ডঃ মাইতির সঙ্গে খাবার টেবিলে গেলাম। চুপচাপ লুচি, হালুয়া, ডিম এবং চা খেয়ে গেলাম। আমার কথাবার্তা বলার কোনো প্রবৃত্তি হচ্ছিলো না। তিনিও বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন না। সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে হঠাৎ তার চোখে চোখে পড়ে যাই। মনে হলো তিনি যেনো কি একটা গভীর বিষয় নিয়ে চিন্তা করছেন। ডঃ মাইতির সঙ্গে আমার একটা সহজ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু এই এক রাতের মধ্যে তাতে যেনো একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। আমার মনের এরকম একটা অবস্থা, যা ঘটুক আমি কেয়ার করিনে। চারপাশের লোকজন এদের আমি চিনিনে, চিনতেও চাইনে। ডঃ মাইতি আমাকে জিগগেস করলেন, সকালবেলা তায়েবাকে একবার দেখে যাবেন কি? আমি নিস্পৃহভাবে বললাম, চলুন। কোনো ব্যাপারে আর উৎসাহ নেই। গতরাতে তায়েবা যদি ঘুমের মধ্যে মরেও গিয়ে থাকে, আমি যদি হাসপাতালে যেয়ে তার মরা শরীর দেখি, তবু কেঁদে বুক ভাসাবো না। আমি কি করবো, আমার করার কি আছে।
সে যাক, ডঃ মাইতির পেছন পেছন আমি তায়েবার ওয়ার্ডে প্রবেশ করলাম এবং অবাক হয়ে গেলাম। এই সাত সকালে জাহিদুল এবং ডোরা তায়েবার বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্য সময় হলে বোধ করি আমি নিজের মধ্যে হলেও প্রচণ্ডভাবে ক্ষেপে উঠতাম। আজকে সে রকম কোনো অনুভূতিই হলো না। বরঞ্চ মনে হলো, ওরা আসবে একথা আমার মনের অবচেতনে জানা ছিলো। আমিও চুপচাপ তায়েবার মাথার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে পেছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছে। এখনো মুখ ধোয়নি। ফ্যানের বাতাসে মাথার চুল উড়াউড়ি করছে। তার চোখেমুখে বেদনামথিত স্নিগ্ধ প্রশান্তির দীপ্তি। আমাকে দেখামাত্রই তার মুখে কথা ফুটলো। এই যে দানিয়েল ভাই, আসুন। আপনি কি কাল মাইতিদার কোয়ার্টারে গিয়েছিলেন? নইলে এতো সকালে আসবেন কেমন করে? আমি মাথা নাড়লাম, তারপর নীরবে জাহিদুলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
জাহিদুলের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেলো না। তায়েবাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর থেকেই একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করে আসছি। আমরা পাশাপাশি বসে কথা বলতে দেখলে ভুকুটি জোড়া মেলে ধরতেন। তিনি আমাদের পরিচয় আর মেলামেশা কখনো সহজভাবে নিতে পারেননি। এমনকি একাধিকবার মন্তব্য করেছেন, আমি ভীষণ নারীলোলুপ মানুষ। নানা গুণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আমি তাঁকে ভড়ং সর্বস্ব একটা ফাঁকা মানুষ জ্ঞান করে আসছি। আর সুযোগ পেলে কখনো ছেড়ে কথা বলিনি। আজকে তিনিও মৃদু হেসে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। সব কিছুর এমন পরিবর্তন ঘটলো কি করে? সকলেই কি তায়েবার ভাবী পরিণতি সম্পর্কে জেনে গেছে?
জাহিদুল সামনের দিকে ঝুঁকে একটা ব্যাটারিচালিত টেপরেকর্ডার বাজিয়ে তায়েবাকে কি সব গান শোনাচ্ছিলেন। আমার আচমকা উপস্থিতিতে সেটা অনেকক্ষণ বন্ধ ছিলো। তায়েবা বললো, রিউইন্ড করে আবার প্রথম থেকে বাজান জাহিদ ভাই। দানিয়েল ভাইও শুনুক। আমাকে বললো, দানিয়েল ভাই শুনুন, ডোরা দিল্লীতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের একটি একক প্রোগ্রাম করেছে। গান বাজতে থাকলো। দেয়ালে হেলান দিয়ে তায়েবা চোখ বন্ধ করে রইলো। বাংলাদেশে থাকার সময়ে ডোরা রেডিও, টিভিতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে গান গাইতো। যখন গান বাজতো তখনো এমনি করে তায়েবা বিদ্যুতবাহিত স্বরতরঙ্গের মধ্যে নিজের সমস্ত চেতনা বিলীন করে দিত। “তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতো দূরে আমি ধাই, কোথাও মৃত্যু, কোথাও বিচ্ছেদ নাই।” ডোরার কণ্ঠ অত্যন্ত সুরেলা। তাতে যেনো বিষাদের একটুখানি ছোঁয়া আছে। এই ছোঁয়াটুকুর স্পর্শেই সঙ্গীতের সুদূরের আহ্বানটি যেনো প্রাণ পেয়ে জেগে উঠে। ডোরা জাহিদুলের কাছে গান শিখেছে। তাঁর সম্পর্কে যার যতোই নালিশ থাকুক, কিন্তু একটি কথা সত্য, যাকে গান শেখান প্রাণমন দিয়ে শেখান। আবার বেজে উঠলো “আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি, আমার যতো বাক্য প্রভু, আমার যতো বাণী।” এমনি করে এক ঘণ্টার প্রোগ্রাম ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজতে থাকলো। সবগুলো গান যেনো তায়েবার বর্তমান অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই নির্বাচন করা হয়েছে। তাহলে ডোরাও কি জেনে গেছে অন্তিম পরিণতিতে তায়েবার কি ঘটতে যাচ্ছে। মনের মধ্যে একটুখানি খুঁতখুঁতোনি অনুভব করছিলাম। তায়েবার সেই প্রিয়গান দুটো ডোরা বাদ দিয়েছে কেনো? ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ এবং দাঁড়াও আমার আঁখির আগে। সকলে সবদিক দিয়ে তায়েবাকে যেনো অন্তিমযাত্রার জন্য প্রস্তুত করে তুলছে। ডোরা যে পার্ক সার্কাসের বাসায় তায়েবাকে সংজ্ঞাহীন রেখে দিল্লীতে জাহিদুলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলো, তাও বোধকরি এ জমজমাট নাটকের শেষ দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার জন্য নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করেই করা হয়েছিলো।
ক্যাসেট শেষ হলে তায়েবা চোখ খুললো। তার ঠোঁটে হাসি খেলে গেলো। ডোরার গানের শেষে এমনি গর্বের হাসি তার চোখেমুখে খেলে যেতে পূর্বে আমি অনেকবার দেখেছি। তায়েবা খুব ক্ষীণকণ্ঠে জিগগেস করলো, লোকে কেমনভাবে নিয়েছে তোর গান ডুরি। বলাবাহুল্য তায়েবা ডোরাকে ডুরি নামেই ডাকে। এবার ডোরা মুখ খুললো। সে এক আজব ব্যাপার বাপ্পা। নানা জায়গা থেকে গান করার এতো অফার আসতে লাগলো যে গোটা মাসেই শেষ করা যেতো না। ডোরা তায়েবাকে বাপ্পা বলেই ডাকে। কি কারণে বড় বোনকে বাপ্পা বলে সম্বোধন করে তার ইতিকথা আমি বলতে পারবো না। তায়েবা বললো, কয়েকটা অনুষ্ঠান করে এলেই পারতিস। এতো তাড়াতাড়ি কেননা চলে এলি। দিল্লী কতো বড়ো শহর, কতো জ্ঞানীগুণীর ভীড় সেখানে। হাতেরলক্ষ্মী পায়ে ঠেললি। ডোরা দু’হাতে তায়েবার গলা জড়িয়ে ধরলো। বাপ্পা তোমার শরীরের ওই অবস্থায়, সে হু হু করে কেঁদে ফেললো। তায়েবা গভীর আগ্রহে তার পিঠে হাত বুলোতে লাগলো। আমার অসুখতো লেগেই আছে, কিন্তু তোর সুযোগ তো আর প্রতিদিন আসবে না। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, জানেন দানিয়েল ভাই, কালকে আপনার যাওয়ার পর থেকে আমি সারারাত বমি করেছি। একবার তো বাথরুমে পা পিছলে পড়েই গিয়েছিলাম। ভাগ্য ভালো আয়াটা ছিলো। নইলে সারারাত পড়ে থাকতে হতো। তায়েবার কথা শুনে ডোরা আমার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে রইলো। জাহিদুলের সে পুরোণো ভুকুটি জোড়া জেগে উঠলো। তিনি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন, তার অর্থ করলে এরকম দাঁড়ায় যে জানতাম, তুমি এলেই একটা অঘটন ঘটবে। তিনি তায়েবাকে জিগ্গেস করলেন, কি হয়েছিলো, বমি হতে শুরু করলো কেনো, কখন পড়ে গিয়েছিলে, কই কিছুতো বলোনি। কিছু কুপথ্য মুখে দিয়েছিলে কি? তায়েবা বললো, না না, সে সব কিছুই না। সন্ধ্যের পর থেকে আপনাআপনি বমি হতে শুরু করলো। এক সময় পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম, আমার মনে হলো, এ নাটকে যা ঘটবে সব দেখে যেতে হবে। পালন করার কোনো ভূমিকা থাকবে না। এমনকি একটা ফালতুরও নয়। অগত্যা আমি উঠে যেতে উদ্যত হলাম। তায়েবার দিকে তাকিয়ে বললাম, তাহলে এখন আসি। পরে না হয় একবার আসবো। না না দানিয়েল ভাই, যাবেন না। আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে, বরঞ্চ ডোরা তোরা যা। প্রোগ্রাম শেষ হলে যাবার পথে খবর দিয়ে যাস। ডোরা এবং জাহিদুল চলে গেলো। সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমাদের ডোরা খুব গুণী। এরই মধ্যে দিল্লীতে প্রোগ্রাম করে এলো, আজ মহাজাতি সদনে গান গাইবে। আমার শরীরটা হয়েছে একটা মস্তবড়ো বোঝা। নইলে আমিও গান শুনতে যেতাম। অনুষ্ঠানে গাইবার সময় ডোরার গান শুনেছি কতোদিন হয়। মা শুনলে কি যে খুশী। হবে। দানিয়েল ভাই, আপনি একটু উঠে দাঁড়ান। আপনার কাঁধে ভর দিয়ে আমি একটু বাথরুমে গিয়ে মুখটা ধুয়ে নেবো। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। আজ দশটায় আবার ডঃ ভট্টাচার্য এসে টেস্টফেস্ট কি সব করবেন। আর সহ্য হয় না। আমি তাকে ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে গেলাম। সে ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে মুখে সাবান ঘষলো। তারপর মুখ ধুয়ে নিলো। চিরুনি নিয়ে চুল আঁচড়াতে চেষ্টা করলো। তায়েবা বললো, আমার পা দুটো কাঁপছে, দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনে। আমি বেসিনে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াবো। আপনি আমাকে একটা টুল এনে দিন। আমি টুলটা এনে দিয়ে বসিয়ে দিলে সে হাঁপাতে লাগলো। তার মুখমণ্ডলে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিলো। দানিয়েল ভাই, আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। খাটের বাজুতে দেখবেন একটা প্লাস্টিকের ঝুড়ি আছে। সেখান থেকে খোঁজ করে একটা তাঁতের শাড়ি, পেটিকোট এবং ব্লাউজ এনে দিন না। এখনো বাসী কাপড় পরে রয়েছি। আমার গা কুটকুট করছে। গেন্ডারিয়ার বাসাতেও দেখেছি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঘরদোর পরিষ্কার করে গোসল সেরে একটা ধোয়া কাপড় পরেছে। আমি প্লাস্টিকের ঝুড়ি থেকে খোঁজ করে শাড়ি, ব্লাউজ এবং পেটিকোট বের করে তায়েবার হাতে দিলাম। সে বললো, এখন টুলটা টেনে ওই দরোজার কাছে নিয়ে কাপড়চোপড়গুলো পরতে হবে। আর আপনি একটু ওপাশে গিয়ে দাঁড়ান। তাকে বসিয়ে রেখে ওপাশে এসে আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। তায়েবা কোন্ কৌশলে এই অল্প পরিসর টুলের ওপর বসে কাপড় চোপড় পরবে আমি ভেবে ঠিক করতে পরছিলাম না।