ডঃ মাইতি নিঃশ্বাস ফেললেন। আপনার অনুমান অনেকটা সত্য। অতিরিক্ত পরিশ্রম এবং টেনশনই তার অসুখটার বাড়াবাড়ির কারণ। যাকগে, যা হয়ে গেছে তার ওপর আপনার তো কোনো হাত নেই। কিন্তু এখন কথা হচ্ছে তায়েবাকে নিয়ে। তার জন্য আপনি কি করতে পারেন? আমি বললাম, মাইতিদা নিজের চোখেই তো দেখতে পাচ্ছেন আমি কি অসহায়। আজ রাতে যেখানে ঘুমাই, কাল রাতে সেখানে যেতে পারি না। এখানে স্রোতের শেওলার মতো আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি। পঞ্চাশ পয়সা ট্রাম ভাড়া বাঁচাবার জন্য ছয় সাত মাইল পথ হাঁটতে আমাদের বাধে না। আজ যদি চোখের সামনে তায়েবা মারাও যায়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য অবলোকন করা ছাড়া আমার করার কি থাকবে? তবে একটা দুঃখ থেকে যাবে। তায়েবা আপন চোখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারবে না। স্বাধীনতা-অন্ত প্রাণ ছিলো তায়েবার। আলাপে আলোচনায় কথাবার্তায় দেখে থাকবেন, তার নামটি কি রকম কম্পাসের কাঁটার মতো স্বাধীনতার দিকে হেলে থাকে। উনিশশো উনসত্তরের আয়ুববিরোধী আন্দোলনে তায়েবা নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করেছিলো। আমার ব্যক্তিগত লাভক্ষতি সেটা ধর্তব্যের বিষয় নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সে দেখে যেতে পারবে না, এটাই আমার বুকে চিরদিনের জন্যে একটা আফশোসের বিষয় হয়ে থাকবে। আমি মিনতি করে জানতে চাইলাম, আচ্ছা মাইতিদা, আপনি কি দয়া করে জানাবেন, তায়েবার অসুখটা কি ধরনের? খুব কি সিরিয়াস? তিনি বললেন, আমি তো ভেবেছিলাম আপনি শক্ত মানুষ। এখন দেখছি মেয়ে মানুষের চাইতে দুর্বল। আগে থেকে কাঁদুনি গাইতে শুরু করেছেন। আচ্ছা ধরুন, তায়েবা মারা গেলো। তখন আপনি কি করবেন? আত্মহত্যা করবেন? আমি জবাব দিলাম, তা করবো না, কারণ সে বড়ো হাস্যকর হয়ে দাঁড়াবে। তাহলে কি করবেন? বসে বসে কাঁদবেন? আমি বললাম, তাও বোধ হয় সম্ভব হবে না। এইখানে এই কোলকাতা শহরে বসে বসে কাদার অবকাশ কোথায়? বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মানুষের কাদবার যথেষ্ট সঙ্গত কারণ আছে। অনেকেই তাদের প্রিয়জন হারিয়েছে। আমিও না হয় তাদের একজন হয়ে যাবো। আপনি তাহলে কিছুই করতে যাচ্ছেন? ডঃ মাইতি ফের জানতে চাইলেন। আমি বললাম, কি করবো, কি করতে পারি? আপনার দিন কাটবে কেমন করে? আমি বললাম, দিন তো একভাবে না একভাবে কেটে যাবে, শুধু মাঝে মাঝে বুকের একপাশটা খালি মনে হবে। মশায় এততক্ষণে আপনি একটা কথার মতো কথা বলেছেন। অনিবার্যকে মেনে নিতেই হবে। এই কথাটা বলার জন্য আপনাকে ডেকে আনা হয়েছে। এখন তায়েবার রোগ সম্বন্ধে আপনি জিগ্গেস করতে পারেন, আমি জবাব দিতে প্রস্তুত। আমি বললাম, বলুন। ডাক্তার ভাবলেশহীন কণ্ঠে জানালেন, লিউক্যামিয়া। জিগগেস করলাম, ওটা কি ধরনের রোগ। তিনি বললেন, ক্যান্সারের একটা ভ্যারাইটি। জিগগেস করলাম, খুব কি কঠিন ব্যাধি। হ্যাঁ, খুবই কঠিন। আমি বললাম, অন্তত যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত তায়েবা বেঁচে থাকবে তো। সে কথা আমি বলতে পারবো না। আমি একজন জুনিয়র ডাক্তার। ডঃ ভট্টাচার্য তাঁর টেস্টের রিপোর্ট বাঙ্গালোরে পাঠিয়ে অপেক্ষা করছেন। জানেন তো সেখানে ক্যান্সার ট্রিটমেন্টের একটা ওয়েল ইকুইপ সেন্টার আছে। সেখান থেকে এ্যাডভাইজ না আসা পর্যন্ত আমাদের বলার কিছু নেই। দিন একটা চারমিনার। আপনার সঙ্গে থাকলে আমাকেও চেইনস্মোকার হয়ে উঠতে হবে দেখছি। চলুন, খাবার দিয়েছে। কথায় কথায় অনেক রাত করে ফেললাম। আমি নীরবে তাকে অনুসরণ করলাম।
ডঃ মাইতির কোয়ার্টারে আমার চোখে এক ফোঁটা ঘুম আসেনি। সারারাত বিছানায় হাসফাস করেছি। কেমন জানি লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো আমার সামনে একটা দেয়াল আচানক মাটি খুঁড়ে দাঁড়িয়ে গেছে। আমার খুব গরম বোধ হচ্ছিলো। মাঝে মাঝে মশারির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে টেবিলে রাখা বোতল থেকে ঢেলে ঢক ঢক করে পানি খাচ্ছিলাম। আর একটার পর একটা সিগারেট টানছিলাম। দূরের রাস্তায় ধাবমান গাড়ির আওয়াজে আমার কেমন জানি মনে হচ্ছিলো। কোথাও যেনো কেউ ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।
শেষরাতের দিকে একটু তন্দ্রার মতো এসেছিলো। সেই ঘোরেই স্বপ্ন দেখলাম আমার আব্বা এসেছেন। স্কুল হোস্টেলে থাকার সময়ে আমি যে বাড়িতে পেয়িংগেস্ট হিসেবে খেতাম, সে বাড়ির সামনে পথ আলো করে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পরনে শান্তিপুরের চিকন পাড়ের ধুতি। গায়ে আদ্দির পাঞ্জাবি, গলায় ঝোলানো মক্কা শরীফ থেকে আনা ফুলকাটা চাদর। আর মাথায় কালো থোবাযুক্ত চকচকে লাল সুলতানী টুপী। আমি জিগ্গেস করলাম, আব্বা এতো সুন্দর কাপড়চোপড় পরে আপনি কোথায় চলেছেন? আমার প্রশ্নে তিনি খুবই অবাক হয়ে গেলেন। বেটা তুমি জানো না বুঝি, আজ তোমার বিয়ে। আমিও অবাক হলাম। কারণ আমি সত্যি সত্যি জানিনে। বাবা বললেন, কখনো কখনো এমন কাণ্ড ঘটে যায়। আমি বললাম, আব্বাজান আমার ঈদের চাপকান কই। অন্তত একখানা শাল এ উপলক্ষে আপনিতো আমাকে দেবেন। আব্বা সস্নেহে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বেটা সাদা ধুতি পরো। আমি বিয়ের সময় সাদা ধুতি পরেই বিয়ে করেছিলাম। তোমার ভাইকেও ধুতি পরিয়ে বিয়ে দিয়েছি। তিনি আমার হাতে একখানা ধুতি সমর্পন করলেন। আমি বললাম, আব্বা আমি যে ধুতি পরতে জানিনে। বেটা বেহুদা বকো না। পরিয়ে দেয়ার মানুষের কি অভাব! যাও তাঞ্জামে ওঠো। আমি বললাম, এ শুভদিনে আপনি অন্তত একখানা ঘোড়ারগাড়ি ভাড়া করবেন না? আব্বা বললেন, বেটা মুরুব্বীদের সঙ্গে বেয়াদবি করা তোমার মজ্জাগত অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে দেখছি। যাও, তাঞ্জামে ওঠো। তারপর তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কোথাও তাকে দেখলাম না। তারপর দেখলাম, চারজন মানুষ আমাকেই একটা খাঁটিয়ায় করে আমাদের গ্রামের পথ দিয়ে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের কাউকে আমি চিনিনে। লোকগুলো আমার খাঁটিয়া বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় সুর করে বলছে, বলো মোমিন আল্লা বলো। তাদের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে রাস্তার লোকেরাও বলছে, আল্লা বলো। আমি মনে মনে বললাম, এ কেমন ধারা বিয়ে গো। বাজী পোড়ে না, বাজনা বাজে না। অমনি পায়ের দিকে বহনকারী দু’জন লোক কথা কয়ে উঠলো। এই লাশটা পাথরের মতো ভারী। একে আমরা বয়ে নিয়ে যেতে পারবো না। মাথার দিকের বাহক দু’জন বললো, না না চলো। আর তো অল্প পথ। তোমরা যাও আমরা পারবো না। তারা কাঁধ থেকে কাত করে আমাকে রাস্তার ওপর ঢেলে দিলো। আমি ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলাম। তন্দ্রা টুটে গেলো। হাঁটুতে প্রচণ্ড চোট লেগেছে। চোখ মেলে চাইলাম, আমি ফ্লোরের ওপর শুয়ে আছি। আর শরীরে সত্যি সত্যি ব্যথা পেয়েছি। কাঁচের জানালার শার্সি ভেদ করে শিশুসূর্যের দু’তিনটে রেখা ঘরের ভেতরে জ্বলছে। খুব পিপাসা বোধ করছিলাম। আবার খাটে ওঠার কোনো প্রবৃত্তি হলো না। তিন চার মিনিট তেমনি পড়ে রইলাম। চোখ বন্ধ করে তার মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে মনে মনে সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করছি। ডঃ মাইতি আমার কাঁধ নাড়া দিয়ে বললেন, একি দানিয়েল সাহেব, আপনি নীচে কেনো? আমি আস্তে আস্তে বললাম, স্বপ্নের ঘোরে খাট থেকে পড়ে গিয়েছি। বাঃ চমৎকার! আপনার মনে এখনো স্বপ্ন আসে, সুতরাং দুর্ভাবনার কোনো কারণ নেই। আশা করি দাড়ি কাটতে এবং স্নান করতে অমত করবেন না। আমি মৃদুস্বরে বললাম, না। তিনি বললেন, বাথরুমে শেভিং রেজার, সাবান ইত্যাদি দেয়া আছে। যান তাড়াতাড়ি যান, এখখুণি খাবার দেয়া হবে। বাথরুমে যেয়ে গালে সাবান ঘষতে ঘষতে দেখি থুতনির কাছে আট দশটা পাকা দাড়ি উঁকি দিচ্ছে। দু’কানের গোড়ায়ও অনেকগুলো বাঁকা চোরা রূপালী রেখা। চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইছিলো। আহা আমার যৌবন শেষ হতে চলেছে। আমি বুড়োত্বের দিকে এগুচ্ছি। এতোদিন চোখে পড়েনি কেনো। এক মাসের মধ্যেই কি ম্যাজিকটা ঘটে গেলো।