আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, ঘরে বিশেষ আসবাবপত্তর নেই। তক্তপোষের ওপর হারমোনিয়াম, তবলা এবং তানপুরা। পাশে পড়ার টেবিল। সামনে একখানি চেয়ার। শেলফে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু পাঠ্য বই। একেবারে ওপরের তাকে সেই চমকার চারকোণা ফুলদানিটি, যার ওপর শোভা পাচ্ছে সদ্যচ্ছিন্ন রজনীগন্ধার গুচ্ছ। মনে মনে অনুমান করে নিলাম, এ বাড়িতে গানবাজনার চল আছে। এ বাড়ির কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। এই ঘরজোড়া তক্তপোষটিতে নিশ্চয়ই একের অধিক মানুষ অথবা মানুষী ঘুমায়।
সুনির্মলদা বললেন, দানিয়েলের সঙ্গে এখনো পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়নি। দানিয়েল, এ হোল আমাদের বোন তায়েবা। আর ও হচ্ছে দানিয়েল, অনেক গুণ, কালে কালে পরিচয় পাবে। তবে সর্বপ্রধান গুণটির কথা বলে রাখি–ভীষণ বদরাগী। নাকের ওপর দিয়ে মাছি উড়ে যাওয়ার উপায় নেই, দু’টুকরো হয়ে যায়। তায়েবা সায় দিয়ে বললো, বারে যাবে না, যা খাড়া এবং ছুঁচোলো নাক। মহিলা আমার তারিফ করলো কি নিন্দে করলো সঠিক বুঝতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পরে আরো দু’জন মহিলা এসে ঘরে ঢুকলো। মুখের আদলটি তায়েবারই মতো। তবে একজনের রঙ একেবারে ধবধবে ফর্সা। তার পরনে শাড়ি। আরেক জন অতো ফর্সা নয়, কিছুটা মাজা মাজা। তার পরনে শালোয়ার কামিজ। তায়েবা পরিচয় করিয়ে দিলো। শালোয়ার পরিহিতাকে দেখিয়ে বললো, এ হলো আমার ইমিডিয়েট ছোটো বোন। নাম দোলা। বিএ পরীক্ষা দেবে। খেলাধুলার দিকে ওর ভীষণ ঝোঁক। আর ও হচ্ছে তার ছোটটি নাম ডোরা। গানবাজনা করে। সুনির্মলদা আপনারা কথাবার্তা বলুন, কিছু খাবার দেয়া যায় কি না দেখি।
সেদিন গেন্ডারিয়ার বাসা থেকে ফিরে আসার সময় দেখি আকাশে একখানা চাঁদ জ্বলছে। আমি পাঞ্জাবির বুকের লালিয়ে যাওয়া অংশটি বার বার স্পর্শ করে দেখছিলাম। একি সত্যি সত্যি বইয়ের মলাটের রঙ নাকি হৃদয়ের রঙ, রক্ত মাংস চামড়া ভেদ করে পাঞ্জাবিতে এসে লেগেছে। আমার মনে হয়েছিলো, ওই দূরের রূপালী আভার রাত আমার জন্যই এমন অকাতরে কিরণধারা বিলিয়ে হৃদয় জুড়োনো সুবাস ঢালছে। আজ সুনির্মলদার বিরুদ্ধে আমার অনেক নালিশ। তবু, আমি তাকে পুরোপুরি ক্ষমা করে দিতে পারবো, কেনোনা তিনি আমাকে বুড়ীগঙ্গার পাড়ে তায়েবাদের সে গেন্ডারিয়ার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
এসপ্ল্যানেড ছাড়িয়ে বাঁক ঘুরে রবীন্দ্রসদন অভিমুখী রাস্তাটা ধরতেই পানির প্রতাপ কমে এলো। বিষ্টি হচ্ছে, তথাপি রাস্তাঘাটে জল দাঁড়ায়নি। এতোক্ষণে কেমন ঝোঁকের মাথায় এতদূর চলে এসেছি। এখন নিজের দিকে তাকাতে একটু চেষ্টা করলাম। প্যান্টে নিশ্চয়ই পঁচাপানির সঙ্গে কোলকাতার যাবতীয় ময়লা এসে মিশেছে। লোমকূপের গোড়ায় গোড়ায় এখন থেকেই চুলকোতে শুরু করেছে। বর্ষাতিটা গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। সস্তার তিন অবস্থার এক অবস্থা প্রথম দিনেই প্রত্যক্ষ করা গেলো। এখানে সেখানে ছড়ে গেছে। পায়ের নীচের জুতো জোড়ার অবস্থা ভুলে থাকার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছিনে। প্রতি পদক্ষেপেই অনুভব করছি, বৃষ্টিতে গলে যাওয়া এঁটেল মাটির মতো সোলটা ফকফকে হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আরেকবার সামনে চরণ বাড়ালেই সোল দুটো আপনা থেকেই পাকা ফলের মতো খসে পড়বে। নিজের ওপর ভয়ানক করুণা হচ্ছিলো। সিগারেট খাওয়ার তেষ্টা পেয়েছে। প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট আর ম্যাচ বের করে দেখি ভিজে একবারে চুপসে গেছে। দুত্তোর ছাই, রাগ করে সিগারেট ম্যাচ দুটোই ড্রেনের মধ্যে ছুঁড়ে দিলাম।
হাসপাতালের গেট খুলতে এখনো প্রায় আধঘন্টা বাকি। এ সময়টা আমি কি করি। মুষলধারে বিষ্টি ঝরছে। ধারে কাছে কোনো রেস্টুরেন্টও নেই যে বসে সময়টা পার করে দেয়া যায়। মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। দারোয়ানের কাছে গিয়ে বললাম, ডঃ মাইতির সঙ্গে দেখা করতে যাবো। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে দারোয়ানের বুঝি দয়া হলো। সে ঘটা করে লোহার গেটের পাল্লা দুটো আলাদা। করলো। আমি ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
তায়েবার কেবিনে ঢুকে দেখি, সে শুয়ে আছে। পাশের বেডের উৎপলা আজও হাজির নেই। তায়েবা কি ঘুমিয়ে পড়েছে, নাকি এমনিতে চোখ বন্ধ করে আছে। মস্তবড়ো পড়ে পড়ে গেলাম। আয়া টায়া কিংবা নার্স জাতীয় কাউকে খোঁজ করার জন্য করিডোরের দিকে গেলাম। আমার সিক্ত জুতো থেকে ফাঁস ফাঁস হাঁসের ডাকের মতো এক ধরনের আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। আর প্যান্ট থেকে পানি পড়ে ধোয়া মোছা তকতকে মেঝে ভিজিয়ে দিচ্ছে। এ অবস্থায় কেউ আমাকে দেখে হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা নষ্ট করার অপরাধে যদি ঘাড় ধরে বের করে দেয় আমার বলার কিছুই থাকবে না। এক সময় তায়েবা চোখ মেলে জিগগেস করলো, কে? আমি তার সামনে যেয়ে দাঁড়ালে খুব গম্ভীর গলায় পরম সন্তোষের সঙ্গে বললো, ও দানিয়েল ভাই, আপনি এসেছেন তাহলে। আমি সেই পেটমোটা ব্যাগটা তার হাতে গছিয়ে দিয়ে বললাম, এর মধ্যে ভাত-মাছ রান্না করা আছে। সে ব্যাগটা স্টীলের মিটসেফের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলো। খুশিতে তার চোখজোড়া চিকচিক করে উঠলো। দানিয়েল ভাই বসুন, টুলটা দেখিয়ে দিলো। তারপর আমার আপাদমস্তক ভালো করে তাকাতেই শক লাগার মতো চমক খেয়ে বিছানার ওপরে উঠে বসলো। একি অবস্থা হয়েছে আপনার দানিয়েল ভাই, সব দেখি ভিজে একেবারে চুপসে গেছে। আমি বললাম, বারে ভিজবে না, রাস্তায় এক কোমর পানি ভেঙ্গেই তো আসতে হলো। তায়েবা জানতে চাইলো, এ বিষ্টির মধ্যে সব পথটাই কি আপনি হেঁটে এসেছেন। আমি বললাম, উপায় কি? ট্রাম বাস কিছুই তো চলে না। তাছাড়া ট্যাক্সীতে চড়া সেতো ভাগ্যের ব্যাপার। সহসা তার মুখে কোনো কথা জোগালো না। বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গিয়ে একটি বড়োসরো তোয়ালে আমার হাতে দিয়ে বললো, আপাততঃ গায়ের ওই কিম্ভুত কিমাকার জন্তুটা এবং পায়ের জুতো জোড়া খুলে গা মাথা ভালো করে মুছে নিন। আমি দেখি কি করা যায়। সে গোবিন্দের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে একেবারে করিডোরের শেষ মাথায় চলে গেলো। গায়ের বর্ষাতিটা খোলার পর ফিতে খুলে জুতাজোড়া বের করার জন্য যেই একটু মৃদু চাপ দিয়েছি অমনি সোল দুটো আপসে জুতো থেকে আলাদা হয়ে গেলো। আমার ভয়ানক আফশোস হচ্ছিলো। এই এক জোড়া জুতো অনেকদিন থেকে বুকের পাঁজরের মতো কোলকাতা শহরের জলকাদা-বিষ্টির অত্যাচার থেকে রক্ষা করে আসছিল। আজ তার পরমায়ু শেষ হয়ে গেলো। গা মোছার কথা ভুলে গিয়ে একদৃষ্টে খসে পড়া সোল দু’টোর দিকে তাকিয়ে রইলাম।