কাপড় পরা শেষ হলে তায়েবা আমাকে ডাকলো। আমি দরজা খুলোম। কাপড়চোপড় পরেছে বটে, কিন্তু আঁচলটাকে সামলাতে গিয়ে ভারী অসুবিধে হচ্ছিলো। কাঁধ থেকে খসে মেঝেতে পড়ে আঁচলটা ভিজে গেলো। তায়েবা বললো, আপনি ভীষণ অপয়া। আমার আঁচলটা ভিজে গেলো। আঁচল তুলে নিয়ে সে পানি চিপে বের করে নিলো। আরেকবার আপনাকে কষ্ট করতে হবে। আমার শিথানে একটি ক্রীম আছে। কাপড় উঠালেই পাবেন। প্লিজ, সেটা গিয়ে একটু নিয়ে আসুন । আমি ক্রীমটাও নিয়ে তার হাতে দিলাম। সে আঙুলের ডগায় ক্রীম তুলে নিয়ে হাতের তালুতে ঘষে ঘষে মুখমণ্ডলে এবং ঘাড়ের কাছাকাছি লাগালো। এখন আপনি আবার আগের মতো দাঁড়ান। আমি দাঁড়ালাম। কিন্তু সে পায়ের ওপর ভর করে আর উঠতে পারলো না। উঃ দানিয়েল ভাই! আমি বললাম, কি তায়েবা। আমার হাঁটু দু’টো ঠক ঠক করে কাঁপছে। শরীরের সমস্ত শক্তি কাপড় পরতেই শেষ হয়ে গেছে। আপনি আমাকে পাঁজাকোলা করে বিছানায় রেখে আসুন না। আমি দুহাত দিয়ে তাকে উঠিয়ে নিলাম। সে একটি হাত আমার ঘাড়ের ওপর রাখলো। কাজটি শেষ হতে দু’মিনিট সময়ও ব্যয় হয়নি। তায়েবার সঙ্গে আমার পরিচয় চার বছর। কিন্তু এভাবে আত্মসমর্পন সে কখনো করেনি।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে কয়েকবার হা করে শ্বাস ফেললো। বুঝলাম, তার অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে। বেশ কয়েক মিনিট পর আমাকে জিগগেস করলো, দানিয়েল ভাই, আপনি কি ডোরার গান শুনতে যাবেন? যান তো একখানা টিকিট দিতে পারি। আমি বললাম, না, কারণ যেখানে থাকি সেখানে যেতে হবে। তারপর পত্রিকা অফিসে গিয়ে লেখার কিস্তিটি পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলো। তারপর নীরবতা ভঙ্গ করে বললো, আপনি ডুরির প্রতি এতো বিরূপ কেনো? ও কি সংসারের কিছু বোঝে? ঝোঁকের মাথায় একটা কাজ করে এসেছে, তা এমন সিরিয়াসলি না নিলেও তো পারেন। তার যখন জন্ম হয়েছিলো তখন মার ভয়ানক অসুখ ছিলো। আমি নিজের হাতেই সেবাযত্ন করে এতো ডাগরটি করেছি। একবার তো মরতেই চলেছিলো। উঃ তখন আমার ওপর কি ধকলটাই না গেছে! গায়ে গতরে বেড়েছে বটে। আসলে ওর কি বয়স হয়েছে? আপনি ওর দিকে একটু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তাকাতে পারেন না। মানুষের ভুলটাকে অতো বড়ো করে দেখেন কেনো?
০৫-৬. হাসপাতাল থেকে
হাসপাতাল থেকে আমি সবটা পথ হেঁটেই বৌবাজারের হোস্টেলে এলাম। ট্রাম-বাসে চড়ার ইচ্ছেও মনের মধ্যে জাগ্রত হয়নি। মনে হচ্ছে আমি একেবারে কাঙাল বনে গেছি। আমার চিন্তা করার কিছু নেই, আকাক্ষা করারও কিছু নেই, ভরসা করার কিছু নেই। তবু হোস্টেলে আসতে পারলাম কেমন করে, সে আমি বলতে পারবো না। গেটের গোড়ায় এসে দেখি ভূড়িঅলা দারোয়ানটির বদলে দুবলা পাতলা দারোয়ানটি দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে বসে খৈনি টিপছে। আমাকে দেখতে পেয়ে পান খাওয়া গ্যাটগ্যাটে দাঁত দেখিয়ে হেসে বললো, বাবু কোটিমে যাইয়ে আজ, হাওয়া বুহুত গরম আছে। কোনো উত্তর না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলাম।
যে রুমে আমরা থাকি, সেখানে মাঝারি রকমের একটা কনফারেন্স বসে গেছে। বাংলাদেশের ছেলেদের অধিকাংশই হাজির আছে। তাছাড়া আছেন কোলকাতার সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। ইনি পোস্টাফিসে চাকরি করেন। ফর্সাপনা সুন্দর চেহারার সদানন্দ মানুষটি। সবসময় পরিষ্কার পাজামাপাঞ্জাবি পরেন এবং দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কেটে থাকেন। অবসর সময়ে কবিতা লিখেন, কিন্তু কোলকাতার কাগজগুলো, এমন কি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকেরাও তাঁর প্রতি এমন নির্দয় যে কবিতা কেউ ছাপতে চান না। বিশ্বাসের দিক দিয়ে তিনি বিপ্লবীও বটেন। কি কারণে বলতে পারবো না, কোনো বিপ্লবী পার্টির সদস্য হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। কথাবার্তা বলে দেখেছি পশ্চিমবাংলার বিপ্লবী পার্টিগুলোর নীতি আদর্শের প্রতি তার ভীষণ রকম অনাস্থা এবং নেতৃবৃন্দের প্রতি সুমন্তবাবুর ভয়ানক রাগ। কথায় কথায় তিনি অবজ্ঞা প্রকাশ করেন। অবশ্য ইদানীং সুমন্তবাবুর বেশ পুষিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের এইসব ভাসমান কর্মহীন উদ্দেশ্যহীন ঘরহারা লক্ষ্মীছাড়া ছেলেদের সঙ্গে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত মার্কামারা সত্যিকার একটি গণবিপ্লবের তাত্ত্বিকভিত্তি নিয়ে হামেশা আলাপ আলোচনা করে থাকেন। তার ধারণা পশ্চিমবাংলা হেজেমজে গেছে। সমাজকে নিয়ে কিছু যদি করার থাকে, তা বাংলাদেশের ছেলেদের দিয়েই সম্ভব। তত্ত্বের জঙ্গলে ওদের ধ্যান ধারণা এখনো পথ হারিয়ে ফেলেনি। বাংলাদেশের প্রতিটি ছেলেকেই সুমন্তবাবু তার আকাঙ্ক্ষিত গণবিপ্লবের একেকজন সৈনিক হিসেবে দেখেন। এরই মধ্যে উদ্যোগী হয়ে বাংলাদেশের ছেলেদের নিয়ে তিন তিনটে কবিতার সংকলন প্রকাশ করে ফেলেছেন। তিনটিতেই সুমন্তবাবুর তিনটি কবিতা সগৌরবে স্থান করে নিয়েছে। মানুষটি রসগোল্লার মতো। মনে হয় টিপলেই রস বেরুবে। কি কারণে বলতে পারবো না, আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয়টা মামুলিপনা অতিক্রম করে হৃদ্যতার স্তরে পৌঁছুতে পারেনি। আমার পরনে ধুতি দেখে মাসুমই প্রথম ফোড়ন কাটলো। দানিয়েল ভাই, বলুন দেখি কোলকাতার হাওয়া এখন কার গায়ে লাগছে? মাসুম কোলকাতার মানুষের মতো টানটোন লাগিয়ে ঢাকার বাংলা ভাষাটি বলতে চেষ্টা করছে আজকাল। একবার সেদিকে ইঙ্গিত করেছিলাম। আজ আমার পরনে ধুতি দেখে মাসুম তার শোধ দিতে চেষ্টা করছে। মাসুমের কথার পিঠে কথা বলার মতো মনের অবস্থা ছিলো না। নীরবে নরেশদার পাশে গিয়ে একটা বালিশ টেনে নিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম। নরেশদা জিগগেস করলেন, কি খবর? আমি বললাম, ভালো নয়। কি রকম বলো দেখি। এসব শেষ হোক, পরে বলবো। আমি চোখ দুটো বন্ধ করে রইলাম। মনে হচ্ছিলো একটা প্রচণ্ড সংজ্ঞাহীনতা আমাকে এখুনি গ্রাস করে ফেলবে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়তে পারছিলাম না। এক ভদ্রলোক যিনি আমার সম্পূর্ণ অচেনা, অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে ঘরভর্তি মানুষের সামনে কথা বলছিলেন। বোধকরি তিনি আগের থেকেই কথা বলছিলেন। আমার আগমনে হঠাৎ করে তাঁর কথায় ছেদ পড়ে থাকবে। বাংলাদেশের ফ্রিডম ওঅরের কথা শুনে লেখাপড়া ছেড়ে ইংল্যাণ্ড থেকে কোলকাতা এসেছি আজ পঁচিশ দিন। কিন্তু এখানে এসে কি দেখেছি? দেখেছি থিয়েটর রোডে যারা বসে আছে তাদের অধিকাংশই এ বাঞ্চ অফ রাস্কেলস। খাচ্ছে দাচ্ছে মজা করছে এভাবে নাকি ফ্রিডম ওয়রের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ভয়ঙ্কর ডিজ-ইলুশনড হয়ে গেছি। মাও সে তুংও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আপনারা নিশ্চয়ই লংমার্চের খবর জানেন!