এখন চোখের জলে আমার সে অভিমান ঘুচেছে। দশ পনেরো বছর থেকে তো বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছি। এখন সেই বাংলাদেশ যুদ্ধ করছে, কিন্তু আমি কোথায়? আমার সব কিছু তো চোখের সামনেই ছত্রখান হয়ে গেলো। আমার মা কোথায়, ভাই-বোনেরা কোথায়, এখানে আমি একেবারে নিতান্ত একাকী। আপন রক্তের বিষে একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি। তার দু’চোখের কোণায় দু’ফোঁটা পানি দেখা দিলো, আমি রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিলাম। তায়েবা বললো, জানেন দানিয়েল ভাই, আগে আমি কোণাকানচি হিসেব করে চিন্তা করতে ঘৃণা করতাম। এখন নানা রকম চিন্তা আমার মাথায় ভর করে। মানুষ মরলে কোথায় যায়, মাঝে মাঝে সে চিন্তাও আমার মনে উদয় হয়। উৎপলা বলছে মানুষ মরলে তার আত্মা পাখি হয়ে যায়। আবার আরতিদি বলেন, এক জন্মে মানুষের শেষ নয়। তাকে বার বার জন্মাতে হয়। এসব বিশ্বাস করিনে, তবে শুনতে ভালোই লাগে। ধরুন কোনো কারণে আরো একবার যদি আমি জন্মগ্রহণ করি, তাহলে নিতান্ত সাধারণ মেয়ে হয়েই জন্মাবো। পরম নিষ্ঠা সহকারে নিজের জীবনটাই যাপন করবো। ঢোলা জামা পরা আঁতেলদের বড়ো বড়ো কথায়, একটুও কান দেবো না। আমি পেটুকের মতো বাঁচবো। খাবো, পরবো, সংসার করবো। আমার ছেলেপুলে হবে, সংসার হবে, স্বামী থাকবে। সেই সংসারের গণ্ডির মধ্যেই আমি নিজেকে আটকে রাখবো। কখনো বাইরে পা বাড়াবো না।
তায়েবার এ সমস্ত কথা আমার ভালো লাগছিলো না। বরাবরই জেনে এসেছি, সে বড়ো শক্ত মেয়ে। কখনো তাকে এরকম দেখিনি। এ কোন্ তায়েবার সঙ্গে কথা বলছি? জোর দিয়ে বলতে চাইলাম, তায়েবা এখনো সামনে তোমার ঢের জীবন পড়ে আছে, যেভাবে ইচ্ছে কাটাতে পারবে। কিন্তু আমার নিজের কানেই নিজের কণ্ঠস্বর বিদ্রুপের মতো শোনালো। তায়েবা বললো, না দানিয়েল ভাই, আপনাকে নিয়ে আর পারা গেলো না। আপনি দেখতে মিনমিনে হলে কি হবে, বড়ো বেশি একরোখা এবং গোঁয়ার। নিজে যা সত্য মনে করেন সকলের ওপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। সে জন্যই ভয় হয়, আমার মতো আপনার কপালেও অনেক দুঃখ আছে। আমার শরীরের খবর আমার চাইতে কি আপনি বেশি জানেন? আমি জানতে চাইলাম, আচ্ছা তায়েবা, তোমার অসুখটা কি? তায়েবা এবার ফোঁস করে উঠলো। কখনো জানতে চেয়েছেন আমার অসুখটা কি? আর অসুখের ধরন জেনে লাভ নেই, অসুখ অসুখই। তবু একটা ডাক্তারি নাম তো আছে। সেটা আমাকে বিরক্ত না করে ডঃ মাইতির কাছে জিগগেস করুন না কেনো। বললাম, ডঃ মাইতির কাছে গতকাল আমি জানতে চেয়েছিলাম, তোমার কি অসুখ। উল্টো তিনি আমাকেই প্রশ্ন করলেন, আমি জানি নাকি তোমার কি অসুখ। সেটা আপনি ডঃ মাইতির সঙ্গে বোঝাঁপড়া করুন গিয়ে। বিরক্ত হয়ে তায়েবা বিছানার উপর শরীরটা ছেড়ে দিলো।
ডঃ মাইতি আবার কি করলো হে? হাতে স্টেথেসকোপ দোলাতে দোলাতে ডঃ মাইতি কেবিনে প্রবেশ করলেন। দানিয়েল সাহেব, হাতখানা একটু বাড়িয়ে দিন, হ্যান্ডশেক করি। এই ঘোরতররা বিষ্টির মধ্যে চলে আসতে পেরেছেন। বাহ! সোজা মানুষ তো নয়। বোঝা গেলো চরিত্রের মধ্যে স্টার্লিং কোয়ালিটি আছে। শেকহ্যান্ডের পর বললাম, আপনার রোগির কি অনিষ্ট করলাম? নিশ্চয়ই, তাহলে ধরে নিচ্ছি আপনি গতকালের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন। আমি হাসলাম। তারপর তায়েবার দিকে তাকিয়ে জিগগেস করলেন, গিলছো না এখনো বাকি আছে। মাইতিদা ভাতের কথা তো একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। এতোক্ষণ দানিয়েল ভাইতে আমাতে ঝগড়া চলছিলো। ডঃ মাইতি বললেন, ঝগড়ার বিষয়বস্তু কি আগে বলো। তায়েবা বললো, মাইতিদা আপনি যেনো কেমন, ঝগড়া করতে গেলে আবার বিষয়বস্তুর দরকার হয় নাকি। যে ঝগড়ার বিষয়বস্তু নেই, তা আমি শুনবো না। ওসব কথা এখন রাখো। ওয়ার্ডে ডঃ ভট্টাচার্যির পা দেয়ার আগে তোমার বায়না করে আনা ওই ভাত মাছ তাড়াতাড়ি গিলে ফেলল। উনি এসে পড়লে একটা অনর্থ বাধাবেন। হঠাৎ আমার পরিধেয় বস্ত্র দেখে ডঃ মাইতির চোখজোড়া কৌতুকে ঝিকমিকিয়ে উঠলো। বাহ! দানিয়েল সাহেব দেখছি আপনার উন্নতি ঘটে গেছে। আমি একটুখানি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। বললাম, আমি সেই বৌবাজার থেকে এক কোমর পানির মধ্যে দিয়ে হেঁটে এসেছি তো। তিনি জিগগেস করলেন, এই ঘোলাজলের সবটুকু পথ কি আপনি নিজের পায়ে হেঁটে এসেছেন? আমি মাথা দোলালাম। এখানে এসে দেখি প্যান্ট ময়লায় ভরে গেছে, আর পা থেকে জুতো নামাতেই সোলদুটো খসে পড়লো। তায়েবা টাকা দিয়ে হাসপাতালের গোবিন্দকে পাঠিয়ে এই ধুতি আর স্যান্ডেল জোড়া কিনে এনেছে। তাহলে দিদিমনির দান দক্ষিণে করারও অভ্যেস আছে। বাহ! বেশ বেশ। তার কথাতে কেমন জানি লজ্জা পাচ্ছিলাম। এই লজ্জার হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যই বলে বসলাম, ধুতি প্যাঁচগোচ দিয়ে পরতে জানিনে। তাই দু’ভাঁজ করে লুঙ্গির মতো করে পরেছি। ঠিক আছে, বেশ করেছেন, আজ হাসপাতাল থেকে যাওয়ার পথে আমার বাসা হয়ে যাবেন, আপনাকে ধুতি পরা শিখিয়ে দেবো। এ সুযোগে আপনার সঙ্গে একটু গপ্পোটপ্লোও করা যাবে। হ্যাঁ কি বলেন। বললাম, আমি তো আপনার কোয়ার্টার চিনিনে, কি করে যাবো। আরে মশায়, অতো উতলা হচ্ছেন কেননা, একটু ধৈর্য ধরুন প্রথমে আমি চিনিয়ে দেবো। তারপর তো আপনি যাবেন। ওই যে হাসপাতালের গেট। তার অপজিটে লাল দালানগুলো দেখছেন তার একটার দোতলাতে আমি থাকি। নাম্বারটা মনে রাখবেন একুশের বি। এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা দোতলায় উঠে বেল টিপবেন। আপনার জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকবো। কি চিনতে পারবেন তো? আমি বললাম, মনে হচ্ছে পারবো। মনে হচ্ছে কেন? আপনাকে পারতেই হবে। এটুকুও যদি না পারেন, কর্পোরেশনের লোকজনদের লিখবো যেনো আপনাকে শহর থেকে বের করে দেয়।