সেই যে গেলো আর কখনো তাদের দেখা আমি পাইনি। নরেশদা বললেন, এই সোনা তো বাংলাদেশের জনগণের সম্পত্তি। আপনারা এখানে নিয়ে এলেন কেনো। থিয়েটর রোডের কর্তাব্যক্তিদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো নালিশ টালিশ করেননি। নাহিদ সাহেব বললেন, থিয়েটর রোডে অনেক ঘোরাঘুরি করেছি। কেউ আমার কথা কানেও তুলতে চান না। যে তিনজন আমরা সোনা নিয়ে এসেছিলাম, তার মধ্যে একজন এমপি-র আপন ছোটো ভাই। আরেকজন স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্টের শালা। তারা এখন কোথায় আছে, কি করছে কিছু জানিনে। অথচ এদিকে শুনতে পাচ্ছি সেই সোনা ইতিমধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেছে। দেখছেন তো এই অবস্থায় আমার কথা কে গ্রাহ্য করে তিনি নিজের দীনদশার প্রতি ইঙ্গিত করলেন। সত্যিই তো এরকম একজন মানুষ দেড় মণ সোনা বয়ে নিয়ে এসেছে, শুনলে এখন কে বিশ্বাস করবে। ভদ্রলোক বললেন, এখন আমি কি করি বলুন তো, পথে-ঘাটে বের হওয়া এক রকম অসম্ভব হয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কোলকাতার এবং বাংলাদেশের চেনা অচেনা মানুষ ভয় দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি যদি কোলকাতা শহর ছেড়ে না যাই, তাহলে আমাকে খুন করা হবে। অথবা পাকিস্তানের গুপ্তচর বলে ভারতের পুলিশের কাছে তুলে দেয়া হবে। আমি এখন কি করবো বুঝতে পারছিনে। আপনারা কি আমাকে কোথাও আশ্রয় দিতে পারেন? তার গল্পটি কেউ অবিশ্বাস করলো না। কেনোনা এরকম ঘটনা এই একটি নয়। আকছার ঘটছে। মুখে মুখে অনেক সহানুভূতিও প্রকাশ করা হলো। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। খুরশিদ কিন্তু নাহিদ সাহেবকে একটা পাকা আশ্বাস দিয়ে ফেললো। কাল এই সময়ে আপনি এখানে আসবেন। থিয়েটর রোডে নিয়ে গিয়ে তাজুদ্দীন সাহেবকে সব কিছু খুলে বলে বদমায়েশদের শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করবো। আজ বাড়ি চলে যান। নাহিদ সাহেব বললেন, এখানে আমার বাড়ি কোথায় যে যাবো? খুরশিদ বললো, যেখানে থাকেন, চলে যান। আমার তো থাকার কোনো জায়গা নেই। খুরশিদ বিরক্ত হয়ে বললো, কাল কোথায় ঘুমিয়েছিলেন। কালতো গোটা রাত শেয়ালদা স্টেশনে কাটিয়েছি। দূর মশায় আপনাকে নিয়ে আর পারা গেলো না। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলো। আমার চোখ দুটো ঘুমে ঢুলে আসছিলো। এতে ক্লান্তশ্ৰান্ত অবস্থায় কি করে যে এতোসব কথাবার্তা নীরবে শুনে আসছিলাম, তার কারণ কি ঠিক বলতে পারবো না। সবাই চলে গেলে নরেশদা জিগগেস করলেন, গতরাতে কি তোমার ঘুম হয়নি? আমি বললাম, না। এখন কি ঘুমোবে? বললাম, হ্যাঁ। কিছু খাবে না। ঘুম জড়ানো অস্পষ্ট গলায় জবাব দিলাম, খেয়ে এসেছি।
বেলা তিনটের দিকে আমার ঘুম ভাঙলো। দেখি রুমে আর কেউ নেই। নরেশদা বসে বসে সুবলচন্দ্র মিত্র এবং হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের অভিধান দুটো নিয়ে কিসব করছেন। অভিধান পাঠ করা এবং একটার সঙ্গে একটা মিলিয়ে দেখা তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যেস। ঢাকায় থাকার সময়ে আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম, বছর তিনেকের মধ্যে তিনি নিজে একখানা অভিধান জন্ম দিতে যাচ্ছেন। জিগ্গেস করলেন, দানিয়েল গতরাতে কোথায় ছিলে? আমি বললাম, তায়েবার ডাক্তার মাইতিবাবুর কোয়ার্টারে। তায়েবার রোগ সম্পর্কে ডাক্তার কিছু বললেন? বললাম, হ্যাঁ লিউক্যামিয়া। ওটা নাকি ক্যান্সারের একটা ভ্যারাইটি। ডাঃ মাইতি বললেন, এ ধরনের রোগির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তাই নাকি? গলার স্বরটা চমকে গেলো। তিনি অভিধান দুটো বন্ধ করে গালে হাত রেখে কি সব ভাবলেন। এখন তুমি কোথায় যাবে? আমি বললাম, গোল পার্কের কাছে অর্চনাদের বাড়ি আছে না সেখানেই যাবো। অর্চনা তো চাকরি করে কলেজে। তিনি কি কলেজে যাননি? এখন গেলে পাবে? আমি বললাম, আজ অফিসে আসবে না। গিয়ে দেখি পেলেও পেতে পারি। সেকি খাবে না? আপনি খেয়েছেন? হ্যাঁ, আমাকে খেতে হয়েছে। রাজার মঠ থেকে দাদা এসেছিলেন। তাঁকে সহ খেয়ে নিয়েছি। মা বাবার কোনো খবর টবর পেলেন? হ্যাঁ, মা বাবা আজ তাঁর বাড়িতে এসে পৌঁছেছেন। আমি বললাম, ভালো খবর। তিনি এখন কোথায়? খবরটা দিয়েই চলে গেছেন আবার। কাপড় চোপড় পরে আমি জিগগেস করলাম, নরেশদা আপনার কাছে টাকা আছে? বললেন, কতো? এই ধরুন পনেরো বিশ। তিনি আমার হাতে বিশ টাকার একখানি নোট দিলেন। আমি বেরিয়ে আসছি, তিনি ডাক দিলেন, একটু দাঁড়াও তায়েবার হাসপাতালের ওয়ার্ড নম্বর এবং বেড নম্বরটি লিখে দিয়ে যাও। আমি কাগজ নিয়ে লিখে দিলাম।
.
০৬.
অর্চনার সঙ্গে আমার পরিচয় অনেকদিনের। চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছিলো। উনিশশো আটষট্টির দিকে অর্চনা একখানি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলো। ওতে আমার একটি গল্প ছাপা হয়েছিলো; আমি এমন আহামরি লেখক নই। তথাপি কি কারণে বলতে পারবো না, লেখাটি অর্চনার মনে ধরেছিলো। তখন থেকেই সম্পর্ক। অবশ্য চোখের দেখা হয়নি। এখানে আসার পূর্বে পশ্চিমবঙ্গে অর্চনাই ছিলো একমাত্র পরিচিত ব্যক্তি। বাড়ির ঠিকানা খোঁজ করে তাকে পেতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি। বড়ো আশ্চর্য মেয়ে অর্চনা। এখানকার একটি কলেজে ফিলসফি পড়ায়। এক সময় নকসাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলো। অধ্যাপক সুশীতল রায় চৌধুরী, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের মূর্তি ভাঙ্গার প্রতিবাদ করে দলের লোকদের হাতে নিহত হওয়ার পর থেকেই অর্চনা নিজেকে আন্দোলন থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। দলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত নয়, কিন্তু অনেকের সঙ্গে ওঠাবসা আছে। ছাত্র পড়িয়ে দিন কাটাচ্ছে বটে, কিন্তু একটা অস্থিরতা সর্বক্ষণ মনের মধ্যে ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে। তা আমি অনুভব করতে পারি। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই ভোলামেলা। আমরা পরস্পরকে তুমি সম্বোধন করি। মাঝে মাঝে আমার অবস্থা যখন খুবই অসহ্য হয়ে ওঠে, কয়েক ঘণ্টা ওদের ওখানে কাটিয়ে মনটাকে ঝরঝরে করে তুলি।