ডঃ মাইতি তায়েবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি খেতে আরম্ভ করো। আমি ওই দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। ডঃ ভট্টাচার্য যদি এসে পড়েন, আমি হাততালি দেবো। তুমি অমনি সব লুকিয়ে ফেলে বাথরুমে ঢুকে পড়বে। একেবাবে সব ধুয়েই তাঁর সামনে আসবে। দানিয়েল সাহেব যান, জলটল দিয়ে সাহায্য করুন। আমি একটা প্লেট ধুয়ে এনে দিলে তায়েবা মিটসেফ থেকে ব্যাগটা বের করলো, তারপর বাটিটা টেনে নিলো। ভাতগুলো প্লেটে নিয়ে অন্য বাটিটা থেকে কিছুটা মাছের তরকারি ঢেলে নিলো। তার মুখে একটা খুশি খুশি ভাব। জানেন, দানিয়েল ভাই, কতোদিন পরে আজ মাছভাত মুখে দিচ্ছি। বললাম, গতোকাল বলেছিলে এক মাস। হ্যাঁ সেরকম হবে। এক গ্রাস ভাত মুখে তুলে নিলো। তারপর হাতখানা ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। আমি বললাম, চুপ করে অমন হাত ঠেকিয়ে আছে, খাচ্ছো না কেনো? না, খাবো না এই খাবার কি মানুষে খায়? কি রকম বিচ্ছিরি রান্না, মুখটা তেতো হয়ে গেলো। আহ্ মাইতিদা। ডাক্তার কেবিনের ভেতরে ঢুকলেন, কি হলো তায়েবা, ভাত খেতে চাইছিলে খাও। খেতে যে পারছিনে, সব তেতো লাগে যে। তার আমি কি করবো। তেলমশলা ছাড়া শুধু হলুদজিরের রান্না আপনি খেতে পারবেন, দানিয়েল ভাই। মাছগুলো লবণমরিচ দিয়ে ভাজা করে আনতে পারলেন না। আপনি কিছুই বোঝেন না। আমি বললাম, তা ঠিক আছে। কাল মাছ ভেজে এনে দেবো। হ্যাঁ তাই দেবেন। তায়েবা হাত ধুয়ে ফেললো। ডঃ মাইতি বললেন, আপনার ভাত মাছ বিজনেস এখানেই শেষ। তারপরেও এসকল জিনিস এ কেবিনে যদি আবার আসে, তাহলে আপনার হাসপাতালে আসাটাই বন্ধ করতে হয়। তায়েবা চুপচাপ রইলো। আমার ধারণা ডঃ মাইতির ব্যবস্থাটি মেনে নিয়েছে। ডঃ মাইতি আমাকে বললেন, এক কাজ করুন, এই ভাতমাছ যা আছে সব বাটির ভেতর ভরে ওধারের ডাস্টবিনের ফেলে দিয়ে আসুন তাড়াতাড়ি। আমি বাক্যব্যয় না করে তাঁর নির্দেশ পালন করলাম। বাটি প্লেট সব ধুয়ে নেয়ার পর ডঃ মাইতি বললেন, এবার আমি চলি দানিয়েল সাহেব, মনে থাকে যেনো। সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার সময়। আমি বললাম, থাকবে। উনি চলে গেলাম।
আমি তায়েবাকে জানালাম, ডঃ মাইতি সাতটা সাড়ে সাতটার সময় আমাকে তাঁর কোয়ার্টারে যেতে বলেছেন। যাবো? অবশ্যই যাবেন। তিনি আর দীপেনদা আমার জন্য যা করছেন দেশের মানুষ আত্মীয়স্বজন তার এক ছটাক, এক কাচ্চাও করেনি। আমি জানতে চাইলাম, দীপেন লোকটি কে? তায়েবা বললো, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই তো আমাকে চেষ্টা তদবির করে এ হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। আপনি চিনবেন কেমন করে। আর আপনারা সব নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। আমি মারা গেলাম, বেঁচে রইলাম, তাতে কার কি এসে যায়। আমি জবাব দিলাম না। তায়েবার অনেক রাগ, অনেক অভিমান। তাকে ঘাটিয়ে লাভ নেই। অনাবশ্যক রাগারাগি করে অসুখটা বাড়িয়ে তুলবে। এখন তো প্রায় ছ’টা বাজে। তোমার ডাক্তার আসার সময় হয়েছে। আজ আমি আসি। আবার আসবেন। আমি বললাম, আসবো। প্যান্ট আর বাটিসহ ব্যাগটা নিয়ে যাই। প্যান্ট নিয়ে এখন আর কাজ নেই। নতুন একটা বাসায় যাচ্ছেন। আমি গোবিন্দদাকে দিয়ে কাল লঞ্জিতে পাঠিয়ে দেবো। এক কাজ করুন। ব্যাগ বাটি এসবও রেখে যান। বরং কাল এসে নিয়ে যাবেন।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে দেখলাম, মাত্র সোয়া ছটা। ডঃ মাইতির কোয়ার্টারে সাত থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে যে কোনো সময়ে গেলে হবে। আমার ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। সেই আড়াইটার সময় বেরিয়ে এতোটা পথ হেঁটে এসেছি। তারপর এতোক্ষণ সময় কাটালাম। পেটে কিছু পড়েনি। সারাটা সময় এরকম ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা ভুলেই ছিলাম। একটা খাবার দোকান তালাশ করতে লাগলাম। এদিকে দোকানপাটের সংখ্যা তেমন ঘন নয়। তাই বাঁক ঘুরে ভবানীপুর রোডে চলে এলাম একটা সুবিধেজনক খাবার ঘরের সন্ধান করতে। হাজরা রোডের দিকে ধাওয়া করলাম। যে দোকানেই যাই, প্রচণ্ড ভিড়। ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়তে আমার কেমন জানি প্রবৃত্তি হচ্ছিলো না। নিশীথে পাওয়া মানুষের মতো আমি পথ হাঁটছি। অবশ্য বিশেষ অসুবিধে হচ্ছে না। অনেক আগেই বিষ্টি ধরে গেছে। এদিকটাতে রাস্তাঘাটের অবস্থা একেবারে খটখটে শুকনো। কোলকাতার টুকরো টুকরো খণ্ড খণ্ড আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে তারা জ্বলছে। দু’পাশের দোকানপাটে ধুমধাম কেনাবেচা চলছে। ঢ্যাকর ঢ্যাকর করে ট্রাম ছুটছে। বাস, লরি,ট্রাক, কার এসব যন্ত্রযানের বাঁশি অনাদ্যন্ত রবে বেজে যাচ্ছে। মানুষের স্রোততো আছেই। তারা যেনো অনাদিকাল থেকেই শহর কোলকাতার ফুটপাতের ওপর দিয়ে উজানভাটি দুই পথে ক্রমাগত প্রবাহিত হচ্ছে। মোড়ের একটা স্যান্ডউইচের দোকানে গিয়ে দু’খানা প্যাটিস আর ঢক ঢক করে পানি খেয়ে নিয়ে ডঃ মাইতির কোয়ার্টারের উদ্দেশ্য হাঁটতে লাগলাম। কোন দিকে যাচ্ছি খেয়াল নেই। শুধু পা দুটো আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কোলকাতায় আসার পর থেকে আমার পা দুটোর চোখ ফুটে গেছে।
সাতটার ওপরে বোধ করি কয়েক মিনিট হবে। আমি ডঃ মাইতির কোয়ার্টারে এসে বেল টিপলাম। একটি ছোকরা চাকর দরোজা খুলে দিয়ে জানতে চাইলো, কাকে চান? আমি জানতে চাইলাম, ডঃ মাইতি আছেন? আছেন, আমি ভেতরে প্রবেশ করে একটা বেতের সোফায় বসে সিগারেট জ্বালালাম। বসবার ঘরের আসবাবপত্তরের তেমন বাহুল্য নেই। কয়েকখানি বেতের সোফা এবং একই ধরনের চাদর ও খাটের ওপর পাতা চাদরটি খুবই সুন্দর এবং মধ্যিখানে একটি বেতের টেবিল। টেবিলের ওপর পাতা চাদরটি খুবই সুন্দর এবং একই ধরনের চাদরও খাটের ওপর পাতা দেখলাম। ওপাশে পুরোনো একটি ক্যাম্প খাট দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে। দেয়ালে একজোড়া বুড়োবুড়ির ছবি টাঙ্গানো। চিনতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, ডঃ মাইতির মা বাবা। তাছাড়া আছে রবীন্দ্রনাথের একটা বড়ো আকারের ছবি। রবীন্দ্রনাথের বিপরীতে বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ এবং মহাত্মা গান্ধীর ছবি। ওষুধ কোম্পানীর দু’টো ক্যালেন্ডার, উত্তর দক্ষিণের দু’টি দেয়ালে পরস্পরের দিকে মুখ করে ঝুলছে। এ ছাড়া এনলার্জ করা একটি গ্রুপ ফটো আছে। গাউন পরা একদল যুবকের ছবি। একটুখানি চিন্তা করলেই মনে পড়ে যাবে মেডিক্যাল কলেজের সার্টিফিকেট গ্রহণ করার সময় এই ছবিখানি ওঠানো হয়েছিলো। একেবারে কোণার দিকে হাতঅলা একটি চেয়ার এবং সামনে একটি টেবিল। ডঃ মাইতি জিগগেস করলেন, চিনতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো। আমি বললাম, না। তিনি ডাক দিলেন, অনাথ। আবার সে ছেলেটি এসে দাঁড়ালে বললেন, চা দাও। আর শোনো এই বাবু আমাদের সঙ্গে খাবেন এবং রাত্তিরে থাকবেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কৌতুক মিশ্রিত স্বরে বললেন, দেখলেন তো কেমন, বাড়িতে এনে গ্রেপ্তার করে ফেললাম। সহসা আমার মুখে কোনো উত্তর যোগালো না। তিনি ফের জিগগেস করলেন, আপনার কি তেমন জরুরী কাজ আছে। আজ রাত্তিরে এখানে থাকলে কোনো বড়ো ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে কি? জবাব দিলাম, না, তেমন কোনো কাজ নেই। আপনার কি আজ রাতটা আমার সঙ্গে গল্প করে কাটাতে আপত্তি আছে? বারে আপত্তি থাকবে কেনো, এখন আমাদের যে অবস্থা, কে আবার আমার খবর নেবে। দানিয়েল সাহেব, এভাবে কথা বলবেন না। মনে রাখবেন, আপনারা একটি মুক্তিসংগ্রাম করছেন। আমি ডাক্তার মানুষ অধিক খোঁজ খবর রাখতে পারিনে। তায়েবাকে দেখতে হাসপাতালে যেসব ছেলে আসে, তাদের অনেকের দৃষ্টির স্বচ্ছতা এবং অদম্য মনোবল লক্ষ্য করেছি। আপনাদের গোটা জাতি যে ত্যাগতিতিক্ষার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। মানুষের সব চাইতে মহত্তম সম্পদ তার চরিত্র, সে বস্তু আপনার দেশের অনেক যুবকের মধ্যে আমি বিকশিত অবস্থায় দেখেছি। কোনো কোনো সময়ে আপনাদের প্রতি এমন একটা আকর্ষণ অনুভব করি, ভুলে যাই যে, আমি একজন ভারতীয় নাগরিক। আমি কখনো বাংলাদেশে যাবো না। পুরুষানুক্রমে আমরা পশ্চিমবাংলার অধিবাসী। পদ্মার সে পাড়ের মানুষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কখনো ছিলো না। কিন্তু আপনার দেশের মুক্তিসংগ্রাম শুরু হওয়ার পর থেকে আমার নিজের মধ্যেই একটা পরিবর্তন অনুভব করছি। একদিনে কিন্তু সে পরিবর্তন আসেনি। ক্রমাগত মনে হচ্ছে আমি নিজেই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের একটা অংশ। এখন আমার ভারতীয়সত্তা আর বাঙালিসত্তা পরস্পরের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এখন বাঙালি বলে ভাবতে আমার খুব অহঙ্কার হয়। আপনার দেশ যুদ্ধে না নামলে আমার এ উপলব্ধি জন্মাতো কিনা সন্দেহ। কথাগুলো লিটারেল অর্থ ধরে নেবেন না। এটা জাস্ট একটা ফিলিংয়ের ব্যাপার।