সোহরাব সাহেব বললেন, সাধে কি আর এরকম কথা মুখ দিয়ে আসে। কতোদিকে কতো কাণ্ড ঘটছে সেসবের হিসেব রাখেন? আমি বললাম, কোনো হিসেবই রাখিনে সোহরাব সাহেব। কি করে রাখবো। সোহরাব সাহেব আমার হাতে একটা লিফলেট দিয়ে বললেন, আপনি হার্মলেস মানুষ, তাই বিশ্বাস করে পড়তে দিচ্ছি। লিফলেটটি আগরতলা থেকে বেরিয়েছে। সংক্ষেপে তার মর্মবস্তু এ রকমঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী সৈন্যের হাতে ধরা পড়বার আগে এক ঘরোয়া সভা ডেকেছিলেন। তাতে তিনি যদি পাকিস্তানী সৈন্যের হাতে ধরা পড়েন, কি কি করতে হবে সেসকল বিষয়ে আলোচনা হয়েছিলো। ওই সভায় একজন নাকি শেখ সাহেবের কাছে সাহস করে জিগগেস করছিলো, বঙ্গবন্ধু, আপনার অবর্তমানে আমরা কার নেতৃত্ব মেনে চলবো। শেখ সাহেব আঙুল তুলে শেখ মনিকে দেখিয়ে বলেছিলেন, তোমরা এর নেতৃত্ব মেনে চলবে। লিফলেটটা ফেরত দিলে তিনি পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে একটা জেন্ট সাইজের পকেট রুমালের মতো পত্রিকা বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, এই দাগ দেয়া অংশটুকু পাঠ করুন। তারপর বিশুদ্ধ বাঙাল উচ্চারণে বললেন, নেতাকে কি আর সাধে গাইল্যাই। পত্রিকাটিও পড়ে দেখলাম। সংক্ষেপে সারকথা এই আগরতলাতে নেতৃত্বের দাবিতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বি ছাত্রের দল একরকম সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছিলো। তার প্রতিবাদে আগরতলার মানুষ মিছিল করে জানিয়ে দিয়েছে ওই মাটিতে বাংলাদেশের মানুষদের মারামারি হানাহানি তারা বরদাস্ত করবে না। বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের মধ্যে হানাহানি করতে চায় নিজেদের দেশে গিয়ে করুক। কাগজটা ফেরত দিয়ে সোহরাব সাহেব আমাকে জিগগেস করলেন, ভালো লেখেনি? আমি মাথা নাড়লাম। অনেকক্ষণ এক নাগাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে পায়ে বাত ধরে গেছে। সুতরাং অধিক কথা না বাড়িয়ে বলে ফেললাম, সোহরাব সাহেব আপনার কাছে এদের জন্য একটা রেশনকার্ড ইস্যুর স্লীপ নিতে এসেছিলাম। আমি জয়সিংহ ব্যানার্জী এবং তার যজমানের মেয়ে সবিতাকে দেখিয়ে দিলাম। তিনি বললেন, আরে সাহেব আপনি আমায় মুসকিলে ফেললেন। এই ভিড় হট্টগোলের সময় আমি কাগজ কোথায় পাই, কি করে কলম জোগাড় করি। আমি পকেট থেকে কাগজ কলম বের করে বললাম, এই নিন, আপনি লিখে দিন। তিনি খসখস করে গদবাধা ইংরেজিতে লিখে দিলেন, প্লীজ ইস্যু রেশন কার্ড ফর মি, সো এন্ড সো… ইত্যাদি, ইত্যাদি। কাগজটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, বাঁদিকের কাউন্টারে যে লোক বসে তাকে দেখলে এই স্লীপটা দিয়ে দেবেন। ওরা চলে গেলো। আমরা আরো কিছুক্ষণ গল্পগাছা করলাম। এরই মধ্যে বিষ্টি ধরে এসেছে। তবে মেঘ কাটেনি। ঘড়িতে দেখলাম একটা বাজে। আমাকে উঠতে হলো। দোতলায় নেমে দেখি আবদ্ধ মানবণ্ডলীর মধ্যে চলাচলের একটা সাড়া পড়ে গেছে। একটানা অনেকক্ষণ আবদ্ধ থাকার পর মানুষের মধ্যে একটা চলমানতার সৃষ্টি হয়েছে। দেখতে দেখতে ভিড় অনেকটা হাল্কা হয়ে এলো। নিচে নেমে এলাম। রাস্তায় পানি নামতে অনেক সময় লাগবে, তাও যদি আবার বিষ্টি না হয়। এখন আমি কি করবো চিন্তা করছি। এমন সময় পিস্তলের আওয়াজের মতো একটা তীক্ষ্ণ তীব্র কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। এই যে দাদা আপনাকে একটা কথা জিগাইরার লাইগ্যা ডাক্তার রায়ের বাড়ি থেইক্যা ফলো করছি। আমি তাকিয়ে দেখলাম, লোকটার গাত্রবর্ণ ধানসেদ্ধ হাড়ির তলার মতো কৃষ্ণবর্ণ। মুখে দাঁড়িগোঁফ গজিয়েছে। পরনে একখানি ময়লা হাঁটু ধুতি। গায়ের জামাটিও ময়লা। একেবারে আদর্শ জয়বাংলার মানুষ। কিছুক্ষণ তাকিয়েও কোনো হদিশ করতে পারলাম না, কে হতে পারে। লোকটি বললো, আমারে আপনে চিনতে পারছেন না দাদা, আমি বাংলা বাজারের রামু। ওহ্ রামু, তুমি কেমন আছো? দাদা ভগবান রাখছে। তোমার মা বাবা সবাই ভালো। দাদা, মা বাবার কথা আর জিগাইবেন না। সব কটারে দেশের মাটিতে রাইখ্যা আইছি। রামু হু হু করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। প্রতিটি হিন্দু পরিবারেরই বলতে গেলে এরকম একেকটা করুণ ভয়ঙ্কর কাহিনী আছে। এসব কথা শুনতে বিশেষ ভালো লাগে না। কারণ আমি তো ভুক্তভোগী নই। তথাপি কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পরক্ষণেই রামু আমাকে ছেড়ে দিয়ে সটান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে সরাসরি জানতে চাইলো। দাদা জয়সিংহ ঠাকুরের লগে আপনার এতো পিরিত কিয়ের। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে মনে রামুকে ধন্যবাদ দিলাম। একটা পীড়াদায়ক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে রামু। বললাম, রামু পিরিত-টিরিত কিছু নয়। জয়সিংহ তাঁর যজমানের মেয়েকে নিয়ে খুব অসুবিধেয় পড়েছেন। আমাকে ধরেছেন একটা রেশন কার্ডের স্লিপ করিয়ে দেবার জন্য। তা করিয়ে দিলাম। মেয়েটির নাকি আর কোনো অভিভাবক নেই। তাই তাকে পোষার দায়িত্ব জয়সিংহের ঘাড়ে এসে পড়েছে। অন্যায় কিছু করেছি রামু? রামু এবারে রাগে ফেটে পড়লো। শালা বদমাইশ বাউন, মা আর বুন দুইডা ক্যাম্পে কাঁইদ্যা চোখ ফুলাইয়া ফেলাইছে। আর হারামজাদা মাইয়াডারে কইলকাতা টাউনে আইন্যা মজা মারবার লাগছে। আর ওই মাগীডাও একটা খানকী। বুঝলেন দাদা এই খবরটা আপনেরে জানান উচিত মনে কইর্যা পাছু ধরছিলাম। তারপর উত্তরের কোনো পরোয়া না করে রামু হাঁট ধুতিটা আরো ওপরে তুলে রাস্তায় পানির মধ্যে পা চালিয়ে হন হন করে চলে গেলো। হঠাৎ করে আমার খুব রাগ হচ্ছিলো। কাউকে খুন করে ফেলার ইচ্ছে জাগছিলো। করার মতো কিছু না পেয়ে রেগে দাঁতে অধর চেপে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরে থুতনির কাছে তরল পদার্থের অস্তিত্ব অনুভব করে আঙ্গুল দিয়ে দেখি, রক্ত। আমার অধর কেটে গিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় লাল রক্ত বেরিয়ে আসছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।