ডঃ মাইতি বললেন, এবার আমার কথা বলি। দয়া করে একটু শুনবেন কি? নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, আপনি বলুন। তাহলে শুনুন, প্লেন এ্যান্ড সিম্পল টুথ। তায়েবার প্রতি আপনার মনের অবচেতনে গভীর ভালোবাসা রয়েছে বলে অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসা বা বিয়ে করার কথা আপনি চিন্তাও করতে পারেননি। তার দিক থেকে হোক, আপনার দিক থেকে তোক বাস্তব অসুবিধে ছিলো অনেক, যেগুলো ডিঙোবার কথা ভাবতেও পারেননি। আমি বললাম, নদীতে বাঁধ দেয়ার কথা বলা যায়, কেনোনা নদীতে বাঁধ দেয়া সম্ভব। কিন্তু সমুদ্র বন্ধন করার কথা কেউ বলে না, কেনোনা তা অসম্ভব। আমার আর তায়েবার ব্যাপারটিও অনেকটা তাই।
ডঃ মাইতি বললেন, তায়েবা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে প্রায় এক মাস হয়। আপনি তো মাত্র গতকাল থেকেই দর্শন দিচ্ছেন। এই এক মাসে তার সম্পর্কে ডাক্তার হিসেবে আমার কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এসে ধরে বসলেন, বাংলাদেশের একজন রোগিকে ভর্তি করতেই হবে। ডঃ ভট্টাচার্যি কিছুতেই রাজী হচ্ছিলেন না। কারণ, হাসপাতালে খালি বেড ছিলো না। শেষ পর্যন্ত আমার অনুরোধেই তিনি রাজী হলেন। মেয়েটাকে প্রথম থেকেই দেখে আমার কেমন জানি অন্যরকম মনে হয়েছিলো। এক মাস খুব দীর্ঘ সময় নয়। তবু এ সময়ের মধ্যে তাকে নানাভাবে জানার সুযোগ আমার হয়েছে। সত্যি বলতে কি, এ রকম স্বার্থবোধ বর্জিত মেয়ে জীবনে আমি একটিও দেখিনি। আমি বললাম, আমিও দেখিনি। এ ব্যাপারেও দেখেছি আপনার মতের সঙ্গে আমার মতের কোনো গরমিল নেই। সে যাক, শুনুন। তায়েবাকে দেখতে হাসপাতালে নানারকম মানুষ আসে। তার যতো কমপ্লেইন থাকুক, সকলের সঙ্গে যথা সম্ভব প্রাণখোলা কথাবার্তা বলে, হাসি ঠাট্টা করে। কখনো কারো কাছ থেকে কিছু দাবি করতে দেখিনি। দেখলাম, একমাত্র আপনার কাছেই তার দাবি। আপনাকেই ভাতমাছ রান্না করে আনতে বললো। আপনার কথা প্রায় প্রতিদিন আমাকে বলেছে। তবুও আপনি যখন এলেন দেখলাম আপনার সঙ্গেই ঝগড়া করছে। যদি আমি ধরে নেই যে তায়েবা আপনাকেই ভালোবাসে, তাহলে কি আমি অন্যায় করবো? আমি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তারপর হাসতে চেষ্টা করলাম। হয়তো, হবেও বা। ধন্যবাদ, ফুল চন্দন পড়ুক আপনার মুখে ডঃ মাইতি। আপনি মশায় চমৎকার কথা বলতে জানেন। কথার মারপ্যাঁচে ফসকে যাবেন তেমন সুযোগ আপনাকে দিচ্ছিনে। আপনি কি ভেবেছেন শুধু শুধুই আপনাকে বাড়িতে ডেকে এনেছি। আপনার সঙ্গে আমার মস্ত দরকার। যাক, ডঃ মাইতি আপনি আমার নিজের মূল্যটা আমার কাছে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিলেন। এই কোলকাতা আসা অবধি কেউ আমাকে বলেনি, আমার সঙ্গে কারো দরকার আছে। নিজের দরকারেই সকলের কাছে সকালসন্ধ্যা ঘুরে বেড়াচ্ছি। তা বলুন, আপনার দরকারটা কি? শুনে হৃদয় ঠাণ্ডা করি। মশায় অতো রাগ কেনন? শুনবেন, শুনবেন অতো তাড়াহুড়া কিসের? আগে রাতের খাবারটা খান। এখনো তো সবে ন’টা বাজে। তারপর ডাক দিলেন, অনাথ। সে ছেলেটি এসে দাঁড়ালো। খাবার হয়েছে রে। ডালটা এখনো নামানো হয়নি। যা তাড়াতাড়ি কর।
আমি জিগগেস করলাম, ডঃ মাইতি আপনি কোয়াটারে একাই থাকেন? একা মানুষ, একাই তো থাকবে। আপনি বিয়ে করেননি? না মশায়, সে ফাঁদে আজো পা দেইনি। আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন? ভালোবাসাটাসা আমাকে দিয়ে পোষাবে না। হঠাৎ করে কাউকে বিয়ে করে ফেলবো। এখনো করেননি কেনো? প্লেন এ্যাণ্ড সিম্পল টুথ হলো, এখনো সবগুলো বোনের বিয়ে দেয়া হয়নি। মশায় আপনি আর কোনো কিছু জিগগেস করবেন না। আপনাকে আমার প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য নেমন্তন্ন করে এনেছি। আপনি যদি আমার কথা শুনতে চান যেয়ে সব কথা বলে আসবো। আমি বললাম, ডঃ মাইতি, আমাদের থাকার কোনো স্থির ঠিকানা নেই। কোথায় আপনাকে ডাকবো? তিনি বললেন, যখন আপনার দেশ স্বাধীন হবে তখন ডাকবেন। আমার যত কথা সব জানিয়ে আসবো। আর আপনার দেশটাও দেখে আসবো। আচ্ছা, বাই দ্যা বাই, তায়েবার মা, ভাই, বোন উনারা কোথায় আছেন বলতে পারেন? আমি বললাম, তার ইমিডিয়েট একটা ছোটো বোনের বিয়ে হয়েছিলো, সেটি ছাড়া আর মোটামোটি সকলের সংবাদ পেয়েছি। তায়েবার ছোটো ভাইটি ঢাকায়। বড়ো ভাই দিনাজপুরে ছিলেন শুনেছি। সেখান থেকে শুনেছি সীমান্ত অতিক্রম করেছে। আর ওরা তো তিন বোন কোলকাতা এসেছে। এক বোন ব্যারাকপুর না কোথায় অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে ট্রেনিং নিচ্ছে। একেবারে ছোট্টোটি একটা এক্সিডেন্ট করে বসেছে। কি নাম বলুন তো দানিয়েল সাহেব, আই থিঙ্ক আই নো হার। আমি বললাম, ডোরা। ডোরা তো একজন বুড়ো মতো ভদ্রলোককে নিয়ে মাঝে মাঝে হাসপাতালে তায়েবাকে দেখতে আসে। হঠাৎ করে আমি মেজাজ সংযম করতে পারলাম না। তাহলে ডোরাসহ ভদ্রলোক এখনো তায়েবার কাছে আসতে সাহস করেন? একটুখানি চোখলজ্জাও নেই। আরে মশায় আপনি ক্ষেপে গেলেন যে! আগে কি ব্যাপার বলেন তো। আমি বললাম, ঐ যে ভয়ঙ্কর ভদ্রলোক দেখেছেন তিনি ডোরাকে বিয়ে করে ফেলেছেন। ঢাকাতে ঐ ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রী ছিলেন তায়েবাদের অভিভাবক। মহিলা শশীকান্ত নামের তার মেয়ের এক গৃহশিক্ষককে নিয়ে শান্তিনিকেতনে ললিতকলা চর্চা করতে গেছেন। আর এদিকে ইনি পাল্টাব্যবস্থা হিসেবে ডোরাকে বিয়ে করে বসে আছেন। আমার বিশ্বাস তায়েবার অসুখ বেড়ে যাওয়ার এটাই একমাত্র কারণ। তাছাড়া আমি আরো শুনেছি মুখের অন্ন জোটাবার জন্য তায়েবাকে অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনটে করে ট্যুইশনি করতে হয়েছে। এই মানুষেরা সে সময় কোথায় ছিলেন? তায়েবার কি অসুখ আমি সঠিক বলতে পরবো না, তবে কথাটা সঠিক বলতে পারি অমানুষিক পরিশ্রম না করলে এবং কাণ্ডটি না ঘটালে তার আজ এ অবস্থা হতো না। এই লোকগুলোর নিষ্ঠুরতার কথা যখন ভাবি মাথায় খুন চেপে যায়। অথচ এরাই ঢাকাতে আমাদের কাছে আদর্শের কথা প্রচার করতো। আপনি অনেক আনকোরা তরুণের মধ্যে জীবনের মহত্তর সম্ভাবনা বিকশিত হয়ে উঠতে দেখেছেন, একথা যেমন সত্যি, তেমনি পাশাপাশি একথাও সত্য যে যুদ্ধের ফলে অনেক প্রতিষ্ঠিত মহাপুরুষের খোলস ফেটে খান খান হয়ে পড়েছে এবং আমরা এতোকালের ব্যাঘ্ৰ চৰ্মাবৃত ছাগলের চেহারা আপন স্বরূপে দেখতে পাচ্ছি। শরণার্থী শিবিরগুলোতে আমাদের মানুষের দুর্দশার সীমা নেই। ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোতে আমাদের তরুণ ছেলেরা হাজার রকমের অসুবিধের সম্মুখীন হচ্ছে। দেশের ভেতরের কথা না হয় বাদই দিলাম। এখানে কোলকাতায় সাদা কাপড়চোপড় পরা ভদ্রলোকের মধ্যে স্থলন, পতন, যতো রকমেই নৈতিক অধঃপতন হচ্ছে, তার সবগুলোর প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি। এখানে যত্রতত্র শুনতে পাচ্ছি, বুড়ো, আধবুড়ো মানুষেরা যত্রতত্র বিয়ে করে বেড়াচ্ছে। পাকিস্তানী সৈন্যদের নিষ্ঠুরতার কথা আমাদের জানা আছে। মাঝে মাঝে এই ভদ্রলোকদের তার তুলনায় কম নিষ্ঠুর মনে হয় না। আমি নিশ্চিত বলতে পারি তায়েবার সঙ্গে এরা কসাইয়ের মতো ব্যবহার করেছে। আমি জানি সে আমাকে কোনোদিন সেসব কথা জানতে দেবে না। এমন কি হাজার অনুরোধ করলেও না। আর আমিও জিজ্ঞেস করবো না। তবে একথা সত্যি যে তায়েবা যদি মারা যায় সেজন্য এঁরাই দায়ী। কিন্তু দুনিয়ার কোনো আদালতে সে মামলার বিচার হবে না।