.
০৪.
হোস্টেলে পৌঁছুতে বেলা দুটো বেজে গেলো। ক্ষীতিশ কলেজ থেকে ফিরেছে। বললো, দাদা, মেজদা নাকি চিত্তকে কি সব রান্নাবান্না করার ফরমায়েশ দিয়ে গেছে। চিত্ত বারে বারে খুঁজছে। আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। নইলে নিজেই কবে খেয়ে নিতাম। ব্যাপার জানেন নাকি কিছু? বললাম, হ্যাঁ ক্ষীতিশ, একজন রোগীর জন্য কিছু খাবার রান্না করে নিতে হবে হাসপাতালে। যদি এরই মধ্যে রান্না হয়ে গিয়ে থাকে তুমি একটু কষ্ট করে ভাত আর মাছ আলাদা আলাদাভাবে এই বাটিটার মধ্যে ভরে দিতে বলল। তক্তপোষের তলা থেকে আমি ছোট্টো বাটিটা বের করে ক্ষীতিশের হাতে দিলাম। অল্পক্ষণ পর ক্ষীতিশ ভাত তরকারি ভর্তি বাটিটা নিয়ে এলে আমি পেটমোটা হাতব্যাগটা টেনে নিয়ে আস্ত বাটিটা ব্যাগের পেটের ভেতর ঢুকিয়ে রাখলাম। ক্ষীতিশ জিগগেস করলো, দাদা কি এখনই বেরুবেন। আমি বললাম, হা ক্ষীতিশ, আমাকে এখুনিই বেরুতে হচ্ছে। কতোদূর যাবেন? পিজি হাসপাতাল। ক্ষীতিশ বললো, শহরে কোনো ট্রাম বাস চলছে না, রাস্তায় এক কোমর জল। আকাশের দিকে চেয়ে দেখুন, যে কোনো সময়ে বিষ্টি নামতে পারে। ব্যালকনির দিকে দরোজা জানালা খুলে দিলো। কালো মেঘ কোলকাতার আকাশের চার কোণ ছেয়ে একেবারে নিচে নেমে এসেছে।ট্রাম বাস ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। হাতে টানা রিকশাগুলো ডিঙিনৌকার মতো চলাফেরা করছে। বাস্তবিকই পথে বেরুবার পক্ষে মোটেই অনুকূল নয়। তথাপি মানুষ চলাচল করছে। মহিলারা মাথায় ছাতা মেলে ধরছে বটে, কিন্তু অনেকেরই পরনের শাড়ি কোমর অবধি ভিজে গেছে। আমি বললাম, যেতেই হবে আমাকে। তুমি বরং একটা উপকার করো। নিচের কোনো দোকান থেকে সস্তায় একটা জয়বাংলা বর্ষাতি কিনে এনে দাও। বিশটি টাকা বের করে তার হাতে তুলে দিলাম। সে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে চলে গেলো।
ইত্যবসরে আমি একটা পুরোনো প্যান্ট পরে হাঁটু অবধি গুটিয়ে নিলাম। দেশ থেকে এক জোড়া জুতো এনেছিলাম। কোলকাতায় আসার পর বিশেষ পরা হয়নি। সেটা পরে নিলাম। স্যাণ্ডেল জোড়ার যে অবস্থা হয়েছে আশঙ্কা করছিলাম পানির সঙ্গে যুদ্ধে পেরে উঠবে না। ক্ষীতিশ বর্ষাতি কিনে এনে দিলে পরে নিয়ে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়লাম। পথে নামতেই আবার ঝম ঝম করে বিষ্টি নামলো। বর্ষণের বেগ এতো প্রবল, পাঁচ হাত দূরের জিনিসও ঝাপসা কুয়াশার মতো দেখাচ্ছে। ফুটপাত দিয়ে চলতে গিয়ে পর পর দু’জন পথচারীর সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়ে ফেললাম। রাস্তা পানিতে ফুলে ফেঁপে একটা ছোটো খাটো বাঁকা নদীর মতো দেখাচ্ছে। এই কোমর পানির মধ্যে চলতে গিয়ে আমার মনে হলো শরীরে মনে যেন আমি কিছুটা কাঁচা হয়ে উঠেছি। এই ধারাজল আমার শরণার্থী জীবনের সমস্ত কালিমা ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য একটা সুড়সুড়ি অনুভব করছিলাম। আমি যেনো আবার সেই ছোট্টো শিশুটি হয়ে গেছি। মনে পড়ে গেলো বাড়ির পাশের খালটিতে কি আনন্দেই না সাঁতার কাটতাম। ছাত করে মনে পড়ে গেলো। একবার ঝড়বিষ্টির মধ্যে ভিজেচুপসে তায়েবাদের গেন্ডারিয়ার বাড়িতে হাজির হয়েছিলাম। তায়েবা দরোজা খুলে আমাকে দেখে রবীন্দ্রনাথের সে গানটির দুটো কলি কি আবেগেই না গেয়ে উঠেছিলো–
‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরান সখা বন্ধু হে আমার’
সেদিন আর আজ। আমি রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছি। প্রতি পদক্ষেপে অতীত, আমার আর তায়েবার অতীত, মনের মধ্যে ঢেউ দিয়ে জেগে উঠছে।
ওর সঙ্গে আমার পরিচয় উনিশো আটষট্টি সালে। সেদিনটার কথা এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে। মৃত্যুর মুহূর্তেও ভুলতে পারবো না। আগস্ট মাসে একটা দিনে প্রচণ্ড গরম পড়েছিলো। আমি গিয়েছিলাম বাঙলা বাজারের প্রকাশক পাড়ায়। নানা কারণে মনটা বিগড়ে গিয়েছিলো। সুনির্মলদা আমাকে বললেন, চলো একটা জায়গা ঘুরে আসি। হেঁটে হেঁটে গেন্ডারিয়ার লোহারপুল পেরিয়ে বুড়িগঙ্গার পারের একটা ছোট্টো একতলা বাড়ির সামনে এসে সুনির্মলদা বললেন, তুমি এখানে একটু দাঁড়াও, আমি দেখি ভেতরে কেউ আছে কিনা। তিনি এগিয়ে গিয়ে দরোজায় কড়া নাড়তে লাগলেন। দরোজার পাল্লা দুটো ফাঁক হয়ে গেলো। সুনির্মলদা ভেতরে ঢুকলেন। আমাকে হাত নেড়ে ডাকলেন, এসো দানিয়েল। আমিও ভেতরে প্রবেশ করলাম। সুনির্মলদা বললেন, দেখো তায়েবা কাকে ধরে নিয়ে এসেছি। সাদা শাড়ি পরিহিতা উজ্জ্বল শ্যামল রঙের মহিলাটি আমাকে ঘাড়টা একটুখানি দুলিয়ে সালাম করলো। সুনির্মলদা তক্তপোষের সাদা ধবধবে চাঁদরের ওপর পা উঠিয়ে বসলেন। মহিলাটি বললেন, আপনিও পা উঠিয়ে বসুন। ক্ষুণ্ণকণ্ঠে বললাম, আমার পায়ে অনেক ময়লা। আপনার আস্ত চাদরটাই নষ্ট হয়ে যাবে, বরঞ্চ আমাকে একটা অন্যরকম আসন দিন। আপনি যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলি। আপনি পাটা ধুয়েই বসুন। আমি পানি এনে দিচ্ছি। এক বদনা পানি এনে দিলে আমি পা দু’টো রগড়ে পরিষ্কার করে বিছানার ওপর বসেছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন আমি একটা পাটভাঙ্গা সাদা পাঞ্জাবি পরেছিলাম। কি একখানা লাল মলাটের বই সারাক্ষণ বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরেছিলাম। ঘামেভেজা পাঞ্জাবির বুকের অংশে মলাটের লাল রঙটা গাঢ় হয়ে গিয়েছিলো। মহিলাটি আমার পাঞ্জাবির দিকে তাকিয়ে জিগগেস করলো, ওমা আপনার পাঞ্জাবিতে এমন খুন খারাবীর মতো রঙ দিয়েছে কে? আমি ঈষৎ অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, কেউ দেয়নি। কখন বইয়ের মলাটের রঙটা পাঞ্জাবিতে লেগে গেছে খেয়াল করিনি। লক্ষণ সুবিধের নয় বলে মহিলাটি সুন্দর সাদা দাঁত দেখিয়ে হাসলো। ফুলদানীতে একটি সুন্দর রজনীগন্ধার গুচ্ছ। তার হাসিটি রজনীগন্ধার মতো সুন্দর স্নিগ্ধ ঘাড়টাও রজনীগন্ধার মতো ঈষৎ নোয়ানো।