আপনার মাও সে তুং এখন বাংলাদেশের ব্যাপারে কি করছেন, সে খবর রাখেন? পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে খুন, জখম, হত্যা, ধর্ষণ সবকিছু অবলীলায় চালিয়ে যাচ্ছে। আর আপনার মাও সে তুং সে ইয়াহিয়ার জল্লাদসৈন্যদের ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য জাহাজ ভর্তি করে বোমা, কামান, অস্ত্রশস্ত্র পাঠাচ্ছে। লংমার্চ তো অতীতের ঘটনা, হালের খবর বলুন। আমার মনে হলো, প্রশ্নকারীর কণ্ঠস্বরটি আমার পরিচিত। ওহ মনে পড়েছে। গান্ধী পিস ফাউণ্ডেশনের মনকুমার সেন একবার যিনি এখানে এসেছিলেন, এই ভদ্রলোক তাঁরই বড়ো ছেলে। নামটি মনে আসছে না। অমর্তসেন না কি একটা হবে। তার বাড়িতে একবার খেতে গিয়েছিলাম। সকলেই কথা বলছে। কোনো আগামাথা নেই। কোথায় শুরু এবং শেষ কোথায় হচ্ছে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। বাংলাদেশের সালাম এবার মুখ খুললো। মাওলানা ভাসানী মাও সে তুং এবং চৌ এন লাইয়ের কাছে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন, যাতে চীন পাকিস্তানের এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে কোনো রকম সহায়তা না করে। আরে থোন ফালাইয়া, আপনার মাওলানা ভাসানীর টেলিগ্রাম দুইখান চৌ এন লাই আর মাও সে তুং যতন কইর্যা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে থুইয়া রাখছে। মাওলানা এখন ইন্ডিয়া কেনো আইছে হেইডা কইবার পারেন? তাবিজ দেয়ার মৌলবী, আপনেরা তারে বিপ্লবী লিডার বানাইছেন। কথাগুলো খুরশিদের। খুরশিদ সম্পর্কে একটু পরিচয় দিতে হয়। সে সব জায়গায় ঘটা করে আওয়ামী লীগের লোক বলে প্রচার করে। জায়গা বুঝে মাঝে মাঝে হাই কম্যাণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, একথা বলতেও পেছ পা হয় না। তবে মুশকিল হলো আওয়ামী লীগের লোকেরা তাকে পাত্তা দেয় না। সত্যিকার আওয়ামী লীগের কাছে ঘেঁষতে না পেরে খুরশিদ আমাদের ডেরায় এসে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের মুণ্ডুপাত করে। ইংল্যান্ড প্রত্যাগত ভদ্রলোক জিগ্গেস করলেন, বাই দ্যা বাই, ক্যান এ্যনি ওয়ান অব ইউ টেল মি হোয়ার মাওলানা ইজ নাউ। উয়ি হিয়ার দ্যাট হি ওয়াজ আন্ডার অ্যারেস্ট। মাওলানা ভাসানীকে ধরে লাল কেল্লায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আরেকজন বললো, অ্যারেস্ট করা হয়েছে একথা সত্যি নয়। তবে তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। আমি নিজে অবশ্য শুনেছি পয়লা মাওলানাকে বালিগঞ্জের একটা বাড়িতে রাখা হয়েছিলো। মাওলানা সন্ধ্যে হলেই সে বাড়ির ছাদের ওপর পায়চারি করতেন। তাঁর লম্বা দাড়ি, পাঞ্জাবি, বেতের টুপি এসব দেখেই আশেপাশের মানুষের সন্দেহ হতে থাকে যে, এ মাওলানা ভাসানী না হয়ে যান না। তাছাড়া মাওলানার আরেকটা একগুয়ে স্বভাবের জন্য ভারত সরকার তাঁকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর তা এই, সন্ধ্যেবেলা সব সময়ে আজান দিয়ে ছাদে চাদর বিছিয়ে মাগরেবের নামাজ পড়তেন।
এক সময় মাওলানা ভাসানী প্রসঙ্গ চাপা পড়ে গেলো। আলোচনা শুরু হলো শেখ মুজিবকে নিয়ে। খুরশিদ বললো, থিয়েটর রোডের যে সকল মাস্তান আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙ্গিয়ে সব কিছু লুটপাট করে খাচ্ছে, এখানে বঙ্গবন্ধু হাজির থাকলে পেঁদিয়ে তাদের পিঠের ছাল তুলে ফেলতেন। সালাম ঠোঁট উল্টে জবাব দিলো, আরে রাখো তোমার বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানীদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেই ধরা দিয়েছে। পৃথিবীর কোনো বিপ্লবী সংগ্রামে নেতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তোমার ওই বঙ্গবন্ধুর মতো শক্রর কাছে সগৌরবে আত্মসমর্পণ করেছে তার কোনো নজীর আছে কি? শেখ মুজিব সব সময় স্যুটকেশ গুছিয়ে রাখতেন। আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্বেই জেলে চলে যেতেন, আর আন্দোলন শেষ হয়ে গেলে বিজয়ী বীরের বেশে জেলখানা থেকে বেরিয়ে ক্রেডিটটুকু নিতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে। শেখ পাকিস্তানের জেলে আর আমরা এখানে কোলকাতার পথে পথে ভেরেণ্ডা ভেজে চলছি। এই অবস্থাটার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী তোমার ওই শেখ মুজিব এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ। শেখের মতো এতো বড়ো জাতীয় বেঈমান আর দ্বিতীয়টি নেই। খুরশিদ হুঙ্কার দিয়ে উঠলো, খবরদার সালাম, ছোটো মুখে বড়ো কথা বলবে না। অন্য লোকের নাম বললে কিছু মনে করতাম না। বঙ্গবন্ধুর নামে কিছু বললে মুখের বত্রিশটি দাঁতের একটিও আস্ত রাখবো না। সালাম এবং খুরশিদ উঠে দাঁড়িয়ে পরস্পর শক্তি পরীক্ষার মাধ্যমে একটা মীমাংসায় পৌঁছার উপক্রম করলে সকলে ধরাধরি করে দু’জনকে থামিয়ে দিলো।
এ ধরনের ঘটনা হামেশাই ঘটে থাকে। এ রকমের একটা বিস্ফোরণের পর আলোচনা আর স্বাভাবিক খাতে এগুচ্ছিলো না। ইংল্যান্ড প্রত্যাগত ভদ্রলোক বললেন, সরি, আমার একটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। সুতরাং এখুনি আমাকে উঠতে হবে। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে সুমন্তবাবুও উঠে গেলেন। বোঝা গেলো, ইংল্যান্ড প্রত্যাগত ভদ্রলোকটি সুমন্তবাবুই সংগ্রহ করে এনেছিলেন। আসরের একেকজন করে উঠে যাচ্ছিলো। ওমা এমনি করে সবাই উঠে গেলে চলবে কেনো? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এখনো তোলাই হয়নি। মাসুমকে কথা বলতে শুনলাম। ‘গুরুত্বপূর্ণ’ শব্দটি মনে হয় সকলের মনে একটু দাগ কাটলো। মাসুম খোঁচা খোঁচা কাঁচা পাকা দাড়িঅলা এক ভদ্রলোকের দিকে ইঙ্গিত করে বললো, নাহিদ ভাই, এবার আপনার কাহিনীটা একটু বলুন। তিনি যে দুঃখে পড়েছেন চেহারাসুরত দেখলেই মনে হয়। উড্রান্তের মতো চোখের দৃষ্টি। জামার একটি হাতা গুটানো, অন্যটি ছেড়ে দেয়া। ভদ্রলোক কথা শুরু করতে গিয়ে একটু একটু করে কাঁপছিলেন। গলার স্বরটিও কাঁপছিলো। যাহোক তিনি তাঁর কাহিনীটা বলতে আরম্ভ করলেন। বগুড়া দখল করার পর আমরা দেড় মণ সোনা স্টেট ব্যাংকের স্ট্রং রুমের সেফটি ভল্ট ভেঙ্গে এখানে নিয়ে আসি। আমরা তিনজন সোনাসহ নৌকোতে করে বর্ডারে এসে পৌঁছোই। সেখান থেকে গাড়িতে করে কোলকাতা এসে দু’টো স্যুটকেশ কিনে সোনাগুলো ভাগাভাগি করে রাখি। তারপর তিনজন শেয়ালদার কাছে একটা হোটেলে উঠি। একদিন না যেতেই অন্য দু’জন বললো, আমাদের পেছনে ভারত সরকারের স্পাই লেগেছে। যদি কোনো রকমে জানতে পারে সোনা আছে, সবকিছু কেড়েকুড়ে নেবে এবং আমাদের জেলে পুরে রাখবে। পরামর্শ দিলো মাল সরিয়ে দেয়া প্রয়োজন। দু’জন হোটেল ছেড়ে স্যুটকেশ দুটো নিয়ে অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলো। আমাকে বলেছিলো, তিনজন এক সঙ্গে গেলে কেউ সন্দেহ করতে পারে। আমি সরলভাবে তাদের কথা বিশ্বাস করেছি। তারা কোনো সেফ জায়গায় ওঠার পর আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে।