আজও প্রাণের ভেতর থেকে একটা গভীর তাগিদ অনুভব করছিলাম। পা দু’টো আপনা থেকেই চলতে আরম্ভ করলো। বাসে গড়িয়াহাটা পর্যন্ত এসে বাকি পথটা টানা রিকশায় গেলাম। এ অবস্থায় এটা একটা বিলাসিতা বটে, কিন্তু হাঁটার মতো পায়ে কোনো জোর পাচ্ছিলাম না।
গোল পার্কের বাড়িতে গিয়ে বেল টিপতেই অর্চনা নিজে এসে দরোজা খুলে দিলো। আমাকে দেখে তার চোখ জোড়া খুশীতে চকচক করে উঠলো। জানো দানিয়েল, আজ ভেবেছিলাম বৌবাজার গিয়ে তোমাকে খুঁজে বের করবো। হোস্টেলটা চিনিনে বটে। তবে ঠিকানাতো ছিলোই। খুঁজে বের করতে কতোক্ষণ। বাংলাদেশের ছেলেদের একটা সারপ্রাইজ দিতাম। আমি বললাম, যাওনি যখন সে কথা বলে আর লাভ কি? সে বললো, আমি তো প্ল্যান করেছিলাম যাবোই। মাঝখানে বৌদি পাকড়ে ফেলে তার বোনের বাড়িতে নিয়ে গেলো। সেখান থেকে এসেই দেখি মা রামকৃষ্ণ মিশনে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছেন। যেই আমি বাড়িতে পা দিয়েছি, অমনি মা ঘরের মধ্যে বন্দি করে নিজে বেরিয়ে গেলেন। মিশনে অক্ষরানন্দ নামে এক মহারাজ এসেছেন। আর তাঁর মুখের বচন নাকি ভারী মিষ্টি। তা কি আর করা। আমি বেচারি বাড়িতে বসে বসে ভেরেণ্ডা ভাজছি। অর্চনা নিতান্ত আটপৌরে কথাও সুন্দর করে বলতে জানে। আমি বললাম, অর্চনা এক কাপ চা খাওয়াবে? ওমা চা তো খাবেই। সে অনুচ্চস্বরে ডাকলো, শোভা, এই শোভা। কাজের মেয়েটি এলে বললো, দুকাপ চা করে নিয়ে আয়। আর দেখো খাবার কিছু আছে কিনা। আমি বললাম, অর্চনা শুধু চা আর কিছুর প্রয়োজন নেই। অর্চনা বুদ্ধিমতী মেয়ে। বললো, দানিয়েল নিশ্চয়ই তোমার একটা কিছু হয়েছে। মুখটা ভয়ানক শুকনো দেখাচ্ছে। জবাবে বললাম, কিছু একটা না হলে শুধু শুধু তো আর তোমার কাছে আসিনে। সে বললে, বাপু কথা না বাড়িয়ে সেটা বলে ফেললো না। আমার সে পরিচিতা বান্ধবী যার কথা তোমাকে বলেছি, গত পরশু তার দেখা পেয়েছি। তাহলে তো পেয়েই গেছো, আমাদের এখানে এসেছো কেনো? আচ্ছা যাক, তোমার সে ভদ্র মহিলার গল্প শুনি। আমি বললাম, বলার মতো আর কোনো গল্প নেই। সেকি, দেখা না হতেই ঝগড়া বাধিয়ে বসে আছো নাকি। আমাকে বুঝি মধ্যস্থতা করতে হবে। আমাকে বলতেই হলো, তার মারাত্মক অসুখ। ডাক্তার বলছে ক্যান্সার। ওমা সেকি! এখন কোথায় আছে। আমি বললাম, পিজি হাসপাতালে। তুমি কেমন করে খুঁজে বের করলে? সে কথা থাকুক অর্চনা। খুঁজে বের করে কি লাভটা হলো। সে ফোঁস করে উঠলো, তোমরা বেটাছেলেরা ভয়ানক নেমকহারাম। সব সময় লাভ খুঁজে বেড়াও। এরই মধ্যে চা এসে গেলো। চুমুক দিতে দিতে টুকটাক কথাবার্তা হলো। অর্চনা জিগগেস করলো, তুমি এখন কি করবে? কি করবো সেটাই প্রশ্ন। ওসব হেয়ালী রাখো। বাস্তবে কি করবে সেটাই বলো। আমি বললাম, যা ঘটবার ঘটে যাবে, আমাকে শুধু দেখে যেতে হবে। বাস এর বেশি আর কিছু না। দানিয়েল তুমি ভয়ানক ভেঙ্গে পড়েছে। বেটাছেলেদের একটু শক্ত হতে হয়। এসময় শক্ত হওয়াই প্রয়োজন। ঠাণ্ডা মাথায় স্থির করো কি করবে। আমি বললাম, স্থির করাকরির আর কিছু নেই। তার পার্টির লোকেরা হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। সেখানে চিকিৎসা হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে চিকিৎসাতে ফল হবে না। সে মারা যাবেই। অর্চনা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো। তুমি নেগেটিভ সাইডটা সব সময় বড়ো করে দেখো। মাথা ঠাণ্ডা করো একটু। আগে রোগি দেখি। তারপর স্থির করা যাবে, কি করতে হবে। আমি অনেক কষ্টে হাসতে চেষ্টা করালাম। বললাম, অর্চনা তোমাকে ধন্যবাদ। সব রকমের বিপদে আপদে সব সময়ে তোমার মুখ থেকে চমৎকার সান্ত্বনার বাণী বেরিয়ে আসে।
এ সময়ে আবার কলিং বেল। অর্চনা উঠে দরোজা খুলে দিলো। দুজন ভদ্রলোক ঘরে প্রবেশ করলেন। তাদের একজন হ্যাংলা মতো। গায়ের রঙ ফর্সা, তবে কিছুটা জ্বলে গেছে। পরনে ধুতি আর সাদা সার্ট। ভদ্রলোকের চেহারার একটা আকর্ষণ আছে। মাথার চুল লম্বা কোঁকড়ানো। সঙ্গের অন্য ভদ্রলোকটি বেটে খাটো। চকোলেট রংয়ের প্যান্ট এবং নীল হাওয়াই সার্ট পরনে। প্রথম দৃষ্টিতেই মনে হবে, এ ভদ্রলোক অত্যন্ত গোছালো। ওঁরা দুজন সোফায় বসলে অর্চনা বললো, এসো দানিয়েল তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে সত্যব্রত আমার কলিগ এবং বন্ধু। আমি ধুতি পরা হ্যাংলাপনা ভদ্রলোকের সঙ্গে হাত মেলালাম। আর উনি হলেন অনিমেষদা। আশা করি দেখে চিনে নিতে তোমাদের অসুবিধে হবে না।
এ হচ্ছে দানিয়েল, আমার বাংলাদেশের বন্ধু। তার সম্পর্কে তো তোমাদের অনেক বলেছি। সত্যব্রতবাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, আরে দানিয়েল সাহেব, আপনার সম্পর্কে অৰ্চনার কাছে এতো শুনেছি যে বলতে গেলে আপনার সমস্ত কিছু মুখস্ত হয়ে গেছে। তাঁর কথায় হাসলাম। তিনি ফের জিগগেস করলেন, আপনি কেমন আছেন, এখানে কোথায় উঠছেন, আর আপনাদের মুক্তিসংগ্রামের সংবাদ কি? আমি আমার নিজের কথা বলতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সম্বন্ধে জানতে চাইলে কেমন নার্ভাস এবং অপ্রস্তুত বোধ করতে থাকি। মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে আমি কতোটুকু বলতে পারি। দেশের ভেতরে কি হচ্ছে কিছু জানিনে। সীমান্তে যা ঘটছে তারও খবর ঠিকমতো পাইনে। থিয়েটর রোডের কর্তাব্যক্তিরা কি আমার সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন? আমি সমস্যাতাড়িত অস্তিত্বের ভারে পীড়িত একজন অতি অসহায় মানুষ। আমার কাছে মানুষ জানতে চাইলে জবাব দিতে গিয়ে কেমন বাধো বাধো ঠেকে। অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশে একটি মুক্তিযুদ্ধ চলছে এবং এই যুদ্ধের কারণেই কোলকাতা মহানগরীর নাভিশ্বাস উঠছে। ভারত পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের জন্য সাজো সাজো রব উঠছে। আমি সেই বিরাট কর্মকাণ্ডের একটা ছিটকে পড়া অংশ। যতোই বিব্রত বোধ করি না কেন, এ জাগ্রত জ্বলন্ত সত্যকে এড়িয়ে যাই কেমন করে। সত্যব্রতবাবু পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা আমাকে দিলেন এবং একটা নিজে ধরালেন। তারপর একটুখানি হেসে বললেন, আমরা আশা করেছিলাম, আপনারা অন্য রকমের একটা ঘটনা ঘটাবেন। মার্চ মাসের প্রাথমিক দিনগুলোতে পশ্চিমবাংলার হাজার হাজার ছেলে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে বাংলাদেশে গিয়ে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলো। আপনারা যুদ্ধের সমস্ত মাঠটা পাকিস্তানী সৈন্যদের ছেড়ে এককেবারে চূড়ান্ত নাজুক অবস্থায় ইন্দিরা সরকারের অতিথি হয়ে ভারতে চলে এলেন, এটা আমরা আশা করিনে। কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না, কিন্তু কিছু না বলাটাও অশোভন। তাই আমাকে বলতে হলো, পাকিস্তানী আর্মির ক্র্যাক ডাউনের এক সপ্তাহ আগেও আমরা ধারণা করতে পারিনি যে আমাদের এভাবে এখানে চলে আসতে হবে। কিন্তু দেখতে পারছেন তো এসে গেছি। এখন করার বেশি কিছু কি আছে? সত্যব্রতবাবু অনেকটা আফশোসের ভঙ্গিতে বললেন, আপনাদের দেশ এবং জনগণের ভাগ্য এখন আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মধ্যে আটকা পড়ে গেছে। দুনিয়ার সমস্ত দেশ চাইবে আপনাদের উপলক্ষ করে দাবায় নিজের চালটি দিতে। মাঝখানে আপনারা চিড়ে চ্যাপটা হয়ে যাবেন। আমার মনে হয় কি জানেন, আপনাদের ওই শেখ মুজিব মানুষটি হাড়ে হাড়ে সুবিধেবাদী অথবা আস্ত একটা বোকারাম। কি সুবর্ণ সুযোগই না আপনাদের হাতে ছিলো। একটা চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো, সেটা বুকের ভেতর জমিয়ে রাখলাম। অর্চনা বললো, তোমরা আলাপ করো, আমি দেখি চা দেয়া যায় কিনা। সে বাড়ির ভেতর চলে গেলো।