গলা খাকারীর শব্দে পেছন ফিরে তাকালাম। গোবিন্দ বাইরে থেকে ফিরে এসেছে। তার হাতে একটা প্যাকেট। ডাক দিলো, এই যে দিদিমনি, নিন আপনার জিনিসপত্তর। এর মধ্যে সব আছে। আর ওই নিন পাঁচ টাকা চল্লিশ নয়া পয়সা ফেরত এসেছে। তায়েবা বললো, অনেকতো কষ্ট করলেন, গোবিন্দদা, এই টাকাটা তুমিই রাখো। গোবিন্দের ভাঙ্গা চোরা মুখমণ্ডলে খুশীর একটা চাপা ঢেউ খেলে গেলো। তায়েবা তার বিছানার ওপর প্যাকেটটা উপুর করলো। ভেতরের জিনিসপত্তর সব বেরিয়ে এসেছে। একটা ধুতি, মাঝামাঝি দামের একজোড়া বাটার স্যাণ্ডেল, সিগারেট, ম্যাচ আর তার নিত্য ব্যবহারের টুকিটাকি জিনিস। আমার দিকে তাকিয়ে তায়েবা কড়া হুকুমের সুরেই বললো, দানিয়েল ভাই, তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢোকেন পরনের ওই প্যান্ট খুলে ফেলে এই সাবানটা দিয়ে যেখানে যেখানে রাস্তার পানি লেগেছে ভালো করে রগড়ে ধুয়ে ফেলুন। এ পানির স্পর্শ বড়ো সাংঘাতিক। স্কীন ডিজিজ-টিজিজ হয়ে যেতে পারে। তারপর এই স্যাণ্ডেল জোড়া পরবেন। দয়া করে আপনার জুতোজোড়া ওইদিকের ডাস্টবিনে ফেলে আসুন ওটা তো আর কোনো কাজে আসবে না। আমি বললাম, তায়েবা আমি যে ধুতি পরতে জানিনে। এবার তায়েবা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো, আপনি এখনো ক্ষেতের কুমড়োই রয়ে গেছেন। কিছুই শেখেননি। অতো আঠারো রকমের প্যাঁচ গোচের দরকার কি? আপনি দু’ভজ দিয়ে সোজা লুঙ্গির মতো করেই পরবেন। যান, যান বাথরুমে ঢোকেন, অতো কথা শুনতে চাইনে। এদিকে ভিজিটিং আওয়ারের সময় ঘনিয়ে এলো।
আর কথা না বাড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। আমি ধুতিখানা লুঙ্গির মতো করে পরে বাইরে এসে জিগগেস করলাম, এখন ভেজা প্যান্টটা নিয়ে কি করি। তায়েবা বললো, কোণার দিকে চিপেটিপে রাখুন, যাবার সময় ব্যাগের ভেতর পুরে নিয়ে যাবেন। তারপর আমাকে আবার বাথরুমে প্রবেশ করতে হলো। শরীর ঘসেমেজে লুঙ্গির মতো করে ধুতিপরা অবস্থায় আমাকে দেখে তায়েবা মুখ টিপে হাসলো। আয়নার সামনে গিয়ে দেখে আসুন, আপনাকে এখন ফ্রেশ দেখাচ্ছে। আপনার এমন একটা কুৎসিত স্বভাব, সবসময় চেহারাখানা এমন কুৎসিত করে রাখেন, মনে হয় সাত পাঁচজনে ধরে কিলিয়েছে। তাকিয়ে দেখলে ঘেন্না করতে ইচ্ছে হয়। তায়েবা এ । কথা কম করে হলেও একশোবার বলেছে। কিন্তু আমার চেহারার কোনো সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। আমি বললাম, তায়েবা আমি বোধ হয় মানুষটাই কুৎসিত। আমার ভেতরে কোনো সৌন্দর্য নেই বাইরে ফুটিয়ে তুলবো কেমন করে? তায়েবা আমার কথার পিঠে বললো, তাই বলে কি চব্বিশঘণ্টা এমন গোমড়া মুখ করে থাকতে হবে, তারও কি কোনো কারণ আছে? সব মানুষেরই এক ধরনের না এক ধরনের দুঃখ আছে, তাই বলে দিনরাত একটা নোটিশ নাকের ডগায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে নাকি? এই যে আমাকে এই অবস্থায় দেখছেন, আমার কি দুঃখের অন্ত আছে, কিন্তু বেশতো আছি। যাক, এ পর্যন্ত বলে তায়েবা হাঁফাতে থাকলো।
আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে একজন সিরিয়াস রোগীর সঙ্গে কথা বলছি। আসলে আমি কথা কাটাকাটি করছি বুড়ীগঙ্গার পাড়ের তায়েবার সঙ্গে। সে তায়েবা আর এ তায়েবা এক নয়, একথা বার বার ভুলে যাই। গেন্ডারিয়ার বাসায় ভাই-বোন পরিবেষ্টিত তায়েবার যে রূপ, তার সঙ্গে বর্তমান তায়েবার আর কি কোনো তুলনা করা যেতে পারে? বড়ো জোর বর্তমান তায়েবা গেন্ডারিয়ার তায়েবার একটা দূরবর্তী ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মাত্র। গেন্ডারিয়ার বাড়িতে তায়েবাকে যে দেখেনি কখনো তার আসল রূপ ধরতে পারবে না। খাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে, রাঁধছে, বাড়ছে, বোনদের তত্ত্ব তালাশ করছে, কলেজে পাঠাচ্ছে, নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে সর্বত্র একটা ঘূর্ণির বেগ জাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। কখনো খলখল হাসিতে অপরূপা লাস্যময়ী, কখনো দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ছে। একে ধমক দিচ্ছে, তাকে শাসাচ্ছে, সদা চঞ্চল, সদা প্রাণবন্ত। আবার কখনো চুপচাপ গম্ভীর। তখন তাকে মনে হয়, সম্পূর্ণ ধরাছোঁয়ার বাইরে, অত্যন্ত দূরের মানবী। কোনো পুরুষের বাহুবন্ধনে ধরা দেয়ার জন্য যেনো তার জন্ম হয়নি। কোনো শাসন বারণ মানে না। দুর্বার গতিস্রোতে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়, এক জায়গায় আটকে রাখে কার সাধ্য। চেষ্টা যে করিনি তা নয়। প্রতিবারই প্রচণ্ড আঘাত করে সে নিজের গতিবেগে ছুটে গেছে। আবার যখন তাকে ছেড়ে আসতে চেষ্টা করেছি, সে নিজেই উদ্যোগী হয়ে কাছে টেনে নিয়েছে। যখন সে নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আকাশের তারকারাজি কিংবা বুড়িগঙ্গাতে ভাসমান নৌকার রাঙ্গা রাঙ্গা পালগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতো, তখন তাকে তারকার মতো সুদূর এবং রহস্যময় নদীতে চলমান রাঙ্গাপালের একটা প্রতীক মনে হতো। যেন কারো কোনো বন্ধনে ধরা দেয়ার জন্য সে পৃথিবীতে আসেনি। তায়েবার অনেক ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে আমি এসেছি। কতোদিন, কতোরাত্রি তার সঙ্গে আমার একত্রে কেটেছে। এ নিয়ে বন্ধু বান্ধবেরা আমাকে অনেক বিশ্রী ইঙ্গিত করেছে। তায়েবার নিজের লোকেরাও কম হাঙ্গামা হুজ্জত করেনি। এমনকি, তার অভিভাবকদের মনেও ধারণা জন্মানো বিচিত্র নয় যে আমি তাকে গুণ করেছি।
আমি কিন্তু তায়েবাকে কখনো আমার একথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। তার সঙ্গে সম্পর্কের ধরনটা কি, অনেক চিন্তা করেও নির্ণয় করতে পারিনি। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে আছে সে। চোখ দুটো সম্পূর্ণ বোজা। নিঃশ্বাস ফেলার সঙ্গে সঙ্গে নাকের দু’পাশটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার ডান হাতটা আমার মুঠোর মধ্যে। এই যে গভীর স্পর্শ লাভ করছি তাতে আমার প্রাণের তন্ত্রীগুলো সোনার বীণার মতো ঝঙ্কার দিয়ে উঠছে। এই স্পর্শ দিয়ে যদি পারতাম তার সমস্ত রোগবালাই আমার আপন শরীরে শুষে নিতাম। তার জন্য আমার সব কিছু এমন অকাতরে বিলিয়ে দেয়ার এই যে সহজ সরল ইচ্ছে- ওটাকে কি প্রেম বলা যায়? যদি তাই হয় আমি তাহলে তায়েবার প্রেমে পড়েছি। দানিয়েল ভাই, কথা বললো তায়েবা। তার চোখ দু’টো এখনো বোজা। কণ্ঠস্বরটা খুবই ক্ষীণ, যেনো স্বপ্নের ভেতর তার চেতনা ভাষা পেতে চেষ্টা করছে। আমি তার দুটো হাতই টেনে নিলাম। দানিয়েল ভাই, আবার ডাকলো তায়েবা। এবার তার কণ্ঠস্বরটি অধিকতরো স্পষ্ট। আমি বললাম, তায়েবা বলো। সে চোখ দুটো খুললো, শাড়ির খুঁটে মুছে নিলো। তারপর ধীরে, অতি ধীরে উচ্চারণ করলো, দানিয়েল ভাই, এবার যদি বেঁচে যাই, তাহলে নিজের জন্য বাঁচার চেষ্টা করবো। আমার বুকটা কেঁপে গেলো। বললাম, এমন করে কথা বলছো কেন? দানিয়েল ভাই, আমার অসুখটি এতো সোজা নয়। আপনি ঠিক বুঝবেন না, মৃত্যু আমার প্রাণের দিকে তাক করে আছে। এক সময় বোটা শুদ্ধ আস্ত হৃদপিণ্ডটি ছিঁড়ে নেবেই। বললাম, ছি ছি তায়েবা, কি সব আবোল তাবোল প্রলাপ বকছো। দানিয়েল ভাই, এই মুহূর্তটিতে এই কথাটিই আমার কাছে সব চাইতে সত্য মনে হচ্ছে। সারা জীবন আমি আলেয়ার পেছনে ছুটেই কাটিয়ে গেলাম। মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব সকলের সুখে হোক দুঃখে হোক একটা অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আমি তো হাওয়ার ওপরে ভাসছি। তারা হয়তো সুখ পাবে জীবনে, নয়তো দুঃখ পাবে, তবু সকলে নিজের নিজের জীবনটি যাপন করবে। কিন্তু আমার কি হবে, আমি কি করলাম? আমি যেনো স্টেশনের ওয়েটিং রুমেই গোটা জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। প্রতিটি মানুষ একটা জীবন নিয়েই জন্মায়। সে জীবনটাই সবাইকে কাটাতে হয়। কিন্তু জীবনযাপনের হিসেবে যদি ফাঁকি থাকে তাহলে জীবন ক্ষমা করে না। ডাক্তারেরা যাই বলুন, আমি তো জানি আমার অসুখের মূল কারণটা কি? এক সময় আমার জেদ এবং অভিমান দুইই ছিলো। মনে করতাম আমি অনেক কিছু ধারণ করতে পারি।