ছিপছিপে এল টাইপের একতলা বিল্ডিংটির লনের কাছে এলাম। লোকটি বললো, একটু দাঁড়ান, জিগগেস করে দেখি। চার পাঁচজন মহিলা লনে পায়চারি করছে সেদিকে লক্ষ করেই হাঁক দিলো, এই যে জয়বাংলার দিদিমণি। আপনাদের দেশের এক ভদ্দরলোক একজন ফিমেল পেশেন্টের খোঁজ করছে। দেখুন তো সাহায্য করতে পারেন কিনা। আমি তাকিয়ে দেখলাম, কপালের দিকে সরে আসা চুলের গোছাটি সরাতে সরাতে তায়েবা সুরকি বিছানো পথের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে। আমাকে ডাকছো নাকি গোবিন্দদা! আজ্ঞে দিদিমণি, আপনাদের জয়বাংলার একজন ভদ্দরলোক একজন ফিমেল পেশেন্ট তালাশ করছেন। আপনি একটু কথা বলে দেখুন তো।
এতোক্ষণে জানা গেলো লোকটির নাম গোবিন্দ। তায়েবা এরই মধ্যে তার পুরোনো সম্পর্ক পাতানোর ব্যাপারটি চালু করে ফেলেছে দেখছি। আমার চোখে চোখ পড়তে তায়েবা আনন্দে চকমক করে উঠলো। পিঠের ওপর ঢলের মতো নেমে আসা ছড়ানো চুলের রাশিতে একটা কাঁপন জাগিয়ে বললো, একে কোথায় পেলে গোবিন্দদা। দিদিমণি আপনার অতোসব জবাব দিতে পারবো না, আমি চলোম। ডঃ মাইতি আমাকে ওয়ার্ডে না পেলে একেবারে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। ডঃ মাইতির কাঁচা খাওয়া থেকে বাঁচার জন্য গোবিন্দ চলে গেলো।
তায়েবাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। এই ক’মাসে তার চেহারায় একটা বাড়তি লাবণ্য ফুটে উঠেছে। তার পিঠ ঝাপা অবাধ্য চুলের রাশি। চোখে না দেখলে চিনে নিতে কয়েক মিনিট সময় নিতো। তায়েবার এমন সুন্দর, সুগঠিত শরীরে কোথায় রোগ ঢুকে হাসপাতালে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে ভেবে ঠিক করতে পারিনি। আমার চোখে সরাসরি চোখ রেখে জিগগেস করলো, দানিয়েল ভাই, এতোদিন আসেননি কেন? কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলেন যে? যান আপনার সাথে কোন কথা নাই। যান চলে যান। পরক্ষণে হাততালি দিয়ে খিল খিল করে হেসে উঠলো। এই যে আরতিদি, শিপ্রা, মঞ্জুলিকা, উৎপলা দেখে যাও কে এসেছে। তায়েবাকে কোনোদিন বুঝতে পারিনি। বোঝার চেষ্টাও ছেড়ে দিয়েছি। পায়ে পায়ে চারজন নারীমূর্তি এগিয়ে এলো এবং আমার মনে একটা খারাপ চিন্তা জন্ম নিলো। এ সমস্ত মহিলা রোগ সারাতে হাসপাতালে এসেছে, না বিউটি কম্পিটিশন করতে এসেছে। তায়েবা বললো, আসুন আরতিদি, পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি হচ্ছেন দানিয়েল ভাই, ভীষণ প্রতিভাবান মানুষ। এসএসসি হতে এমএ পর্যন্ত সবগুলো পরীক্ষায় প্রথম হয়ে আসছেন। স্কলারশীপ নিয়ে বিলেত যাবার ব্যবস্থাও পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিলো, মাঝখানে সংগ্রাম শুরু হয়ে গেলো, তাই..। আর আরতিদির বাড়ি ছিলো আপনাদের চাঁটগায়ে। আমার পাশের কেবিনে থাকেন। এ হচ্ছে শিপ্রাগুহ ঠাকুরতা। বরিশালের বানরীপাড়ার মেয়ে। আর যে মঞ্জুলাকে দেখছেন তারও আসল বাড়ি বাংলাদেশে ময়মনসিংহ জেলায়। পোড়ামুখী তিন বছর ধরে এই হাসপাতালে ডেরা পেতে আছে। অবশেষে উৎপলার হাত ধরে বললো, এর পরিচয় আপনি জানতে পারবেন না। ওর সাতপুরুষের কেউ কস্মিনকালেও পদ্মার হেপাড়ে যায়নি। একেবারে জাত ঘটি, তার ওপর আবার ব্রাহ্মণকন্যা। এখন ঠেকায় পড়ে এই মেলেচ্ছনির সঙ্গে রাত্রিবাস করতে হচ্ছে। ‘রাত্রিবাস’ শব্দটি এমন এক বিশেষ ভঙ্গি সহকারে উচ্চারণ করলো সকলে হো হো করে হেসে উঠলো। এই ঘটা করে পরিচয় করানোটা যে আমার ভালো লাগেনি তায়েবার অজানা থাকার কথা নয়। তুচ্ছ জিনিসকে বড়ো করে দেখানোর ব্যাপারে তার জুড়ি নেই। কিন্তু আজকের বাড়াবাড়িটা সমস্ত সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। জীবনে আমি ফার্স্ট সেকেণ্ড কোনোদিনই হতে পারিনি। একবার উত্তীর্ণ ছাত্রমণ্ডলীর তালিকায় ওপরের দিক থেকে লাস্ট এবং শেষের দিক থেকে ফার্স্ট হয়েছিলাম। গোটা ছাত্রজীবনে সাফল্যের সেই ধারাটিই আমি মোটামুটিভাবে রক্ষা করে আসছি। এজন্য আফসোসও নেই। বরঞ্চ পরীক্ষায় যারা ভালোটালো করে তাদের প্রতি রয়েছে আমার মুদ্রাগত আক্রোশ। মুখে সাত আট দিনের না-কামানো দাড়ি। পায়ে জয়বাংলা চপ্পল, জামা-কাপড়ও তেমনি। অনাহার, অর্ধাহার, অনিদ্রার ছাপ মুখে ধারণ করে আমি জয়বাংলার মূর্তিমান শিলাস্তম্ভে পরিণত হয়েছি। এটাই আমার বর্তমান, এটাই আমার অস্তিত্ব। এই কোলকাতা শহরে অনেক মানুষ আমাদের সমাদর করেছে আশাতীত দয়া-দাক্ষিণ্য দেখিয়েছে, অনেকে হেলাফেলাও করেছে। ভালো লাগুক, খারাপ লাগুক সব নির্বিচারে মেনে নিয়েছি। কিন্তু তায়েবার আজকের আচরণ আমার কাছে একটা ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা বলে মনে হলো। তার ঠিকানা সংগ্রহ করে হাসপাতাল অবধি আসতে আমাকে কি কম কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে! পারলে মুখে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে সোজা পা ঘুরিয়ে ফেরত চলে যেতাম। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূল ছিলো না। তাছাড়া শরীরে মনে এতোদূর ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত ছিলাম যে সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় আনকোরা একটি অভাবিত নাটক জমিয়ে তোলা সম্ভব ছিলো না।
তায়েবা আমাকে তার কেবিনে নিয়ে গেলো। দুটো মাত্র খাট, পানির বোতল, গ্লাস ইত্যাদি রাখার একটা কাঠের স্ট্যাণ্ড, স্টীলের একটা মিটসেফ জাতীয় বাক্স, যেখানে প্রয়োজন মতো কাপড় চোপড় রাখা যায় এবং ভিজিটরদের জন্য একটি টুল… এই হলো আসবাবপত্তর। তায়েবা বিছানায় উঠে বালিসটা বুকের কাছে টেনে নিয়ে আমাকে টুলটা দেখিয়ে বললো, বসুন। জানেন তো ভিজিটরদের রোগীর বিছানায় বসতে নেই। তাছাড়া আপনার পায়ে সব সময়ে রাজ্যের ময়লা থাকে, কোনো সুস্থ মানুষও যদি আপনাকে বিছানায় বসতে দেয়, পরে পস্তাতে হয়। কথাটা সত্যি। আমি ওদের বাসায় গেলে আগেভাগে আরেকটি চাদর বিছিয়ে দিতো। তারপর আমি বসতাম। এভাবে খাটজোড়া ধবধবে সাদা চাঁদরের অকলঙ্ক শুভ্রতা রক্ষা করা হতো।’