এই সময়ের মধ্যে গোবিন্দকে সঙ্গে নিয়ে তায়েবা ফিরে এলো। সে গোবিন্দকে কি একটা ব্যাপারে অনুরোধ করছে। আর গোবিন্দ বারে বারে মাথা নেড়ে বলছে, না। দিদিমণি, সে আমাকে দিয়ে হবে না। দেখছেন কেমন করে বিষ্টি পড়ছে। দোকান পাট সব বন্ধ। তাদের কথা ভালো করে কানে আসছিলো না। আমি জুতো জোড়ার কথাই চিন্তা করছিলাম। তায়েবা গোবিন্দের কানের কাছে মুখ নিয়ে কি একটা বলতেই তাকে অনেকটা নিমরাজী ধরনের মনে হলো। বললো, টাকা আর ছাতার ব্যবস্থা করে দিন। আমার খুব ভয় লাগছিলো, পাছে তায়েবা আমাকে কোনো টাকা পয়সা দিতে বলে, আসলে আমার কাছে বিশ বাইশ টাকার অধিক নেই এবং টাকাটা খরচ করারও ইচ্ছে নেই। পঞ্চাশ নয়া পয়সা ট্রাম ভাড়া বাঁচাবার জন্য দৈনিক চার ছয় মাইল পথ অবলীলায় হেঁটে চলাফেরা করছি ইদানীং। আমার জুতোর খসে পড়া সোল দু’খানি তায়েবার দৃষ্টি এড়ালো না। জিগগেস করলো, কি হলো আপনার জুতোয়? আমি বললাম, কোলকাতায় পানির সঙ্গে রণভঙ্গ দিয়ে এই মাত্র জুতোজোড়া ভবলীলা সাঙ্গ করলো। সে বালিশের তলা থেকে একটা পার্স বের করে আপন মনে টাকা গুণতে গুণতে উচ্চারণ করলো, ও তাহলে এই ব্যাপার। কেবিনের বাইরে গিয়ে গোবিন্দের সঙ্গে নিচু গলায় আবার কি সব আলাপ করলো। ভেতরে ঢুকে আমাকে বললো, আপনার সেই জন্তুটা একটু দিন, গোবিন্দ একটু বাইরে থেকে আসবে। গোবিন্দের হাতে নিয়ে বর্ষাতিটা দিলো। গোবিন্দ হাঁটা দিয়েছে, এমন সময় ডাক দিয়ে বললো, গোবিন্দদা এক মিনিট দাঁড়াও। আমার কাছে এসে জানতে চাইলো আপনার তো সিগারেট নেই। আমি বললাম, না। কি সিগারেট যেনো আপনি খান। চারমিনার। এই ছাইভস্ম কেননা যে টানেন। সে দরোজার কাছে গিয়ে বললো, গোবিন্দ, ওখান থেকে পয়সা দিয়ে এক প্যাকেট চারমিনার আর একটা ম্যাচ আনবেন। তারপর তায়েবা বাথরুমে যেয়ে পা দুটো পরিষ্কার করে এসে কোনো রকমে নিজেকে বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিলো। স্যাণ্ডেল না পরে সে বেরিয়ে গিয়েছিলো, এটা সে নিজেই খেয়াল করেনি। এই হাঁটাহাঁটি ডাকাডাকিতে নিশ্চয়ই তার অনেক কষ্ট হয়েছে। সেদিন আমি ভুল করেছিলাম। আসলে তায়েবা সে আগের তায়েবা নেই। একটুকুতেই হাঁপিয়ে ওঠে। এখন সে বিছানায় পড়ে আছে শীতের নিস্তরঙ্গ নদীর মতো। চুপচাপ শান্ত স্থির।
আমার কেমন জানি লাগছিলো। খুব ম্লান কণ্ঠে ধীরে ধীরে বললো, দানিয়েল ভাই জানেন, জীবনে আপনি খুব বড়ো হবেন। তার গলার আওয়াজটা যেনো অনেক দূর থেকে ভেসে আসছিলো। কণ্ঠস্বরে চমকে গেলাম। তবুও রসিকতা করে বললাম, বড়ো তো আর কম হইনি, এখন বুড়ো হয়ে মরে যাওয়াটাই শুধু বাকি। আপনি সবসময় কথার উল্টো অর্থ করেন। থাক, আপনার সঙ্গে আর কথা বলবো না। এমনিতেও আমার বিশেষ ভালো লাগছে না। সে হাঁ করে নিশ্বাস নিতে লাগলো। আমি জানতে চাইলাম, তায়েবা আজ তোমার শরীরটা কি খুব খারাপ? না না অতো খারাপ নয়। দেখছেন না কি নোংরা বিষ্টি। তাছাড়া আমাকে আজ আবার ইঞ্জেকশন দিয়েছে। যেদিন ইঞ্জেকশন দেয় খুবই কষ্ট হয়। অনেকক্ষণ ধরে দিতে হয়তো। আমি বললাম, ঠিক আছে, কথা না বলে চুপ করে থাকো। সারাদিন তো চুপ করেই আছি। একবার মাত্র মাইতিদা এসেছিলেন সেই ইঞ্জেকশন দেয়ার সময়। তারপর থেকেই তো একা বসে আছি। কথা বলবো কার সঙ্গে। উৎপলার সঙ্গে টুকটাক কথা বলে সময় কাটাতাম। কাল শেষ রাত থেকে তার অসুখটা বেড়েছে তাই তাকে ইনটেনসিভ কেয়ারে নিয়ে গেছে। আজ সকালে আমাদের ওয়ার্ডের পঁয়তাল্লিশ নম্বরের হাসিখুশী ভদ্র মহিলাটি মারা গেছেন। আমার কি যে খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আমিও মারা যাবো। প্রতিদিন এখানে কেউ না কেউ মরছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ছুটে পালিয়ে যাই কোথাও। আমি বললাম, কোথায় যেতে চাও তায়েবা। সে জবাব দিলো জানিনে। হঠাৎ তায়েবা আমার ডান হাতখানা ধরে বললো, আচ্ছা দানিয়েল ভাই, আপনার মনে আছে একবার ঝড়বিষ্টিতে ভিজে সপসপে অবস্থায় আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আমি বললাম, কি আশ্চর্য তায়েবা, আসার সময় পথে সে কথাটি আমারও মনে পড়েছে। সে উৎফুল্ল হয়ে ওঠার চেষ্টা করে বললো, বুঝলেন দানিয়েল ভাই, আপনার সঙ্গে আমার মনের গোপন চিন্তার একটা মিল রয়েছে। তায়েবা গুনগুন অস্কুটস্বরে সে গানের কলি দু’টো গাইতে থাকলো। আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরান সখা বন্ধু হে আমার।
জানেন দানিয়েল ভাই, গেন্ডারিয়ার বাড়ির জন্য আমার মনটা কেমন আনচান করছে। গতরাতে স্বপ্নে দেখেছি আমাদের পোষা ময়নাটি মরে গেছে। পাশের কাঠ ব্যবসায়ীর বাড়িতে রেখে এসেছিলাম। সেই অবধি মনটা হু হু করছে। এরকম বিষ্টির সময় বুড়িগঙ্গা কেমন ফেঁপেফুলে অস্থির হয়ে ওঠে। পানির সে কেমন সুন্দর চীৎকার। তিন বোন পাশাপাশি এক সঙ্গে ঘুমোতাম। দিনাজপুর থেকে মা আর বড়ো ভাইয়া এসে থাকতো। ছোটো ভাইটি সারাক্ষণ পাড়ায় ঝগড়াঝাটি মারামারি করে বেড়াতো। এখন জানিনে কেমন আছে। একটা যুদ্ধ লাগলো আর সব কিছু ওলোট পালোট হয়ে গেলো। এখানে আমি পড়ে আছি। দোলা গেছে তার গ্রুপের মেয়েদের সঙ্গে ট্রেনিং নিতে সেই ব্যারাকপুর না কোথায়। মা দিনাজপুরে। বড়ো ভাইয়া কোথায় খবর নেই। ইচ্ছে করেই তায়েবা ডোরার নাম মুখে আনলো না, পাছে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বরাবর দেখে আসছি তায়েবার কাছে গোটা পৃথিবী একদিকে আর ডোরা একদিকে। রেডিও কিংবা টিভিতে ডোরার রবীন্দ্র সঙ্গীতের যেদিন প্রোগ্রাম থাকতো, সে রিকশাভাড়া খরচ করে চেনাজানা সবাইকে বলে আসতো আজকের রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রোগ্রামটা শুনবেন, আমার বোন ডোরা গান গাইবে। আর ডোরাও ছিলো তায়েবার অন্তপ্রাণ। অতো বড়ো ডাগর মেয়েটি, তবু তায়েবাকে জড়িয়ে ধরে না ঘুমোলে ঘুম আসতো না। তায়েবা কাছে না বসলে খাওয়া হতো না। মাঝে মাঝে ডোরার পেটে কি একটা ব্যথা উঠতো। তখন তায়েবাকে সব কিছু বাদ দিয়ে ডোরার বিছানার পাশে হাজির থাকতে হতো। আজ তায়েবার এই অবস্থায় ডোরা কি করে প্রায় বুড়ো একজন মানুষের সঙ্গে দিল্লীহিল্লী ঘুরে বেড়াচ্ছে আমি ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারিনে। তায়েবা দু’চোখ বন্ধ করে আছে আমি এক রকম নিশ্চিত যে, সে ভোরার কথাই চিন্তা করছে।