আমি বললাম, বাংলা এবং বাঙালিত্বের প্রতি পশ্চিমবাংলার সকল শ্রেণীর মানুষের একটা অতুলনীয় সহানুভূতি এবং জাগ্রত মমত্ববোধ আছে বলেই এখনো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শিরদাঁড়া উঁচু করে থাকতে পেরেছে। পশ্চিমবাংলার বদলে যদি গুজরাট কিংবা পাঞ্জাবে বাংলাদেশের জনগণকে আশ্রয় গ্রহণ করতে হতো, ভারত সরকার যতো সাহায্যই করুক না কেনো, আমাদের সংগ্রামের অবস্থা এখন যা তার চাইতে অনেক খারাপ হতো। পশ্চিম বাংলার মানুষের প্রাণের আবেগ, উত্তাপ এবং ভালোবাসা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে প্রাণবন্ত এবং সজীব রেখেছে। ছেলেটা চা দিয়ে গেলো। আপনার কাপে কচামচ চিনি এবং কতোটুকু দুধ দেবো বলুন। বললাম, দুধ আমি খাইনে! দু কি আড়াই চামচ চিনি দেবেন। হো হো করে হেসে উঠলেন, ডঃ মাইতি। একটা বিষয়ে দেখছি আপনার সঙ্গে আমার চমৎকার মিল আছে। আমিও চায়ের সঙ্গে দুধ খাইনে।
চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, আমি মুখ মানুষ। প্রোফেশনের বাইরে গেলেই নাচার হয়ে পড়ি। আপনার মতো একজন স্কলার মানুষের সঙ্গে কি নিয়ে কথা বলবো, মশায় সাবজেকট খুঁজে পাচ্ছিনে। আবার সেই হো হো হাসি। আমি বললাম, আপনিও তাহলে তায়েবার কথা বিশ্বাস করে আছেন। এসএসসি থেকে এমএ পর্যন্ত সবগুলো পরীক্ষায় কখনো বিশের মধ্যে থাকার ভাগ্যও আমার হয়নি। তায়েবা যাদেরকে চেনেজানে একটুখানি খাতির করে। তাদের সম্পর্কে বাড়িয়ে বলে, এটাই তার স্বভাব। আমার ব্যাপারে এই পক্ষপাতটুকু এতোদূর মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো যে আমার নিজের কান পর্যন্ত গরম হয়ে উঠেছিলো। এনিয়ে তার সঙ্গে আমার অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছে। ডঃ মাইতি বললেন, আপনার ব্যাপারে তার একটা লাগাম ছাড়া উচ্ছ্বাস এরই মধ্যে আমি লক্ষ্য করেছি। আপনাকে স্কলার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়, আপনি বিষ্টিতে কাপড়জামা ভিজিয়ে এলে বাজার থেকে লোক পাঠিয়ে নতুন কাপড়জামা কিনে আনে। এগুলো কি একজন রোগির পক্ষে বাড়াবাড়ি নয়? আসলে আপনাদের সম্পর্কটা কী রকম। আপনি যদি জবাব না দেন আমি অবাক হবো না।
বললাম, ডঃ মাইতি জবাব দেবো না কেনো? লোকে তো বন্ধুজনের কাছেই প্রাণের গভীর কথা প্রকাশ করে। আপনাকে আমি একজন বন্ধুই মনে করি। তায়েবার সঙ্গে আমার সম্পর্কের ধরনটা কি নিজেও আমি ভালো করে নির্ণয় করতে পারিনি। আমার ধারণা সে আমাকে করুণা করে। এই যুদ্ধটা না বাধলে, বিশেষ করে বলতে গেলে এই অসুখটা না হলে তার সঙ্গে আমার দেখা হতো কিনা সন্দেহ। সে তার পার্টির কাজকর্ম নিয়ে থাকতো। আমি আমার কাজ করতাম। তিনি ফের জানতে চাইলেন, আপনাদের মধ্যে একটা হৃদয়গত সম্পর্ক আছে এবং সেটা গভীর, একথা কি অস্বীকার করবেন? ডঃ মাইতি, ও বিষয়টা নিয়ে নিজেও অনেক চিন্তা করেছি, কিন্তু কোনো কুলকিনারা পাইনে। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে একটা গভীর সম্পর্ক আছে, কিন্তু পরক্ষণে মনে হয়েছে, না কিছুই নেই। সকাল বেলার শিশির লাগা মাকড়সার জাল যেমন বেলা বাড়লে অদৃশ্য হয়ে যায়, এও অনেকটা সেরকম। সে তার পার্টি ছাড়তে পারবে না। কেনোনা তার অস্তিত্বের সবটাই তার পার্টির মধ্যে প্রোথিত। আর আমার চরিত্র এমন কোনো বিশেষ পার্টির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো মোটেই উপযুক্ত নয়। এতে সব গোঁজামিলের মধ্যে হৃদয়গত একটা সম্পর্ক কেমন করে টিকে থাকতে পারে, আমার তো বোধগম্য নয় ডাঃ মাইতি। ডাক্তার হাততালি দিয়ে উঠলেন, এই খানেই তো মজা। মানুষ ভয়ানক জটিল যন্ত্র। তার হৃদয় ততোধিক জটিল। অতো সহজে কিছু ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। আচ্ছা দানিয়েল সাহেব, আপনি কি রাজনীতি করেন? বললাম, মানুষ সব সময়ে তো একটা না একটা রাজনীতি করে আসছে। আমি তা এড়াবো কেমন করে? কিন্তু আমি কোনো পার্টির মেম্বার নই। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যদি আমার যথাসর্বস্ব দাবি করে, না দিয়ে কি পারবো? আমি সহজ মানুষ, অতো ঘোরপ্যাঁচ বুঝিনে।
ডঃ মাইতি টেবিলে একটা টোকা দিয়ে বললেন, এমনিতে আমি সিগারেট খাইনে। কিন্তু আপনার কথা শুনে একটা সিগারেট টানতে ইচ্ছে করছে। একটা চারমিনার জ্বালিয়ে টান দিয়ে খক খক করে কেশে ফেললেন। মশায়, বললেন তো খুব সহজ মানুষ। আসলে আপনি জটিল এবং দুর্বোধ্য মানুষ। কিন্তু বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। হয়তো তাই, সব মানুষই একটা না একটা দিকে দুর্বোধ্য, আমরা খেয়াল করিনে। আরে মশায় ওসব গভীর কথা এখন তুলে রাখুন। আপনাকে একটা সিম্পল প্রশ্ন জিগগেস করি, ইচ্ছে করলে আপনি জবাব নাও দিতে পারেন। আমি বললাম, নিশ্চয়ই জবাব দেবো, বলুন আপনার প্রশ্নটা। ডঃ মাইতি স্থির চোখে তাকিয়ে বললেন, তায়েবার সঙ্গে পরিচয়ের পর অন্য কোনো নারীকে কি আপনি। ভালোবেসেছেন? আমি বললাম, না তা হয়নি। কেনো বলুন তো? হয়তো পরিবেশ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি বলেই। অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসার কথা কখনো আপনার মনে এসেছে? না, তাও আসেনি। আচ্ছা মেনে নিলাম, অন্য কারো সঙ্গে প্রেমে পড়ার কথা চিন্তা করতে পারেননি। অন্ততঃ বিয়েটিয়ের ব্যাপারে কখনো সিরিয়াস হতে চেষ্টা করেছেন কি? আমি বললাম, তাও করিনি। আত্মীয়স্বজন বার বার চাপ দিয়েছে বটে, কিন্তু আমি বার বার এড়িয়ে গেছি। ধরে নিন, এটা এক ধরনের আলসেমী। আপনি একজন পূর্ণবয়স্ক যুবক মানুষ। আপনার কোনো খারাপ অসুখটসুখ নেই তো? কিছু মনে করবেন না। আমি একজন ডাক্তার। ডাক্তারের মতো প্রশ্ন করছি। আমি বললাম, শরীরের ভেতরের ব্যাপারস্যাপার সম্পর্কে তো স্থির নিশ্চিত হয়ে কিছু বলার ক্ষমতা আমার নেই। এমনিতে কোনো রোগটোগ আছে বলে তো মনে হয় না।