে, অন্যায় কি করেছি। আপনি তো অনেক কাজ করে পড়াশোনা করেন। সব ছেড়ে ছুঁড়ে একটুখানি মন লাগালে আপনিও অনায়াসে ফাস্টটাস্ট কিছু একটা হতেন। আর যারা ফার্স্ট সেকেন্ড হয় তারা আপনার চাইতে ভালো কিসে? নিজের তারিফ শুনতে কার না ভালো লাগে। মনের উষ্মর ভাবটি কেটে গেলো। আমি হাসি মুখে বললাম, আর বিলেত যাওয়ার ব্যাপারটি। আরে দূর দূর ওটা একটা ব্যাপার নাকি, আজকাল কুকুর বেড়ালেরাও হরদম বিলেত আমেরিকা যাচ্ছে। আপনি চাইলে অবশ্যই যেতে পারেন। তাছাড়া…। আমি বললাম, তা ছাড়া আর কি। তাছাড়া আপনি একটা গেঁয়োভূত। একেবারে মাঠ থেকে সদ্য আসা একটি মিষ্টি কুমোড়। আমি বললাম, আমি যে মিষ্টি কুমোড় সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কুকুর বেড়ালও বিলেত আমেরিকা যাচ্ছে একথা সত্যি। কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছো টিকিট করে ওসব দেশে যেতে হয়। আপনি সব কথার কুষ্ঠিনামা বের করতে চান। চাল বোঝেন, চাল? ঐ মেয়েরা প্রতিদিন কথায় কথায় আমার সঙ্গে চাল মারে। আজ না হয় আমিও একটা চাল মারলাম। আপনি এটুকুও বোঝেন না? তুমি তো পরিচয় করিয়ে দিলে, তোমার দিদি, তোমার সই, তোমার বান্ধবী, এখন বলছে সব চালবাজ। আমার দিদি, আমার সই, আমার বান্ধবী ঠিক আছে, কিন্তু চাল মারতে অসুবিধেটা কোথায়? আপনি মেয়েদের সম্পর্কে জানেন কচু। সে বুড়ো আঙুলটি উঠিয়ে দেখালো।
শুনুন দানিয়েল ভাই, তায়েবা ঝলমল করে উঠলো। সেদিন হাসপাতালে একটা কাণ্ড ঘটে গেছে। এখানকার ধনী ঘরের এক মহিলা সেদিন বিউটি পারলারে গিয়ে ছাতার মতো এক মস্ত খোঁপা তৈরি করিয়ে আনে। বাড়ি আসার পরে কি হলো জানেন, মহিলার মনে হলো তার মগজের ভেতর কিছু একটা নড়ছে, লাফ দিচ্ছে। এরকম একটা আজগুবী অসুখের কথা কেউ কখনো শোনেনি। সকলের খুব দুশ্চিন্তা। অনেক ডাক্তার দেখানো হলো। কেউ বিশেষ কিছু করতে পারলো না। মহিলাকে নাকি স্যার নীলরতন হাসপাতালে নেয়া হয়েছিলো। সেখানে ডাক্তারেরা কিছু করতে পারেনি। অবশেষে তাকে এক রকম ফেন্ট অবস্থায় এ হাসপাতালে আনা হয়। ডাক্তারেরা স্থির করেন, মহিলার খোঁপাটি খুলে যন্ত্রপাতি দিয়ে দেখতে হবে মগজের ঘটনাটি কী। সত্যি সত্যি নার্সরা যখন মাথার খোঁপাটি খুলতে লেগে গেলো, মহিলা ফেন্ট অবস্থায়ও দু’হাত দিয়ে খোঁপা খুলতে বাধা দিচ্ছে। পরে যখন খোঁপা খোলা হলো অমনি এক টিকটিকি বাহাদুর লেজ দুলিয়ে লাফ দিলো। খোঁপা বাঁধার কোন ফাঁকে আটকা পড়ে গেছে টের পায়নি। সেই থেকে টিকটিকিটি যতোই বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছে, মহিলার মনে হয়েছে, মাথার মগজ খুলি ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সত্যি ঘটনা, বুঝলেন মেয়েরা কেমন হয়? আমি বললাম, যতোদূর জানি, তুমিও তো একজন মেয়ে, তোমার বিষয়েই বা অন্যরকম হবে কেমন করে। তায়েবা কৃত্রিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো, আপনি এখনো মিষ্টি কুমোড়ই থেকে গেছেন। কিছু শিখতে পারেননি।
এই সময়ে ডান হাতে স্টেথিসকোপ দোলাতে দোলাতে এক ভদ্রলোক কেবিনে প্রবেশ করলেন। বয়স খুব বেশি হবে না। ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের কোঠায়। চোখের দৃষ্টি অসম্ভব ধারালো। চেকন করে কাটা একজোড়া শাণিত গোঁফ। ধারালো চিবুক। একহারা গড়নের চেহারাখানা ব্যক্তিত্বের দীপ্তিতে খোলা তলোয়ারের মতো ঝকঝক করছে। সন্ধ্যের এ আলো আঁধারিতেও আমার দৃষ্টি এড়ালো না। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই যে এদিকে আসুন তো। আমি এগিয়ে গেলে তিনি অনেকটা ধমকের ভঙ্গিতে জিগগেস করলেন, কি বেল বাজলো আওয়াজ শুনতে পাননি? আমি মৃদুস্বরে বললাম, পেয়েছি। পেয়েছেন তো হাসপাতালে বসে আছেন কেন? আপনাদের ঘাড় ধরে বের করে না দিলে শিক্ষা হবে না দেখছি। এই যে মাইতিদা থামুন, থামুন। আমাদের দুজনের মাঝখানে তায়েবা এসে দাঁড়িয়েছে। আপাততঃ আপনার চোখা চোখা কথাগুলো তুলে টুলে রাখুন। আমি কতো বলে কয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়ার জন্য দানিয়েল ভাইকে সেই বিকেল থেকে আটকে রেখেছি। এদিকে আপনি তাকে ঘাড় ধরে বের করে দিচ্ছেন। ডঃ মাইতি স্মিত হেসে বললেন, এই তোমার দানিয়েল ভাই, যিনি ফার্স্ট ছাড়া কিছুই হন না। মশায় আপনার অসাধারণ কীর্তিকাহিনী শুনতে শুনতে তো পাগল হবার উপক্রম। অধীর আগ্রহে দিন গুণছি, কখন এসে দর্শনটা দেবেন। শুনেছি মশায়ের কোলকাতা আগমনও ঘটেছে তায়েবার অনেক আগে। যাক ভাগ্যে ছিলো, তাই দেখা হলো। তিনি আমার সঙ্গে শেকহ্যাণ্ড করলেন। তারপর বললেন, আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি ওয়ার্ডে। একটা রাউন্ড দিয়ে আসি।